[প্রথমপাতা]
|
ধারাবাহিক উপন্যাসঃ হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ (পর্ব-২২)
- শাশ্বত স্বপন -
পৃথিবীকে জয় করে নিলেও স্রষ্টার কাছে পরাজয় বরণ করতে হবেই। এটা সবাই জানে।
তবুও জয় করার চেষ্টা করে মৃত্যু পর্যন্ত। মৃত্যুকে জয় করতে গিয়েই পরাজয় বরণ
করতে হয়। স্রষ্টা মানুষকে কোন না কোন দিক দিয়ে অসম্পূর্ণ রাখেনই। দেখা
যাবে, খুব ধনী ব্যক্তি তার তিন মেয়ে, ছেলে নাই অথবা তিন ছেলে, মেয়ে নাই।
আবার হয়তো দেখা যাবে কোন সন্তানই নাই। এই যে ন্যান্সি, আট বছরের সাধনার ফল,
সে মেন্টাল পেসেন্ট। নজরুল চৌধুরী এদেশের দশজন ধনীর মধ্যে একজন। অথচ তিনিও
অসম্পূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, আমাদের সংসার, আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে
কেন স্রষ্টা এত খেলা খেলছেন? এখানে কি মজা তার? তিনি আমাদের মরতে দিচ্ছেন
না, জীবন্ত লাশ করে রেখেছেন। কি জানি, হয়তো এবার মুখের দিকে তাকাবেন। মিসেস
নজরুল যে কথা শোনালেন--তা কি ভিতর থেকে, না বাহির থেকে, নাকি আবেগ থেকে।
আবেগ থেকে মানুষ এমন সব বেফাঁস কথাবার্তা বলে ফেলে যা পরে চিন্তা করে সেও
লজ্জা পায়। কিন্তু তিনি তো সত্যি বললেন। তিনি কি কোন ফাঁক রেখে কথা বলেছেন?
‘বোন’--হ্যাঁ বোনই তো। প্রথমে তো বোনই--তারপরে দেখা যাবে। কোন নারী প্রথমেই
প্রেমিকা বা বউ পরিচিতা হয় না--হয় বান্ধবী নয়তো বোন । এই বোন আর আপন বোন এক
নয়। সবাইকে আপন বোন ভাবলে বিয়ে করব কাকে? প্রেম করব কার সাথে। আর ন্যান্সির
সাথে যেভাবে মিশে আছি তাতে কি ভাবা উচিত? কিন্তু সে তো মেন্টাল পেসেন্ট।
হোক পেসেন্ট--মানুষ তো, নারী তো। ভালো হলে না হয়, দেখা যাবে। এখন সে আমার
প্রেমিকা যাকে শুধুই ভালোবাসার নিঃশ্বাস দেব--কামনার নিঃশ্বাস নয়। মানুষ
কথা দেয়--আবার কথা ফিরিয়েও নেয়। ঠিক দেয়ালে টেনিস বল মারার মতো। আন্টি কি
পরে আমাকে ফিরিয়ে দেবে? এই যে তিনি আমাকে আপন বাড়ির মতো ভাবতে বললেন, এটা
কি সৌজন্যতা নাকি সত্যিই। কি হিসেবে আমি এটাকে আপন বাড়ি ভাবব? আমি যদি আপন
হতাম তবে কথা ছিল। আমি তো তাদের আত্মীয়-পুত্রও নই। যদি...। না, না এরা মেনে
নেবে না। কিছুতেই না। আমি তাদের ভাতিজা, ভাগনে কিছু নই। আমি পথের মানুষ।
আমার পায়ের নিচে আমার অধিকারভুক্ত সাড়ে তিন হাত মাটি নেই--আমার ঠিকানা
নেই--গস্তব্যহীন জীবন আমার। বিষে বিষে বিষাক্ত আমার জীবন।
এরপর আমার কাছে যা যা আসতে লাগল--তা দেখে আমি নিজেও বিমূর্ত হলাম। প্রথমতঃ
একটা আংটি। আংটিটি নাকি ফ্রান্সিসের আঙুলে ছিল। ন্যান্সি তাকে দিয়েছিল।
পোস্টমর্টেমের পর আরও কিছু ঐ বাসায় দেওয়া হয়েছিল। ম্যাক্সিম এগুলো এ বাড়িতে
দিয়ে গেছে। কারণ এগুলো সবই ন্যান্সির দেওয়া। এরপর একটা ঘড়ি, একটি স্বর্ণ
খচিত ক্যাপ ও একটি সোনার চেইন। আমাকে এগুলো দেওয়া হলো এই কারণে যে, আমার
দেহে এগুলো দেখে তার কোন ভাবান্তর হয় কিনা। আমি সবকিছু পরিধান করে আয়নার
সামনে দাঁড়ালাম। মনে মনে বললাম, ভাই ফ্রান্সিস কি প্রেমের মাঝে তুমি ছিলে!
একটা বেল্ট দেওয়া হলো--এটাও ফ্রান্সিসের। ব্যাডমিন্টন খেলার সময় মাজায় নয়তো
কপালে এটা বাঁধে। বলা হলো, পরে আরো কিছু দেওয়া হবে। আমি ছোট্ট একটা চিঠি
লিখলাম, যাতে ঘুম থেকে উঠে এটা দেখে। তাহলে হয়তো গণ্ডগোল করবে না। গালে
একটা চুমো দিলাম। পকেট থেকে ফুল বের করে হাতে একটা ধরিয়ে দিলাম। আর একটা
চিঠির উপর রেখে চিঠিসহ মুখের সামনে রাখলাম।
এই চেহারা নিয়ে সিঁদুরের বাসায় যাওয়া ঠিক হবে না। ক্যাপ, ঘড়ি, চেইন খুলে
ফেললাম। সাধারণ পোশাক পরে আন্টির সামনে গেলাম। টিউশনির কথা বললাম। ছাত্রীর
কয়দিন পর পরীক্ষা--তাও বললাম।
--বল কি? ঘুম থেকে উঠেই গণ্ডগোল করবে। তোমাকে ছাড়া এ বাড়ির সবাইকে ওর অসহ্য
লাগে। তুমি যাকে পড়াও তার মা-বাবাকে কিছু একটা অসুবিধা অথবা চাকুরির কথা
বলে বিদায় নাও। আর যদি কর বা করতে হয় তবে ওকে ঘুম পাড়িয়ে যেতে পারবে।
গাড়িতে আসবে-যাবে। যেহেতু তোমার ছাত্রীর সামনে পরীক্ষা।
--না, তা দরকার হবে না--দেখি বিদায় নিয়ে আসতে পারি কিনা। একটা চিঠি লিখে
হাতের কাছে রেখেছি। ঘুম থেকে উঠে ওটা পড়লে মনে হয় বিরক্ত করবে না। আমি দুই
ঘন্টার মধ্যে চলে আসব। এতক্ষন ও ঘুমাবে মনে হয়।
--ও কিন্তু ভালোভাবে পড়তে পারে না। আগে তো ফ্রান্সিস ছাড়া আর কোন স্মৃতি
শক্তি ছিল না। এখন আস্তে আস্তে লেখাপড়াটার স্মৃতিটা আসছে।
--ও
--তুমি গাড়িতে চড়ে যাও। ও অন্তত: তিন ঘন্টা ঘুমাবে।
--আমি যেখানে যাচ্ছি, সেখান থেকে টেলিফোন করব, যদি দেরী হয়ে যায়।
--তুমি তো এ বাসার টেলিফোন নম্বর জান না।
--ডায়েরীতে দেখেছিলাম। মনে নেই এখন।
--৯৮৯৪৬০৬, দাঁড়াও লিখে দিচ্ছি।
আন্টি ফোন নম্বর কাগজে লিখে আমাকে দিল। ড্রাইভার গাড়ি দিয়ে সিঁদুরের বাসায়
পৌঁছে দিল। গাড়ি বাইরে অপেক্ষায় রইল। নক করে ঘরে ঢুকতেই সিঁদুর থাণ্ডারড্
হয়ে গেল। তার মুখ শুকনো।
--স্যার, এই বিকালে আসলেন যে?
--পরে বলব। আগে বল, তোমার মুখে শুকনো কেন?
সিঁদুরের মুখটা এবার গম্ভীর হয়ে গেল। সে বইপত্র গোছাতে লাগল।
--স্যার, মা-বাবা আমাকে কোলকাতা পাঠিয়ে দেবে।
--বল কি!
--ওখানে আমার মামা-মামী আছেন। আমাদের অবশ্য ওখানে বাড়িও আছে।
--কবে যাবে?
--পরীক্ষার পর মনে হয়।
--তা অনেক সময়।
এদেশের সিংহভাগ হিন্দুদের এক ঠ্যাং এদেশে, আরেক ঠ্যাং ভারতে। বাঙালিত্ব
ধুকে ধুকে মার খাচ্ছে ধর্ম তত্ত্বের কাছে। এদেশ এরা নিরাপদ ভাবে না। সেই
দেশ বিভাগের সময় থেকে যাত্রা শুরু হয়েছে এখনো থামছে না। কি করবে? মুসলমান
প্রধান দেশ মানে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করলে, এরা তো ভয়ে
কাঁপবেই। অথচ স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়েছিল ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের জন্য।
--স্যার, আপনাকে একটা কথা বলব?
--কি কথা?
--পড়া শেষে বলব।
--আমিও পড়া শেষে তোমাকে আমার একটা সুসংবাদ দেব।
--কি সুসংবাদ স্যার?
--পড়া শেষে।
--না স্যার, না শুনলে অংক করতে ভুল হয়ে যাবে।
--প্লীজ, ডোন্ট রিকোয়েস্ট।
দুই মাসও হয়নি এ টিউশনির বয়স অথচ কত আপন! বিদায়ের কথা বললে হয়তো আর বাকি
সময়টুকুও পড়ানো যাবে না। তাই কোনকিছু না বলে অনেকটা জোর করে অংক, ইংরেজি,
শেষ করলাম। জ্যামিতি করাতে গিয়ে ওর দিকে তাকালাম। বিষাদ চেহারা! বুঝলাম না।
জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে না। আজ তার যতই খারাপ অবস্থা হোক--আমি আজ বিদায়
নেবই--আমাকে নিতেই হবে। মায়ার বন্ধন আমার জন্য নিষিদ্ধ। আমাকে সব ভালোবাসা
দু’পাশে কাটিয়ে সম্মুখে যেতে হবে। আমি ওর মা-বাবাকে আসতে বললাম। সিঁদুর
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। জানতে চাইল কি ব্যাপার? আমি আশ্বাস দিলাম তেমন কিছু
নয়। সে তার মা-বাবাকে নিয়ে এলো। চাকুরি সম্পর্কে তাদের অবহিত করলাম। দু’জনে
খুশি হলেও সিঁদুর গম্ভীর হয়ে আছে। তাদেরকে চাকুরির নমুনাটা অন্যভাবে বলেছি।
দু’জনে আমার মঙ্গল কামনা করে চলে গেলেন। মা-বাবা যেতেই দেখি, সিঁদুরের চোখে
জল।
--তাহলে স্যার আপনাকে আমার কথা বলে লাভ কি? আপনি তো...
--আমি তোমাকে কখনও ভুলব না, মাঝে মাঝেই আসব।
--আসবেন তো?
--অবশ্যই।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|