[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক প্রেমের গল্প

শ্যাওলা-কাঁটা-বেড়া

  

 

- শাশ্বত স্বপন -

 

৫ম পর্ব

ইন্দ্রানী ও শুভ সামাজিক মানুষগুলি থেকে পৃথক। তাদের পরিচয় ছড়িয়ে পড়লে কোন সমাজেই শান্তিতে তারা বাস করতে পারবে না। তাই বলে শুভ এসব কেয়ার করে না। না দিক ঠাঁই, এ সমাজ। তারাই দু’জনে নতুন সমাজ গড়বে। তাদের দু’জনার মাঝেই একদিন গড়ে উঠবে নতুন এক সমাজ। খেয়ে না খেয়ে আদিম হয়ে বাঁচবে। তবুও ভালোবাসার সেতু ভাঙ্গতে দেবে না কিছুতেই। ইন্দ্রানীর দু’চোখ বেয়ে জল ঝরছে। ঠোঁট কাঁপছে। ওড়না মাটিতে পড়ে গেছে। শুভ ইন্দ্রানীর কাছে এসে চোখের দিকে তাকাল। আবার নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে ভালোবাসার তীব্র গন্ধ ছুটছে। ভালোবাসার গন্ধে যেন সোনালী ফসল চিকচিক করে জ্বলছে। যে স্থানে তারা পা রেখেছে সে স্থান যেন সোনা হয়ে গেল। ভালোবাসার গন্ধে কেমন যেন মাদকতা আছে; দুজন দুজনকে টানে--এ কোন গোলাপের গন্ধ নাকি রজনীগন্ধার নাকি হৃদয়ের মাঝে ফোঁটা কোন পদ্ম ফুলের সুঘ্রাণ। নিজের অজান্তেই ভালোবাসার মাদকতায় শুভ ইন্দ্রানীকে বুকে টেনে নিল। যেন এ সম্পত্তি আর নিজের সম্পত্তি--এক ও অবিচ্ছেদ্য। ইন্দ্রানী ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। এ কান্না অতি কষ্টের মাঝে ফুটে উঠা একটি গোলাপের জন্য। এ কান্না সুখের জন্য। কিছু কিছু বেদনাতে এমন সুখ নিহিত থাকে--যা ব্যক্তিকে পাগল করে দেয়। শুভ ওর মুখে নিজের মুখ ঘষে আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করল। আগুন জ্বলল। কিন্তু দু’জনার কেউ তাতে পুড়ে ছাই হল না। এ আগুন জ্বলতে জানে, জ্বালাতে জানে। কিন্তু ইন্দ্রানী-শুভ এ মুহুর্তে কেউ এ আগুনে জ্বলতে চাইল না। শুধু আগুন জ্বালিয়ে রাখল দু’জনার বুকে। দু’জনার বুকের স্পন্দন এক হয়ে যেন বাইরে বের হতে চাইল। বুকে বুক চেপে আছে। হৃদয়ের কথা হৃদয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসার গভীরতা মাপছে, সাহস মাপছে, ঘৃণা মাপছে--সবাই সমান। শুভ ইন্দ্রানীর পায়ের কাছে এসে পায়ের ময়লা পরিস্কার করে দিল। এতক্ষণ ময়লাগুলি ছোট ছোট শিকল হয়ে পায়ে জড়িয়ে ছিল; পরাজিত হয়ে বহু ময়লা পা থেকে খসে পড়ছে। দৌঁড়ানোর ফলে পায়ের সেন্ডেল কখন যে খসে পড়েছে--তা মনেও নেই। ফর্সা পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। ভাঙ্গা শামুক রক্তাক্ত করেছে তার টুকটুকে আপেলের মত গোলাপী পা।
--ইন্দ্রানী, আসলে আমরা মা-বাবার কাছে বন্ধী--মা-বাবা সমাজের কাছে বন্ধী-- সমাজ ধর্মের কাছে বন্ধী--ধর্ম সময়ের কাছে বন্ধী। পাহাড় আকৃতির এত সব বন্ধিদশা থেকে মুক্ত হবার কোন পথ খোলা ছিল না বলেই পালিয়ে এলাম। এ ছাড়া আমাদের আর উপায় ছিল না, আছে কিনা সেটা আমার জানা নেই।
--পালিয়ে এসেছি বলে আমার মধ্যে কোন দ্বিধা নেই। আগে ছিল কিনা--জানি না। তবে এখন নেই।
--পরে হয়তো হতে পারে?
--হলে মনকে বুঝাব, যে সময়ে পালিয়ে এসেছি--সে সময়ে পালিয়ে আসার খুবই প্রয়োজন ছিল--আমার জন্য, আমাদের জন্য--ভালোবাসার জন্য--বেঁচে থাকার জন্য।
--হ্যাঁ, ইন্দ্রানী--আমিও মনকে বুঝাব, ঐ সময়ের প্রয়োজনেই পালিয়ে এসেছি এবং ঐ সময়ে কোন ভুল মনে হয়নি বলেই ভুল করিনি।
--ভাবছি, দাদা যদি শুনে তবে সব থানায় খবর চলে যাবে।
--হ্যাঁ ইন্দ্রানী, তোমার ম্যাজিস্ট্রেট ভাইটাকে বড় ভয় করে। এখন তো আছে মানিকগঞ্জ জেলায়। মুন্সিগঞ্জ আর মানিকগঞ্জ জেলা কাছাকাছি। এ দুই জেলা ছেড়ে আমাদের বহুদূরে যেতে হবে। চট্টগ্রামে আমার এক বন্ধু আছে সেখানে উঠব। ঢাকায় থাকা যাবে না।
--হ্যাঁ, ঢাকায় থাকা সম্ভব নয়। সবাই ভাববে, আমরা ঢাকায় আছি। ঢাকায় তোমার, আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন। তোমার আত্মীয়-স্বজন হয়তো আমাদের মেনে নেবে কিন্তু আমার আত্মীয়রা কিছুতেই মেনে নেবে না।
-সে আমি ভালভাবেই জানি। সুজন যে নিজেকে এতদিন নাস্তিক বলে ভাবত; সেও কেমন জানি আমতা আমতা করছিল। আমাকে বলে, শুভ, ইন্দ্রানী হিন্দু মেয়ে, না মানে আমাদের সমাজ তো--
আমি বললাম, এতদিন তুই না বলেছিলি মুচি আর পাল বা বনিক বা দাস বা সাহা বা কুন্ডুর ভালোবাসায় যত বাঁধা--মুসলমান আর ঐ বর্ণগুলোর ভালোবাসায় একই বাঁধা। মুচিরা হিন্দু হলেও হিন্দুরা মুচিদের নিচু পর্যায়ে ভাবে, নিচু চোখে দেখে।
--হ্যাঁ, বলেছিলাম। আমাদের হিন্দুদের মধ্যে দুই বর্ণের বিয়া সামাজিকভাবে খুবই কম হয়। বর্ণে বর্ণে, জাতে জাত মিলিয়ে আমাদের বিয়ে হয়।
--আরো বলেছিলি। এই ভণ্ড হিন্দুত্বের গায়ে মুসলমানের ছোঁয়া লাগুক। অন্তত: বর্ণ প্রথা নিপাত যাক।
--হ্যাঁ বলেছিলাম।
--আরো বলেছিলি--কাউকে না কাউকে দুই ধর্র্মের বিয়ে শুরু করতেই হবে। তবে না অন্যেরা সাহস পাবে।
--হ্যাঁ বলেছিলাম। এভাবে সবাই বিয়ে করলে এদেশের হিন্দুরা সব মুসলমান হয়ে যাবে। মুসলমান তো হিন্দু হয় না।
--এখন তোর কাছে মনে হচ্ছে, হিন্দু প্রাণিগুলির পৃথিবীতে থাকা খুবই প্রয়োজন। কোন প্রাণি পৃথিবীতে বেঁচে থাকে বা থাকা উচিত। যারা চলমান প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারে। ডারউইনের অস্তিত্ববাদ মনে পড়ে? পৃথিবীতে সেই মানুষকে বেঁচে থাকার কোন প্রয়োজন নেই; যারা আধুনিক জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না; যারা বিজ্ঞানকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করছে অথচ বিজ্ঞানীদের বকেই চলেছে। বিজ্ঞানকে আড়ালে লুকিয়ে শত বছরের পুরনো মৃত অর্ধমৃত, অন্ধকার, ঘোলাটে বানীগুলিকে ব্যবহার করছে। টিভি, সিনেমা হলের এর পর্দায় বসে বিজ্ঞানের বাণী না শুনায়ে ধর্মের বাণী শুনাচ্ছে। সমাজ পরিবর্তনশীল। দেশ কোন ধর্মের আইনে চলে না--গণতন্ত্রের আইনে চলে। গণতন্ত্রের আইনে কোথাও লেখা নেই--দুই ধর্মের নারী-পুরুষ কখনও বিয়ে করতে পারে না। হিন্দু- মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান একত্রে বসবাস করলে এমন ঘটনা ঘটবেই যদি ভালোবাসা, প্রেম বলে পৃথিবীতে কিছু থাকে। ভালোবাসা তো দুই-তিন-চার ভাগে বিভক্ত নয়।
--তবুও সামাজিক নিয়মের কথা বলছিলাম। জন্ম থেকে যে দেব-দেবীর কাছে থেকেছে; সে হঠাৎ মসজিদ, নামায, কোরআন শরীফ, ঈদ এগুলোর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে তো? তাছাড়া পরিবার থেকে সে ত্যাজ্য কন্যা হয়ে যাবে।
--সামাজিক নিয়মের কথা বলছিস--যা মানুষ যুগ যুগ ধরে কলুর বলদের মতো টানছে--ভবিষ্যতেও টানবে। এই সামাজিক নিয়ম ইচ্ছে করলেই সমাজপতিরা পরিবর্তন করতে পারেন। এই যে আমি ইন্দ্রানীকে ভালোবাসি এবং যদি বিয়েই করি এবং সমাজপতিরা মেনে নেয়, তবে কার বাপের সাধ্য ধর্মের চাবুক টেনে আমাদের আটকাবে? আসলে ধর্ম নয়, সামাজিক কাঠামো পরিবর্তন করা দরকার, তাতে যদি ধর্মের পা মচকে যায়--ধর্ম কাঁদবে না--সে কোনদিন কাঁদেনি--ভবিষ্যতে কাঁদবেও না; কাঁদবে ধর্মান্ধরা, ধর্মপতিরা, সমাজপতিরা। আর মসজিদ, নামায বলছিল; দেখ, ধর্ম মানুষের অন্তরের ব্যাপার। বিয়ে হওয়ার পর আমাদের সমাজে কন্যা, কন্যা থাকে না; হয়ে যায় বধূ। কন্যার বাপ আর বধূর বাপ এক নয়। কন্যা বধূ হলে কন্যার বাপ-মা এমনিতেই পর হয়ে যায় অথবা আস্তে আস্তে হয়। আর শ্বশুর-শ্বাশুরী হয়ে উঠে মা-বাবা। তুই মেট্রিকে ছিলি সাইন্স-এ, এখন আছিস আর্টস-এ এবং ভালভাবেই মানিয়ে নিয়েছিস। নাকি ভুল বললাম? দেখ সুজন, ইন্দ্রানী আর আমার মাঝে সামান্য সামাজিক তফাৎ আছে কিনা; তার চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে, তোর বর্তমানের মানসিক সমস্যা। যুক্তিকে তুই সমাজের পঁচা বস্তার মধ্যে চাপা দিয়ে রেখেছিস।

 

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ