ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাক-জ্যোৎস্নায়
কাক-ভোর (পর্ব-৮)
শাশ্বত স্বপন
কিছুদিন পর এক সন্ধ্যা
রাতে হঠাৎ শিখাদের বাড়িতে অনেক মানুষের চিৎকার শুনা গেল। কালী, তুলসী,
শেফালী--কেউ কিছু বুঝতে পারল না। তুলসী জয়ের হাতে হারিকেন দিয়ে কালীসহ তারা
তিনজনে শিখাদের বাড়ি মুখী হাঁটতে শুরু করল। বাড়ীতে গিয়ে দেখে এক আধাবয়সী
পুরুষকে ঘিরে আছে অনেক মানুষ। উঠানের মাঝখানে লোকটি বসে আছে। দাঁড়ি আর
পোশাক-আশাকে বুঝা যাচ্ছে, উনি একজন দরবেশ। গ্রামে সবাই উনাকে ফকির বলে। উনি
অবশ্য শুধু ফকির বলবে গোস্বা করে। দরবেশ বললে খুশি হয়। তাই কাছের মুরিদরা
তাকে দরবেশ ফকির বলে, এই উপাধীতে তার সন্মতি আছে।
শিখাকে জিজ্ঞাসা করে কালী জানতে পারল, দরবেশ ফকির ভাড়ে পড়েছে। ফকির পাগলের
মত হাত দুটি মাটিতে চাপরাচ্ছে। শিখা বলল, এই ফকির মানুষের যে কোন সমস্যার
সমাধান করে দিতে পারে। শিখার বৃদ্ধ দাদা বেশ কিছুদিন ধরে পাগলামী করছে।
বৃদ্ধ বয়সে পাগলামী অসম্ভব কিছু নয়, হতে পারে। অথচ সকলের ধারণা অন্য রকম।
শিখার কাকাত ভাই যার বয়স দশ মাস, তার সব সময় অসুখ লেগেই থাকে। আরো অনেকের
খারাপ বাতাসের ছোঁয়া, ভূত-পেত্মী আছড় ইত্যাদি ধরণের রোগ আছে। কালী শিখার
কাকার দিকে তাকিয়ে আছে। কাকা ফকিরকে জিজ্ঞাসা করছে, কি করলে তার পুত্র
আরোগ্য লাভ করবে। ফকির ক্লান্ত মুখে অদ্ভুত ভংগীতে বলতে লাগল, পাঁচ টাকা
আটানা মাজারে দিতে হবে। পাঁচ সের চাল আর পাঁশ সিকে পাঁচ জন ভিক্ষুককে দিতে
হবে এবং পাঁচ পুকুরের পানি একটি বোতলে মিশিয়ে আবুল দরবেশকে দিতে হবে। বোতলে
ফু দিলে সেই পড়া পানি বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে।
আবুল দরবেশ সেই। সবাই বলে, আবুল ফকির একজন দিব্য পুরুষ। সে এক অলৌকিক মানব।
ছোট ছোট ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া সবাই অবাক হয়ে
দেখছে। কালীর বিশ্বাস হচ্ছে না। তবু কালীর জানতে ইচ্ছে করছে অতি গোপনীয়
একটা ব্যাপার--যা এতগুলি মানুষের সামনে বলা যাবে না।
-- ঠাকুরমা, বারেকের বাবা কাগজে কি লিখেছিল?
-- কি জানি, গোপন ব্যাপার।
-- আমিও কাগজে লিখে দেই?
-- কি লিখবি?
-- তোমাকে বলা যাবে না।
-- তোর বাবার ব্যবসা ভাল যাচ্ছে না। ফকিরকে জিজ্ঞাসা করি?
ফকিরকে জিজ্ঞাসা করা হল। সে এক দামে একটা তাবিজ কিনতে বলল এবং আবুল ফকিরের
কাছে যেতে বলল। কালী এতক্ষণে শিখার কাছ থেকে কলম নিয়ে গোপনীয় সমস্যাটা
লিখেছে। নাসরিন জিজ্ঞাস করল,
-- কি লিখেছিস?
-- বলা যাবে না।
কাগজটা ফকিরের সারগেদের মাধ্যমে ফকিরকে দেওয়া হল। সে মুখে পুড়ে সত্যি সত্যি
খেয়ে ফেলল। তিন-চার মিনিট অদ্ভূত ভংগী করে বলল, খুব শীঘ্রই ফল পাবে।
আবুল ফকির তার কর্ম মহৎ থেকে মহত্তর করার জন্য কারো কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিত
না। যা খরচ হয়, শুধু তাই নিত। সবাই এজন্য তাকে জোড় করে লাউ, কুমড়া, চাউল,
ডাউল, শাক-সবজি ইত্যাদি দিয়ে আসে। এসব দিয়ে তার সংসার ভালই চলে। তার চাপার
জোর আছে। গ্রাম্য শালিশীতে বসলে সবাই সাবধানে কথা বলে। তাকে কেউ কিছু বলতে
সাহস পায় না। কারণ সে বাণ মারতে পারে। সে মনসা পূজায় ভোগ দেয়। কালীপূজায়
সক্রিয়ভাবে হিন্দুদের সাথে থাকে। তার গুরু নাকি শ্মশান কালী। একবার এক মনসা
পূজায় সে গান গেয়েছিল, জয় জয় মা মনসা, জয় বিষ্ণু হরি লো, বন্দনা করিলাম
প্রথম, মা মনসার স্মরণে....। বয়স্ক হিন্দু বুড়া-বুড়ীরা বলে, আবুল ফকির
পূর্ব জন্মে হিন্দু ছিল।
কালীর গাঁয়ের রং কবে, কিভাবে ফর্সা হবে। কবে তার চেহেরা ভগবান সুন্দর করে
দেবে--এই দুইটা লাইনই সে কাগজে লিখেছিল। দীর্ঘ দুই মাস পরও সে তার ফল
পায়নি। বরং সে আরো অনাকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। দেহ মোটা হচ্ছে। চেহেরা ফুলে
যাচ্ছে। তবে কালীপদ ভাল ফল পেয়েছিল। তার ব্যবসা এখন খুব ভাল চলছে। মায়ের
দেওয়া তাবিজ সে মাকে খুশী করার জন্য মাজায় দিয়েছিল। প্রথম দিন স্নান করার
সময় নদীতে ফেলে দিয়েছে। এখন রমজান মাস, ঈদের মওসুম, সামনে দুইটি ঈদ, তারপর
দূর্গা পূজা, লক্ষ্মীপূজা তো আছেই। ফলে ব্যবসা তো ভাল হবেই। কিন্ত? তুলসীর
ধারণা তাবিজের কারণেই হয়েছে। ফলে সে আবুল ফকিরের বাড়িতে চাউল, ডাউল,
শাক-সবজি ইত্যাদি নিজ হাতে দিয়ে এসেছে।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |