|
ধারাবাহিক
গল্পঃ
হরিদাসের রমজান মাস
শাশ্বত স্বপন
২য় পর্বঃ পাঁচ পুরুষের ভিটা
“আকাশের
দিকে তাকিয়ে হরিদাস বলে, ভগবান, তোমার এই চিড়া, মুড়ি, বাতাসায় যেমন তোমার
ইফতার হয়, তেমনি তোমার পূজাও চলে, একই উপকরনে পূজা ও রোজা দুই-ই চলে”
বাজারের মন্দিরটার বেশির ভাগ খরচ তিনি দেন। তার আশির্বাদ ছাড়া, বাজারের
বার্ষিক কির্ত্তন, পূজা-অর্চণা কিছুই হয় না। তার মুখ থেকে মিথ্যা কথা কেউ
শুনে নাই। গ্রামের দুই পাড়ার মসজিদে নামাজীদের প্রায়ই মারামারি হয়। এক
পাড়ার লোকদের অন্য পাড়ার মসজিদে নামাজ পড়া নিষেধ। যদিও বা কেউ ভুল করে
নামাজে যায়, সেদিনই মারামারি লাগে। বিশ পচিশ ফুট প্রস্থের খাল এর দুই দিকে
দুটি বড় পাড়া। রমজান মাস আসলে প্রথম রোজার আগেই হরিদাস খাল পাড়ের সাঁকোটা
নিজের বাড়ির বাঁশ কেটে মেরামত করে দেয়। আর ইফতারের সময় হলে তার দোকানের মুড়ি,
চিড়া, বাতাসা, গুড় দিয়ে সকলে ইফতার করে। ইফতারের সময় তাকে সবাই ইফতার দেয়।
সে খায়, আপন মনে হাসে, আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ভগবান, তোমার এই চিড়া, মুড়ি,
বাতাসায় যেমন তোমার ইফতার হয়, তেমনি তোমার পূজাও চলে, একই উপকরনে পূজা ও
রোজা দুই-ই চলে।
এই এলাকার মুসলমান চেয়ারম্যান, চাউলের বেপারী, সংসদ সদস্যের
ম্যানেজার--সবাই প্রায় হিন্দু। আর প্রত্যেকের চোখ মূল সড়কের সাথে হরিদাসের
বাড়ি আর ধানী জমির উপর। মূল সড়ক নাকি একদিন বিশ্বরোড হবে। সেই হিসাবে এই
বাড়ি ও আশে পাশের জমির কি দাম হতে পারে, তা নিয়ে যতটা না
চেয়ারম্যান-বেপারী-এমপি ভাবে, তার চেয়ে বেশি ভাবে এদের হিন্দু ম্যানেজাররা।
হরি দাসের চার কি পাঁচ পূর্বপুরুষ এই বাড়িতে বসবাস করেছে। তার পূর্বপুরুষরা
তার মতই সৎ ছিল বলে গ্রামে একটা সুনাম আছে। সেই সাথে দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত।
দেশ বিভাগের সময় থেকে এ পাড়ার যারাই ভারতে চলে গেছে, তারা সবাই তাদের
জমি-জমা সব হরিদাসের পিতা হরি আনন্দর কাছে কম দামে বিক্রি করেছে, কেউবা বিনা
বিনামূল্যেও তাদের দিয়ে গেছে। কেউ অবশ্য তাদের জমি মা কালীর নামে দান করে
তার কাছে রেখে গেছে। এসব জমির কোনটা কাগজে-কলমে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে, কোনটা
হয়নি। তবে যারা এসব করতে পারেনি, তারা গ্রামের দশজনকে ডেকে মৌখিক ভাবে হরি
আনন্দকে জমি দান করেছে। দেশ ভাগের সময় হরিদাসের বয়স কুড়ি হবে। সবাই হরি
আনন্দকেও ভারতে চলে যেতে উপদেশ দিয়ে গেছে। কিন্তু সে যায়নি।
পাড়ার গণেশ কাকার কথা হরির মনে পড়্। দেশান্তর হবার আগের দিন হিন্দু-মুসলমান
সবাইকে ডেকে বলতে শুরু করল, ‘আপনারা কইতে পারেন, আমরা আপনেগো কাছে কেন এসব
বেচলাম না? এ পাড়ায় শত শত বছর আমরা হিন্দুরা বসবাস করতাছি, এই যে হরি আনন্দ,
তার চার পুরুষ এখানে মরেছে, তাদের নামে মঠ আছে, তার পূর্ব পুরুষরাই নানা
জায়গা থেকে আমাগো পূর্বপুরুষদের এখানে আনছে। এখানে অনেকের চিতা-ভস্ম আছে,
মন্দির আছে। এগুলো এই পরিবারের কাছে মন্দিরের মত যত্নে থাকবে, আপনাদের কাছে
যা অধর্ম। পারলে সব বিনা পয়সায় দিতাম, কিন্তু কোলকেতা গিয়ে তো কিছু করে
খাইতে হবে, তাই হরি দাদার কাছে কিছু টাকা নিয়ে সাব-কবলা দলিল দিয়ে গেলাম।’
সবাই তার সাথে একমত হল। বর্তমান গ্রাম চেয়ারম্যানের বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলতে
লাগল, গণেশ, তুই আমার জন্মকালের বন্ধু, তুই জাসনে, তুই হরি আনন্দদার মত
সাহস নিয়ে থাক। তোদের ভিটা, মন্দির যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকবে। আমি জিন্দা
থাকতে কোন অনিয়ম অইতে দিমু না। হরিদার বাপ দাদারাই এ গ্রাম সৃষ্টি করেছে,
ওদেরকে আমরা মাথায় তুলে রাখব। ওদের বাপদাদাদের সাহায্য নিয়েই আমার তিন
পুরুষ তথা এ গ্রামের প্রতিটি মানুষ বেঁচে ছিল, এখনও আছে।
কাপালী বাড়ীর পশ্চিম দিকের পুকুরের জলে প্রতিদিন অস্তায়মান গোধূলীর সূর্যের
ছায়া পড়ে, লাল আভায় মেঘ মাখা রং এর ছবিটা পুকুরে জলে ভাসতে থাকে। পুকুরে
মাটির ঢেলা ছুড়ে ফেললে ছবিটা কাঁপতে থাকে। হরির বয়স যখন সাত কি আট, তখন থেকে
সে পুকুরের জলে গোধূলীর স্থির-কম্পমান ছায়া দেখে আসছে। কাপালী বাড়ীর শেষ
পুরুষ বোরজা কাপালী সবার শেষে কোলকাতা চলে যায়। হরি আনন্দর বড় ভাই নিত্য
আনন্দ জমি-বসতভিটা, প্রায় ছয় একর জায়গা কিনে রাখে। নিত্য আনন্দ নিঃসন্তান,
তাই সবই হরি-মোহনকে দিয়ে গেছে । কাপালী বাড়িতে আছে বিশাল বাগান, দীঘি,
মঠ-মন্দির, রামপ্রসাদের আশ্রম, সবই এ পরিবার দেখা-শুনা করে। কিছু দরিদ্র
মানুষকে হরি বসবাস করতে দিয়েছে। এরা নমঃশুদ্র, পেশায় মিস্ত্রী, স্বর্ণকার,
কেউ মুলিবাঁশের খুচি বানায়। পূর্বের রাস্তা তাদের জমির উপর দিয়েই গেছে,
রাস্তার পুর্বে তাদের সাত একরের মত ফসলী জমি, তারপর বিল। এই সম্পত্তি ঘরামী
বংশের, যে উপাধী এক সময় তাদের পূর্বপুরুষের ছিল। ঘরামীরা
ফসল-মাছ-বাগান-ব্যবসা নিয়েই দাপটে ছিল। এই পরিবারের কোন এক শিক্ষিত ব্যক্তি
কুষ্ঠি নিয়ে ঘাটাঘাটি করে আবিস্কার করে হরি আনন্দরা পূর্বে ঘরামী ছিল...।
এই নিয়ে অবশ্য রায় পরিবারে কেউ কোন প্রতিবাদ করেনি। ঘরামীরা সাধারনত
মানুষের ঘর বানিয়ে দেয়, আমরা যাদের কাঠমিস্ত্রী বলি, ছোট চোখে দেখি। সম্ভবত
এই কারণে হরির পূর্বপুরুষরা বংশের উপাধী ত্যাগ করে স¤্রাট বা বৃটিশদের দেওয়া
রায় উপাধী গ্রহণ করে। কেন তারা রায় বাহাদুর উপাধী পায়নি? মনে হয়,আগে খুব বড়
মাপের জমিদারী ছিল না। যে বেশি খাজনা দিত বা যার প্রভাব, দাপট বেশি, যাকে
দিয়ে স¤্রাট বা বৃটিশরা বেশি লাভবান হত, তাদেরই তারা বেশি ভালোবাসত, বেশি
সুবিধা দিত, বিরাট আয়োজনে উপাধী দিত।
দখিনে বীরেন্দ্র পালের দুই একর জায়গা, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সব খুলনায় ছিল,
ব্যবসা-সংসার এক জায়গায় রাখতে তারাও হরিআনন্দর বড় জ্যাঠার বড় ছেলে সামন্তর
কাছে বিক্রি করেছিল। সামন্ত রায়ের পরিবারটা ছিল ঐ সময়ে মস্ত বড় জমিদার,
যদিও জমিদারী প্রথা ছিল না, অনেক জমি, সম্পত্তির মালিক হলেই মানুষ জমিদার
মনে করত। এরা ছিল বেশ উচ্চ শিক্ষিত পরিবার, এদের ক্লাশ কনসাস বেশ ধারালো
ছিল। হরি আনন্দর তিন ভাইয়ের কাছে সব সম্পত্তি , গ্রামের সাধারন মানুষের
ভাষায়, জলের দামে বিক্রি করে গেছে। সামন্তদের বাপ-দাদার মঠ এবং নিজস্ব
মন্দিরের দায়িত্ব হরি আনন্দকে দিয়ে যায়, তবে দলিলে লিখা আছে এসব ধর্মীয়,
পূর্বপুরুষের চিহৃ কোনভাবে হরিদের বংশ ধ্বংশ করতে পারবে না। আর সামান্য কিছু
ভিটে সামন্ত রায় তাদের দরিদ্র দূর সম্পর্কের আত্নীয়-স্বজনকে দান করে যায়।
দেশ ভাগের সময়ে এদের কিছু সদস্য আসাম, কিছু সিলেট, কিছু লন্ডনে চলে যায়।
স্বল্প বিদ্যা আর ভিটে মাটির টান, সেই সাথে অনেক পরিবারের
মঠ-মন্দির-সম্পত্তি দেখা শুনার দায়িত্ব, অনেক পরিবার তাদের আহার-বাসস্থানের
জন্য এই হরিদাস রায় পরিবারের মুখের দিকে চেয়ে থাকে বলে, যাই যাই করে এই
পরিবারের কোলকাতা যাওয়া হয়নি। আর চলে গেলে, কে দেখবে এত সব
সম্পত্তি-মঠ-মন্দির-আশ্রম । সবাই তো তার পূর্বপুরুষ বা তার কাছে বিশ্বাসের
সাথে সব দিয়ে গেছে। সে কাকে দিয়ে যাবে, এত বড় গুরু দায়িত্ব নেবার মত আর তো
কেউ নাই।
বাজারের মন্দিরটার বেশির ভাগ খরচ তিনি দেন। তার আশির্বাদ ছাড়া, বাজারের
বার্ষিক কির্ত্তন, পূজা-অর্চণা কিছুই হয় না। তার মুখ থেকে মিথ্যা কথা কেউ
শুনে নাই। গ্রামের দুই পাড়ার মসজিদে নামাজীদের প্রায়ই মারামারি হয়। এক
পাড়ার লোকদের অন্য পাড়ার মসজিদে নামাজ পড়া নিষেধ। যদিও বা কেউ ভুল করে
নামাজে যায়, সেদিনই মারামারি লাগে। বিশ পচিশ ফুট প্রস্থের খাল এর দুই দিকে
দুটি বড় পাড়া। রমজান মাস আসলে প্রথম রোজার আগেই হরিদাস খাল পাড়ের সাঁকোটা
নিজের বাড়ির বাঁশ কেটে মেরামত করে দেয়। আর ইফতারের সময় হলে তার দোকানের মুড়ি,
চিড়া, বাতাসা, গুড় দিয়ে সকলে ইফতার করে। ইফতারের সময় তাকে সবাই ইফতার দেয়।
সে খায়, আপন মনে হাসে, আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ভগবান, তোমার এই চিড়া, মুড়ি,
বাতাসায় যেমন তোমার ইফতার হয়, তেমনি তোমার পূজাও চলে, একই উপকরনে পূজা ও
রোজা দুই-ই চলে।
এই এলাকার মুসলমান চেয়ারম্যান, চাউলের বেপারী, সংসদ সদস্যের
ম্যানেজার--সবাই প্রায় হিন্দু। আর প্রত্যেকের চোখ মূল সড়কের সাথে হরিদাসের
বাড়ি আর ধানী জমির উপর। মূল সড়ক নাকি একদিন বিশ্বরোড হবে। সেই হিসাবে এই
বাড়ি ও আশে পাশের জমির কি দাম হতে পারে, তা নিয়ে যতটা না
চেয়ারম্যান-বেপারী-এমপি ভাবে, তার চেয়ে বেশি ভাবে এদের হিন্দু ম্যানেজাররা।
হরি দাসের চার কি পাঁচ পূর্বপুরুষ এই বাড়িতে বসবাস করেছে। তার পূর্বপুরুষরা
তার মতই সৎ ছিল বলে গ্রামে একটা সুনাম আছে। সেই সাথে দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত।
দেশ বিভাগের সময় থেকে এ পাড়ার যারাই ভারতে চলে গেছে, তারা সবাই তাদের
জমি-জমা সব হরিদাসের পিতা হরি আনন্দর কাছে কম দামে বিক্রি করেছে, কেউবা বিনা
বিনামূল্যেও তাদের দিয়ে গেছে। কেউ অবশ্য তাদের জমি মা কালীর নামে দান করে
তার কাছে রেখে গেছে। এসব জমির কোনটা কাগজে-কলমে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে, কোনটা
হয়নি। তবে যারা এসব করতে পারেনি, তারা গ্রামের দশজনকে ডেকে মৌখিক ভাবে হরি
আনন্দকে জমি দান করেছে। দেশ ভাগের সময় হরিদাসের বয়স কুড়ি হবে। সবাই হরি
আনন্দকেও ভারতে চলে যেতে উপদেশ দিয়ে গেছে। কিন্তু সে যায়নি।
পাড়ার গণেশ কাকার কথা হরির মনে পড়্। দেশান্তর হবার আগের দিন হিন্দু-মুসলমান
সবাইকে ডেকে বলতে শুরু করল, ‘আপনারা কইতে পারেন, আমরা আপনেগো কাছে কেন এসব
বেচলাম না? এ পাড়ায় শত শত বছর আমরা হিন্দুরা বসবাস করতাছি, এই যে হরি আনন্দ,
তার চার পুরুষ এখানে মরেছে, তাদের নামে মঠ আছে, তার পূর্ব পুরুষরাই নানা
জায়গা থেকে আমাগো পূর্বপুরুষদের এখানে আনছে। এখানে অনেকের চিতা-ভস্ম আছে,
মন্দির আছে। এগুলো এই পরিবারের কাছে মন্দিরের মত যত্নে থাকবে, আপনাদের কাছে
যা অধর্ম। পারলে সব বিনা পয়সায় দিতাম, কিন্তু কোলকেতা গিয়ে তো কিছু করে
খাইতে হবে, তাই হরি দাদার কাছে কিছু টাকা নিয়ে সাব-কবলা দলিল দিয়ে গেলাম।’
সবাই তার সাথে একমত হল। বর্তমান গ্রাম চেয়ারম্যানের বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলতে
লাগল, গণেশ, তুই আমার জন্মকালের বন্ধু, তুই জাসনে, তুই হরি আনন্দদার মত
সাহস নিয়ে থাক। তোদের ভিটা, মন্দির যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকবে। আমি জিন্দা
থাকতে কোন অনিয়ম অইতে দিমু না। হরিদার বাপ দাদারাই এ গ্রাম সৃষ্টি করেছে,
ওদেরকে আমরা মাথায় তুলে রাখব। ওদের বাপদাদাদের সাহায্য নিয়েই আমার তিন
পুরুষ তথা এ গ্রামের প্রতিটি মানুষ বেঁচে ছিল, এখনও আছে।
কাপালী বাড়ীর পশ্চিম দিকের পুকুরের জলে প্রতিদিন অস্তায়মান গোধূলীর সূর্যের
ছায়া পড়ে, লাল আভায় মেঘ মাখা রং এর ছবিটা পুকুরে জলে ভাসতে থাকে। পুকুরে
মাটির ঢেলা ছুড়ে ফেললে ছবিটা কাঁপতে থাকে। হরির বয়স যখন সাত কি আট, তখন থেকে
সে পুকুরের জলে গোধূলীর স্থির-কম্পমান ছায়া দেখে আসছে। কাপালী বাড়ীর শেষ
পুরুষ বোরজা কাপালী সবার শেষে কোলকাতা চলে যায়। হরি আনন্দর বড় ভাই নিত্য
আনন্দ জমি-বসতভিটা, প্রায় ছয় একর জায়গা কিনে রাখে। নিত্য আনন্দ নিঃসন্তান,
তাই সবই হরি-মোহনকে দিয়ে গেছে । কাপালী বাড়িতে আছে বিশাল বাগান, দীঘি,
মঠ-মন্দির, রামপ্রসাদের আশ্রম, সবই এ পরিবার দেখা-শুনা করে। কিছু দরিদ্র
মানুষকে হরি বসবাস করতে দিয়েছে। এরা নমঃশুদ্র, পেশায় মিস্ত্রী, স্বর্ণকার,
কেউ মুলিবাঁশের খুচি বানায়। পূর্বের রাস্তা তাদের জমির উপর দিয়েই গেছে,
রাস্তার পুর্বে তাদের সাত একরের মত ফসলী জমি, তারপর বিল। এই সম্পত্তি ঘরামী
বংশের, যে উপাধী এক সময় তাদের পূর্বপুরুষের ছিল। ঘরামীরা
ফসল-মাছ-বাগান-ব্যবসা নিয়েই দাপটে ছিল। এই পরিবারের কোন এক শিক্ষিত ব্যক্তি
কুষ্ঠি নিয়ে ঘাটাঘাটি করে আবিস্কার করে হরি আনন্দরা পূর্বে ঘরামী ছিল...।
এই নিয়ে অবশ্য রায় পরিবারে কেউ কোন প্রতিবাদ করেনি। ঘরামীরা সাধারনত
মানুষের ঘর বানিয়ে দেয়, আমরা যাদের কাঠমিস্ত্রী বলি, ছোট চোখে দেখি। সম্ভবত
এই কারণে হরির পূর্বপুরুষরা বংশের উপাধী ত্যাগ করে স¤্রাট বা বৃটিশদের দেওয়া
রায় উপাধী গ্রহণ করে। কেন তারা রায় বাহাদুর উপাধী পায়নি? মনে হয়,আগে খুব বড়
মাপের জমিদারী ছিল না। যে বেশি খাজনা দিত বা যার প্রভাব, দাপট বেশি, যাকে
দিয়ে স¤্রাট বা বৃটিশরা বেশি লাভবান হত, তাদেরই তারা বেশি ভালোবাসত, বেশি
সুবিধা দিত, বিরাট আয়োজনে উপাধী দিত।
দখিনে বীরেন্দ্র পালের দুই একর জায়গা, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সব খুলনায় ছিল,
ব্যবসা-সংসার এক জায়গায় রাখতে তারাও হরিআনন্দর বড় জ্যাঠার বড় ছেলে সামন্তর
কাছে বিক্রি করেছিল। সামন্ত রায়ের পরিবারটা ছিল ঐ সময়ে মস্ত বড় জমিদার,
যদিও জমিদারী প্রথা ছিল না, অনেক জমি, সম্পত্তির মালিক হলেই মানুষ জমিদার
মনে করত। এরা ছিল বেশ উচ্চ শিক্ষিত পরিবার, এদের ক্লাশ কনসাস বেশ ধারালো
ছিল। হরি আনন্দর তিন ভাইয়ের কাছে সব সম্পত্তি , গ্রামের সাধারন মানুষের
ভাষায়, জলের দামে বিক্রি করে গেছে। সামন্তদের বাপ-দাদার মঠ এবং নিজস্ব
মন্দিরের দায়িত্ব হরি আনন্দকে দিয়ে যায়, তবে দলিলে লিখা আছে এসব ধর্মীয়,
পূর্বপুরুষের চিহৃ কোনভাবে হরিদের বংশ ধ্বংশ করতে পারবে না। আর সামান্য কিছু
ভিটে সামন্ত রায় তাদের দরিদ্র দূর সম্পর্কের আত্নীয়-স্বজনকে দান করে যায়।
দেশ ভাগের সময়ে এদের কিছু সদস্য আসাম, কিছু সিলেট, কিছু লন্ডনে চলে যায়।
স্বল্প বিদ্যা আর ভিটে মাটির টান, সেই সাথে অনেক পরিবারের
মঠ-মন্দির-সম্পত্তি দেখা শুনার দায়িত্ব, অনেক পরিবার তাদের আহার-বাসস্থানের
জন্য এই হরিদাস রায় পরিবারের মুখের দিকে চেয়ে থাকে বলে, যাই যাই করে এই
পরিবারের কোলকাতা যাওয়া হয়নি। আর চলে গেলে, কে দেখবে এত সব
সম্পত্তি-মঠ-মন্দির-আশ্রম । সবাই তো তার পূর্বপুরুষ বা তার কাছে বিশ্বাসের
সাথে সব দিয়ে গেছে। সে কাকে দিয়ে যাবে, এত বড় গুরু দায়িত্ব নেবার মত আর তো
কেউ নাই।
চলবে
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|