[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ (পর্ব-২০)

  

 

- শাশ্বত স্বপন -

 

ন্যান্সি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ উঃহু করে আমাকে জড়িয়ে ধরল। মাথা ধরেছে। এই তিন বছরে তার দেহে যে পরিমাণ ঔষধ গেছে--তা তার ওজনের বেশি হবেই। ফলে ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া তো হবেই। একটু পরে মাথা ব্যথা কমে গেল। সে হেসে উঠল। আমাকে নিয়ে কোথায় যাওয়া যায়, তাই ভাবতে লাগল। বুয়া চা বিস্কুট, কলা, আঙুর, আপেল, কোক ইত্যাদি নিয়ে এলো। সে এগুলো বুয়াকে বারান্দায় রাখতে বলল। আমাকে নিয়ে বারান্দায় গেল। তার এখন কি যে আনন্দ হচ্ছে--তা তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যায়। আমি সোফায় বসলাম। ও আমার পাশে বসল। একটা আঙুর আমার মুখে পুড়ে দিল। ভয় পেয়ে আঙুল সরিয়ে নিল। ভেবেছিল আমি কামড় দেব। ফ্রান্সিসের সাথে নিশ্চয়ই এসব ঘটেছে। আমি তার মুখে আঙুর দিতেই সে আঙুলে কামড় বসিয়ে দিল। উঃহু বলে সরিয়ে আনতেই সে দু’হাত দিয়ে আঙুলটাকে ধরে ফুঁ দিতে লাগল। দু’জনেই হাসতে লাগলাম। হাসি আমার মুখ থেকে খুব কমই আসে। মনে হচ্ছে, ন্যান্সির কাছ থেকে আমি নতুন করে হাসতে শিখছি। এক সময় আল্পনাকে অনেক হাসাতাম। আল্পনার মন খারাপ থাকলে পেটে সুরসুরি দিতাম।
চায়ের একটা কাপ আমাকে দিতেই তার চোখ-মুখে এমন একটা ভাব লক্ষ্য করলাম যা আমাকে বিস্মিত করল। এক চোখ বোঁজা অবস্থার উঃ আঃ করতে লাগল।
--ন্যান্সি, কেমন লাগছে তোমার?
--আমাকে ধর...আমি...
কিছুক্ষণ কি এক যন্ত্রণায় ছটফট করল। কি যেন আবোল-তাবোল বকল, কিছুই বুঝলাম না। এমন সব শব্দ করল যা সাজালে কি অর্থ হয় ভাবতে লাগলাম। গাড়ি...ফুল...সবকিছু...না...উহু...ব্যথা...যাব না...ও ও ও...ফ্রান্সিস...। ন্যান্সি ঘুমিয়ে গেছে। মিসেস নজরুল দেখে গেলেন। বেশ লজ্জা পেলাম। তিনি আমার জড়তা কাটানোর জন্য জিজ্ঞাসা করলেন--
--ঘুমিয়ে গেছে?
--হ্যাঁ, মাথায় খুব যন্ত্রণা।
--প্রায়ই হয়। সবে তো শুরু। ও এমন কাজ হঠাৎ হঠাৎ করে বসে--যা ভাবাও যায় না।
--কি সব কথা বলল--কিছুই বুঝলাম না।
--এরকম কথা কম্পিউটারে রেকর্ড করা হয়েছে--কিছুই ধরা পড়েনি। ওকে বিছানায় শুইয়ে দাও।
আমি তাই করলাম। রুমে আমি আর ন্যান্সি ছাড়া আর কেউ নেই। বিছানায় শুইয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। একটু পরেই দেখি সে চোখ খুলল। চোখ ছলছল করছে।
--আমার কিছু ভালো লাগছে না।
--সমুদ্র দেখবে?
--হ্যাঁ, দেখব। এক্ষুণি দেখব।
--না, এক্ষুণি না। ঘুমাও পরে যাব--
ন্যান্সি কি যেন ভাবছে। মিসেস নজরুল একটা টেপ-রেকর্ডার রেখে গেল। আমি একটা ক্যাসেট নাড়াচাড়া করলাম। রবীন্দ্র সংগীতের ক্যাসেট। চালু করলাম। ‘ধন্য হলো সকল অঙ্গ--পূর্ণ হল অস্তর--সুন্দর হে সুন্দর...।’ আমার কোন অঙ্গ ধন্য হয়েছে কিনা জানি না--তবে হৃদয়ের পুরো অংশ বেদনাতে ভরে গেছে। এক হৃদয়ে এত বেদনা কি করে থাকে? হৃদয় কি কম্পিউটারের মতো এত বেদনা ধারণক্ষম?

আমি জানি, এখন খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করি--এই মেয়েটিকে ছেড়ে কোথাও বোধহয় যেতে পারব না। যেতে চাইলেও এরা আমাকে যেতে দেবে না। ন্যান্সি তো যেতে দেবেই না। কিন্তু ‘আমি’ যেতে চাই--পারি না। আমি বাঁচার মতো বাঁচতে চাই কিন্তু পারি না। জীবন্ত লাশ হয়ে আমি বেঁচে আছি। পারি না কোন সিদ্ধান্ত নিতে। সাহস আছে কিন্তু দেখাতে পারি না। হৃদয়ে অনেক দুঃখ-কষ্টের কথা আছে--কাউকে বলতে পারি না--বলার মতো মানুষ পাই না। আমি কি--আমি নিজেই জানি না। টেপে গান বাজছে--‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলায়রে...।’ আমি উৎকণ্ঠে ন্যান্সিকে বললাম, ন্যান্সি, গ্রামে যাবে?
সে দৌঁড়ে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরল। আমি ওর দিকে তাকালাম। সে তার হাত দিয়ে আমার চোখ মুছে দিল। বুঝলাম, আমার চোখে পানি। আজকাল কি হয়েছে আমার? আমি কি অসার? আমি কাঁদি--চোখ দিয়ে পানি ঝরে অথচ আমি নিজেই কিছু উপলব্ধি করতে পারি না। সেলিম ওর দুঃখ-কষ্ট অনেক কিছুই আমাকে বলেছে অথচ আমি ওর কাছে তেমন কিছুই বলিনি। মুখ-চোরা স্বভাব আমার। নিজের কথা নিজের অজান্তেই লুকিয়ে রাখি।
--তুমি কাঁদছ কেন?
--কৈ নাতো, চোখে ডিস্টার্ব আছে।
--আঙ্কেলকে বল।
--বলব, অবশ্যই বলব।
--গান ভালো লাগে?
--খুব--

অনেক বেলা গড়িয়ে গেছে। লাঞ্চের সময় বুয়া দু’জনকে ডাকল। দু’জনে দুই প্লেটে খেতে বসলাম। খাবার টেবিলে বসে সে এমন সব কাণ্ড করছে--যা দেখে ছোট শিশুর কথা মনে পড়ে। আমি কিছুই বলছি না। তার শিশু সুলভ কাণ্ড-কারখানা দেখছি। সে এটা খাবে না, ওটা খাবে না। চৌত্রিশটা আইটেম দেওয়া আছে। যেটা তার ভালো মনে হয়, সেটাও একটু মুখে নিয়ে ফেলে দেয়। বুয়া, রেহানা তাকে এটা-ওটা খেতে বলে, সে আরো রেগে যায়। তার মায়ের দিকে সে খাবার ছুঁড়ে মারে। বুয়াকে তরকারি ছুঁড়ে মারে। কারণ বুয়া তাকে তরকারি খেতে কর্তৃত্ব দেখিয়েছে। সরাসরি এ বাড়ির সদস্য যদিও নয় তবুও ডাক্তারকে ন্যান্সি বেশি ভালোবাসে। সে যা করতে চায়--ডাক্তার তাতেই সায় দেয়। নিষেধ করে না। বুয়ার কাছ থেকে জানতে পারলাম, একদিন সে টিভি ভাঙ্গতে চাইল--ডাক্তার তাকে অনুমতি দিল। সে টিভি ভেঙ্গে ফেলল আছাড় দিয়ে। ডাক্তার হাত তালি দিল। কিন্তু ন্যান্সি গম্ভীর হয়ে রইল। মনে হয়, সে খুশি হয়নি। বুয়া টিভি ভাঙ্গার গল্প বলার সাথে সাথে ন্যান্সি চিৎকার জুড়ে দিল। রেহানা ও বুয়া দু’জনেই চলে গেল। আমি ডাকলাম, “ন্যান্সি আমার কাছে বস।” সে গাল ফুলিয়ে আছে। আমার প্লেট ফেলে দিল। সেও খাবে না--আমাকেও খেতে দেবে না।বললাম, ‘আমি চলে যাব এক্ষুণি।’

সে আবার চিৎকার জুড়ে দিল। আমি উঠে দাঁড়াতেই সে আমাকে আবার বসাল। মাপ চাওয়া ভঙ্গীতে আমার পায়ের সামনে ফ্লোরে বসে পড়ল। আমি অনেকটাই জোর করে তাকে কিছু পরিমাণ খাওয়ালাম। সে চেয়ারে বসে আমার গায়ে হেলান দিয়ে পড়ল। আমি আর খেলাম না। চলে এলাম ওর বিছানায়। ও টেপ চালু করতে গেল। মিউজিকের তালে তালে গুন গুন করে গান গাইছে আর নাচছে। বিছানায় গড়াগড়ি দিতেই মুরাদের কথা মনে পড়ল। ওর টাকার দরকার। সন্ধ্যায় সিঁদুরকে বলতে হবে, তোমাকে আর পড়াতে পারব না। হয়তো সপ্তাহে দুই-একদিন আসতে পারব--যা না আসাই ভালো। বুয়া আমাকে ডাকল। ন্যান্সি বুয়াকে দেখে মারতে গেল। বুয়া দৌঁড়ে চলে গেলে। ন্যান্সি বুয়ার দৌঁড়ানো দেখে হাসল।

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ