ধারাবাহিক
গল্পঃ
হরিদাসের রমজান মাস
শাশ্বত স্বপন
১ম পর্বঃ
রমজানের হাঁটযাত্রী
‘রোজাদাররা ওঠো--, সেহরীর সময় অইছে...।’ দিঘলী বাজারের পাহাড়াদারদের চিৎকারে,
দরজা বা দোকানের ঝাপের আওয়াজে, কারো না ওঠে উপায় নেই। যারা রোজা রাখার নিয়ত
করত, তা উঠে সেহেরী খেয়ে নামাজ পড়ত, তারপর আবার ঘুমাত। কেউ ঘুম ঘুম চোখে
কোন রকম খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, আর যাদের রোজা রাখার নিয়ত নাই, তারা উঠে, বিরক্ত
হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ত।
কাক-জোৎস্নায় কিছু মানুষ বাজারের গলি দিয়ে হেঁটে নদীর পাড়ে চলে যায়। প্রায়
প্রতিদিনই এ রকম দৃশ্য বাজারের পাহাড়াদাররা দেখে। বাজারের সাথে মরা নদী,
হাঁটু জল থাকলে মাল কোছা দিয়ে সবাই পার হয়। পানি বেশি হলে নৌকা মাঝিকে ডেকে
তুলে নদী পার হয়। নদীটি পদ্মা নদীর শাখা, চৈত্র মাসে শুকিয়ে যায়, এর দখিনে
দীর্ঘ বালুচর। বালুচরের ফাঁকে ফাঁকে খুব বেশি চোখে পড়ে পিয়াজ, রসুন, ধান,
নদীর কূল জুড়ে নটে আর কাশ জাতীয় ঘাসের বিশাল সীমানা। টিন-ছন-কাঁশ-মুলিবাঁশ
দিয়ে ছবির মত করে গড়া চরের ঘরগুলোর চারপাশে কলাগাছ; কোথাও একটি, কোথাও দুইটি
ঘর, আবার বেশ দূরে একটি-দুইটি ঘর। দিঘলী বা তার আশে পাশের গ্রাম, বাজার থেকে
কেউ কাক-জোৎস্নায়, কেউ কাক-ভোরে, কেউবা ভোরের আযান শুনার পর এই বিশাল চর
পায়ে হেঁটে পদ্মা নদীর উত্তর পাড়ে ভিড়ানো বাদাম তোলা নৌকাগুলোর কাছে চলে আসে,
তারপর নৌকায় চড়ে ব্যবসা বানিজ্যের গল্প করতে করতে দখিন পারে শরীয়তপুরের
নাওডোবা, নাওখোলা, বড়কৃষ্টনগর-এ সাপ্তাহিক হাঁটে যায়। কাক-জোৎস্নার হাট
যাত্রীর সংখ্যা কম, যদিও তারা হাঁটে আগে পৌঁছে যায়, বাড়ি ফিরেও আগে আগে।
কাক-ভোর বা ভোরের হাঁট যাত্রীর সংখ্যা বেশি। এদের কেউ বাদাম বিক্রেতা, কেউ
বেলুন বিক্রেতা, কেউবা তিলা, বাতাসা, নিমকি, চিনি মাখানো মিষ্টি, কদমা
বিক্রি করে, কেউ রোজা, কেউ বেরোজা। বেরোজা বলে রোজার মাহাত্ম বুঝে না, তা
নয়; বরং বহু রোজাদারের চেয়ে এরা বহুগুনে ভাল মানুষ। কাক ভোরের হাঁট যাত্রী
সোরাব মিয়া তার বানর জোড়া কাঁধে নিয়ে বালু চরে হাঁটছে। বানরদের চমৎকার নাম
দিয়েছে--পুরুষ বানরটির নাম পঠিংকুমার আর মহিলা বানরটির নাম আলকাতরা পরী।
হরিদাস রায়ও প্রায় প্রতি সপ্তাহে এসব হাঁটে যায়। হাঁট থেকে প্রয়োজনীয়
মালপত্র কিনে নৌকায় তোলে দেয়; কোনদিন মালের নৌকায় চড়ে আসে, নৌকার কয়েক দিন
সময় লাগতে পারে জানলে সে সোরাবদের সাথেই বিকালে হাঁটা শুরু করে, রাতে বাড়ি
ফিরে। মাল-পত্র দিঘলী বাজারে বিক্রি হয়। তার পূর্ব পুরুষরাও আরো বড় বড়
ব্যবসা করেছে। বাজারের পূর্ব পাশে তার দোকান, একবারে গ্রাম লাগোয়া।
মুদিমালের সাথে অন্যান্য মালও থাকে। কথা ও কাজে সৎ ও ধার্মিক বলে তার দোকানে
ভীড় বেশি থাকে। অথচ মাস শেষে তার বিশেষ লাভ থাকে না। তবে তার ভাষায়
‘ঠাকুরের কৃপায় তার দোকান ও সংসার ভালই চলছে।’
তবে যে বিষয়টা সকলের কাছে তাকে মহৎ করেছে, তা হল, রমজান মাস আর দূর্গা পূজা
এলেই হরিদাস তার মাল-পত্র কেনা দামে, কম দামে বা সামান্য লাভে বিক্রি করে।
প্রতিদিন সে তার কপালে চন্দনের তিলক দিয়ে আর ধূপ জ্বালিয়ে দোকানের ব্যবসা
শুরু করে। রমজান মাসে তার লোকসান হয় নয়তো কোন মতে চালান ওঠে। মাসের হিসাব
শেষে লোকসান হলে সে বেশি খুশি হয়, বলে, ‘সবাই লাভবান হইছে, সবাইরে খুশি করতে
পারছি, সবাই খুশি অইলেইতো ভগবান খুশি হয়।’
হরিদাসের বাড়িটা সারা বছর দেব-দেবীতে পরিপূর্ণ থাকে। তার ধর্মের প্রতি তার
যেমন শ্রদ্ধা; অন্য ধর্মেও প্রতিও তার সমান শ্রদ্ধা। তার কথা--রমজান
মুসলমানের পবিত্র মাস। এ মাসে বেশি লাভ করলে আল্লাহ বেজার হবেন; আর যিনি
আল্লাহ তিনিই তো ভগবান।
চলবে
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |