|
অনামিকা
শাশ্বত স্বপন
কয়েকদিন ধরে মেয়েটার খুব জ্বর। সকালে একটু কমলেও
দুপুরে আবার বেড়ে যায়। বিকালে মেয়েটার দিকে তাকাতে আমার খুব কষ্ট হয়। সে
আমার মেয়ে নয়। তবুও কোন অংশে পিতৃত্বকে একটুখানি খাঁট করিনি তার কাছে।
কল্পনার কাছ থেকে আঘাত পাওয়ার পর এই হতাশাগ্রস্থ জীবনে আর বিয়ে করা হয়নি।
জীবন মানে বিয়াল্লিশ বছরের বিরহ-জ্বালায় জর্জরিত এক মরুময় হৃদয়। ‘সময়ের কাছে
জীবনের পরাজয়’ মেনে নিয়ে আজো চিরকুমার হয়ে আছি অথচ মেয়েটাকে বলেই চলেছি,
দেখিস, একদিন হুট্ করে একটা বুড়ি বউ নিয়ে আসব। অনি আমার এই হাস্যোচ্ছ্বোল
কথার অর্থ বুঝে। নিজের অজান্তে কল্পনার কাছে লেখা চিঠি, যা কোনদিন কল্পনাকে
পাঠানো হয়নি, অনি পড়েছে, অনেকবার। কোন কোন সময় দশটা প্রশ্ন করলেও একটার
উত্তরও ঠিকমত তার কাছে পাওয়া যায় না। তার বয়স পনের হল, নবম শ্রেণীতে
উত্তীর্ণ হল অথচ একটুও পরিবর্তন হল না। বাজার থেকে তার প্রিয় একটা বস্তু
কিনে এনে দিলে সে হালকাভাবে আনন্দ প্রকাশ করে। যেমন, জ্বর আসার আগে তাকে
সুন্দর এক জোড়া জুতা এনে দিয়েছিলাম। সে তা তার হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে
তাকিয়ে রইল। এভাবেই সে আনন্দ প্রকাশ করে। কখনও হাসতে দেখিনি বললে ভুল হবে।
একদিন শিকারী কুকুরটাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটছিলাম বারান্দাতে। আর তা দেখে সে
এমন একটু মৃদু হাসল যে তা বুঝবার আগেই বাতাসে মিলিয়ে গেল।
হ্যাঁ, সে আমার মেয়ে নয়। কিন্তু কোন অপরিচিত স্থানে কারো সাথে দেখা হলে
বলেই ফেলবে আপনার বড় মেয়ে বুঝি? হ্যাঁ, আমার বড় মেয়ে একমাত্র মেয়ে।
কোলকাতার ‘বৌ বাজার’ এলাকার তাজমহল হোটেলের কোন এক কামরার বারান্দায়
কান্নারত প্রায় পাঁচ বছরের শিশু, কোন কথা বলে না, ভীড়ের মাঝে যেতেই এক
ভদ্রলোক বলে ফেলল, ‘এই সর সর, মেয়ের বাবা এসে গেছে। আপনার মেয়েই তো, নাকি?
একবারে বাপের মত চেহেরা?’ আশে পাশে শকুনের মত পাখা ঝাপটানি আমার সারা দেহে
কম্পন দিয়ে উঠল। এত সুন্দর একটা মেয়ে? ওকে লালন-পালন করে বড় করলে দালালরা
ভাল ব্যবসা করতে পারবে। লোকটা বলল, আমার মত চেহেরা। আমি নিজের অজান্তে বলে
ফেললাম, ‘হ্যাঁ, আমার মেয়ে। আপনারা যার যার কাজে যান।’ কান্নার্ত মেয়েটিকে
কোলে নিতেই সে আমার কাঁধে ঘুমিয়ে গেল। এই সেই মেয়ে অনামিকা কুড়িয়ে পাওয়া এক
বনফুল। পরিচয় অজ্ঞাত বলে নাম রেখেছি অনামিকা।
অনামিকার কোন কিছু দরকার হলে কানের কাছে ফিসফিস করে এমনভাবে বলবে যেন, কত
গোপনীয় ব্যাপার। মেয়েটা এত বড় হয়েছে অথচ আজো সে তার বিছানা শূন্য রেখে আমার
বিছানায় ঘুমাবে এবং তার এক হাত আমার গায়ের উপর থাকবেই। স্কুলে আমাকেই দিয়ে
আসতে হবে এবং নিয়েও আসতে হবে। পাড়ার অনেক ছেলেই বাঁকা চোখে তার দিকে তাকায়।
সে সামান্য ভ্রুক্ষেপও করে না। একদিন বন্ধুসুলভ আচরণে তাকে বলেছিলাম, মাগো
কোন ছেলেটাকে তোমার ভাল লাগে? সে অকপট জবাব দিল, তোমাকে।
আমি আর কোন প্রশ্ন করতে সাহস করলাম না। হঠাৎ বৈশাখের আকাশে ঝড় বইতে শুরু
করল। মেঘের বিকট আওয়াজে ভয় পেয়ে অনি আমার গায়ে হেলান দিয়ে পড়ল, একেবারে
নিঃশব্দে। আকাশের এত রহস্য অথচ কোন প্রশ্ন অনি আমাকে করে না। মনে হয়, ও যেন
সব জানে। বাসায় টিভি আছে অথচ ওটা সে অন করে দশ মিনিট স্থির থাকতে পারে না।
খুব ভাল অনুষ্ঠান হলে আর তার প্রিয় কলা-কুশলী হলে হয়তো পুরো অনুষ্ঠান দেখবে।
আবার কখনও ‘হাত-পা শির শির করে, মাথা খুব ভারী মনে হয়’ এই কথা বলেই আমার
গায়ে হেলান দেবে।
- বিপা?
- কি মা?
হ্যাঁ, ও আমাকে বিপা বলে। আমিই বলেছি ওকে বিপা বলতে। সবাই অবশ্য অবাক হয়।
আমার কথা হল, সে তো আমার মেয়ে নয়, আমি তো ওকে জš§...। এই শেষ, আর কিছু বলবে
না। জোর করে দু’একটা কথা বলব, দেখব ঘুমিয়ে গেছে। একবার ঘুমিয়ে গেলে আর
জাগিয়ে ভাত বা ঔষধ খাওয়ানো যাবে না। একদিন সুন্দর একটা শাড়ী এনে দিয়েছিলাম।
সে ওটা বুয়ার সাহায্যে পরে আমার গলা ধরে বলল, ‘বিপা, কেমন দেখাচ্ছে? বললাম,
বা! খুব সুন্দর মামনি!’ তার কপালে চুমো দিলাম। ঠোঁট দু’টি দৈর্ঘ্যে
প্রশস্ত করে আর চোখ দু’টি খুব ছোট করে সে তার আনন্দ প্রকাশ করল। আদর করে
বললাম, ‘তোকে বড় ঘরে বিয়ে দেব, মা?’ সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বুকে কয়েকটা
কিল-ঘুষি দিয়ে চলে গেল। তারপরের দিন দেখা গেল শাড়ী আর নেই। হয়তো কাউকে
দিয়েছে; নয়তো ফেলে দিয়েছে। বাসায় ফিরার পথে একদিন একটা মেয়ে বলল, ‘স্যার,
আপনের মাইয়া আমারে এই সালোয়ার, কামিজ, শাড়ী দিয়া দিছে। একেবারে নতুন স্যার
আমি হেরে বুঝাইলাম...।’
দুঃখ পেলাম, অনি এত দামী শাড়ীটাও...। মেয়েকে বুঝালাম। সে কোন কথা বলল না। এ
নিয়ে আমি আর কোন কথা বাড়ালাম না। সে রাতে খেল না। নিজের বিছানায় শুয়ে রইল।
আমি সিগারেট ধরালাম। যদিও অনির জন্য সিগারেট খাওয়া একেবারে ছেড়েই দিয়েছি।
তবুও আজ ছোট ভাই, কল্পনার কথা মনে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে অনি কেঁদে কেঁদে আমার
হাত ধরল। সিগারেট ফেলে দিল। গলা ধরে কাঁদতে লাগল। ‘না মাগো, তোকে আমি বিয়ে
দেব না, সত্যিই বলছি।’ আরেক দিন দু’টো চিঠি একটা টেবিলের উপর, আরেকটা
বিছানায় দেখলাম। বিছানার চিঠিটা ও খুলে পড়েছে। আমি চিঠি দুটি পড়তে শুরু
করলাম ‘অনামিকা, না, তুমি নায়িকা। তুমি শুধু আমারি নায়িকা। শুভেচ্ছা নিও।
কেমন আছ? এতদিন ধরে তোমার পিছনে ছুটেছি অথচ আজও... । আমি মাস্তান হয়ে যাব।
তারপর তোমাকে জোর করে... অনি আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। ইতি, তোমারই বিরাজ।’
আরেকটা চিঠি ‘অনি, সেদিনকার অপরাধ ক্ষমা করিও। এত চিঠি তোমাকে দিলাম। অথচ
সব চিঠি তুমি ডাস্টবিনে ফেলে দাও শুনে খুব...। ইতি, তোমার সাইরাজ।’
কোন চিঠির পুরোটা পড়লাম না। বুঝা যাচ্ছে অনেকদিন থেকেই...। আশ্চর্য! ছেলে
দুটি এত করে প্রেম নিবেদন করছে অথচ তার কোন অনুভূতিই নেই। আমি ছেলে দুটিকে
চিনি। অনিকে ডাকলাম,
- অনি, মাগো কে চিঠি দিয়েছে?
- কি যেন নাম, সাইরাজ ভাই আর ওটা বিরাজ ভাই দিয়েছে।
- তুই আনলি কেন?
- জোর করে দিল যে।
আমি কয়েক দিন দেখলাম। না, তার দৃষ্টি সমান্তরাল, চলতে পথে কোন দিকে তার
দৃষ্টি নেই। একদিন দরজার করিডোরে বসে আছি। হঠাৎ কে যেন, অনির পড়ার ঘরের
জানালায় নক করলো। অনি জানালা খুলে দিল।
- আমার চিঠির উত্তর দিলে না কেন?
- কি উত্তর দেবো, আমি পড়িনি তো। আমাকে এখন প্রশ্ন করো সব উত্তর দেব।
- উড় ণড়ঁ খড়াব গব? মানে আমাকে তুমি ভালবাস?
- হ্যাঁ
- সাইরাজকেও ?
-হ্যাঁ
- কাকে বেশি ভালবাস ?
- বিপাকে
- বিপা আবার কে ?
- আমার বাবা
ছেলেটা চলে গেল। আমি ডাকলাম,
- অনি কে এসেছিল ?
- বিরাজ
- কি বলল তোমাকে ?
তারপর অনি সব বলল আমার কাছে। আমি রাত আটটার দিকে নিউরোলজিস্ট ডাঃ ওয়াদুদের
কাছে গেলাম। এই নিয়ে দশ বার হলো। মনোবিজ্ঞানী ডাঃ ফিরোজ এর কাছে পূর্বে
পাঁচ বার গিয়েছি। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ঔষধ জোর করে হলেও খাওয়াতে লাগলাম
দিনের পর দিন। পরদিন স্কুলে ও নিজেই গেল। বাড়ী ফিরে কেঁদে কেঁদে অফিসে আমাকে
টেলিফোন করল, ‘বিপা ওরা আমাকে আরো চিঠি দিয়েছে। বিরাজ মুখে জোর করে চুমু
দিয়েছে।’
আমি বিকালে বিরাজ ও সাইরাজকে বুয়াকে দিয়ে ডাকালাম। ওরা দুজনই এল। ছেলের মত
ওদের আদর করলাম। তারপর বুঝাতে শুরু করলাম। ওরা দু’জনেই নিজেদের ভুল বুঝল।
‘আমাদের মাফ করবেন স্যার।’ ওরা আমাকে স্যার বলে কারণ এক সময় ওদের আমি
প্রাইভেট পড়াতাম।
- ওর কি রোগ হয়েছে, স্যার ?
- ওর রোগ কিছুই ধরা পড়ছে না। তোমরা ওকে বিরক্ত করো না। তোমরা ওর বন্ধু। যখন
ইচ্ছা হয়, বাসায় এসে ওর সাথে গল্প করো।
- অনি
- কি বিপা?
- ওদের জন্য চা বিস্কুট আনো।
ও একেবারে অবুজ। অনেক কিছু মনে হয় বুঝে, আবার মনে হয় কিছুই বুঝে না। ‘বিপা,
বিরাজকে চুমু দিয়ে দেই, আর সাইরাজকে আদর করে দেই, তারপর চা বি¯ু‹ট দেই?’
করলোও তাই ওরা দুজনে ভুল বুঝতে পেরে দু’চোখে জল নিয়ে চলে যেতে চাইলে অনি
সাইরাজকে ডাকল, ‘দাড়াও সাইরাজ ভাই, সিগারেট খাবে না। সিগারেট নিয়ে যাও।’
দু’জনই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল। মাঝে মাঝে আমি গভীর রাতে জেগে উঠি। তারপর
আনমনে কিছুক্ষন বারান্দায় হাঁটা-হাঁটি করি। অনি প্রায়ই রাতে বাথরুমে যায়।
বাথরুমে যেতে ভয় পেলে আমার গলা ধরে বলবে,
- বিপা, ও বিপা, বাথরুমে যাব। ভয় করে। সাদা কি যেন...।
বাথরুমের কাজ শেষ হলে যদি মন ভাল থাকে তবে ওকে নিয়ে ছাদে চলে যাই। তারপর
হয়তো প্রশ্ন করি
- অনি, কখনও মা বাবার কথা মনে পড়ে?
- আগে পড়তো, এখন মনে পড়ে না। বিপা, আবার সেই স্বপ্ন দেখেছি। আমি শুধু
হেঁটেই চলেছি অজানা এক নির্জন দ্বীপে। সেখানে তুমি, সাইরাজ, ছালমা খালা,
বুয়া কেউ নেই।
হ্যাঁ, এই একই স্বপ্ন অনি এই পর্যন্ত কম করে হলেও একশবার দেখেছে। স্বপ্ন
দেখে সকালে আমার কাছে সব বলত। মনোবিজ্ঞানীর ঔষধেও কিছু হচ্ছে না।
- গান গাইতে ইচ্ছে করে অনি ?
- গান শুনবে বিপা ?
- হ্যাঁ গাও মা
অনি গান শুরু করলো, ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মনরে আমার ...।’ গান শেষ হতেই
আবার শুরু করল, ‘আমি চলে গেলে পাষাণের বুকে লিখ না আমার নাম...।’
হঠাৎ অনি গান থামিয়ে দিলো
- বিপা, ভাল লাগে না। জানো বিপা মাঝে মাঝে আমার ফুটবল খেলতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু মেয়েরা যে ফুটবল খেলে না। বিপা তোমাকে কতবার বলছি, তুমি বিয়ে কর।
সালমা খালা কিন্তু খুব ভাল। কোন ছেলে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছিল। তারপর...।
- মাগো, তুমি আগে ভাল হও।
- আমিতো ভালই আছি। কি হয়েছে বিপা আমার। বল না?
- সেটাইতো বুঝতে পারলাম না, মা ?
এমনি করে এস.এস.সি. পরীক্ষার সময় চলে এল। তার অবস্থার আরো অবনতি ঘটল।
সাইরাজ নামের পাড়ার ছেলেটি যথাসাধ্য তাকে সাহায্য করত। এখন সে তার শ্রেষ্ঠ
বন্ধু। খুব গল্প করে। তবে অনির চেয়ে সাইরাজকে বেশি কথা বলতে হয়। গত মে মাস
থেকে সে অনিকে অংক করাচ্ছে। সে কোন বিষয়ে খুব একটা ভাল না। তার কিছুই মনে
থাকে না। আমি একদিন দেরী করে অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি সাইরাজ ওর মাথায় জল
ঢালছে। বুয়া ছুটাছুটি করছে।
- কি হয়েছে সাইরাজ ?
- স্যার, আমি অন্যায় করে ফেলেছি?
- কি অন্যায় করেছ ?
- অনি অনেকক্ষন ধরে কেমন জানি করছে। কাছে এসে আমার ঘাড়ে মাথা রেখে চোখ বুজলো।
আমি ওকে আদর করে বললাম, তুমি সুস্থ্য হলে আমি তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে
যাব, শুধু তুমি আর আমি। স্যার...
- তোমার জন্য নয়, এ কথার জন্যও নয়। ও আজ কয়েকদিন ধরে এমন করছে।
- বিপা, বুকে খুব কষ্ট। সালমা খালাকে একটু ডাক না।
সালমাকে ডাকা হল, সে মায়ের মত অনিকে সেবা করতে লাগল। ছালমা পাশের বাসায় থাকে,
সাইরাজের ফুপু। একদিন বিকালের দিকে বিরাজ আমাদের বাসায় এসে তার ভুলের কথা
বারবার বলতে লাগল, লেখাপড়া না করে বন্ধুদের সাথে এত দিন গা ভাসিয়ে চলেছিল।
আজ সে বোম্বে চলে যাচ্ছে তার বড় ভাইয়ের কাছে। যাওয়ার সময় সে অনিকে একটা
সুন্দর ছবি দিল। ‘প্রকৃতির মাঝে ধাবমান সময়ের কাঁটা’ খুব সুন্দর ছবি। মাথায়
হাত দিয়ে সে অনিকে আদর করল। ‘চুমু দিলে না, বিরাজ ভাই ?’ বিরাজ যে ওকে এত
ভালবাসত তা আজ বুঝলাম। কেঁদে কেঁদে সে অনিকে আশীর্বাদ করল। ‘ তুমি সুস্থ্য
হও অনি। ভগবান তোমার আয়ু...। আর বলতে পারলো না। সে চলে গেল। আমি কোন কথাই
বললাম না। অনি আমার হাত ধরে কিছুক্ষন তাকাল বিরাজের দিকে। তারপর বিছানায় এসে
ঘুমিয়ে গেল। আর কখনও বিরাজ সম্পর্কে একটা প্রশ্নও তুলেনি আমার কাছে।
এস.এস.সি. পরীক্ষা শেষ। অনি আর আমি এখন লন্ডনের ওখএগ ঐড়ংঢ়রঃধষ-এ। বিপজ্জনক
কোন রোগ ধরা পড়ল না। এখানে এসে সে পুরোপুরি সুস্থ্য। সুন্দর চেহারা
ক্রমান্বয়ে নীল হতে লাগল। ইচ্ছে করছে, ওকে নিয়ে লন্ডনেই থেকে যাই। কিন্তু
সামর্থ্য? চাকরী না হয়ে যদি বড় ব্যবসা হত। লন্ডনের বিভিন্ন দর্শণীয় স্থান
ঘুরে বেড়ালাম। তারপর আবার ফিরে এলাম দেশে। অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি
টেলিফোর করি। গল্প করি, কখনো জানতে চাই, কি খাবে, আজ কোথায় যেতে ইচ্ছে করে?
- জানো বিপা, সাইরাজকে ওর বাবা আমেরিকা পাঠিয়ে দেবে। সকাল থেকে আমার খুব
খারাপ লাগছে।
- সাইরাস কেমন মা ? কেমন লাগে ওকে তোমার?
- মাথা ঘুরছে, শরীর শিরশির করছে। বেলা এগারটার দিকে বমি করেছি। সালমা খালা
এসেছিল। সাইরাজ ঔষধ দিয়ে গেছে।
- মাগো, আমি এখনই আসছি।
- বিপা, টিয়া পাখি আনবে না।
- হ্যাঁ, এখনি আনবো।
লন্ডনে যখন ছিলাম তখন অনিকে বলেছিলাম, দেশে গিয়ে এক জোড়া টিয়া পাখি কিনে
দেব। বাড়ি যাবার পথে টিয়া পাখি কিনে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এখানে কোথায় টিয়া
পাখি পাওয়া যায়। বেল টিপে পিয়নকে ডাকলাম।
- শুন, এখানে কোথায় টিয়া পাখী পাওয়া যায়, জানো?
- জে স্যার, জানি।
- এই টাকা নাও। তুমি এখনি এক জোড়া পাখি কিনে আনবে । শুন, খাঁচা সহ আনবে।
খাঁচা সহ টিয়া পাখি এনে দিলাম অনির হাতে। সেই প্রশস্ত ঠোঁটের মৃদু হাসি।
- বিপা, সাইরাজ আমাকে ধানমন্ডির লেকে নিয়ে যাবে।
- যেও মা।
কয়েকদিন সাইরাজ এসে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যায়। কখনও অসুস্থ হয়ে
সাইরাজের দু’হাতের বাহুতে শায়িত অবস্থায় ফিরে আসে, কখনও হাত ধরে ফিরে আসে।
তবুও মনে হয় দু’তীরে দু’টি মন। একদিন সাইরাজকে জিজ্ঞাসা করলাম,
- ওকে কতটুকু বুঝলে ?
- সামান্যও না স্যার।
সাইরাজকে আমি ইচ্ছা করে ওর পিছনে লাগিয়েছি। দেখতে চেয়েছি পরিবর্তন। হড়, হড়,
পযধহমব কোন পরিবর্তন হল না।
আমরা এখন পিজি হাসপাতালের করিডোরে। অনি অপারেশন থিয়েটার কক্ষে। মনে হচ্ছে,
মেয়েটা যেন, একা হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলাম।
- স্যার, আমার মেয়ের রোগটার নাম কি?
- দেখুন, ব্যক্তিগত জীবনে বহু রোগ নিয়ে পরীক্ষা করেছি, চিকিৎসা করেছি; ইঁঃ
যবৎ ফরংবধংব রং ঁহশহড়হি. বিভিন্ন রোগের লক্ষন দেখা যাচ্ছে তার দেহে।
লন্ডনের রিপোর্টগুলো দেখলাম। ঝঁমমবংঃরড়হ অনুযায়ী ঔষধও খাওয়ালেন, অথচ উন্নতি
হল না।
- স্যার এ রোগের কি কোন নাম নেই ? আপনাদের...
- না, দেখুন আপনার মেয়ের বিগত সাত বছরের চিকিৎসাগত যে রিপোর্ট তা বিভিন্ন
রোগের। এমন কোন রোগ বলতে পারছি না যার কারণে এত উপসর্গ তথা এই অবস্থার
সৃষ্টি হতে পারে। আচ্ছা, দু’দিন অপেক্ষা করুন।
দু’দিন নয়, পাঁচ দিন অপেক্ষা করলাম। অনিকে নিয়ে গবেষণা চলছে। বিকাল পাঁচটা।
আমার আর সাইরাজ ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলাম। ডাক্তার পরিচয় করালেন, ‘উনি
একজন বিখ্যাত প্যাথোলজিস্ট, জীবাণুবিদ ডাঃ রতন চন্দ্র মন্ডল। উনার সাথে
চারজন উনার সহকারী।’ সাক্ষাৎ করার কথা। না, কেউ হাত বাড়াল না। সবাই চিন্তিত।
জীবাণুবিদ আমার পাশের চেয়ারে এসে বসলেন। বুঝা যাচ্ছে, সবাই হতাশ। ডাঃ রতন
বলতে শুরু করলেন, আপনার মেয়ে, তাইনা । কথাটা না বললেও চলত। তবুও বোধ হয় জড়তা
কাটালেন। একটু থেমে বলতে শুরু করলেন, আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে। আজ থেকে অনেক
বছর আগে ম্যালেরিয়া রোগ যার হত, সে নিশ্চিত মৃত্যু পথযাত্রী অথবা কলেরা,
যক্ষ্মা-ই ধরুন...। পরবর্তীতে টিকা, ঔষধ আবিষ্কার হল, ফলে রোগ প্রতিরোধ
সম্ভব হল। ঈধহপবৎ, অওউঝ এই ভয়ঙ্কর রোগগুলিও আমাদের কহড়ষিবফমব এর মধ্যে।
যদিও এই রোগ গুলিকে পুরোপুরি জয় করা সম্ভব হয়নি। আগে বহু লোক এসব রোগে মারা
গেছে আমরা তথা চিকিৎসকরা সনাক্ত করতে পারিনি। যখন রোগকে সনাক্ত করা গেল তখন
এদের নাম দেওয়া হল। আপনার মেয়ে এমনি এক অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এটা
পৃথিবীতে একেবারে নতুন। কেউ এর নাম তথা পরিচয় জানে না। যদি আমরা ইহা সনাক্ত
করতে পারি তাহলে বাংলাদেশের সুনাম হবে। এ রোগে পৃথিবীতে অনেক লোকই মরছে।
না, অওউঝ বা ঈধহপবৎ- এ জাতীয় নয়। এটা এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে। অবশ্য আমার
কথা পুরোপুরি সঠিক নাও হতে পারে।
আমার শরীর দিয়ে ঘাম বের হল। আমার মেয়েকে কি তাহলে মরতে...। আমি দাঁড়িয়ে
গেলাম। দু’জন গবেষক আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বসাল। এখন যেন, আমি আট বছরের নাছোর
বান্দা শিশু। আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আমার বলতে ইচ্ছে করছে, আমার মা-মণিকে
ফিরিয়ে দাও। সাইরাজ কাঁদছে, নিরবে। আমি পারছি না, চোখে জল নেই। ছত্রিশ বছর
ধরে কাঁদতে কাঁদতে চোখের সাগর মরুভূমি হয়ে গেছে। এখন আর চোখ থেকে জল ঝরে
না। তার সহকারী বললেন, দেহের কোষ নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। দুই-তিন ধরণের
মিথজীবী জীবাণু একত্রে আছে। আকারে ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে কোনটা ক্ষুদ্র, কোনটা
বড়। আলো অথবা সামান্য স্পর্শে এগুলো জড় হয়ে থাকতে পারে আট ঘন্টারও বেশি।
তাই পরীক্ষা করতে বেশ সময় লেগে গেল। ক্ষুদ্রতা ও জড়তা শক্তির কারণে এ রোগের
জীবানু এতদিন মানে লন্ডনেও ধরা পড়েনি। কোন গবেষক হয়তো পাঁচ ঘন্টার বেশি
লেন্স নিয়ে বসে থাকেনি। আমার চোখে ধরা পড়ত, আবার হারিয়ে যেত, বেশ বিরক্ত
লেগেছে। দুই-তিন ধরনের জীবাণুর সম্মিলিত ক্রিয়ায় এ রোগ হয়েছে। এ রোগে মানুষ
প্রায় এক যুগ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এটা জš§গত আবার পরিবেশগতও হতে পারে।
আরেকজন বললেন, স্যার, আমার মনে হয়, জš§ গত এবং ভাইরাস জাতীয় জীবাণু অর্থাৎ
অওউঝ এর কোন শাখাও হতে পারে। আবার ভাইরাসের বিবর্তনও হতে পারে। আরেকজন
বললেন, স্যার, বিগত রিপোর্ট অনুযায়ী যা বুঝা যাচেছ, যদি পূর্ব থেকে এ রোগ
হয়ে থাকে তবে অনেক রোগ এ জীবাণুদের কারণে হয়েছে বলতে হয়। মেয়েটার নীল রং
এখন অন্য রকম মনে হচ্ছে। আমি বলতে চাচ্ছি, দীর্ঘ সময় পর পর তার গায়ের রং
কিছুটা পাল্টে যায় যা পূর্বের কোন রোগের লক্ষণই নয়। সুতরাং এ রোগ যে কোন
রোগ থেকে পৃথক। তবে নতুন কোন হরমোন সম্পর্কে আমি গবেষণা করতে চাই। চতুর্থ
জন বলছে, স্যার, আমি প্রথম এবং শেষ সিদ্ধান্তের প্রতি রায় দিচ্ছি এবং আমিও
হরমোনের ব্যাপারে আরো গবেষনা করতে চাই। সেই সাথে সবষধহড়পুঃবং ও সবষধহরহ
নিয়েও কাজ করতে চাই। ডাঃ রতন বললেন, ঠিক আছে, সব পরে দেখা যাবে। এখন সফিক,
তুমি রোগীর বাবাকে ঋরহরংযরহমটা বুঝিয়ে বল।
ডাঃ সফিক আমার মাথায় হাত দিযে বললেন, বাস্তব বড় কঠিন, তবুও এমন কোন লোক নেই
যে, বাস্তবের মুখোমুখি হয়নি বা হবে না।
God creats us and he takes away us. there is no man who cross the
death...no one...। শোভন সাহেব, আপনার কন্যা আমাদের নতুন এক রোগের
সঙ্কেত দিয়ে দিল। কাগজ পত্রগুলি ভাঁজ করলেন। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে
বললেন, অনামিকা ইহজগতে নেই, ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না লিল্লাহে রাজেউন...।
আল্লাহপাক তাকে বেহেস্তবাসী করুন। সাইরাজ এবার সশব্দে কাঁদতে লাগল। কত বৎসর
পর চোখের দু’তীরে পানি অনুভব করলাম, মনে পড়ছে না। বড় শান্তি, বিভৎস্য শান্তি
আমার! এখন আমার চেয়ে সুখী কে আছে! আজ কোথায় কল্পনা তুমি...। আমার ভয়ঙ্কর
আনন্দ দেখে যাও। তুমি ছলনা করেছ, অনিও করলো। ভালোবাসা দিয়ে কাউকেই বেঁধে
রাখতে পারলাম না। ভালবাসার বন্ধন এত শিথিল! ডাক্তার আবার শুরু করলেন, আপনার
মেয়েকে আমাদের তথা পৃথিবীর মানুষের কল্যাণে দান করুন। ওকে নিয়ে দেশের
বাইরেও গবেষণা হবে।
কাগজে কি লিখা ছিল, জানি না। স্বাক্ষর করে মেয়ের লাশ দান করে এলাম। এ নিয়ে
ভাবলাম না কারণ ওকে কবর দেওয়াও ঠিক হবে না। ওতো হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখও
হতে পারে। তাই বিশ্বের কল্যাণে দান করে এলাম একটা স্বাক্ষর দিয়ে। বাড়ী ফিরে
শুনি সাইরাজ কিছুতেই খেতে চায় না। ওর ফুপু আমাকে জানিয়ে দিয়ে গেল। সাইরাজকে
আমার বাসায় এনে খাওয়ালাম। টিয়া পাখি দু’টিকে ছেড়ে দিলাম। তারপর ব্যক্তিগত
জীবনের গল্প বললাম। কিছুদিন পর শুনলাম সালমার বিয়ে হয়ে গেছে। সাইরাজ একদিন
বিদায় নিয়ে তার বড় মামার কাছে জার্মানীতে চলে গেল। সবাই চলে গেল। এখন শুধু
আমি একা ....বড় একা...।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|