[প্রথমপাতা]
|
রোহিঙ্গাঃ নিজ দেশে পরবাসী
- শাশ্বত স্বপন -
পর্ব-১
২৯ মার্চ হতে বার্মায় আদম শুমারি শুরু হয়েছে , চলবে এপ্রিলের ১০ পর্যন্ত।
গত তিন দশকের মধ্যে এটিই হচ্ছে সেদেশে প্রথম আদমশুমারি। মায়ানমার সরকার
ঘোষণা করেছে যে, আদমশুমারির সময় মুসলমানদেরকে রোহিঙ্গা হিসেবে নিবন্ধিত করা
হবে না। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায় প্রায়ই বাংলাদেশকে দোষ চাপায় যে, বাংলাদেশ শরণার্থী পুশব্যাক
করছে। আর এখন জাতিসংঘই রোহিঙ্গাদের শরণার্থী বানাবার কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এ
ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে স্পষ্ট করে জাতিসংঘের কাছে দাবী করতে
হবে,আরাকানের রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের সুযোগ দিতে হবে, নয়তো এ শুমারির
আয়োজন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে এবং বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে থাকা ও মায়ানমারের
ভেতরে বিভিন্ন প্রদেশে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা
করেই আদমশুমারি করতে হবে।
মায়ানমারে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে বৃহত্তর আরাকানি জাতি ও রোহিঙ্গাদের
নাগরিকত্বের সুযোগ নেই। তাদের নির্মূল চেষ্টার অংশ হিসেবে আরাকানের নাম
পাল্টে রাখাইন প্রদেশ রেখেছে মুসলিমবিদ্বেষী সামরিক জান্তা। ওই আইন অনুসারে
পরের বছর ১৯৮৩ সালে আদমশুমারি হয়। দেশটির উগ্র বৌদ্ধরা দাবি করছে,
আদমশুমারির সময় মুসলমানদেরকে রোহিঙ্গা হিসেবে নিবন্ধিত করা হলে তারা
আনুষ্ঠানিকভাবে নাগরিক হিসেবে গণ্য হয়ে যেতে পারে। মায়ানমার সরকারের
মুখপাত্র ইয়ে হাতুত শনিবার সাংবাদিকদের বলেছে, ‘কোনো পরিবারের কেউ যদি
নিজেকে রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচয় দেয়, তাহলে তাকে নিবন্ধিত করা হবে না।’ সে
বাঙালি হিসেবে পরিচয় দেয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের পরামর্শ দিয়েছে।এমনিতেই
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করতে
রাজি নয়, তারপর যদি রোহিঙ্গা পরিচয় বদলিয়ে তাদের বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করা
যায় তাহলে সে দেশ থেকে তাদের বিতাড়নকে এক ধরনের বৈধতা দিতে পারবে।
জাতিসংঘ আশ্বস্ত করেছিল, সরকার সব জনগোষ্ঠীকে শুমারিতে অন্তর্ভুক্ত করবে।
এতে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতির একটি পথ দেখা গেলেও বাঁধ সেধেছে দেশটির উগ্র
বৌদ্ধরা। যদি রোহিঙ্গাদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলে তারা শুমারি
বর্জন করবে। পরে রোহিঙ্গা হিসেবে কাউকে নিবন্ধন না দেয়ার ঘোষণা দেয় সরকার।
তবে রোহিঙ্গারা নিবন্ধিত হতে পারবে বাঙালি হিসেবে। কিন্তু রোহিঙ্গারা
বাঙ্গালী হিসাবে নিবন্ধন করতে রাজী নয়। কোনো অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে যদি
মিয়ানমার সরকার এভাবে আদমশুমারির পরিকল্পনা নিয়ে থাকে তাহলে সাম্প্রতিক
বছরগুলোতে যেভাবে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর সংখ্যাগুরু বৌদ্ধরা হামলা
চালাচ্ছে, তাতে আদমশুমারি শেষে তা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই প্রবল।
জটিল ভূ-রাজনীতি, অস্থিতিশীল পাশ্ববর্তী দেশসমূহ, জাতিগত সংঘাত ইত্যাদি
বিষয় আবার সামনে চলে আসে। মায়ানমার প্রাচীনকাল থেকেই সমৃদ্ধ। এ দেশ নিয়ে
অনেক কল্পকাহিনীও শুনা যেত।আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের প্রায় ৫ গুন বড় এদেশ
আর জনসংখ্যা আমাদের অর্ধেকেরও কম। এত বড় দেশ, ১৩৯টা (রোহিঙ্গা বাদে)জাতির
বসবাস করতে পারলে রোহিঙ্গারা পারবে না কেন?রোহিঙ্গার স্বাধীন আরাকান চায়
বলে?নাকি দেশে দেশে ইসলামের নামে যে সন্ত্রাস হচ্ছে, রোহিঙ্গারা ভবিষ্যতে
সেরকম করতে পারে আর সেই ভয়ে তাদের দাবিয়ে রাখছে, দেশান্তর করতে চাইছে।
মায়ানমারের এ শুভ আদমশুমারী বাংলাদেশের জন্য খারাপ পরিণতি ডেকে আনবে।নিজ
দেশে পরবাসী, বাংলাদেশেও পরবাসী; কেউ তাদের ভাল চোখে দেখবে না। আত্নরক্ষা
বা জীবনযুদ্ধে সন্ত্রাসী, জঙ্গী হতে কোন কোন গোষ্ঠী বাধ্য করতে পারে।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে এবার রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য
এবং আজকের পরিনতি বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক।
রোহিঙ্গা কারা?
মায়ানমার-উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে জানা যায়, রোহিঙ্গা আদিবাসী
জনগোষ্ঠী পশ্চিম মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের একটি উলেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিক
জনগোষ্ঠী। এরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা
অলিখিত। মায়ানমারের রাখাইন,আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং মংডু, কিয়ক্টাও,
মাম্ব্রা, পাত্তরকিল্লা এলাকায় এদের বাস। বর্তমানে(২০১২ সাল-আদমশুমারী নয়,
ধারনাগত) প্রায় ৮,০০,০০০ রোহিঙ্গা মায়ানমারে বসবাস করে। মায়ানমার ছাড়াও
৫ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এবং প্রায় ৫লাখ সৌদিআরবে বাস করে বলে
ধারনা করা হয় যারা বিভিন্ন সময় বার্মা সরকারের নির্যাতনের কারণে দেশ
ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের
সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গাদের মত চীনা জনগোষ্ঠী যেমন - কোকাং,
পানথাইদের(চীনা মুসলিম) মত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাকে নির্যাতন করে থাকে।
বর্তমান মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে এ জনগোষ্ঠী বেশি বসবাস করে। ইতিহাস ও
ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল,
আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। তাদের কথ্য
ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছে; উর্দু, হিন্দি, আরবি
শব্দও রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে , সপ্তম শতাব্দীতে
বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয়
নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা। তবে
তৎকালীন রাজসভার বাংলা সাহিত্যের লেখকরা ঐ রাজ্যকে রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজ্য
হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
তবে ইতিহাস এটা জানায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল
আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য
দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়।এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ
ভূখণ্ড। তখন বড় ধরনের ভুল করে তারা এবং এটা ইচ্ছাকৃত কিনা, সে প্রশ্ন
জ্বলন্ত। আমাদের 'প্রাক্তন প্রভুরা' মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা
প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ
ধরনের অনেক গোলমাল বাঁধিয়ে গেছে ব্রিটিশরা।
(চলবে)
তথ্যসূত্র-
১.মায়ানমার-উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
২.পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামের আলো- লেখকঃ চৌধুরী শামসুর রহমান,
প্রকাশক-পাকিস্তান পাবলিকেশন্স,পুরানা পল্টন, ঢাকা, (দ্বিতীয় সংস্করণ-১৯৬৮
খ্রীঃ)।
৩.সিরিকোট থেকে রেঙ্গুন- মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার ঃ চাঁটগা প্রকাশন, দিদার
মার্কেট, চট্টগ্রাম,(প্রথম সংস্করণ-২০০৫ খ্রীঃ)।
৪.http://community.skynetjp.com/id887.htm
৫.http://www.freedomnews24.com/category-list/article/134
৬.http://www.somewhereinblog.net/blog/smismailblog/29317074
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|