পৌষ সংক্রান্তিঃ পুরান ঢাকায় ঐতিহ্যবাহী
ঘুড়ি উৎসব
শাশ্বত স্বপন
পৌষ সংক্রান্তি পুরনো
ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী দিন। এ দিন পুরনো ঢাকার দয়াগঞ্জ, মুরগীটোলা,
কাগজিটোলা, গেন্ডারিয়া, বাইনানগর, বাংলাবাজার, লক্ষ্মীবাজার, সিংটোলা,
কাগজীটোলা, সূত্রাপুর, ধূপখোলা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সদরঘাট,
কোটকাচারী এলাকার মানুষ সারাদিন ব্যাপি ঘুড়ি উড়ায়, নানা রকমের খাবার এর
আয়োজন করে। সন্ধ্যায় আগুন নিয়ে খেলা আর আতশবাজি তো আছেই । আতশবাজির লাল
নীল আলোয় আলোকিত পুরান ঢাকাকে দেখতে চাইলে যেতে হবে কোনও বাড়ির ছাদে ।
বরাবরের মত এবারের অনুষ্ঠানও দুইদিনে ভাগ হয়েছে, সরকারীভাবে লক্ষ্মীবাজার,
সিংটোলা, কাগজীটোলা, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়ায় ১৪ তারিখ হবে পৌষ সংক্রান্তি
উৎসব।অন্যদিকে বাংলা পন্চিকা অনুসারে শাখারিবাজার ও তার আশেপাশের এলাকায়
এবার পৌষ সংক্রান্তি হবে ১৫ জানুয়ারি।
ঘুড়ি। পুরান ঢাকায় কবে, কখন, কোথায় প্রথম ঘুড়ি উৎসব শুরু হয়েছিল--তা ইতিহাস
থেকে ভালোভাবে জানা যায় না। ঐতিহাসিকদের মতে, ১৭৪০ সালের দিকে নবাব নাজিম
নওয়াজেস মোহাম্মদ খাঁন এর সময় থেকে ঢাকায় ‘ঘুড়ি উড়ানো’ উৎসব হিসাবে প্রচলিত
হয় এবং নবাব পরিবাররা এ উৎসবের উৎসাহদাতা ছিলেন। সেই সময় ঘুড়ি উড়ানো আনন্দ
অভিজাত মহলে সীমাবদ্ধ ছিল--যা এখন সর্বসাধারনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
পুরান ঢাকার ঘুড়ি উৎসবের আনন্দ বরাবরের মত এ বছরও জাঁকজমকভাবে উদযাপিত হয়েছে।
প্রজাপতি, পঙ্খিরাজ, চুড়িদার, গাহেলদার, কাউঠাদার, চোখদার, চাঁনদার, ঘর
গুড্ডি, বাক্স গুড্ডি, কয়রা ইত্যাদি নানারকমের ঘুড়ি উড়ানো; পাকার্ড,
ফেস্টুন প্রদর্শনী এবং সাজানো ঘোড়ার গাড়ীতে অলি-গলি ঘুড়ে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে
পুরান ঢাকার মানুষের পৌষ সংক্রান্তি উৎসব উদযাপিত হয়েছে। মোড়ে-মোড়ে, বাড়ীর
ছাদে-ছাদে, কাব, সংঘ অথবা বন্ধুদের দল মিলে গান বাজিয়ে নেচে-গেয়ে সারাদিন
সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে। সকাল থেকে শুরু হওয়া হিন্দি গানের আওয়াজ রাত ২টা/৩টা
পর্যন্ত চলে। কেউ কোন বিরক্তি প্রকাশ করেছে বলে আজ পর্যন্ত শুনি নাই।
পূজা-পার্বন আর ডোল-কাসার কান ফাটানো আওয়াজ তো সারা বছরই পুরান ঢাকায় লেগেই
আছে, তারপর হিন্দু বিয়েতে পূজার মতই সময়-অসময় ডোল-কাসার শব্দ; আবার রমজান
মাসে সেহেরীর সময় মসজিদের মাইকে বা মুসুল্লিদের ঘুম থেকে উঠার আহ্বান অথবা
হাজার-হাজার গরু কোরবানীর সময়টাতেও সবাই অনেক ধৈর্য্যশীল থাকে, যেন সবই
নিজেদের কাজ। শত শত বছর ধরে পুরান ঢাকার মানুষ এভাবেই ধৈয্যের অগ্নি
পরীক্ষায় কালোতীর্ণ।
পৌষের শেষ দিন, কেউ বা মাঘের প্রথম দিন সনাতন হিন্দুরা বাসার কাছে খোলা
জায়গায় পৌষ সংক্রান্তির পূজা করে গুচ্ছ কাঠের গুড়িতে আগুন জ্বালিয়ে। নানা
রকমের শাড়ি, জড়িদার কাপড়-চোপড় পড়ে ছোট বড় সব বয়সের নারীরা আগুনের চারিদিকে
পূজা সামগ্রী সাজিয়ে বসে ‘বুড়া-বুড়ির পূজা’ উদযাপন করে; পৌষ মাসকে বিদায়
জানিয়ে মাঘ মাসকে গ্রহণ করে।
পৌষ সংক্রান্তির আগমন উপলক্ষে পুরান ঢাকার ছাদে ছাদে গত কয়েকদিন ধরে
বর্নাঢ্য ঘুড়ি উৎসব চলছে, তবে ১৪ ও ১৫ তারিখে সবচেয়ে বেশি ঘুড়ি আকাশে দেখা
গেছে।ছোট বড় সবাই নানা রঙের সূতা মেজে, হরেক রকমের ঘুড়ি উড়িয়ে, বিচিত্র
রকমের পিঠার আয়োজনে নাচ-গান-বাজনার মধ্য দিয়ে সারাদিনব্যাপী ঘুড়ি উৎসবের
আযোজন করে। রাতের বেলা পটকা ফাটিয়ে, আকাশে নানা রকম আতশবাজি জ্বালিয়ে
কিশোর-যুবকরা আনন্দ করেছে। আবার কেউ কেউ মুখের ভিতর কেরোসিন তেল নিয়ে সামনে
মশাল রেখে মুখের তেল মশালের উপর ছুড়ে মারে--হঠাৎ করে আগুন জ্বলে ওঠে ঘন
কুয়াশার অন্ধকারে। কেউ কেউ রাতের আঁধারে ঘুড়ির সূতার সাথে আলোকিত ফানুশ
বেঁধে আকাশে উঁড়িয়ে দেয়; দূর থেকে দেখলে মনে হয়, আকাশে যেন ধুমকেতুর গুচ্ছ
জ্বলছে। পৌষকে বিদায় দেবার এ যেন অন্য রকম পৌষ সংক্রান্তি উৎসব।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |