|
ওইখানে যেওনাকো তুমি (২৭ পর্ব)
-
মেহেরুন নেছা রুমা
-
তাল বেতাল কথা ভাবতে ভাবতে রুপা ঘর
থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। কেন সে মৃত্যুকে মেনে নিবে। তার মৃুত্যর মধ্য দিয়ে কি
তার উপর লেপন হওয়া কালিমা মোচন হবে ? নাকি সেই সব নরপশুদের শাস্তি হবে,নাকি
তার স্বামীর মনে তার প্রতি যে ভালবাসা মায়া ছিল তা ফিরে আসবে ? কিছুইতো হবে
না। তবে কেন নিজের জীবন থামিয়ে দিব রুপা !
কখনো নয়। কারো দয়া,কারো পরিচয় কিংবা ভালবাসায় নয়। একা বেঁচে থাকবে রুপা।
সমাজ তাকে খারাপ বললে বলবে। সব দ্বায় তার নিজের। ওই ঘটনা জানার পর বাবা মা
কোনদিন তাকে পরিচয় দিবে না। এটা নিশ্চিৎ জানে রুপা। সেও নিজের সাফাই গাইতে
পারবে না কারো কাছে। চোখের সামনে যে প্রমান তারা দেখবে তারপর তো রুপার কোন
কথা বলার অবস্থা থাকবে না এবং কেউ তা শুনবেও না। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন
সুযোগই তার থাকবে না।
রুপা বাসা থেকে বের হওয়ার পর অভি বাসায় আসে। তারও কিছুক্ষণ পর রুপার বাবা
মা পৌঁছে। অভি ঘরে ঢুকে রুপাকে দেখতে না পেয়ে সিডিগুলো নিয়ে বাইরের ঘরে বসে
থাকে। ওদের দুজনের কাছেই দু সেট চাবি থাকে সব সময় । তাই ঘরে ঢুকতে কোন
সমস্যা হয়নি অভির। রুপার বাবা মা মনে করে রুপার কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে বা রুপা
গুরুতর অসুস্থ্য। কারন জরুরী খবর দিয়ে অভি তাদেরকে ঢাকা আসতে বলেছে এবং
তারপর থেকে রুপার সাথে বাবা মায়ের একবারও কথা হয়নি।
ঘরে ঢুকেই তারা রুপাকে খুঁজে । অভি তাদেরকে বসতে বলে প্রথমেই নানান
কুরুচিপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করে অপমান করতে থাকে। যে মেয়ে এত নোংরা কাজ করতে
পারে সেই মেয়ের বাবা মায়ের লজ্জায় মরে যাওয়া উচিৎ। তাকে কেন ঠকাল,কেন এসব
গোপন রেখে মেয়ের বিয়ে দিল। বাবা মা অভির কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। তারাতো
রুপার এমন কোন খারাপ ঘটনার কথা জানে না যার জন্য তাদের লজ্জা পাওয়া উচিৎ।
বরং মেয়ে হিসেবে রুপাকে নিয়ে যথেষ্ট গর্ব করার মত ছিল।
বলতে বলতে অভি সেসব সিডি বাবার হাতে দিয়ে বলে, ওই ঘরে যেয়ে একা একা এসব দেখে
আসেন। তারপর আমাকে যা বলার বলেন।
বাবা বলেন, এসব কিসের সিডি ?
আপনার মেয়ের।
আমার মেয়ের ? রুপার?
জ্বি। আপনারতো ওই একটিই মেয়ে। দুটি থাকলে এমন আরো এক ডজন সিডি হত।
রুপার মা এগিয়ে আসে।
অভি তুমি তোমার শ্বশুরের সাথে এভাবে কথা বলছ কেন ? আমাদের রুপা কোথায় ? আর
এসব কিসের সিডি ?
অভি তখন সিডি সম্পর্কে যা বলল তা শুনে রুপার মা সেখানেই বেহুশ হয়ে পড়ে যায়।
বাবা বলেন ,অসম্ভব । রুপা এসব করতেই পারে না। এটা নিশ্চয়ই কোন ষড়যন্ত্র।
জন্ম থেকে রুপাকে জানি। কোনদিন আমাদের চোখের আড়ালে কোন ছেলের সাথে কথাও
বলেনি। বিয়েতে পর্যন্ত আমাদের উপর ভরসা করে চোখ বুজে রাজি হয়ে গিয়েছিল। সেই
মেয়ের নামে তুমি এমন বদনাম করতে পারলে অভি ? রুপা তোমার স্ত্রী।
আপনি যা বলছেন তা আমিও জানি। কিন্তু এখন এই সিডি দেখে তারপর বলেন আমার কথা
মিথ্যা নাকি সত্য।
বেঁচে থাকতে এর চেয়ে লজ্জাজনক অবস্থা আর হতে পারে না। রুপার বাবা মা সেই সব
সিডি দেখলেন। তাদের মেয়েকে দেখলেন ঠিকই কিন্তু মন কিছুতেই মানতে পারছে না।
তাদের জন্ম এবং সংস্কার সব কি বৃথা গেল ? সেদিনই অভির কাছে ক্ষমা চেয়ে বাবা
মা জন্ম জন্মান্তরের জন্য রুপাকে ত্যাগ করে ঢাকা থেকে ফিরে গেলেন। ওই মেয়ে
কোনদিন তাদের পরিচয়ে যেন পরিচিত না হয়, কখনো তার চেহারা দেখবে না বলে শপথ
করলেন।
সেদিন রুপা রেহানার হোস্টেলে এসে সবকিছু খুলে বলল। বিয়ের পর
বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছিল। ওখানে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না।
তাছাড়া ওই ঘটনা এতদিনে হয়তো হোস্টেলে ছড়িয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন
ছাত্রীকে নিয়ে ওমন ঘটনা সবার আগে তারাই কোন না কোন উপায়ে টের পাবে। এটাই হয়ে
থাকে।
রেহানা রুপাকে একটা চাকরী ঠিক করে দিল। দিনে অফিসে যায় রাতে পড়াশুনা করে।
অনার্স ফাইনাল পরীক্ষাটা তাকে দিতেই হবে। এত কিছুর পর রুপা যদি নিজের
অস্তিত্ব নিয়ে টিকিয়ে রাখতে চায়,সবার আগে তাকে আত্ম নির্ভরশীল হতে হবে। নীরা
ঢাকাতে পোস্টিং এর পর খুব ব্যস্ত থাকে। রুপাকে মানসিকভাবে শক্তি অর্জন করার
সব রকম সহযোগিতা নীরা এবং রেহানা দুজনেই করে থাকে। নীরা রুপাকে বলে অনার্স
পরীক্ষাটা দিয়েই রুপা যেন বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে। সমাজ যা বলে বলুক।
রুপা যেন কোন কিছুতে ভয় না পায়। দশজন পুরুষ মিলে জোর করে একটা মেয়ের সবকিছু
লুটে নিলেই সেই মেয়ে নষ্টা হয়ে যায় না। নারীতো কোন ফল বা ফুল নয় যে নষ্ট হয়ে
যাবে বা পঁচে যাবে। ওটা জীবনের একটা দুর্ঘটনা। রিকসা থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে
যাওয়ার মত। চিকিৎসা শেষে আবারো দু পায়ে এগিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
এর মধ্যে নীরার সহযোগিতায় অভিকে তালাকের কাগজপত্র পাঠিয়ে দেয় রুপা।
লক্ষ্য যদি অটুট থাকে, আর সাথে অধ্যবসায় কোন অসাধ্যই সাধ্য হতে সময় লাগে
না। অনার্স পরীক্ষায় যেমন রুপা ভাল রেজাল্ট করেছে তেমনি প্রথমবার বিসিএস
দিয়েই সে প্রিলিমিনারী পার হয়ে এখন লিখিত পরীক্ষার দোর গোড়ায়। সবকিছু একধারে
রেখে দিনরাত পড়ছে সে। একসাথে চালিয়ে যাচ্ছে মাস্টার্সের লেখাপড়া। রুপা যখন
ক্যাম্পসে যায় আশে পাশে ফিসফাস কেউ না কেউ কিছু বলে। রুপা সেসব মনের ধারে
কাছেও নেয় না। তার মত সে ক্লাস করে,পরীক্ষা দেয়।
কয়েক মাস পর।
রেহানা আর রুপা ,নীরার বাসার সামনে গিয়ে নীরাকে ফোন দিল রেহানা।
ফোন রিসিভ করতেই রেহানা বলে-
নীরা ঘটনা শুনেছিস ?
না তো ? কিসের ঘটনা ?
আরে রুপাতো আর একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে !
কি বলিস ! কি হয়েছে রুপার ?
এবার যা হয়েছে তা রিতিমত বোমা ফাটানো।
এত ভূমিকা না করে খুলে বল রেহানা।
কথার ফাঁকেই রুপা নীরার কলিংবেল বাজাল। নীরার সেদিকে খেয়াল নেই। সে রেহানার
কাছ থেকে রুপার দুর্ঘটনার খবর শুনতে কান পেতে আছে ফোনে।
রেহানা বলছে,তোর দরজায় বেল বাজছে। দরজাটা খুলে আয় আগে। তারপর বলছি ।
আগে তুই রুপার কথাটা বল। দরজায় কেউ না। মনে হয় ভিক্ষুক আসছে।
বলতে বলতে দরজা খুলে নীরা অবাক।
বেশ জব্দ করতে পারিস তো তোরা। এখানে দাঁড়িয়ে আমাকে রুপার কথা বলে ফোন করা
হচ্ছিল তাই না ?
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রেহানা বলল,রুপা কি দুর্ঘটনা ঘটাল শুনবি না ?
নীরা একবার রুপার দিকে তাকাল। রুপা মিটিমিটি হাসছে। এ মেয়েতো সহজে হাসার
পাত্রী নয়।
নীরা ওদেরকে এক মিনিট বসতে বলে উঠে ঘরের মধ্যে গেল। ফিরে এল এক বাটি মিস্টি
হাতে।
তিনজনে তিনজনের মুখের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।
নীরাই বলল, রুপার দুর্ঘটনা উপলক্ষে মিষ্টি। ধর হা কর,বলেই আস্ত একটা মিষ্টি
রুপার মুখে দিয়ে দিল নীরা। তারপর রেহানাকে। এবার সে বলল,রুপার মুখ দেখেই আমি
বুঝেছি সে কত বড় দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে,আমার সামনে এখন দেশের একজন প্রথম শ্রেনীর
কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে আছে। কি ঠিক বলেছি না রুপা ? এটাইতো তোর দুর্ঘটনা ! তুই
এখন ক্যাডার হয়ে গেছিস।
আপু তুমি বুঝলে কি করে ?
তোকে কি আমি আজ থেকে জানি ? রেহানা যখন দুর্ঘটনার কথা বলল প্রথমে আমি ভয়
পেয়েছিলাম ঠিকই ,কিন্তু তোকে দেখার পরই আমি বুঝে গেলাম দুর্ঘটনাটা কি। এখন
বল,কোন ডিপার্টমেন্টে পড়েছিস ?
বড় বোন যেখানে ছোট বোন কি সেখানে না যেয়ে পারে ?
নীরা রুপার গলা জড়িয়ে ধরল। সেই সাথে রেহানা। তিনটি নারী জগতের সকল বন্ধনের
চেয়ে সবচেয়ে আন্তরিক সবচেয়ে আপন আর শক্ত দৃঢ় বন্ধনে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল।
এই শহর রুপাকে দিয়েছে অনেক । তার চেয়ে কেড়েও নিয়েছে বহুগুন। শিখিয়েছে অনেক
কিছু,আবার তারচেয়েও রুপা শিখে নিয়েছে ঢের বেশি। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সে
এই শহরটাকে নিজের করে নিয়েছিল। আজ সেই নিজের শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে কোন এক
অজানা অচেনা শহরে। যেখানে তার কর্মজীবন শুরু হবে। রুপার পথ চলা আবার হল শুরু।
সেই কবে থেকে রুপা শুরুই করে যাচ্ছে। শেষ আর হয় না। সারা জীবনই বেঁচে থাকার
জন্য লড়াই শুরু করতে হয়,লড়াই করতে করতে আবার লড়াই শুরু হয়। শেষ আর হয় না।
হয়তো এটাই নিয়ম। জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারীর লড়াইয়ের কোন শেষ নাই। শুরু
আছে অসংখ্যবার।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|