[প্রথমপাতা]

 

 

 

ওইখানে যেওনাকো তুমি(১০ম পর্ব)
 
 

- মেহেরুন নেছা রুমা -

 

 
একদিন তুলি রূপাকে নিয়ে তুলিদের বাড়ির বাগানের পাশের ঐ হেলে পড়া নারকেল গাছটার উপর বসে। এখানে বসেই ওদের রাজ্যের যত কথা হয়।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর তুলি বলে ,রূপা একটা কথা বলব তোকে । কাউকে বলবি না যেন । আপুর কাছেও না।
তুলির মুখের দিকে তাকিয়ে বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করছে রূপা। তারপর বলে , তোর কি হয়েছে খুলে বলতো তুলি ? ক’দিন থেকেই দেখছি তুই যেন কি ভাবছিস। কি এমন কথা তোর যা কাউকে বলা যাবে না ?
রূপা আমার মনে হয় আর পড়াশুনা হবে না।
- কী বলছিস তুলি ? পড়াশুনা হবে না মানে কি ?
হবে না মানে আমার মনে হচ্ছে আমি পরীক্ষায় পাস ই করব না। আর পাস করব কি,আমি তো লেখাপড়াই করতে পারিনি।
কেন ? কেন পারিসনি ? আমাকে তো কিছু বলিসনি এতদিন ? তোর সমস্যাটা কি খুলে বল তুলি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে তুলি। তারপর বলে কিভাবে যে বলি তাইতো বুঝতে পারছি না।
আমার সাথে কথা বলতে তোর এত জড়োতা থাকার তো কথা না তুলি। বলে ফেল ঘটনাটা কি ।
রূপা ,তুই তো আমার নাদিম ভাইকে চিনিস। আমাদের মামাতো ভাই।
হ্যা চিনি তো । আমাদের কলেজেই তো বিএ পড়ছে তাই না ? তোর সাথে কথা বলতে দেখেছি অনেক বার। কি হয়েছে তার ?
তার কিছু হয়নি।
তুলি একটু চুপ করে থেকে বলে, আসলে নাদিম ভাইকে আমি মনে মনে পছন্দ করতাম। সেও আমাকে পছন্দ করত। একদিন সে আমাকে তার মনের কথা বলে। আমি প্রথমে পাত্তা দেইনি। তারপর সে আমার পিছু ছাড়ে না। আমাকে প্রতিদিন তার মনের কথা বলে চিঠি দিত ।
কি আশ্চর্য ! এত কিছু হচ্ছিল আর তোর সাথে চব্বিশ ঘণ্টা থেকে আমি টেরই পেলাম না ! কখন করতিস এসব লুকোচুরি ? আমাকেও বলিস নি ?
শোন না আগে।
আচ্ছা বল।
তো নাদিম ভাইকে আমি বারবার ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম। তাকে আমি ঠিকই পছšদ করতাম। কিন্তু সেটা আমি প্রকাশ করিনি। ছেলেরা মেয়েদের সাথে প্রেম প্রেম খেলে । আসলে তারা কোন মেয়েকেই ভালোবাসে না। এ কথা আপুর কাছে এত শুনেছি যে নাদিম ভাইয়ের আকুলতা ব্যকুলতাকে আমি গ্রাহ্যই করিনি। কিন্তু ক’দিন আর আমি পেরেছিলাম। শেষ পর্যন্ত নাদিম ভাই আমার মনটাকে জয় করেই ছাড়ল। আমি তার কাছে সমর্পিত হই। গভীর ভাবে ভালোবেসে ফেলি।
ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে গভীর একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। প্রথমে আমাদের মন দুটি একাত্ম হয়ে যায় । তারপর আমাদের শরীরটাও মনের সাথে মিলে একাকার হয়ে উঠি পরস্পরকে জড়িয়ে। নাদিম ভাই আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না ,আমিও না। কলেজে যে প্রায়ই তোকে আমি শরীর খারাপের কথা বলে বাড়ি চলে যাবার কথা বলতাম,আসলে আমি বাড়ি যেতাম না। নাদিম এর সাথে যেতাম।
রূপা যা শুনছে সবকিছু আজগুবি গল্প বলে মনে হচ্ছে। এত কাছের বান্ধবী ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে আর সে মোটেও টের পেল না।
তুলি বলল,এসব তুই না হয়ে অন্য কেউ হলে টের পেত। তুই তো দিনরাত লেখাপড়া নিয়ে ডুবে থাকিস। তাই আমার প্রতি তোর কোন সন্দেহ জাগেনি মনে। আমিও তোকে বলিনি। ভেবেছি তোকে বললে তুই আবার আপুকে বলে দিস কিনা। আর নাদিমও বারবার বলে আসছিল আমি যেন কাউকে না বলি। তাহলে আমাদের মেলামেশায় সমস্যা হবে।
কিন্তু এখন আর তোকে না বলে পারলাম না। আসলে এখন আমার আর সময় নাই রূপা।
কি বলছিস তুই ? কিসের সময় নাই ।
আমাদের খুব শিঘ্রই বিয়ে করতে হবে। না হলে ..
তুলি ? তুই এসব কি বলছিস ? তোর মুখে এসব কথা আমাকে শুনতে হচ্ছে ? আমরা না এক সাথে এসব নিয়ে মাঠে নেমে কাজ করেছি। কাউকে ভালোবাসিস সেটা না হয় স্বাভাবিক। কিন্তু তার জন্য নিজের সর্বনাশ কেন করছিস ? কত কত মেয়েকে আমরা সচেতন করেছি। কত মেয়েকে সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা করেছি। কত মেয়ের আত্মহত্যা করার ইচ্ছাটাকে দমিয়ে দিয়েছি আমরা। এ সব কাজেই তো তুই ছিলি ।
দেখ রূপা ,আসলে আমরা মুখে অনেক কিছুই বলতে পারি। করতেও পারি। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় নিজের বুদ্ধি বিবেচনাকে হার মানিয়ে কোথায় যে নিয়ে যায় তা আমার জায়গায় না এলে তুই বুঝবি না।
নাদিম কে প্রথমে আমার শুধু ভাল লাগত। এক সময় সেই ভাল লাগাটা কঠিন ভালোবাসায় রূপ নেয়। আর সেও আমাকে প্রেমের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বহুদূর। এক সময় তার সাথে আমার সব ধরনের সম্পর্ক হয় রূপা। আমি নিজেও ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারিনি।
আমার এখন বিয়ে করার সময় না,তাছাড়া আমরা যে নারীদের অল্প বয়সে বিয়ে,অল্প বযসে সন্তান নেয়া এসবের বিরুদ্ধে কাজ করেছি ,সেটা ভেবে আমার বিবেক আমাকে বাধা দেয়। কিন্তু ভালোবাসাটা আসলে এমন একটা বিষয় যে, এখানে আমি নিজেই নিজের বুদ্ধি জ্ঞান সব হারিয়ে ফেলেছি। আমি পাগলের মত তাকে সবকিছু উজার করে দিয়েছি। ভালোবাসা আসলে বিচার বুদ্ধির ধার ধারে না রূপা।
নাদিম আমাকে ঠিকই পড়াশুনা চালিয়ে যেতে ঠিকই উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু আমি নিজেই মন বসাতে পারিনি । পরীক্ষার জন্য আমার প্রস্তুতিও ভাল ছিল না। এখন মনে হচ্ছে আমি পাস করতেই পারব না।
তুলি তোর কথাগুলো আমাকে খুবই কষ্ট দিচ্ছে । তোর মনে এত কিছু চলছিল একটিবারও আমি জানতে পারলাম না। আমিকি তোর বন্ধু নই বল ? আর নাদিম ভাইয়ের সাথে তোর সম্পর্ক থাকলে থাকবে । তার জন্য লেখাপড়া ছেড়ে এখনি বিয়ের কথা ভাবছিস কেন ? তুই এখন বিয়ে করলে আমাদের সংগঠন কোথায় গিয়ে দাড়াঁবে বুঝতে পারছিস ? আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাল্য বিয়ে রোধ করেছি । আর এখন আমরাই বাল্য বিয়ে করছি ? আসলে নীরা আপু চলে যাওয়াতেই আমাদের এই সমস্যাগুলি হচ্ছে। তুই তোর আপুকে দেখে শিখতে পারলি না তুলি ?
দেখ রূপা আমি এ সবই বুঝি । কিন্তু সমস্যাতো অন্য খানে। সেটা তোকে আমি কি করে বলি।
তুই না বললেও আমি মনে হয় বুঝতে পারছি তুলি। তুই বড় ধরনের কোন ভুল করে ফেলছিস তাই না ?
রূপার কথা শুনে তুলি হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল। রূপাকে জড়িয়ে ধরে বলল,আমি এখন কি করব রূপা ? আমার অনেক বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। বাবা মা জানতে পারলে আমাকে জেন্তা পুতে ফেলবে। তার উপর নিজে যে সব সংস্কার নিয়ে কাজ করেছি এখন নিজেই তার তলে ডুবে মরছি । এই চিন্তায় আমার পড়াশুনাও কিছু হয়নি। বড় আপুর সামনে আমি কোনদিন মুখ দেখাতে পরব না । আসলে নাদিমকে যখন ভালবাসতাম,আর তাকে খুশি করতে আমি নিজেকে উজার করে দিয়েছি। সে একটু অভিমান করলে আমার কলিজা ছিড়ে যেত। তাকে কোন কিছু না করতে পারিনি আমি। মনে হত ভালবাসার চেয়ে মুল্যবান আর কিছু নেই। তার মন জোগাতে আমার দিন রাত ভাবনার অন্ত ছিল না। যখন যেদিন যা বলত আমি তাই শুনেছি।
রূপা চিন্তায় পড়ে গেল। এই সংকট থেকে উত্তরণ কিভাবে সম্ভব তা তার জানা নেই। সাকিরা আপু থাকলে আজ তার কাছে যাওয়া যেত ।
রূপা বলল, নাদিম ভাই এখন কি বলছেন তোকে ?
সে বলছে, সেও বুঝতে পারেনি যে এমনটা হয়ে যাবে। এখন নাদিমও ঘাবড়ে গেছে। একবার বলে চলো আমরা পালিয়ে যেয়ে বিয়ে করি। আবার বলে এখন সে বিয়ে করলে তার পুরো ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। বিয়ে করে আমাকে নিয়ে চলবে কিভাবে ।
তুলি ,আমার মনে হয় আমরা নীরা আপুকে বিষয়টা খুলে বলি। সে নিশ্চয়ই একটা উপায় বের করবে।
না রূপা না।এটা আমি পারব না কিছুতেই। নাদিমের সাথে আমার সম্পর্ক আছে ,এটা না হয় বলার মত কথা ছিল। কিন্তু আমার মধ্যে যে এখন এই সম্পর্কের সৃষ্ট আর একটি প্রাণ নিশ্বাস নিচ্ছে সেটা আমি কি করে কাউকে বলি ? সবার আগে তো বাবা শুনলেই আত্মহত্যা করবে। জীবনে কোন অন্যায় করেনি বাবা,অন্যায় মেনেও নেয়নি। আমার অপকর্মের ফল বাবাকে ভোগ করতে দেব না আমি। সে তো লজ্জায় অপমানে মরেই যাবে রূপা।
এত কিছু বুঝিস তো এমন কাজ করলি কেন ?
আবারো হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল তুলি।
রূপা তুই এখন আমাকে বাঁচা বোন। আমি কিছুই ভাবতে পারছি না।
আমি বলিকি নাদিম ভাইকে একদিন খবর দে । তার সাথে বসে একটা সমাধান বের করি।
আচছা তাকে আসতে বলব। সে তো এখন আমাদের বাড়ি আসবে না। আমাদেরও পরীক্ষা শেষ। কলেজেও যেতে পারব না। তাহলে বাইরেই কোথাও দেখা করতে হবে।
তাই কর তুলি। তারপর আমাকে খবর দিস।
চার দিন পর সন্ধ্যাবেলা তুলির একটা চিঠি রূপার হাতে পৌঁছে দেয় পাশের বাড়ির একটি ছোট্ট ছেলে। রূপা তখন মায়ের সাথে রানাœঘরে পিঠা বানাতে ব্যস্ত। চিঠি খানা ওড়নার আঁচলে বেঁধে রেখে হাতের কাজটা শেষ করছিল । মনটা পড়ে আছে ওই ওড়নার আঁচলের দিকে। কি লিখেছে তুলি। এখনি কাজ ফেলে উঠে গেলে মা বকবেন। সেজন্য তাড়াহুড়ো করে কাজটা শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে নিজের ঘরে গিয়ে চিঠির ভাজ খুলল।
রূপা,
এই চিঠি যখন তোর হাতে পৌঁছবে তখন আমি তোদের সবার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাব। অনন্ত লজ্জা দিয়ে গেলাম আমি তোদের সবাইকে। এই আমার প্রতি এখন নিজেরও অসীম লজ্জা হয় । বড় আপুকে জীবনের আদর্শ ভেবে তার মত করে মানুষ হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পিচ্ছিল পথে পা ফসকে আমার জীবনটা ভুলের গর্তে পড়ে যায়। তোকে তো সবই বলেছিলাম।
তুই বলেছিলি নাদিমকে নিয়ে পরামর্শ করে বের করব আমার এখন কি করা উচিৎ। সেদিনই আমি নাদিমকে খবর দেই। সে কোন সারা দেয়নি। আমার একের পর এক খবর পেয়ে সে আমাকে ছোট্ট একটা চিরকুট পাঠায়। তাতে লেখা , তার সামনে বি এ পরীক্ষা। এখন পড়াশুনা ছাড়া সে আর কিছইু ভাবতে পারবে না। আমার ব্যাপারটা পরে ভেবে দেখবে। আর এখন এ অবস্থায় আমাকে তার কিছুতেই বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমি যেন কোন ক্লিনিকে গিয়ে সমমস্যা সমাধান করে ফেলি।
এ পর্যন্তই তার লেখা। আমি তারপর লজ্জা শরম ভুলে বেহায়ার মত কলেজে গিয়ে তার সাথে দেখা করি। তার হাতে পায়ে ধরে মিনতি করি। বলি আমার এ অবস্থায় তুমি আমাকে একা করে চলে যাচ্ছ ? তুমি তো আমাকে ভালোবাস তাই না ?
সে তখন বলে, আবেগ দিয়ে জীবন চলে না তুলি । এখন আমি বিয়ে শাদি করা তো দুর,তোমাকে সময় দেয়াই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পরীক্ষায় ভাল ফল না করতে পারলে আমাকে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিবেন।
তার কথা শুনে আমি চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। দূর থেকে ছেলে মেয়েরা আমাকে দেখছিল। কি লজ্জা আমার তা তোকে বলে বুঝাতে পারব না রূপা। আমি বললাম ,তোমার জন্য আমি নিজের পড়াশুনা ঠিক মত করতে পারলাম না, যে সম্পর্কে জড়াতে চাইনি,তা তুমি জোর করে সৃষ্টি করলে। তখন কত মিষ্টি করে বললে,এ সবই ভালোবাসার অংশ। শরীরের ভেতরই মন বাস করে। তাই মনের সম্পর্কে শরীরকে যোগ না করলে নাকি প্রেম পরিপূর্ণ হয় না। আমি তো প্রেম দিতে চেয়েছি শতভাত নিখাদ। তাই তো ভালোবাসার মানুষকে সুখি করতে নিজের বিপদের আশংকাকেও উড়িয়ে দিয়েছিলাম । আমার একবার না করাতে তুমি কত অভিমান করলে। তোমার অভিমান ভাঙাতে আমি আমাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। আমি তো তোমাকে মন থেকে ভালোবেসেছি। আমার সমস্ত বিশ্বাসকে মুঠো ভরে তোমার হাতে সমর্পন করেছিলাম। তুমিকি সেই বিশ্বাস ভেঙ্গে দিবে নাদিম ? নাদিম কোন কথা বলে না। আমি চোখের পানিতে ভাসছি ,তাকে বলছি ,এখন তুমি কেন আমার কথা ভাবছ না ? তুমি বললে অবশ্যই বাচ্চাটাকে আমি নষ্ট করব,কিন্তু তোমার তো আমার সাথে থাকতে হবে নাদিম।
সে তখন বলে, তুলি তোমার এসব নাকে কান্না আমার ভাল লাগছে না। দয়া করে তোমার জীবন তুমি ভাব , আর আমাকে আমার মত থাকতে দেও।
তখন আমিকি এই দুনিয়াতে আছি না নেই তা বলতে পারব না। আমি একবার ওর পায়ের উপরও পড়েছিলাম। মিনতি করে বলেছি ,নাদিম আমাকে এভাবে ছুড়ে ফেল না । তুমি চাইলে আমি বছরের পর বছর তোমার অপেক্ষা করব । কিন্তু এখন আমি কি করব সেটা তুমি বল। আমি বাচ্চাটা নষ্ট করতে রাজি আছি। কিন্তু তুমি আমাকে বিয়ে করো । না হয় এখন বিয়ের কথা কাউকে জানাব না। তুমি প্লিজ আমার সাথে প্রতারনা কর না।
রূপা তুই নিশ্চয়ই এখন আমার উপর অনেক রাগ করছিস ? কেন একটা পুরুষের কাছে আমি ভিক্ষা চাইছি সেজন্য। আমি আমার নিজের ভালোবাসা,নিজের সম্মান আর আমার পরিবারের সম্মান রক্ষার্তে আমি ওর পায়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে বারবারই ফিরিয়ে দিয়েছে। এক সময় সে আমাকে বলত, আমি নাকি একটা গোলাপ । যার কেউ কোনদিন গন্ধ নেয়নি। সেই গন্ধ আমি তাকে দিয়েছিলাম। আর এখন সে সেই গোলাপকে জুতার তলায় পিষ্ট করে চলে গেল ।
আসলে জগতে কোন পুরুষই নারীকে ভালবাসে না। এটা আমি নাদিমকে দিয়েই বলতে পারছি। কারন কিছুদিন আগেও নাদিম কথায় কথায় আমার জন্য জীবন দিতে পারত। ডাকার আগে ছুটে আসত। যখন থেকে আমার এই সর্বনাশ শুরু হল,তখন থেকে সে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছিল । ওর কাছ থেকে ফিরে এসে আমি ঠিক করেছি এ মুখ আমি আর কাউকে দেখাব না। কি করে দেখাব বল ? জীবনের ’পর সমস্ত আস্থা আমার উঠে গেছে। নাদিমকে যে ঘৃনা করব তারও উপায় নেই আমার। আর ক’দিন পরেই আমার শরীরের পরিবর্তন মানুষের চোখে পড়বে। তখন আমার গলায় দড়ি দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। তার চেয়ে এখনই যদি মরে যাই তো আমার সেই রূপটি কারো দেখতে হবে না ।
আমি তো হেরে গেলাম রূপা। সবকিছু থেকেই হেরে গেলাম। আমার এই ঘটনা তুই ছাড়া কেউ জানে না। এই সমাজ থেকে আমি আমার নিজেকে রক্ষা করতে এবং আমার বাবা মাকে মানুষের কথা শুনার হাত থেকে রক্ষা করতেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই জীবন শেষ করে ফেলব। আমি তো পাপ করেই ফেলেছি। এখন আত্মহত্যা মহাপাপ জেনেও আমার এছাড়া কোন উপায় নেই। তোর কাছে অনুরোধ , তুই আমার এ সর্বনাসের কথা কাউকে বলিস না। তাহলে বাবা মা কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। আমি কেন নিজের জীবন নিজে শেষ করলাম তাদের কাছে সেটা অজানাই থাকুক ।
বড় আপু থাকলে হয়তো আমাকে এভাবে অপমান নিয়ে মরে যেতে দিত না। সে নাদিমের সাথে বোঝা পড়া করেই ছাড়ত। তাতে কি হত,আমার সম্মান কি বাড়ত ? বরং ঘটনাটা যারা না জানত তারাও জেনে যেত। আর যার মনে আমার জন্য ভালোবাসার ছিটেফোটাও নেই তার সাথে সমঝোতা করে টিকে থাকার কোন অভিপ্রায় আমার নেই।
সবশেষে আমাকে তোরা ক্ষমা করিস। তুই পড়াশুনা করে অনেক বড় হবি। একদিন তোকে নিয়ে সবাই গর্ব করবে । আমিও অন্য জগতে থেকে তোর সাফল্য দেখে তৃপ্তি পাব। এই চিঠিই আমার দুনিয়াতে করা সর্বশেষ কর্ম। তোর কাছে পৌছাতে পৌছাতে আমি পৃথীবি থেকে পরপারে চলে যাব।
রূপা ,কোনদিন যদি নাদিমের সাথে দেখা হয়,আমার হয়ে ওর মুখে এক দলা থুতু ফেলতে পারবি ? আর একটা কথা তোকে বলি। যদিও আমি জানি তুই আমার মত বোকা মেয়ে না। তারপরেও একটা কথা মনে রাখিস ,কোন পুরুষকে বিশ্বাস করবি না। ভালোবাসা তো দূরের কথা। আসলে পুরুষরা জানেই না ভালোবাসা কি । তারা মেয়েদের ধরার জন্য জাল বিছায়, জালে ধরা পড়লে তাকে নিয়ে আদর সোহাগ করে,পরে তাদের মন তৃপ্ত হওয়া পর্যন্ত মন প্রাণ নিবিষ্ট করে। এক সময় তাদের মন ভরে গেলে জাল গুটিয়ে লেজ গুটিয়ে চলে যায়। ওরা কোন মেয়ের ভালোবাসা পাবার যোগ্যই না। মেয়েদের মনটাকে তারা খেলনা মনে করে। যেটা পাবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, এক সময় সেটা নিয়ে খেলার সাধ মিটে গেলে ছুড়ে ফেলে। নারীর মনটাকে আছড়ে ভাঙতে তাদের কোন বিবেকে বাঁধে না। ঠিক যেমন বাচ্চারা এক খেলনা নিয়ে বেশিদিন খেলতে চায় না সেরকম। মুখে যতই নারীপ্রেম দেখাক না কেন, তলে তলে সব পুরুষই পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী। মেয়েদের প্রকৃত প্রেমকে তারা মেয়েদের দুর্বলতা মনে করে। তাই সেখনেই আঘাত দেয় সবচেয়ে বেশি।
লিখতে গেলে সারা দিনেও আমি শেষ করতে পারব না। যাবার বেলা এত কথা লিখেই বা কি হবে আমার। কোন সুন্দর মনের পুরুষ পেলে তাকেই বিয়ে করবি,নচেৎ নয়। সাকিরা আপু যে বিয়ে করেনি ,কাউকে ভালোবাসেনি আসলে সেই উপযুক্ত নারীর মত কাজ করেছে। নিজের মুল্যবান হ্্রদয়টাকে কারো হাতের পুতুল হতে দেয়নি।
তোর জীবনটা অনেক সুন্দর হোক এই প্রার্থনা আমার।
তুলি।
চিঠিখানা পড়তে পড়তেই রূপা ঘামছিল । হাত পা কাঁপছিল। কাঁপতে কাঁপতে চিঠি শেষ করে কাউকে কিছু না বলেই অন্ধকারের মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মা তখনও রান্নাঘরে । মাকে যে বলা হয়নি সেটাও রূপার খেয়াল নেই। রাস্তা দিয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তুলিদের বাড়ির কাছাকাছি যেতেই সমস্বরে চিৎকার শুনতে পেল। রূপাকে দৌঁড়াতে দেখেই কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করল কি হয়েছে । বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই সেই ছোট্ট ছেলেটির সাথে দেখা ,যে রূপাকে চিঠিখানা পৌঁছে দিয়েছিল।
ছেলেটি বলল,রূপা আপু আমি আপনাকেই খবর দিতে যাচ্ছিলাম। তুলি আপু মরে গেছে।

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ