[প্রথমপাতা]
|
ভালোবাসা এমনি হয়
-
মেহেরুন নেছা রুমা
-
সুইমিং পুলের স্বচ্ছ নীল টলটলে পানিতে সোডিয়াম বাতির প্রতিচ্ছবিকে মনে
হচ্ছে অষ্টাদশী চাঁদ। আশে পাশের প্রায় সবকটি টেবিলই ফাঁকা। অপূর্ব বেছে
বেছে এমন নির্জন জায়গাগুলোই পছন্দ করে। কেননা কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ মোহিনীর
কখনো পছন্দ নয়।
কিছুক্ষণ পরপর হাতঘড়িটার দিকে মোহিনীর দৃষ্টি। আপাত দৃষ্টিতে এটাই মনে হতে
পারে যে মোহিনী অধীর আগ্রহে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু এ সময়’কে
পাহাড়া দেয়ার অন্য কোন মানেও যে থাকতে পারে সেটা যে বোঝার সেই একমাত্র
বুঝতে পারে।
অপূর্ব বলল, তোমাকে বেশ অস্থির মনে হচ্ছে। এত অস্থিরতারতো কিছু নাই। সময়তো
ভালোই যাচ্ছে আমাদের। তাহলে কেন অযথা হাতঘড়িটাকে নাজেহাল করছো?
চাঁদের ওই বাঁকা ফালির মতই গোলাপী ঠোঁট দুটো একটু প্রসারিত করে মিষ্টি
হাসির অবয়ব এনে মোহিনী বলল, হ্যাঁ, সময় শুধু ভালোই যাচ্ছে না, খুবই ভাল
যাচ্ছে। তারপরেও যে উদ্দেশ্যে আসা সেটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলেই ভালো।
দৃষ্টিটা আরো একবার ঘুরিয়ে নিল হাতঘড়িটার দিকে এবং হাতে থাকা সেলফোনটার
দিকে। কোন টেক্সট মেসেজ যদি থাকে-“আপু সরি আজ আমি আসতে পারিছ না”।
কিন্তু সেরকম কিছুই নজরে পরল না মোহিনীর।
তৃতীয় চেয়ারটা যেন ওদের দুজনের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, আর জানতে চাইছে
তাকে কখন ব্যবহার করা হবে। সুইমিং পুলের পূর্বপাশে যেখানে সারি সারি
দাঁড়িয়ে আছে ঝাউ, ঝুমকো জবা, কামিনী আর গাছে গাছে হলুদ বেগুনি আলমন্ডা ফুল।
তারই পাশ দিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে এই জায়গাটায় আসার থাই দরজাটা যেন
একটু ফাঁকা হলো। বেয়াড়া হাত উঁচু করে সালাম দিতেই বেগুনি শাড়ির আঁচলখানি
দুলতে দেখা গেল। সুইমিং পুলের স্বচ্ছ পানিতে প্রতিফলিত সোডিয়াম বাতির
একচ্ছটা পড়ল গিয়ে আগত নারীর মুখের উপর। ঝলকে উঠল উপস্থিত দুটি মানব মানবী।
মোহিনী অপূর্বর দিকে চেয়ে হেসে বলল, ‘ওইতো এসে গেছে’। অপূর্ব ভাবলেশহীন
চোখে তাকিয়ে থাকে মোহিনীর দিকে। আর সেই ভাবলেশহীনতার মধ্যে যে গভীর ভাবটি
মনের দিগন্তরেখায় এপাড় ওপাড় দাগ কেটে ফস করে বেরিয়ে যায় সেটা দুজনেই অনুভব
করল। মুখ ফুটে প্রকাশের কোন প্রয়োজন পড়েনি।
দুজনই উঠে নীলাকে স্বাগত জানালো। বেলী ফুলের সুবাস চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়ে
নীলা তার উপস্থিতির জানান দিয়ে তৃতীয় চেয়ারটাতে বসল।
সময় কিছুক্ষণ পার হতেই নিজের ভেতর একরকম অস্থিরতা অনুভব করে অপূর্ব। মনে
হচ্ছে ভালোলাগার সমস্ত উপলক্ষ্যই যেন কেউ ছো মেরে কেড়ে নিয়েছে । মোহিনীকে
তাড়া দিয়ে বলল, ‘এবার তাহলে ওঠা যাক’। পাশের চেয়ারে লজ্জাবতী লতার মতই বসে
থাকে নীলা। বেগুনি শাড়িটা তাকে বেশ মানিয়েছে। কথা যা হচ্ছে সবই মোহিনী আর
নীলার মধ্যে। অপূর্ব শুধু শ্রোতা মাত্র। কিন্তু তার চোখদুটি খোলা, মনটাও
তেমনি মেলে ধরে আছে। তাতে যা কিছু অবলোকন করার তা সে ঠিকই করছে, পরিবেশ যতই
প্রতিক’লে থাকুক। মন ভরে দেখছে পাশের নয়ানাভিরাম সুইমিংপুলের টলটলে পানিতে
প্রতিফলিত সোডিয়াম লাইটের প্রতিবিম্বকে। তারসাথে আরো একটা উপভোগ্য দৃশ্য
রয়েছে পানিতে। যা অপূর্ব’র পাশ থেকেই দেখা যাচেছ। আর তাই সে মন ভরে দেখে
নিচ্ছে, সবার অলক্ষ্যে, সবার অগোচরে -পানিতে মোহিনীর ছায়া।
নীলা আসার আগ পযর্ন্ত সময়টা অপূর্বর কাছে বেশ উপভোগ্য ছিল। পরিবেশটা তখন
ওদের সময়টাকে গ্রাস করছিল মুঠো ভরে ভরে। নীলার উপস্থিতি কেন জানি অনুভূতিতে
খসখসে ভাবের সঞ্চার করলো। প্রকাশটা ছিল অপূর্বর দিক থেকেই। কিন্তু
উপলব্ধিটা হয়তো মোহিনীও করেছিল।
নীলাকে বিদায় দিয়ে রিক্সায় চড়ে বসে অপূর্ব আর মোহিনী । এতক্ষণ পরে চাঁদের
আলোটা সুযোগ বুঝে ঝাপিয়ে পড়ছে ওদের উপর। অকৃত্রিম ধারায় সে বর্ষিত হচ্ছে এই
ভূবনতলে। মোহনীয় হয়ে উঠছে এই পথ, পথের দুপাশের সারি সারি গাছ, এই ক্ষণ,
ভালোবাসায় ছেয়ে থাকা দুটি মন সিক্ত হতে হতে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে।
অপূর্বর পাশে বসে চাঁদের আলোর মতই শান্ত অথচ প্রচন্ড আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে
মোহিনী। অপূর্ব একহাতে জাড়িয়ে ধরে পাশে নির্ভিঘেœ বসে থাকা মানবীর কাঁধ
বরাবর। মোহিনীও নিজেকে যেন একটু এলিয়ে দেয়। জনহীন মসৃণ পথ, ঘূর্নায়মাণ
রিক্সার চাকা, প্রিয়তমের নিবিড় আলিঙ্গণ- যেন জীবনের পরতে পরতে ছন্দ ও সুরের
মূর্ছনা-ভালোলাগার এক অনবদ্য কবিতা। মোহিনীর হ্্রদয়ের এক এক সুক্ষè কোণ
থেকে আলোড়িত হয়-তুমি আমার সব, আমার অস্তিত্ব, আমার অবলম্বন, আমার সত্ত্বা।
এভাবেই জড়িয়ে রাখো আমায়, আজ, কাল, পরশু,সারাদিন,,সারারাত,অনন্তকাল ।
মোহিনীকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজের বাসায় ফেরে অপূর্ব । সিঁড়ি বেয়ে উঠতে
উঠতে মোহিনী ভাবে, ‘সময়’ তুমি কেন আর একটু রুখতে পারো না। হায় খোদা, কেন
আমার ভাগ্য বারবার আমাকে ওর কাছ থেকে আলাদা করে দেয়! কেন আমাদের দু’জনকে দু
’প্রান্তে থাকতে হয়! পৃথিবীতে সত্যিকার ভালোবাসলে নাকি সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে
মিলিয়ে দেন, তবে কি আমাদের ভালোবাসাটা সত্যি নয়? সত্যিকার ভালোবাসা তাহলে
কীরকম?
বাইরে থেকে এসে প্রথমেই মোহিনী খুব ভালকরে গোসল করে। যত পরিচ্ছন্ন জায়গায়ই
যাক না কেন, গোসল না করা পর্যন্ত নিজেকে ফ্রেশ মনে হয় না তার কাছে। একই
অভ্যাস অপূর্বও রপ্ত করেছে। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে সেল ফোনটা
হাতে নিতেই মোবাইলের লাইট জ্বলে উঠল মোহিনীর হাতেই।
এই ফোনটা চব্বিশ ঘণ্টাই সাইল্যান্ট থাকে। অপূর্বর সাথে সম্পর্কিত সকল
কিছুকেই এমন করে দুনিয়া থেকে আড়াল করে রাখতে হয়, এটাই বড় কষ্ট মোহিনীর।
ইচ্ছা তো হয় সারা দুনিয়াকে চিৎকার করে বলতে ‘অপূর্ব ই তার সবকিছু’,
অপূর্বকে দেখাতে পারলে মনে হয় মানুষ হিসেবে তার জন্মটাই স্বার্থক হয়ে উঠত।
মোহিনীর জন্মটাই যেন বৃথা। সৃষ্টিকর্তা যদি দুনিয়াতে পাঠিয়েই থাকবেন,
অপূর্ব’র মত মানুষের সাথে যদি সাক্ষাৎই করিয়ে থাকবেন, অপূর্ব’র প্রতি
হ্্রদয়ের গভীরে যদি নিস্কন্টক ভালোবাসা মায়া মমতার সঞ্চারই করে থাকবেন, তবে
কেন অপূর্বর কাছ থেকে দূরে থাকা? কেন হ্্রদয়ের এত কাছাকাছি থেকেও দুটি
মানুষকে একাকিত্ব গ্রাস করে? কেন তৃতীয় একজনের খোঁজ করতে হয়? কেন
চতুর্থজনের হস্তক্ষেপে ভালোবাসা নিভৃতে কাঁদে?
হ্যালো বলতেই অপূর্ব বলে, এইতো লক্ষèী মেয়ে। ফোন দেয়ার সাথে সাথেই রিসিভ।
আমিওতো ফোনটা হাতে নিয়েছিলাম তোমাকে কল করার জন্য। এরই মধ্যে তোমার কল। তাই
রিসিভ করতে সময় লাগেনি।
এভাবেই সবসময় হাতে নিয়ে থাকবে। তোমাকে কল করে কানের কাছে রিং এর আওয়াজ
শুনতে ভালো লাগে না আমার। অপেক্ষা সহ্য হয় না একটুও।
আমারো তাই। ফোন করার সাথে সাথেই যেন তোমার আওয়াজ শুনতে পাই সেটাই আশা করি।
একটা সেকন্ড অপেক্ষা করা যেন যুগ যুগান্তরের মত মনে হয়। মোহিনী বলল।
তারপর কি করছ এখন ?
এইতো এসে কাপড় ছেড়ে গোসল করে তোমাকে নিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করছি।
মোহিনী বলল, জ্বি এভাবেই গড়াগড়ি করো স্বপ্নে আর কল্পনায়।
শুধু কি স্বপ্ন আর কল্পনায়? মাঝে মাঝেতো বাস্তবেও গড়াগড়ি করি।
মোহিনীর মনটা আচমকাই উদাস হয়ে গেল । বলল, ওই মাঝে মাঝেটা কেন যে চিরকালের
জন্য হয় না। জানো তোমাকে খুব মিস করছি আমি।
অপূর্ব বলে, এখন দূরে আছো তাই এমন করে বলছো। যখন কাছে থাকতে তখন হয়তো আমাকে
তুমি এভাবে অনুভব করতে না। সারাক্ষণ আমার সান্নিধ্য তোমার কাছে একঘুয়ে
লাগতো।
তোমার বুঝি তাই মনে হয়? জানো পৃথিবীতে কিছু জিনিস কখনোই একঘুয়ে মনে হয় না।
কখনো সেটা পুরোনোও হয় না। আর সেটা হলো প্রিয়জনের সান্নিধ্য। ‘তোমাকে পেলে
দুনিয়ার আর কোনকিছুর প্রতি আমার কোন আকাঙ্খা থাকতো না’।‘ আমার কাছে মনে হয়
পৃথিবীতে মনের মত একজন মানুষ পাওয়া সবচেয়ে কঠিন । আর সেটা কেউ পেয়ে গেলে
সবকিছুর বিনিময়ে তাকে রক্ষা করা উচিৎ। কারন এর চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই।
’
জানি। কিন্তু সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে ভাবলে তোমার দৈনন্দিন কাজকর্মে মন বসাতে
পারবে বলো? আমিতো তোমারি আছি। কেউতো এসে আমাকে বাজ পাখির মত ছোবল মেরে নিয়ে
যাচ্ছে না কোথাও। মোহিনী বলল, সেটা তুমি বুঝবে কি করে? তুমি তো আর আমাকে
মিস করো না আমার মত করে।
ঠিক বলছ। আমি কেন তোমার মত করে মিস করবো? আমিতো আমার মত করে মিস করি । বলেই
হাহা করে হেসে উঠল অপূর্ব। বিছানার পাশের কোলবালিশটাকে যতটা জোরে চেপে ধরা
যায় ততটাই চেপে ধরে বলল, এই দেখ তোমাকে মনে করে কোলবালিশটাকে আলুভর্তা
বানিয়ে ফেলছি। এভাবেই মিস করছি তোমাকে। কোলবালিশটা আমার বুকের মধ্যে চাপা
পড়ে এখন চিৎকার করে বলছে বাঁচাও বাঁচাও।
অপূর্বর এমন কথায় মোহিনীর মনের উদাসীনতা উবে গেল নিমিষেই। খিলখিল হাসির
ঝিলিক রিনিঝিনি বাজছে অপূর্বর কানে।
রাজ্যের নিস্তব্ধতা এসে হঠাৎ ই থামিয়ে দিয়ে গেল মোহিনীর মুক্ত হাসিটা।
কানের কাছ থেকে মোবাইলটা সামনে এনে অপূর্ব দেখল লাইন কেটে গেছে। আর একবার
ডায়াল করল কিন্তু অপরপ্রান্ত থেকে কোন সাড়াই পাওয়া গেল না। যা বোঝার বুঝে
নিয়ে কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরে ঘুমের চেষ্টা করল সে। মুহুর্তেই গভীর ঘুমে
হারিয়ে গেল অপূর্ব।
রাত এগারোটা।
আছো মোহিনী ?
হ্যাঁ আছি। না থেকে কি পারি?
জানো বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আমার মনে হত বাবা আমার একটা পঁচা নাম রেখেছেন।
আফসোস করে ভাবতাম মানুষের কত সুন্দর সুন্দর নাম! কিন্তু এতকাল পরে আমার
নামটা সৌন্দর্যমন্ডিত হয়ে উঠল।
অপূর্ব লিখলো, সেটা কিরকম ?
আমার নামটা যখন তোমার মুখে শুনি, তুমি যখন আমাকে মোহিনী বলে ডাকো মনে হয় এর
চেয়ে মধুর কোন নাম নেই দুনিয়াতে। আমি আর আমার নামটা তখন স্বার্থক হয়ে উঠি।
ফেসবুকের চ্যাটিং বক্সে চলতে থাকে কথার মালা। সারি সারি কথা, মুহুর্মূহু
কথা। সময় ফুরিয়ে যায় দ্রুত। এখানে আসলেই যেন একটা দনব পৃথিবীর সমস্ত সময়
গোগ্রাসে গিলতে থাকে । শুধু এখানে নয়, অপূর্ব’র সাথে কাটানো প্রতিটি
মুহুর্তই এমন। যেন আসলো আর গেল। পৃথিবী থেকে ভালোলাগার মুহুর্তগুলো এভাবেই
দ্রুত ফুরিয়ে যায়। তবু মন ভরে না। কিছুতেই ভরে না । একটা অপূর্ণতা হ্্রদয়ের
কোণে বসবাস করে সারাক্ষণ। কেন তোমাকে চিরদিনের মত করে পেলাম না। কেন তুমি
শুধু আমারি হতে পারলে না। আমার সমস্ত ভালোবাসা তোমাকে দিয়েও কেন তোমাকে
নিয়ে আমার দুনিয়া সৃষ্টি করতে পারলাম না। আরো কতটা ভালোবাসলে সৃষ্টিকর্তার
কাছে হ্্রদয়ের সততার প্রমাণ মিলবে!
মোহিনী লিখলো, ডিনার করেছো ?
হ্যা করেছি এইমাত্র। তুমি?
আমিও করেছি। আচ্ছা এখন বলো, নীলাকে কেমন দেখলে?
দেখেছি খারাপ না।
খারাপ না মানে কি? তোমার পছন্দ হয়েছে কি হয়নি সেটা বলো।
জানি না।
জানি না মানে কি?
এত কথার মানে বলতে পারবো না।
তার মানে কি নীলাকে তোমার ভালো লাগেনি?
ভেবে দিখিনি।
তাহলে কখন ভাববে?
সেটাও জানিনা।
আজবতো তুমি! এ পর্যন্ত নয়টা মেয়ে দেখালাম তোমাকে। একটাকেও তোমার পছন্দ হলো
না। আসলে তুমি কেমন বউ চাও বলোতো?
অপূর্ব বলল, আর কতবার বলব একই কথা।
কতবার বলেছ তুমি?
তোমার সাথে জীবনে প্রথম যখন কথা হয়েছিল তখনিতো বলেছিলাম তোমার মত একটা বউ
চাই আমার। ঠিক তোমার মত।
আমার মত কোথায় পাবে? তারচে আমাকেই নিয়ে যাওনা।
সেটা পারলে কি আর না নিয়ে এভাবে জ্বলি?
সত্যি করে বলোতো নীলাকে তোমার ভালো লাগেনি?
সবই ঠিক আছে কিন্তু কোথায় যেন কী নেই। ঠিক মিলাতে পারছি না কোথায় কিসের
অভাব। এমনিতে ভালোই। কিন্তু তোমার মত না। একটুও না।
মোহিনী বলল, তাহলে কি ধরে নেব নীলাকেও তোমার পছন্দ হয়নি?
হতে পারে।
“অপূর্ব’র জন্য পাত্রী খোঁজার দায়িত্বটা মোহিনীর উপরই পড়েছে। দায়িত্বটা
দিয়েছে স্বয়ং অপূর্ব। তার কারন দুটি। এক হলো, অপূর্বর কাছে মোহিনীই দুনিয়ার
সেরা পাত্রী। মোহিনীকে যার চোখে ভাল লেগেছে তার আর অন্য কোন মেয়েকে কখনোই
ভাল লাগবে না। অপূর্ব চেয়েছিল মোহিনীর আত্মীয় কিংবা বান্ধবী কিংবা পরিচিত
কাউকে বিয়ে করবে। তার ধারনা মোহিনীর পছন্দ হবে মোহিনীরই মত। মোহিনীর
রুচিবোধের উপর মুক্তর শতভাগ আস্থা।
আর দ্বিতীয় কারন হচ্ছে মোহিনীর মাধ্যমে কেউ মুক্তর জীবনে আসলে সেই মেয়ে ঘরে
থাকলেও মোহিনীর অবাধ আসা যাওয়া এবং মুক্তর সাথে সম্পর্কটা বহাল তবিয়তে
থাকবে। মেয়েটির আত্মীয় কিংবা বন্ধু হিসেবে মোহিনী তখন ওই পরিবারের একজন
বন্ধু হয়ে থাকবে।
এখন হয়তো দুজনেই এমনটা ভাবছে। ভবিষ্যতে সময়ের ব্যবধানে কখন কি হবে সেটা
নিয়ে কেউই ভাবতে চায় না।
মোহিনী এ পর্যন্ত নয়টি মেয়ে দেখিয়েছে অপূর্বকে। প্রতিবারই কিছু না কিছু বলে
মেয়েগুলোকে নাকোচ করে দেয় অপূর্ব। আজও তাই করল। মোহিনী বলে , আমার কাছে
তোমাকে দেখানোর মত আর কোন পাত্রীই নেই। আর তোমাকে তো আমি যেই সেই পাত্রী
দিতে পারি না। পাত্রী হতে হবে আমার অপূর্বর জন্য শতভাগ যোগ্য। যার কাছে
তোমাকে রেখে আমিও স্বস্তিতে থাকতে পারি। যেখানে তোমার কোন অযতœ না হয়। যে
তোমাকে এবং তোমার পরিবারকে ভালোবেসে আপন করে নিবে।
অপূর্ব বলল, তাহলে আর আমার জন্য পাত্রী খুঁজে লাভ নেই। কেননা তোমার মত করে
কোন মেয়েই আমাকে ভালোবাসবে না । ‘আর জগতে অপূর্বকে ভালোবাসার জন্য
সৃষ্টিকর্তা একমাত্র মোহিনীকেই সৃষ্টি করেছেন।’
অনেকবারই অপূর্ব এমন কথা বলেছে। আর প্রতিবারই ধন্য হয়ে গেছে মোহিনী। মনের
আবেগে দুটি চোখ ছলছল করে ওঠে। হ্্রদয়ের কম্পন যায় বেড়ে।
ঘড়ির কাটা রাত একটা ছুঁই ছুঁই। দুজনের কথা শেষ হয় না। রাতটা যেন ক্রমেই ছোট
হয়ে আসছে। তবু ঘুমাতে যেতে হবে । অপূর্বকে সকালে অফিসে যেতে হয়। দেরি করে
ঘুমালে ভোরে উঠতে দেরি হয়। তাই দুজনে রাত্রির শুভ ইতি টেনে বিদায় বলে যেতে
যেতেও আরো পনের মিনিট পার করলো। কম্পিউটার বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে বিছানায়
গিয়েও চোখে ঘুম আনতে আনতে আরো ঘণ্টা খানেক। যতক্ষণ জেগে থাকে মন জুড়ে, চোখ
জুড়ে ,কল্পনা জুড়ে শুধু মুক্ত বিচরণ করে। এপিঠ ওপিঠ করে রাত শেষ হয়ে আসে।
চোখের পাতা এক হয়ে আসলে স্বপ্নের দরজা খুলে আবার অপূর্ব এসে জুড়ে বসে। কত
কথা বলে তারা। কত খুনসটি, ঝগড়া-ঝাটি,মান-অভিমান, হাসা-হাসি, ভালোবাসা-বাসি।
রাত ফুরিয়ে ভোরের আলো ফোটে। অপূর্বকে মনের আকাশে সূর্যের মত উদিত করে নিয়ে
দিনের সূচনা করে মোহিনীা।
ঘুম ভাঙলে বিছানায় শুয়েই সেলফোনটা হাতে নিয়ে টেক্সট লিখে “শুভ সকাল।”ন’টায়
অফিসে রওয়ানা দেয় অপূর্ব । ঘর থেকে বেরিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে রাস্তায়।
গাড়িতে উঠে সিটে বসে আবার টেক্সট করে-“গাড়িতে উঠলাম, কেমন আছো, অফিসে
যাচ্ছি” । শুধুমাত্র মোহিনীর জন্যই এই ফোনটা বহন করে সে। “
অফিসে গিয়ে নাস্তা করে টেবিলে বসতেই ফোনটা বেজে ওঠে।
জ্বি ম্যাডাম বলেন।
শুরু হয় দিনের প্রথম কথা বলা। অবিরাম চলতে থাকে কিছুক্ষণ। যেখানে শেষ
হয়েছিল তারপর থেকে আবার শুরু। সব বলতে হবে তাদের, সব শুনতে হবে, জানতে হবে,
জানাতে হবে। এরপরও রয়ে যায় যেন অনেক কিছু বলার। বলার যেন শেষ নেই। কত কি
বলতে হবে, শুনতে হবে দুজনের। শুধু মনে হয় কেন সময়টা থমকে থাকে না, কেন এত
বাঁধা, এত সামাজিকতা, এত কাছে তবু কেন এত দূরে থাকা! এত ভালোবাসা তবু কেন
এত বিরহ! এত এত সুখ তবু কেন এত কষ্ট! কলিজা ছেড়া কষ্ট, সহ্য করতে না পারা
কষ্ট, সুখটাও তেমন। সহ্য হয় না। আসে আর ফুরিয়ে যায়। তবু চাই, জীবনে এই সুখও
যেমন চাই কষ্টটাও চাই। ভালোবাসার দহন, কাছে না পাওয়ার দহন, জীবনে ভালোবাসার
মর্ম শিরায় শিরায় উপলব্ধি করে মোহিনী। হ্্রদয়টা বলে আরো বেশি ভালোবাসতে
চাই। হ্্রদয়ের পরতে পরতে সৃষ্টি করতে চাই তোমার জন্য ভালোবাসা। ভালোবাসতে
বাসতে মরে যেতে চাই। আবার জন্ম নিতে চাই তোমার জন্য। “শুধু তোমারি জন্য
মোহিনী আর একবার জন্মাতে চায় এই পৃথিবীতে।”
এভাবেই দিনের শুরু থেকে রাত অব্ধি প্রতিটি ক্ষণ দুজন যে প্রান্তেই থাকুক
হ্্রদয়ের দরজা দুটি দুজনের জন্য খোলা থাকে সবসময়। কড়া নাড়লেই বেজে ওঠে
রিনিঝিনি কাকনের সুরে। প্রতি মুহুর্তের খোঁজ নেয়াটা যেন রুটিনে পরিণত
হয়েছে। সুযোগ পেলেই দেখা। ভালোবাসায় পূর্ণ হয় দুটি প্রাণ। তবুও যেন তৃপ্ত
নয়। তবুও দূরে চলে যেতে হয়। একটা অপূর্ণতা নিয়ে একাট দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ভিন্ন
বাড়িতে ফিরে যেতে হয় মোহিনীকে।
মোহিনী মনে মনে ভাবে এতগুলি মেয়ে দেখালাম তবুও অপূর্ব কাউকে পছন্দ করলো না।
এবার খুব ভালোকরে একটা মেয়ে দেখবো। যাকে দেখামাত্রই ওর পছন্দ হয়। অনেক ভেবে
চিন্তে খুঁজে বের করল একজনকে। মোহিনীর এক বান্ধবীর ছোটবোন। অসম্ভব সুন্দরী
এবং অত্যন্ত বিনয়ী মেয়ে। সমস্যা হলো মেয়েটাকে বিয়ে দেয়ার জন্য এখনো তার
পরিবার প্রস্তুত নয়। মেয়েটা লেখাপড়া ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। সেই মেয়েকে অনেক
বলে কয়ে শুধুমাত্র একবার অপূর্বর সামনে আসার অনুরোধ করে শেষ পর্যন্ত মোহিনী
সফল হলো।
দেখা করতে মেয়েটার ইউনিভার্সিটিই যেতে হলো। সেখানে ওদের জন্য দশ মিনিট সময়
অনেক কষ্ট করে যোগাড় করেছে মেয়েটা।
কফি হাউজে বসে আশে পাশের ছাত্রছাত্রীর দিকে তাকাচ্ছে মোহিনী। এমন ভার্সিটি
লাইফ তারও ছিল। তবে সে এখনকার মেয়েদের মত জীবনটা উপভোগ করার কোন সুযোগই
পায়নি। কিছু দৃশ্য তার ভালো লাগছে, কিছু আবার একেবারে বেহেল্যাপনা মনে
হচ্ছে। মনে মনে ভাবছে এসব ছেলে-মেয়েরা কেমন পরিবার থেকে এসেছে! স্বাধীনতার
মানে কি স্বেচ্ছাচারিতা?
হাতে একগাদা বই পুস্তক সহ কফি হাউজের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে মারিয়া।
বসতে বসতে সালামটা দেয়। মোহিনীর দিকে তাকিয়ে বলে, আপু দশ মিনিট পর আমার
একটা জরুরী ক্লাস শুরু হবে। সরি আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারছি না। মোহিনী পরিচয়
করিয়ে দেয় অপূর্বর সাথে। পুরো কফি হাইজে ছেলেমেয়েরা গিজগিজ করছে। আর
তারমধ্যে এই টেবিলটা সবচেয়ে বেশি ঝকঝক করছে। এটা অপূর্বর ভাবনা। এতগুলো
মেয়ের মধ্যে তার সামনেই বসে আছে জগতের সেরা মেয়েটি।
মোহিনী অপূর্বর দিকে একবার তাকিয়ে হাসিমুখে চারিদিকটা একবার দেখে নিল। মনে
মনে গর্ব করে বলছে , ‘এতগুলো ছেলের মধ্যে অপূর্বর সমকক্ষ একটাও নেই’।
মারিয়া না থাকলে এমন কথা মোহিনী অপূর্বকে সরাসরিই বলে দিত। তার কথা হল- ‘যা
কিছু আমি অনুভব করবো তা আমি প্রকাশও করবো। প্রকাশের মাধ্যমেই জগতের সবকিছু
আরো বেশি স্বার্থক হয়ে ওঠে। অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি পায়।’
নির্দিষ্ট সময়ের শেষে মারিয়া চলে গেলে ওরা দুজনও বের হয়ে রাস্তায় পড়ল।
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল অনেকটা দূর। অপূর্ব বলল, আর কত হাঁটবে
এবার রিক্সা নেই?
রিক্সা নিলেইতো পথ ফুরিয়ে যাবে নিমিষেই। তোমার সাথে আরো একটু বেশি সময়
থাকতে চাই। হাঁটলে আরো একটু বেশি সময় তোমাকে কাছে পাবো।
মুগ্ধতা ছুঁয়ে যায় অপূর্বকে। এ মুগ্ধতা শুধু মোহিনীর কথাতেই অনুভব করে সে।
অপূর্বও চায় এমন করেই মোহিনী তার পাশে থাকুক আরো একটু বেশি সময়, একটু নয়
অনেক বেশি সময়, যে সময় কখনো ফুরিয়ে না যায়। অনন্তকাল মোহিনীকে পাশে পেতে
চায় অপূর্ব। কিন্তু চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? কিছু চাওয়া অপূর্ণই থেকে যায়।
মোহিনীকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে অপূর্ব আবার অফিসে ফিরে যায়। আবার ডুবে যায়
কাজে। কিন্তু মনের আকাশে মোহিনী নামের তারাটি মিটমিট করে জ্বলতেই থাকে।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে মোহিনীকে মোবাইলে টেক্সট করে, প্রতিউত্তর পেয়ে মনে দোলা
দিয়ে যায় সুখানুভূতি। কখনো অপূর্বর দেরি হলে মোহিনী আবার টেক্সট পাঠায়।
খোচা দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘কাকে নিয়ে ব্যস্ত তুমি, আমার কথা ভুলেই গেছ মনে
হচ্ছে? নিশ্চয়ই কোন মেয়ের সাথে আড্ডা দিচ্ছ।
পরক্ষণেই জবাব আসে, হ্যাঁ ঠিক ধরেছ। আমার অফিসে ডজন খানেক সুন্দরী আছে।
ওদের দিকে তাকাতে তাকাতে আমি দুনিয়া ভুলে যাই। আর তাই তোমাকে এসএমএস করতেও
ভুলে যাই।
এই হলো শুরু। এরপর একটার পর একটা এসএমএস। রেগেমেগে একাকার। একসময় উত্তপ্ত
পানি আবার শীতল হয়ে আসে। দু:খ প্রকাশ করে । এভাবে ভালোবাসার ঠোকাঠুকিতে
হ্্রদয়ে ঝংকার বাজে প্রতিনিয়ত।
অফিসে বসেও কাজের ফাঁকে অপূর্ব উঁকি মারে ফেসবুকে। মোহিনীও বাসায় বসে
সেদিকেই পথ চেয়ে থাকে। কখনোই কোনদিক থেকেই বিচ্ছিন্ন হতে চায় না এই হ্্রদয়।
একই সাথে ফোনে কথা বলে আবার কম্পিউটারেও কথা চলে। ঘুম ভাঙে ভালোবাসার
মানুষটিকে মনে করে, তাকে নিয়েই সারাক্ষণ মনের আকিঁবুকি,
ফোন,ফেসবুক,ইন্টারনেট সব মাধ্যমেই তার সাথে যোগাযোগের জন্য মনটা প্রচন্ডরকম
আকর্ষিত হতে থাকে, ঘরে থাকলেও কাছে পেতে মন চায় আবার বিশেষ কোন প্রোগ্রামে
বাইরে যেতেও তাকেই পাশে রাখতে ইচ্ছা, অথবা তাকে নিয়েই কোন সাধারণ মুহুর্তকে
‘বিশেষ’ করে তোলা। সবশেষে আবার ঘুমাতে গেলেও তাকে নিয়ে কল্পনার সাগরে ভাসতে
ভাসতে চোখের পাতায় ঘুম নিয়ে আসা ,আবার ঘুমের ঘোরে স্বপ্নেও তাকে বাঁচিয়ে
রাখা। এভাবেই ফের জেগে ওঠা। এরই নাম হয়তো ভালোবাসা। ‘ভালোবাসলে তাকে কখনোই
কোনভাবেই মন থেকে ক্ষনিকের জন্যও বিচ্ছিন্ন করার সাধ্য কারো নাই।’
রাত এগারোটা
ফেসবুকের চ্যাটিংবক্স এ নাচতে থাকে লাল রং এর সংখ্যাটি। ক্লিক করতেই
অপূর্বর চোখের সামনে বিরাট ইতিহাস। এ ইতিহাসের রচয়িতা মোহিনী । এভাবেই
ইতিহাস লিখে রাখে সে। মনে হয় এটা মোহিনীর ব্যক্তিগত ডায়েরী। রাজ্যের যত কথা
সব মনের মাধুরী মিশিয়ে রং লাগিয়ে লিখে রাখে এখানে। অপূর্ব মনোযোগের সাথে
পড়ে নেয় লেখাগুলো। এরই মধ্যে ঠুকতে থাকে মোহিনী।
কি করো জান?
অপূর্ব লিখে-দাঁড়াও লেখাগুলো পড়ে নেই।
ওকে।
বলে ঠিকই, কিন্তু মোহিনী সময় দেয় না অপূর্বকে। তার লেখা সে ঠিকই লিখতে
থাকে। এত এত কথা প্রতিদিন কোথায় জমে থাকে তার মনে। অপূর্বর জানতে ইচ্ছা করে
মোহিনীর মনের ভান্ডারে আরো কত কথা আছে। তারও শুনতে মন চায়, জানতে ইচ্ছা করে
সবকিছু। মোহিনীর মনটাকে একেবারে উলোট পালোট করে পড়ার ইচ্ছাটা তারও প্রবল।
মোহিনীর মনের সম¯ত পরিসরটা নিঙড়ে দেখতে ইচ্ছা করে অপূর্বর। ওই মনে কি আছে,
কতটা প্রেম আছে, কার জন্য আছে এসব দেখতে ইচ্ছা করে একেবারে প্রত্যক্ষভাবে।
চোখের সামনে মোহিনীার হ্্রদয়টা মেলে ধরে যদি কোনদিন পরখ করতে পারতাম-এমনি
উচ্ছাস তার মনে।
কথার ট্রেন চলে অবিরাম।
মোহিনী বলে, এখন বলো কেমন দেখলে মারিয়াকে ?
মনে মনে বলে আজ নিশ্চয়ই মারিয়াকে পছন্দ হয়েছে অপূর্বর। মারিয়া এমন মেয়ে যে
পছন্দ না হয়ে পারেই না। তাই উত্তরটা জানতে অধীর হয়ে অপেক্ষা করে সে।
অপূর্ব বলে, তোমার কেমন লেগেছে সেটা বলো।
আমারতো ভালোই লাগছে।
তাহলে আমারো তাই।
কয়েক মিনিট কারো কোন কথা নেই।
অপূর্ব বলে, কি ব্যাপার চুপ হয়ে গেলে যে? আছো নাকি নাই?
বেশ শান্তভাবে জবাব দেয় মোহিনী-আছি।
মারিয়াকে পছন্দ হলে কি করবে? অপূর্ব জানতে চায়।
তোমার সাথে বিয়ের আয়োজন করবো আর কি করবো।
আয়োজনটা কবে করতে চাও তুমি?
মোহিনীর হ্্রদয়ের স্পন্দন যেন থেমে যাচ্ছে। কথার জবাব খুঁজে পাচ্ছে না সে।
মোহিনীকে চুপ করে থাকতে দেখে অপূর্ব বলে,
কোথায় হারালে মোহিনী?
হারাইনি, আছি।
তাহলে চুপ করে আছো কেন?
এমনি।
আচ্ছা বললে নাতো বিয়ের আয়োজনটা কবে করতে চাও।
তার মানে মারিয়াকে তোমার পছন্দ হয়েছে তাই না?
অপূর্ব বলে, তুমিইতো চাও মারিয়াকে যেন আমি পছন্দ করি। আর যেহেতু তোমার এত
পছন্দ আমার কি পছন্দ না হয়ে পারে ?
যাক তাহলে শেষ পর্যন্ত তোমার পছন্দ হলো। এখন তাহলে কাজটা আগানো যায় কি বলো?
সেটা তোমার ব্যাপার। এখন ম্যাডাম অন্য কথা বলেন। এই এক পাত্রী দেখার নাম
করে আমার কম সময়তো নষ্ট করলেন না আর আমার কম কথা খরচ করলেন না। যে সময়গুলো
আমি আপনাকে দিতে পারতাম।
পাত্রী দেখাতে যেয়ে তোমার সময় নষ্ট করেছি আমি? পাত্রীকি আমার জন্য দেখেছি
নাকি ?
কিছু কষ্ট, কিছু সুখ, মনের ব্যক্ত অব্যক্ত কথা বলতে বলতে রাতের দ্বিপ্রহর
পার হয়ে যায়। দুজনে দু প্রান্তে হাই তুলে। কিন্তু কম্পিউটার রেখে যেতে মন
চায় না কারো। তবু যেতে হয়। সময়টা ওদের জন্য কখনোই থেমে থাকে না। বরং দ্রুত
ফুরিয়ে যায়।
মোহিনীর চোখে কিছুতেই ঘুম আসে না আজ। অপূর্বর সাথে সম্পর্কের অতীত বর্তমান
ভবিষ্যৎ এমনভাবে মন ও মগজে তোলপাড় করছে যেন ঘুম চোদ্দ সীমানার ধারে কাছেও
নেই। এমন করেই রাত শেষ হলো । ফজরের আজানটাও স্পষ্ট শুনতে পেল মোহিনীা।
ইচ্ছা করছে মোবাইলে কল দিয়ে অপূর্বকে ডেকে তুলে। কথা বলে হালকা করে মনের
পাথর। কিন্তু সেটা পারে না মোহিনী। মন চাইলেও অনেক কিছুই তার পক্ষে করা
সম্ভব হয় না।
ভোরের আলোয় প্রকৃতি পরিস্কার হতেই পাখিরা কিচিরমিচির ডেকে উঠল। অনেক চেষ্টা
করেও মোহিনী একটুও ঘুমাতে পারলো না। বরং বিছানায় গড়াগড়ি করতে আরো অস্বস্তি
লাগছিল। পাশের মানুষটা তখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে মোহিনী। দরজা খুলে বাইরে আসতেই ঠান্ডা অনুভূত হলো। এখন
ফাগুন মাস। ভোর বেলাটা তাই এমন মিষ্টি। শান্ত।
এক কাপ চা নিয়ে বারান্দার চেয়ারটাতে বসে মোহিনী। সারারাত না ঘুমানোয় মাথাটা
কেমন ঝিমঝিম করছে। ভাবলো একবার গোসল করে নেই। তাতে শরীরটা ভালো লাগবে হয়তো।
গোসল করে দিনের কর্মপ্রক্রিয়াতে যোগ দিয়ে কিছুতেই কোনকিছুতে মন লাগাতে
পারছে না সে। মারিয়াকে পছন্দ হয়েছে অপূর্বর। খবরটা তার কাছে খুশির নাকি
বেদনার! সে ই তো মারিয়াকে দেখিয়েছে অপূর্বকে, তাহলে এমন অস্থির লাগছে কেন!
সকাল এগারোটায় ঘর থেকে বেরোল মোহিনী। আজ সারাদিন অপূর্বর সাথে থাকবে। আগে
থেকে রান্নাকরে গোপনে ব্যাগে ভরে নিয়েছে অপূর্বর জন্য কিছু পছন্দের খাবার।
ছুটির দিন তাই দিনটাকে স্পেশিয়াল করে তুলবে দুজন মিলে। বাসার কাছাকাছি
যেতেই রাস্তায়ই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো অপূর্বকে। সকালের স্নিগ্ধ রজনীগন্ধার
মতই শুভ্র স্নিগ্ধ অপূর্ব। মুখে লেগে ছিল মিষ্টি হাসিটা। মোহিনীর কাছে মনে
হয়‘ এই হাসি দিয়েই অপূর্ব জয় করে নিতে পারে বিশ্বকে’। সেই হাসি দিয়ে অপূর্ব
জয় করেছে মোহিনীকে। মোহিনী আসবে তাই নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই উঠে পড়ে
অপূর্ব। সময় গুণতে থাকে ।
কথা হয় অনেক বিষয়ে। তারমধ্যে এক আধবার মারিয়া প্রসঙ্গ। বিষয়টা উপস্থাপন করে
মোহিনী। আবার নিজেই আশা করে অপূর্ব প্রসঙ্গটা বাতিল করে দিক, অন্তত আজকের
জন্য। না। একেবারে সারাজীবনের জন্য। অপূর্বর জীবনে মোহিনী ছাড়া আর কেউ
থাকবেনা। আর কাউকে এ ঘরে দেখতে চায়না মোহিনী। কাউকে অপূর্বর এত কাছে দেখতে
চায়না সে। অপূর্বর হ্্রদয়ে মোহিনী ছাড়া আর কারো উপস্থিতি কল্পনাতেও দেখতে
চায়না সে। মোহিনী নিজেকে স্বার্থপর ভাবে। স্বার্থপরের মত আগলে রাখতে চায়
তার ভালোবাসার মানুষটিকে। অপূর্বর জীবনে আর কেউ আসলে এভাবে তার জীবন থেকে
হারিয়ে যাবে সুখের চিত্রগুলো। এমন করে অপূর্বর বুকের জমিনে নিরাপদে নিভৃতে
আশ্রয় নিতে পারবে না সে। মোহিনী বড় বেশি হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। আরতো কোন কিছু
চায়না সে। পৃথিবীতে এত এত মানুষ, কাউকে নিয়েতো ভাবতে চায়না সে। কারো জন্য
পরোয়া নেই। দুনিয়ার এই একটি মাত্র মানুষটিকে সে চায়, নিজের মত করে চায়। এই
একটি মানুষের হ্রদয়ের পুরো অংশটা জুড়ে থাকতে চায়। ‘আর সব কিছুর বিনিময়ে এই
একটি মানুষের জন্য বেঁচে থাকতে চায় সে।
কিন্তু চাইলেই তো পাওয়া যায়না। অপূর্ব তার কোনদিনই হবেনা। কোনদিন হওয়ার নয়।
অপূর্ব চিরকালই দূরের নক্ষত্র। মুক্ত কোনদিন মোহিনীকে দুনিয়ার কাছ থেকে
ছিনিয়ে নিবে না। কখনো না।
মোহিনী ভাবে,আমিতো প্রয়োজনের সময়ে মুক্তকে সময় দিতে পারিনা। মাঝে মাঝে
অপূর্বর অনেক কষ্ট হয়। সমাজ সংসারের খাতিরে অপূর্বকে অবশ্যই সংসারী হতে
হবে। কাউকে না কাউকেতো বিয়ে করতেই হবে। আমি স্বার্থপর হতে চাই না। অপূর্বর
জন্য আমি সব সহ্য করবো। নিজের ভালোবাসাকে না হয় আর একজনের হাতেই তুলে দিব ।
অপূর্বর ভবিষ্যৎ থমকে দেয়ার কোন অধিকারই আমার নাই।
নিজেকে কঠিন মানুষে পরিণত করার অ্িঙগকার করে মোহিনী। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে
এভাবে নিজের মনটাকে সংকীর্ণ করবে না সে। সবকিছু উজাড় করে দিবে অপূর্বকে।
এমনভাবে অপূর্বর বিয়ের আয়োজন করবে যেন পৃথিবীতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। না হয়
থাকলোই কেউ অপূর্বর ঘরে-মনে। তাতে কী? মোহিনী কি কম পেয়েছিল? মোহিনীর মন
থেকে কি অপূর্বর প্রতি ভালোবাসা কমে যাবে? কখনোই না। ভাবনা চিন্তার শেষে
একদিন অপূর্বর কাছে জানতে চায়-
আমি কি মারিয়ার মায়ের কাছে বলবো তোমার কথা?
অপূর্ব চুপ করে থাকে। তারপর বলে, কি বলবে?
কেন ,তোমার কথা বলবো। তুমি মারিয়াকে পছন্দ করেছ সেটা বলবো।
কথা হয় অপূর্বর ঘরে বসে। অপূর্ব বিছানা থেকে উঠে বসে। তারপর বলে, সত্যিকি
তুমি চাও আমি মারিয়াকে বিয়ে করি?
হ্যা, চাইতো। কেন তোমার কি মনে হয় আমি চাই না?
আমার যা মনে হয় তা কি আমি করতে পারি?
অবশ্যই পারো। বলো তুমি কি চাও?
আমি কি চাই সেটা পরে হবে। এখন বরং একটু বাইরে থেকে আসি।
মোহিনী বলল, এখন আবার কোথায় যাবে?
কিছু খাবার নিয়ে আসি। দুজনে একসাথে খাবো । তুমি বসে বসে টিভি দেখতে থাকো।
আমি যাবো আর আসবো। ভয় পেলে ফোন দিও। দরজায় আমি তালা দিয়ে যাই। তুমি থাকো।
অপূর্ব বাইরে চলে গেলে মোহিনী পুরো ঘরটা দেখে নিল। ছুটির দিন অপূর্বকে
নিজের কাজগুলো করতে সময় না দিয়ে নিজে এসে বসে রয়েছে। কাপড় চোপড়গুলো গুছাতে
শুরু করল মোহিনী। বিছানার পাশের টেবিলটা গুছাতে গিয়ে অপূর্বর নীল মলাটের
ডায়েরীর ভেতর থেকে কলমটা নিচে পড়ল। এই ডায়েরীটা মোহিনীর চেনা। নববর্ষ
উপলক্ষ্যে মোহিনীই এটা অপূর্বকে দিয়েছিল। অপূর্ব মোহিনীকে নিয়ে অনেকগুলো
কবিতা লিখেছে এই ডায়েরীতে। মাঝে মাঝে অপূর্ব নিজে সেসব কবিতা পড়ে শুনাতো।
কলমটা জায়গামত রাখতে যেয়ে ডায়রীর পাতায় মোহিনী নিজের নামটা গোটা গোটা
অক্ষরে দেখতে পেল। লেখাটা পড়ার লোভ সামলাতে পারলনা সে। বিছানার উপর ডায়রীটা
রেখে পড়ে ফেলল কয়েকটি পৃষ্ঠা। যে পৃষ্ঠাগুলো শুধু মোহিনীকে নিয়েই লেখা।
মোহিনীকেই বলা-
মোহিনী,
আমি কখনোই তোমার মত করে প্রকাশ করতে পারিনা, বলতে পারিনা আমি কি চাই। আমি
আবেগ দিয়ে নয়, বাস্তবতার নিরিখে দুনিয়াকে দেখতে চাই। তোমার খাঁচা থেকে আমিই
তোমাকে বের করে নিয়ে এসেছিলাম আমার দুনিয়াতে। আমার আকাশে তোমার পাখা মেলে
উড়ে বেড়ানোর অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছি। তোমাকে আমি সত্যিকার মোহিনীরূপে দেখতে
চেয়েছি। তুমি জানোনা তুমি আমার জীবনটা কতখানি বদলে দিয়েছ। তোমাকে অনেক কিছু
না বললেও তুমি বুঝতে পারো আমার না বলা কথা। তেমনি আমিও বুঝতে পারি তোমাকে।
আমার মনে হয় তোমার শ্বাস-প্রশ্বাসের ভাষাও আমি যতটা বুঝি তুমি নিজেও তা বুঝ
না।
মোহিনী, তোমার কষ্টগুলো তুমি যতখানি অনুভব করো তারচেয়ে অনেক গুণ বেশি আমি
অনুভব করি। চোখের পানি পুরুষের শোভা নয়। তাই আমি সেটাও দেখাতে পারি না।
তুমিতো একজনের সংসারে আছো। সেখান থেকে আমাকে মন প্রাণ উজাড় করে দিয়ে
ভালোবেসে যাচ্ছ। সবকিছু করছো আমারি জন্য। আমিও যতটা পারি তোমাকে ভাল রাখতে
চেষ্টা করি। সমাজের খাতিরে আমরা দুজন এই জীবনে এক হতে পারবো না। কিন্তু মনে
মনে তুমি-আমি বহু আগেই এক সত্ত্বা হয়ে গিয়েছি। তোমার জীবনের কষ্টগুলো আমি
মুছে দিতে চেয়েছি। এখনো চাই। তুমি আমাকে কতখানি চাও সেটা বলার অপেক্ষা
রাখেনা। আমার হ্্রদয় এমন অবুঝ নয় যে একজন মোহিনীর মনটা পড়তে পারবে না আমি।
মোহিনী, তোমার বর্তমান অবস্থানে রেখেই আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। সেখান
থেকে তোমাকে ছিনিয়ে আনার জন্য নয়। যখন তোমাকে ভালোবাসি অবস্থাটা যে এমন হবে
একটুও বুঝিনি। ভেবেছিলাম আমার জীবনে যে খুশি সে আসুক। তুমি যেমন ছিলে তেমনি
থাকবে। তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা এমনি থাকবে। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি অনুভব
করি তুমি আমার জীবনের সাথে কতটা নিবিড়ভাবে মিশে গেছ। তোমাকে কিছুতেই আমি
দূরে রাখতে পারবোনা। বিয়ে সংসার এসব সামাজিক প্রক্রিয়া। সামাজিকতার খাতিরে
আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম । বিশেষ করে আমার মা-বাবার জন্য। কিন্তু আমি
কিছুতেই ভেবে কুল পাচ্ছি না, যে হ্্রদয়ে তোমাকে রেখেছি, যেখানে তুমি ছিলে
একেবারে আমার। যে ঘরে তোমাকে নিয়ে থেকেছি, সেখানে আর কাউকে আমি কি করে
স্থান দেই। তুমি হয়তো কষ্ট করে সহ্য করে নিবে এক সময়। কিন্তু ঐটুকু কষ্ট
আমি তোমাকে দিতে পারবো না কখনোই। আমি হয়তো বিয়ে করে সংসার সাজাতে পারবো ।
কিন্তু তার ফলে তুমি যে কষ্ট পাবে সেটা আমি কিছুতেই সইতে পারবো না। মোহিনীর
জীবনে অপূর্বর আগমন কষ্ট দিতে নয়,কষ্ট মুছে দিতে ।
মোহিনী তুমি আমার সংসার গুছিয়ে দিতে আমাকে একটি বউ দিতে চেয়েছ । যে আমাকে
ভালোবাসবে, আমার পরিবারকে ভালোবাসবে, আমার যতœ নিবে। তুমি তোমার পরিচিত
জগতে আমার জন্য উপযুক্ত একটি পাত্রী খুঁজেছ। আজ পর্যন্ত যতগুলি পাত্রী
আমাকে দেখিয়েছ তারা প্রত্যেকেই আমার বউ হবার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু আমি
তাদের কাউকেই বিয়ে করতে পারবো না। কথাটি আমি তোমাকে মুখেই বলতে পারতাম।
কিন্তু কেমন করে বলব তাই বলি বলি করে বলা হয়নি। তাই আজ আমি এই ডায়রীতে লিখে
তোমাকে আমার মনের কথাটি জানাতে চাই। আমি জানি তুমি এই লেখাটা এখন পড়ছ। তুমি
ডায়রীটা পড়বে সেজন্যই আমি তোমাকে সেউ সুযোগ দিয়ে বাইরে গিয়েছি। আমি আগেও
বলেছি তোমাকে আমার চেয়ে ভাল কেউ বুঝে না। আমি এটাও দেখতে পাচ্ছি তুমি
ডায়রীটা পড়তে পড়তে ভীষণ আবেগী হয়ে পড়ছো। তোমার হ্্রদয়ের স্পন্দন বেড়ে
যাচ্ছে, একটু পর তোমার কান্না পাবে এবং তখন আমি এসে তোমার চোখের পানি মুছে
দিব।
মোহিনী, তুমি আমাকে এক একটি পাত্রী দেখিয়েছ। তুমি আন্তরিকতার সাথেই চেয়েছ
আমি যেন ভাল একটা বউ পাই। কিন্তু কখনোই চাওনি যে আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কোন
মেয়েকে বিয়ে করি, সংসার করি। অন্য কোন মেয়েকে তোমার মত করেই আপন করে নেই ।
এটা তোমার দোষ না। আমাকে তুমি ভালোবাসো বলেই এমনটা ভাবো। আমার ক্ষেত্রেও এই
স্বার্থপরতা আছে। তুমি যখন রেস্তোরা ,পার্ক, ভার্সিটিতে ওইসব পাত্রীদের
দেখাতে আমাকে নিয়ে যেতে আমি না করতাম না। আমি তোমাকে খুশি করতে তোমার কথামত
সব জায়গাতেই যেতাম। দেখতে চেয়েছি তুমি কতটা ভাবো আমার জন্য। আমার কথা ভেবে
তুমি কতটা সুখি হতে পারো। তোমাকে সুখি করতেই আমি ওইসব মেয়েদেরকে দেখতে
যেতাম। কিন্তু আমি খুব ভাল করেই বুঝতাম তুমি ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছ। এটা
এমন এক কষ্ট যা তুমি নিজের ভেতর চেপে রাখতে, আমাকেও প্রকাশ করতে না আমি
কষ্ট পাব বলে। কিন্তু আমি বুঝতাম।
তুমি বারবার ঘড়ি দেখতে। হয়তো দুনিয়া বুঝতো তুমি কারো জন্য অপেক্ষা করছো।
কিন্তু আমি বুঝতাম তোমার অপেক্ষাটা কিরকম। তুমি এজন্য ঘড়ি দেখতে যে আমার
সাথে কাটানো সময়টা কতখানি শেষ হয়ে গেল। যেন মেয়েটা আরো একটু পরে আসে। তুমি
এজন্য ঘড়ি দেখতে যে আমাদের সময়গুলো পাগলা ঘোড়ার মত কতটা দ্রুত কেন ফুরিয়ে
যায়,কেন ফুরিয়ে যায়। তুমি সময়কে আটকে রাখতে চাইতে। তুমি মোবাইল চেক করতে আর
আশা করতে যেন ওই মেয়েগুলো কোন বার্তা পাঠায় ‘আপু আমি আসতে পারছি না’। আমি
তোমার মনের ভাষা বুঝতে পারতাম। আর বুঝতে পেরে ধন্য হতাম। কেননা পৃথিবীতে
এমন কোন পুরুষ নেই, যে তোমার মত মেয়ের এমন ভালোবাসা পেয়ে নিজেকে গর্বিত মনে
না করে।
তুমি চেয়েছো আমি যেন তোমার দেখানো মেয়েগুলো থেকে একজনকে বিয়ে করি। কিন্তু
আমি জানি আমি যদি ওই মেয়েদের কাউকে পছন্দ করতাম বিয়ে করার কথা বলতাম তুমি
বাইরে খুশি হওয়ার ভাব করলেও অন্তরে কষ্ট পেতে। কেননা তুমি কথনোই চাওনা আমি
তোমাকে ছাড়া আর কোন মেয়েকে ভালোবাসি। সর্বশেষ তুমি মারিয়াকে দেখালে। আমাকে
জিজ্ঞাসা করলে আমার পছন্দ হয়েছে কিনা। আমি আসলে মারিয়া কেন কোন মেয়েকেই
আমার বউ হিসেবে দেখিনি। কিন্তু আমার অনুমানটা কতখানি সত্য নিজেকে একবার
প্রমাণ করার জন্য আমি বলেছি হ্যাঁ মারিয়াকে আমার পছšদ হয়েছে। আর সাথে সাথে
আমি প্রমাণ পেয়ে গেছি। মোহিনী আমি যখন ফেসবুকে এসএমএস এ লিখেছি যে মারিয়াকে
পছন্দ হয়েছে বিয়ের আয়োজন করো, তুমি কিন্তু তখন একটি মুহুর্তের জন্য চুপ হয়ে
গিয়েছিলে। আমি দেখতে পেয়েছি তোমার ছলছল দুটি চোখ, আমি অনুভব করেছি তোমার
হ্্রদয়ের স্পন্দন তখন থেমে গিয়েছিল। তুমি কোন কথা বলতে পারছিলে না। এতে আমি
নিশ্চিৎ হয়েছি যে আমার অনুমান সত্য। আমি তোমার মনের ভাষা বুঝি।
আর এই কষ্টটা কিরকম কষ্ট সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে বুঝে। তুমি হয়তো জানোনা
এটা আমি কতটা অনুভব করি। তোমার সাথে কথা বলতে বলতে যখন তোমার দিক থেকে লাইন
কেটে যায় তখন আমি এক ধরনের কষ্ট পাই। তোমার হাজবেন্ডের অকস্মাৎ আগমনে তুমি
ফোন কেটে দিয়ে মোবাইল লুকিয়ে রাখো। তখন আমার যে কষ্ট হয় সেটা কখনো তোমাকে
বলি না। কারন আমিতো তোমার অবস্থাটা বুঝি। তারপরেও কখনো কখনো ভাবি কেন
মোহিনী শুধু আমার হলো না। কেন মোহিনী আমাকে ছাড়া আর একজনের পাশে ঘুমায়, কেন
মোহিনী শুধু আমার জন্য সবকিছু বিলিয়ে দেয় না। যখন রাতের বেলা ফেসবুকে কথা
বলতে বলতে তোমার ঘুমের সময় হয় তখন আমার এক ধরনের কষ্ট হয়। এটা ভেবে কষ্ট হয়
যে তখন তুমি তার পাশে শুয়ে আছো। কেন তার কাছে তোমাকে যেতে হয়। কেন তুমি
আমার কাছে আসো না। এসব ভেবে আমি কষ্ট পাই। মোহিনী আমিও অনেক স্বার্থপর।
আমিও তোমাকে কারো সাথে শেয়ার করতে পারি না। আমারো অনেক কষ্ট হয়। আর কষ্ট
পাই বলেই আমি চাই আমার মত এই কষ্টগুলো যাতে তুমি কোনদিন না পাও। কারন আমি
জানি এটা কতটা অসহণীয় কষ্ট। মোহিনী এসব দিক বিবেচনা করেই শুধুমাত্র তোমাকে
কষ্ট না দিতে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি জীবনে অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করবো
না। আমার বিয়ে হয়ে গেছে তোমার সাথে। আমি এটা ভাবতে পারি না যে আমার ঘরে
অন্য একটা মেয়ে থাকবে, আর তার জন্য তুমি যখন তখন আমার ঘরে আসতে পারবে না,
যখন তখন আমাকে ফোন করতে পারবেনা,রাত জেগে আমার সাথে ফেসবুকে কথা বলতে পারবে
না, ছুটির দিনে তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতে পারবো না, আমিও তখন আমার বউয়ের
আগমনে তোমার সাথে কথা শেষ না করেই লাইন কেটে দিতে বাধ্য হবো, তোমার সাথে
দেখা করতে হলে বউয়ের কাছে একশ টা মিথ্যা বলতে হবে। এসব ভেবে অনেক কষ্ট
পাচ্ছি। তোমার কিরকম কষ্ট হবে সেটা অনুভব করছি। আর তোমাকে সেসব কষ্ট দিতে
আমি কিছুতেই পারবো না মোহিনী। কোনদিন না। তাতে আমার ঘর সংসার না হলেও
কিচ্ছু আসে যায় না। আমার জীবনে যা কিছু পাওয়ার আমি পেয়ে গেছি। তোমাকে
পেয়েছি তোমার অকৃত্রিম ভালোবাসা পেয়েছি। এই নিয়ে বাকিটা জীবন সুখে থাকবো।
তুমি আর কখনো আমাকে বিয়ে করার কথা বলোনা। আমিও আর বলবো না তোমাকে আমার জন্য
মেয়ে দেখ। আমরা দুজন দুজনের জন্য সুখি হবো। এভাবেই হব। এই আমাদের ঘর আমাদের
সংসার।
মোহিনী, আমার মোহিনী, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আর ভালোবাসি বলেই তোমাকে
আজ সবকিছু বললাম। তোমাকে সারাজীবন এভাবেই পেতে চাই। এর বেশি আর কিছু পাওয়ার
নাই্। যদি সৃষ্টিকর্তার রহমতে কোনদিন দুনিয়াতে চমৎকার কিছু হয়ে যায়, সেদিন
যদি তুমি পুরোপুরি আমার হয়ে যাও তবে সেটা হবে আমাদের জন্য বিশেষ উপহার। আর
আমার মনের দরজা ঘরের দরজা তোমার জন্য চিরকাল খোলা রইল। এ ঘরে এই মনে তোমার
অবাধ বিচরণ থাকবে । যখন খুশি এসো, যখন খুশি যেও। পারলে চিরকালের জন্যও থেকে
যেতে পারো। তাহলেও আমি তোমাকে বরণ করে নেব। সমাজ সংসারের পরোয়া না করে তুমি
যদি আসতে পারো আমার নিতে কোন বাঁধা নেই। আর না পারলেও আমার আফসোস নেই। যা
আছি যেমন আছি অনেক ভালো আছি। আমার জীবেন মোহিনী ছিল মোহিনী আছে আর মোহিনী ই
থাকবে।
এইতো আমার কথা শুনে তোমার হ্্রদয়ে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে, অন্তর কেঁপে
কান্না পাচ্ছে, তোমার দুচোখ গড়িয়ে অশ্র“ পড়ছে। পিছন ফিরে দেখ আমি দাঁড়িয়ে
আছি তোমার অশ্র“ মুছে দেয়ার জন্য। আমার দিকে ফিরো মোহিনী। আমি তোমার
অপূর্ব। শুধুই তোমার। এই বুকে শুধু তুমিই থাকবে। নির্ভয়ে নিরাপদে
নিশ্চিন্তে তুমি এখানে ঘুমিয়ে থেকো। দুনিয়ার কেউ তোমার এই জায়গা নিতে আসবে
না।
তোমার ‘অপূর্ব’।
ডায়রির পাতায় মোহিনীর চোখের পানি টপটপ পড়ছে। ওটা হাতে নিয়েই পিছনে ফিরে
দেখে অপূর্ব দাঁড়িয়ে আছে । অপূর্বর চোখের দিকে তাকাতেই মিষ্টি একটা হাসি
দিয়ে মোহিনীকে বাহুর মধ্যে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। অপূর্বর আলিঙ্গনে মোহিনীর
আবেগ আরো উপচে পড়লো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে অপূর্বর বুকটা ভিজিয়ে
দিচ্ছিল। চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলো দুজন । কতক্ষণ যে এভাবে ধরেছিল কেউই তা
হিসেব করার প্রয়োজন মনে করলো না। পৃথিবীর সমস্ত সুখ এখন এইখানে। এই দুটি
হ্্রদয়ের আনাচে কানাচেও টইটুম্বুর হয়ে বিরাজ করলো ভালোবাসা । কারো মুখ ফুটে
আর কিছু বলার দরকার হলোনা। মোহিনীর চোখের পানি মুছে দিয়ে আদরে আদরে বরে দিল
অপূর্ব। এভাবেই পৃথিবীতে ভালোবাসা বেঁচে থাকে। ভালোবাসা বড় বেশি স্বার্থপর,
সবকিছু নিজের মত করে পেতে চায়। ভালোবাসলে মানুষ স্বার্থপর হয়ে ওঠে, তা শুধু
ভালোবাসার খাতিরেই।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|