[প্রথমপাতা]
|
ওইখানে যেওনাকো তুমি(১৫ পর্ব)
- মেহেরুন নেছা রুমা
-
মহিলার জন্য রুপারও মায়া হচ্ছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিশ্চয়ই
তাদের মধ্যে গন্ডগোল লাগবে। যে পুরুষ মেয়ের শিক্ষকের কাছে এমন প্রস্তাব
রাখতে পারে ,সে যে বাইরে গিয়ে কোন পর নারীতে গমন করে না তার কি নিশ্চয়তা
আছে ?
বিষন্ন মনে রূপা হোস্টেলে ফিরে আসে।
পড়াশুনা করতে ইচ্ছা করছে না আজ। একটা উপার্জনের পথ পেল আবার ছুটেও গেল। এখন
কি করা যায়। সুইটির বাবা যদি ঘরে ঢুকার সাথে সাথেই তাকে বেঁধে ফেলত, কি
করতে পারত রূপা। ভাবতে পারছে না সে। বড় রকম বিপদ থেকে আজ রক্ষা পেল।
বই নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে আজকের ঘটনাটি বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে।
পাশের বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে টুকটুক করে মোবাইলে কথা বলছে কনিকা। বাকিরাও
যার যার টেবিলে বসে পড়ছে। এ রুমে একমাত্র কনিকার পড়াশুনার কোন তাগিদ নাই।
সারাক্ষণই গায়ে বাতাস লাগিয়ে বেড়ায়। মাঝে মাঝে রূপা বললে বলে,আমার পড়াশুনা
করতে ভাল লাগে না।
কনিকা মোবাইলে কথা বলা শেষ করে রূপার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে ,আমি
সব খবর নিয়ে এসেছি রুপা। তুমি সারাদিন কোথায় ছিলে ? তোমার অপেক্ষায় থেকে
থেকে আমার যাচ্ছে তাই অবস্থা।
কেন ,কি হয়েছে ? কি খবর নিয়েছ ?
তোমার দেখছি কিছু মনে থাকে না ? সেই যে বিজ্ঞাপনটা। ওখানে গিয়েছিলাম। এলাহি
ব্যাপার স্যাপার বুঝলে ? আমি তো ঠিক করেই ফেলেছি কালই তুমি আর আমি বায়োডাটা
দিয়ে আসব। তুমি না যেতে চাইলে বায়োডাটা আমাকে দিও। আমিই দুজনেরটা দিয়ে আসব।
কনিকা তোমার মাথা থেকে ওটা যায়নি দেখছি। আমি যে যাব সেটা তোমাকে কে বলছে ?
আরে বলবে আবার কে ? তুমি একবার ভাব তো আমরা দুজন মডেল হয়ে যাব। কত্ত টাকা
উপার্জন হবে আমাদের। দেশ বিদেশের সবাই আমাদেরকে চিনবে। মানুষ অটোগ্রাফ নিতে
লাইন দিবে। আমার তো ভাবতেই কেমন লাগছে ! আমিতো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তুমি
চান্স পেয়েই গেছ। তোমার ফিগার তো একেবারে মডেলদের মতই। পছন্দ তাদের না হয়ে
পারেই না।
কিন্তু আমার যে আগ্রহ নাই কনিকা। আমি ঢাকা এসেছি পড়াশুনা করতে । মডেল হতে
না।
শোন রুপা। তুমি মডেল হলেও পড়াশুনা করতে পারবে। আমি তাদের সাথে সব আলাপ করে
এসেছি। পড়াশুনা করেও অনেকেই অভিনয় করছে। কোন অসুবিধা হয় না। আর প্রতিদিন তো
আমাদের কাজ থাকবে না। কোন একটা বিজ্ঞাপনে চান্স পেলেই আমাদের আর টাকার কথা
ভাবতে হবে না। তোমার বাড়ি থেকে আর টাকা আনতে হবে না। বরং তুমি বাড়িতে দিতে
পারবে। আর এখন ভাল ভাল পরিবারের শিক্ষিত মেয়েরাই এসব করছে। ওখানে গেলেই যে
আমাদের হয়ে যাবে তা তো না। একবার গিয়ে দেখি ই না। তুমি এমন করছ কেন রূপা ?
চলো না যাই।
আচ্ছা যাব। এবার চুপ করো,আমি একটু পড়ব।
সত্যি যাবে ? যাবে সত্যি আমার সাথে ? বলেই রূপাবে ধরে গালে একটা চুমু দিল।
রুপা চমকে গিয়ে বলল,তুমি তো দেখছি মডেল হওয়ার স্বপ্নে পাগল হয়ে গেছ।
একটা কথা বলি রূপা। আমরা যে ওখানে যাব সেটা কাউকে বলো না । পরে হতে না
পারলে লজ্জা করবে। তার চেয়ে বিষয়টা তোমার আর আমার মধ্যেই থাকুক।
রেহানা আপুকে একবার বলে দেখি ,সে কি বলে।
আরে না না । তাকে তো বলাই যাবে না। সে শুনলে প্রথমেই তোমাকে ভেটো দিবে।
তাকে বল না রূপা। আমরা বায়োডাটা দিয়ে আসি,তারপর ডাকলে ইন্টারভিয়্যুটা
দেই,টিকে গেলে সবাইকে বলব,আর না হলে চুপচাপ থাকব। এখনি কাউকে বলাবলির কি
দরকার।
রূপাও দেখল কনিকার কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সে যখন এত করে বলছে তো
দেখা যাক না কি হয়।
কনিকার কথা মত পরদিন দু’জনের বায়োডাটা নিয়ে কনিকা একাই গেল সেখানে। রূপার
ক্লাস ছিল বলে সে যায়নি ।
নীরার চিঠি এসেছে। অনেক দিন পর নীরার চিঠি এল। চিঠিটা নিয়ে ঘরে ঢুকেই খাম
ছিড়ে পড়া শুরু করল রূপা।
রুপা,
কেমন আছিস ? পড়াশুনা ঠিকঠাক চলছে তো ? শহরের অলিতে গলিতে লুকিয়ে থাকে নানা
রকম ফাঁদ। তার বেশির ভাগই নারী ধরার ফাঁদ। খুব সাবধানে চলাফেরা করবি। মনে
রাখিস,একবার কোন ফাঁদে পা দিয়েছিস তো মরেছিস। এ সমাজটা বুঝে শুনে নিজেকে
রক্ষা করে চলা অনেক কঠিন ব্যাপার। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া
একুশ জন নারীকে উদ্ধার করেছি । দেশের মিডিয়াগুলোতে খবরটা এসেছিল । কত
ভদ্রঘরের এক একটা মেয়ে ফাঁদে পড়ে জীবন নষ্ট করেছে। অন্ধগলি থেকে আর বের হতে
পারে না তারা। নিজের চোখে এসব দেখে বড়ই কষ্ট হয় আমার। আমি আগামী মাসের
শেষের দিকে ঢাকা আসব। তারপর সম্ভবত ঢাকাতে পোস্টিং হবে আমার । সেই চেষ্টাই
করছি। ঢাকা আসলে তোকে হোস্টেল থেকে বাসায় নিয়ে আসব। অসীমকে সব বলা আছে। তার
কোন আপত্তি নাই। সে নিতান্তই ভদ্রলোক। স্বভাব চরিত্রও ভাল। তোর কোন অসুবিধা
হবে না থাকতে।
রেহানার কাছে তোর টিউশনি সংক্রান্ত ঘটনাটির কথা শুনেছিলাম । সেই মেয়ের মা
নাকি তার স্বামীকে ছেড়ে চলে গেছে। ভালই করেছে মহিলা। এমন পুরুষের সাথে ঘর
করার কোন মানে হয় না। আত্ম সম্মান বলে একটা কথা আছে। বৌ এর অনুপস্থিতিতে
সুযোগ পেলেই অন্য নারীকে কু প্রস্তাব দেয়, সেই পুরুষের সাথে আবার কিসের
বসবাস !
ভাল করে পড়াশুনা করিস-এটা একটা সস্তা উপদেশ। তোকে সস্তা উপদেশ দিতে ভাল
লাগে না। আশা করছি খুব শিঘ্রই তোর সাথে দেখা হবে।
নীরা আপু।
বাবার কাছে বাড়ির খবরা খবর শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল রূপার। ওরা যেখানে
বসেছে তার উল্টো দিকের চেয়ারে আরো একটা মেয়ে তার বাবার সাথে বসে কথা বলছে।
কেউ কারোটা শুনছে না ,তবে একটু পর পর চোখাচোখী হচ্ছে।
কিছুদিন আগে হঠাৎ একদিন রাত দশটার সময় রূপক বাড়িতে এসে হাজির। প্রথমে তাকে
দেখে বাবা মায়ের কাছে এক প্রকার অচেনাই মনে হয়েছিল । এই ক’মাসে ছেলেটার কী
হাল হয়েছে। হাড়ের উপর চামড়া মোড়ানো দেহ ,সাথে মুখ ভর্তি দাঁড়ি গোফ । ময়লা
জামা কাপড় থেকে বোটকা গন্ধ ,আর সিগারেটের গন্ধে পুরো ঘরটাই ধোঁয়াশা হয়ে
গেল।
ঘরে এসেই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রূপক বলল , আমার দশ হাজার টাকা লাগবে । আজ
রাতের মধ্যেই টাকা নিয়ে চলে যেতে হবে ।
এসব কথাই রূপা হোস্টেলের ভিজিটিং রুমে বসে শুনছিল বাবার কাছ থেকে।
তারপর বাবা ? সে এতদিন কোথায় ছিল সেসব জিজ্ঞাসা করনি ? তারপর বাড়ি থেকে যে
টাকা এবং গহনা নিয়ে গিয়েছিল সেসব কি করেছে ?
বাবা বললেন , আমি সরাসরি তার সাথে কোন কথা বলিনি। তোর মাকে দিয়ে জিজ্ঞাসা
করিয়েছিলাম। কোথায় ছিল সে তা বলেনি। বলে আমাদের ওসব জেনে কি দরকার। আর বাড়ি
থেকে যে টাকা পয়সা এবং গহনা নিয়ে গিয়েছিল সেটা দিয়েই তো এতদিন চলছিল । এখন
যেই টাকা ফুরিয়ে গেছে অমনি এসেছে আবার ।
তারপর বাবা ?
তারপর কি ? তোর মাকে দেখি আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ছেলেকে মাদুর পেতে বসিয়ে
ভাত খাওয়াচ্ছে। তারপর ছেলেকে বলছে ,বাবা মায়ের উপর রাগ করে বাড়ি থেকে দূরে
থাকবি বাবা ? আমরা যা করি তোদের ভালোর জন্যই তো করি। তুই আর যাসনে বাপ
আমার।
কিন্তু তোর মায়ের কান্না আর আবদারের কোন দাম থাকেনি তোর ভাইয়ের কাছে। সে
মাথা নিচু করে ভাত খেয়ে গেল। দেখে মনে হয়েছিল কতদিন অভুক্ত ছিল । ভাত খেয়েই
বলে,বাবাকে বলো টাকাটা দিতে । আমাকে যেতে হবে। তখন তোর মা একটু রেগে গেল।
সে বলল, তোর জন্য কি তোর বাবা টাকা হাতে নিয়ে বসে আছে নাকি ? এতদিন কোথায়
ছিলি তার ঠিক ঠিকানা নাই,ঘর থেকে যে ছেলে টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে যায় তাকে
আবার টাকা দিতে যাব কোন দু:খে । আর টাকাটা আসবে কোথা থেকে শুনি ?
তারপর যেন বারুদে আগুন লেগেছে এমন করে সে ক্ষেপে গেল। সামনের খালি প্লেট
ছুড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,আমাকে টাকা দিবে কেন ? দিবে তো তোমাদের
মেয়েকে। তাকে শহরে রেখে পড়াচ্ছ,মাসে মাসে টাকা পাঠাচ্ছ। ভবিষ্যতে সেই
তোমাদেরকে দেখে রাখবে সেই আশায় তাই না ?
না ,তোমার বুঝতে ভুল হচ্ছে রুপক। ছেলে মেয়েরা ভবিষ্যতে দেখে রাখবে সেই
স্বার্থে বাবা মা তাদেরকে মানুষ করে না। ছেলে মেয়েরা নিজেরা যাতে ভবিষ্যতে
নিজেদেরকে দেখে রাখতে পারে সেজন্যই তাদেরকে বড় করে। বাবা মা সন্তানদের জন্য
বিনা স্বার্থেই সবকিছু করে। কিন্তু দ:ুখের বিষয় সন্তানরা কোনদিন সেসবের
মূল্য দেয় না।
তারপর বাবা ? সে কি রাতেই চলে গিয়েছিল ?
হ্যাঁ । রাগ দেখিয়ে আমাকে, তোর মাকে গালাগালি করে তখনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
তারপর থেকে তোর মায়ের শরীরটা ভাল না। আমি তো তাকে বুঝাই , এমন ছেলের জন্য
চোখের পানি কেন ফেলে সে। কেন শুধু শুধু ছেলের শোকে নিজেকে অসু¯্য’ করে
তোলে।
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন রুপার পরীক্ষা শেষ হতে আর কতদিন লাগবে। তৃতীয়
সেমিষ্টারের পরীক্ষা চলছে। আর দুটি পরীক্ষা শেষ হলেই রূপা একবার বাড়ি যাবে
বলে ভাবছে। রূপা বাবাকে বলল ,বাবা আমার একটা বান্ধবী আছে ,কনিকা। সে কোনদিন
লঞ্চে চড়েনি। আমি ভাবছি কনিকাকে আমাদের বাড়ি বেড়াতে নিয়ে যাব। সে লঞ্চে চড়ে
যেতে খুবই আগ্রহী।
আচ্ছা যেতে চাইলে নিয়ে যাস।
বাবা মেয়ের আলাপ চারিতা শেষ হলে রূপা রুমে গিয়ে পড়া শুরা করল।
শেষ পরীক্ষার দিন সন্ধ্যেবেলা রূপা রেহানার হোস্টেলে আসল। আজ রেহানার ছয়
বছর পর প্রোমোশন হয়েছে। তাই মনটা ভীষন ভাল। অফিস থেকে ফিরেই মনে মনে এক রকম
ভেবেছিল আজ রুপা আসবে। রুপাকে দেখে সেভাবেই বলল,আয় তোর জন্যই অপক্ষো
করিছলাম।
আমার জন্য অপেক্ষা মানে ? তুমি কি জানতে নাকি আমি আসব ?
জানতাম না ,তবে মন বলছিল আর আমিও তোকে মনে মনে চাইছিলাম।
কেন আপু ? কোন বিশেষ কিছু আছে নাকি ?
হুম,ছ’বছর পর আমার প্রোমোশন হয়েছে বুঝলি ? যে মেয়েটা আমার তিন বছর পর
চাকরীতে এসে আমার বস বনে গিয়েছিল সে মেয়েটা বসের খাঁচা ভেঙে ফুরুৎ করে আর
একজনের সাথে চলে গিয়েছে। তার উপর বস খুুবই বিরক্ত হয়ে এক রকম তার উপর জেদ
দেখাতে যেয়েই আমাকে পদোন্নতি দিল।
সেই মেয়েটা কোথায় গেছে ? আর তাতে বসের ই বা এত জেদ কেন ?
আরে বুঝলি না ,সে তো ছিল বসের কেনা ময়না পাখি। ক’দিন ধরেই পোষা ময়না পাখিটা
পাখা ঝাপটাতে শুরু করেছিল। হয়তো কোথাও তার জোড়া মিলিয়েছিল। আর সে কারনেই সে
বসের অবাধ্য হয়ে উঠল। গত সপ্তাহে চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে মেয়েটা চলে গেল।
আপু,এখন আপনাকে যে প্রোমোশন দিল তো আপনাকে আবার তার কেনা ময়না পাখি বানাতে
চাইবে না তো ?
এই তো তোর মাথায় বুদ্ধি খুলে আসছে। সেটা সে চাইবে না। আর আমি তো সেরকম
সুন্দরী নই। ওই মেয়েটা তার সাথে এমন করার পর বসের কিছুটা আত্মপলোব্ধি হয়েছে
যে আমাকে দীর্ঘদিন দরে সে বঞ্চিত করে আসছে। আর সেই বোধ থেকেই আমার
পদোন্নতি। এখানে ওই মেয়ের বেলায় যা ছিল আমার বেলায় সেটা না। আমারটা লিগ্যাল
প্রোমোশন।
তাহলে তো অনেক সুখবর আপু।
হ্যাঁ ,তাই তো তোকে আশা করছিলাম। চল দ’ুজনে আজ ইচ্ছা মত ঘুরে ফিরে রাতে
বাইরে থেকে খেয়ে আসি।
আমার তো আটটার মধ্যে রুমে যেতে হবে আপু। আজ তো আমি বলে আসিনি। আর আজ ছুটির
দিনও না।
এক কাজ কর। একটা ফোন করে বলে দে যে আজ রাতে তুই হোস্টেলে ফিরবি না। আমার
এখানে আছিস।
রুপার হোস্টেল কর্তৃপক্ষ রেহানাকে জানে। স্থানীয় অভিভাবকের নামের জায়গায়
রেহানার নামটিই দেয়া আছে । তাই রেহানার কাছে গেলে তাকে কোন কৈফিয়ৎ দিতে হয়
না।
রূপা রেহানার ফোন থেকেই হোস্টেলে জানিয়ে দিল যে আজ আসবে না।
ARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|