[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাস: ওইখানে যেওনা কো তুমি
 
 

- মেহেরুন নেছা রুমা -

 
তুলিদের বাড়ি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় উঠতেই মনে হল সন্ধ্যা নেমে এসেছে । আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল। শীতের শেষ বিকেলে নীল চাদরের মত কুয়াশা নেমে প্রকৃতিতে একটু আগে ভাগেই সন্ধ্যা এসে পড়ে। কোথা থেকে ইদানিং কিছু অচেনা ছেলে এসে সামনের স্কুল মাঠে ব্যাডমিণ্টণ খেলে। ওখান দিয়ে যাওযার সময় ওদের মুখ দিয়ে নানা ধরনের শব্দ বের হয়। তার মধ্যে কোনটা কথা,কোনটা শিস,কোনটা গানের কলি,আবার কোনটা কেবলি হুসহাস । মনে হয় হাস মুরগি তাড়াচ্ছে। কেউ বা আবার আয় আয় তি তি তি বলেও ডাক দেয়।
এদের সাথে এ পাড়ার ছেলেদের নতুন বন্ধুত্ব হয়েছে হয়তো বা। তাই তাদের নতুন আনাগোনা।
বড় বড় পা ফেলে নিচের দিকে তাকিয়ে রুপা মাঠ পার হয়। মনে মনে বলে ,বাড়ি যাবার পথে এই মাঠটা না থাকলে ভাল হত। ওদের হুসহাস ফিসফাস শব্দ শুনলে কেমন গা গুলিয়ে ওঠে।
শীতের একটা পুরো রাত পরিপূর্ণ ঘুমের জন্য যথেষ্ট। আজানের একটু পরই রুপার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম তো ভাঙ্গে , কিšতু আয়েশী শরীরটাকে টেনে নিয়ে মনটা চায় না এখনি লেপের মধ্য থেকে বের হয় । সপ্তাহের এই একটি দিনের শুরুটা রূপার কাছে বড়ই অপ্রিয়। সকাল সাতটায় স্কুলের ঘণ্টা বাজে। আর বাড়ি থেকে রওয়ানা দিতে হয় আরো এক ঘণ্টা আগে। পৌষ মাসের হাড় কাঁপানো শীতে সারা রাতের ওম হওয়া লেপের মধ্য থেকে বেরিয়ে সকাল হবার আগেই বুড়ো ঠাকুরের মত ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে কুয়াশা ঠেলে দেড় কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে যায় রূপা। পা’দুটি অবশ হয়ে আসে শীতে,হাতের আঙ্গুলগুলো বেঁকে আসতে চায় যেন। অর্ধেক পথ হাঁটার পর গা গরম হতে থাকে একটু একটু করে।
উঠি উঠি করা মনটাকে দমিয়ে রাখে রূপার আরাম পাওয়া শরীরটা। লেপটাকে আরো একটু টেনে দেয় কপাল পর্যন্ত। পা দুটি দ’এর মত করে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকে।
রান্নাঘর থেকে এসে ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে মা ডেকে ওঠেন ,ওরে রূপা এখনো শুয়ে আছিস ? স্কুলের দেরী হয়ে যাবে মা। তাড়াতাড়ি উঠে গরম ভাতটা খেয়ে নে।
স্কুল যখনি থাকুক গরম ভাত খেয়ে স্কুলে যাওয়া যেন একটা আইন এবং এই আইন মানতে এ বাড়ির স্কুলগামি সকলেই বাধ্য। কিন্তু এ বাড়িতে এই কাক ডাকা ভোরে আর কাউকেই স্কুলে যেতে হয় না। রপাকে ছাড়া।
রূপার বড় দু’ভাই রূপক আর রাসেল। একজন দশম শ্রেনী আর একজন সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র। বাড়ির কাছাকাছি একটি স্কুল আছে ,রূপার বাবা রূপাকে সেখানেই ভর্তি করাতে চেয়েছিল। কিন্তু রূপার ঐ এক জেদ ,পড়তে হয় তো সবচেয়ে ভাল স্কুলেই পড়ব ,না হয় পড়বই না।
পৌষের এই ভোর বেলা বড় দুটি ভাই যখন লেপের মধ্যে আরাম করে ঘুমিয়ে থাকে, আর রূপাকে বুড়ো ঠাকুরের মত ঠকঠক করে স্কুলে যেতে হয়, রূপা তখন মনে মনে বলে ,কাছের ঐ বেড়া ভাঙ্গা স্কুলে (রূপার কাছে সেটি বেড়াভাঙ্গা স্কুল,কারন ওটাতে ভাল কোন শিক্ষকও নাই,আর নাই ভাল ছাত্র ছাত্রীও) ভর্তি হলেই ভাল হত। আরামের ওম ছেড়ে উঠতে হত না। মনে মনে স্কুল কর্তৃপক্ষকে গালি দেয়। সব স্কুল সকাল এগারোটায় শুরু হয়,সপ্তাহের ঐ একটি হাটের দিন তার স্কুলটাই শুরু হয় সকাল সাতটায় । এটা কিরকম নিয়ম। হাটের দিন মেয়েদের স্কুল বলে হাটে লোকজন আসার আগে মেয়েদের চুপি চুপি স্কুলে যেয়ে আবার ঘরে ফিরে আসতে হবে কেন ? ঐ দিন ছেলেরা যেমন সময় মত তাদের স্কুলে যেতে পারে,মেয়েরা কেন পারবে না। রাস্তাঘাটে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায় বলে মেয়েদেরকে নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা !
মানুষের আনাগোনা কি,বলতে হয় পুরুষ মানুষের আনাগোনা। মানুষের বললে তো আবার মেয়েদেরও গণনায় ধরতে হয়। কিন্তু এ সমাজ তো মেয়েদের মানুষ বলতেই নারাজ। মেয়েরা হল ‘নারী জাতি’,যেন তারা মানুষ জাতি নয়। পুরুষদের স্পর্শ আর দৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্যইতো হাটের দিনে বিশেষ ব্যবস্থা। ভীরের মধ্যে স্কুলগামি মেয়েদের শরীরে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় কত রকমের যে স্পর্শ এসে পড়ে। মেয়েরা এসব মুখ বুজেই সহ্য করে যায়। যেন এটা মেয়েদেরই লজ্জা। কেন সে এই জনসমাগমে ঘরের বাইরে এল। সে কেন চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকতে পারল না। তাইতো যেদিন রাস্তায় পুরুষদের আধিক্য থাকবে মেয়েরা সকলের ঘুম ভাঙ্গার আগেই বাইরের কাজ সেরে ঘরে ফিরে যাবে।
রূপা এখন এসব একটু একটু বুঝতে পারে। কিছুদিন আগের একটি ঘটনা রূপার মনে পুরুষদের সম্পর্কে এক কঠিন ধারনার জন্ম দেয় ।
সবেমাত্র ষষ্ঠ শ্রেনিতে ভর্তি হয়ে কিছুদিন হল স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। কারো সাথে খুব একটা বন্ধুত্ব হয়ে উঠেনি এখনো। এখানের ছাত্র ছাত্রীরা দল বেঁধে পায়ে হেঁটেই স্কুলে যায়। রিকসা ছাড়া এ এলাকায় আর কোন যানবাহন নাই। গ্রামের ছেলে মেয়েরা প্রতিদিন রিকসায় চড়ে স্কুলে যাবে এই রীতি এখনো হয়ে ওঠেনি। কালে ভদ্রে কেউ শখ করে রিকসায় উঠে।
শিউলি ,কলি কাকলী ,তুলি,রাবেয়া,জলিদের মত অনেকের সাথে দল বেঁধে স্কুলে যেতে আসতে রূপার ভালই লাগে। কত রকম গল্প হয়,কত কি দেখা হয়। রাস্তার দু পাশের কোন দৃশ্যই তাদের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না। একজন দেখলেই সবাই তা দেখে । এ দুনিয়াটা বড় বিচিত্র। যা দেখে তাই ভাল লাগে। দেখার জিনিসেরও যেমন শেষ নেই ,তেমনি নেই কৌতুহলের শেষ । গল্প আর কথার ছলে পথের দূরত্ব তাদের কাছে ছোট মনে হয়। মনে হয় বাড়ি থেকে স্কুলটা আরো একটু দূরে কেন হল না। হাঁটতে হাঁটতে এক এক করে বন্ধুদের সংখ্যা কমতে থাকে।
তুলি রূপার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। একসাথে যাওয়া আসা ,বসা ,পড়া,গল্প করা । গল্পের বিষয় বস্তু সবই দু’জনের একরকম। রূপাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে একটু সামনের দিকে এগোলেই তুলিদের বাড়ি। এমনি করে অনেকের সাথে হাঁটতে হাঁটতে পথের শেষে শেষ সঙ্গী তুলিকে যখন তার বাড়ির সামনে বিদায় দিতে হল, ঠিক তখনি পিছন থেকে ডাক দিলেন আফজাল চাচা। হাটের থেকে রিকসায় করে বাড়ি আসছিলেন । উত্তর বাজারে তার কাপড়ের দোকান। রূপাদের বাড়ির সাথে লাগোয়া আফজাল চাচার বাড়ি ।
আফজাল চাচা বললেন ,রূপা মা উঠে এসো ,তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেই।
রূপা বলল, লাগবে না চাচা । আমি যেতে পারব।
আরে আসোনা ,আমিতো একাই যাচ্ছি।
খুব আন্তরিকতার সাথে চাচা যখন দু’তিনবার ডাকলেন, রূপা রিকসায় উঠল। মনে মনে বলে ভালই হয়েছে। বাকিটা পথ একা যেতে হত। এখন চাচার সাথে কত আরামে রিকসায় করে চলে যাব।
পাশে বসিয়ে চাচা এই কথা সেই কথা নিয়ে রূপার সাথে মিষ্টি করে গল্প করছেন। দাঁতের নিচে মিষ্টি পান মসলা চিবিয়ে মুখটা লাল করে বেশ রসালো করে কথা বলেন আফজাল চাচা। শুনতে বড় মধুর লাগে। কথার আগে পিছে ‘মা’ শব্দটি রূপাকে বড় কাছে টেনে নেয়।
সেই আফজাল চাচা স্নেহের পরশ মেশানো আদুরে ভাষায় রূপার সাথে কথা বলতে বলতে সাপের মত তার ডান হাতখানি বিচরণ করাতে চাইছে রূপার ছোট্ট শরীরখানির বাঁকে বাঁকে। পিছন থেকে হাত দিয়ে রূপার কোমরে কেবলি চাপ দিচ্ছিলেন। আর মুখে বলেই যাচ্ছে আদরের বুলি-আহারে এতটুকু মেয়ে এতখানি পথ হেঁটে এত কষ্ট করে স্কুলে যাচ্ছ। রোদে পুরে মা আমার কেমন কালো হয়ে গেছে ! আহারে বাছা খিদে লাগছে বুঝি ? খিছু খাবে রূপা মা ?
চাচা যতই কথা বলছেন আর হাতের কাজ করছেন রূপার শরীর ও মনে কী ভীষণ উদ্বেগ বয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে রিক্সা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে। ঘৃনায় যেন পেট গুলিয়ে আসতে চাইছে ।
চাচা বলছেন, আমি তো প্রতিদিনই বাজারে যাই। তুমি আমার সাথেই স্কুলে যেতে পার রূপা। রিকসায় করে তোমাকে পৌছে দিব মা। বলছেন আর রূপাকে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরছেন। এদিকে চেপে বসো না,পড়ে যাবে তো- এই বলে কাছে টেনে নিচ্ছে। রূপা কোন কথা বলতে পারছে না। এ মুহুর্তে ইচ্ছা করছে বুড়োর মুখে থুতু দিয়ে রিকসা থেকে নেমে যেতে। মনের ভেতর ঘৃনায় ক্ষোভে কড়মড়িয়ে ওঠে রূপা।
বাবার সাথে চাচার এত ভাল সম্পর্ক,এত øেহ করে কথা বলেন । তাই চাচার আচরনটা ভীষন খারাপ লাগলেও রূপা কিছু বলতে পারছিল না। আর কি ই বা সে বলতে পারে। এতটুকু একটা মেয়ে বাপের সমান চাচাকে কি বলবে,বলবে যে আমার শরীরে হাত দেন কেন ? বা চাচা আপনি খুব খারাপ কাজ করছেন। কি বলতে পারে রূপা ? যে রূপার এখনো বুঝার ক্ষমতাই হল না যে মেয়েদের শরীরের দিকে পুরুষের দৃষ্টি কেন এত তীক্ষè থাকে, কেন তারা ছোবল দিতে চায় । এই ছোবল দেয়াটা খারাপ এবং কতখানি খারাপ। তারপরেও রূপার মনটা বিষিয়ে ওঠে আফজাল চাচার প্রতি। মুখ বুজে শক্ত হয়ে অসহ্য যন্ত্রনা মনে চেপে রেখে বসে থাকে । মনে মনে থু থু দেয় চাচা নামধারী পুরুষটির পান চিবানো মুখটির উপর। কিন্তু রূপা পারে না ।
আমাদের সমাজের কোন রূপাই হয়তো এটা করতে পারে না। যদিও প্রতিনিয়ত তারা এমন অসংখ্য চাচা ,মামা ,বড় ভাই ,খালু ,দুলাভাইদের এমন অসহ্য øেহের কবলে পড়েন।
এরপর প্রায়ই চাচা বাড়িতে এলে রূপা আর কাছে যায় না। তাকে দেখলেই তার লালসা ভরা চোখ দুটির কথা মনে পড়ে,মনে পড়ে তার সাপের মত হাতের বিচরনের কথা।
আফজাল চাচা একদিন বাবাকেই বলেন , রূপা মা আমাদের অনেক মেধাবি মেয়ে। অনেক ভাল করেছেন তাকে ভাল স্কুলে ভর্তি করিয়ে। লেখাপড়া যদি করতে হয় তো করার মতই করা। র্কিন্তু স্কুলটা এত দূর,এতটুকু মেয়ে হেঁটে হেঁটে যায় দেখলে বড় মায়া হয় ভাইজান।
মুখের ভেতরের পানের দলাটা এ গাল থেকে ওগালে নিয়ে থু করে একটু পিক ফেলেন মাটিতে। আবার বলেন, বলিকি ভাইজান ,আমি যখন দোকানে যাই রূপাতো আমার সাথেই যেতে পারে। চাচা ভাতিজি রিকসায় করে গল্প করতে করতে চলে যাব। কি বলেন ভাবি ? বলে রূপার মায়ের দিকে তাকায়।
রূপার মা বলে,ওর হেঁটে যেতে কোন সমস্যা হয় না ভাই। আর একসাথে সব মেয়েরা দল বেঁধে হেঁটে যায় এটাই তো ভাল। এটুকু কষ্ট করতে না পারলে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া হয় না। আমি ছেলে মেয়েদের কষ্ট সহ্য করতে শিক্ষা দেই।
রূপাকে যেদিন আফজাল চাচা রিকসায় তুলে শরীরটাকে পাকা কাঁঠাল টেপার মত করে টিপে দেখতে চেয়েছিল, সেদিন রূপা বাড়ি এসে তার মাকে বলল ,মা আফজাল চাচা আমার গায়ে কেমন করে হাত দেয়, আর কথা বলতে বলতে খোঁচা খোঁচা দাড়ি দিয়ে আমার গালের সাথে গাল মিশাতে চায়। রূপার মায়ের মন আঁতকে উঠে। সে খুব ভাল করেই জানে কখন একজন পুরুষ মেয়েদের সাথে এমন ব্যবহার করে,কেন করে। মায়ের মনে ভয় ঢুকে। মেয়েটা বড় হচ্ছে,কত দিক থেকে কত শয়তানের হাত এসে মেয়েটাকে ছুতে চাইবে। মেয়ে বড় হয়ে উঠলে মায়েদের মনে সদা আতংক সদা ভয় , অন্তরটা থরথর করে কাঁপতে থাকে।

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ