[প্রথমপাতা]
|
ওইখানে যেওনাকো তুমি(৬ষ্ঠ পর্ব)
- মেহেরুন নেছা রুমা
-
‘যে পুরুষ অর্থের জন্য একজন নারীকে বিয়ে করে , সে কোনদিন তার স্ত্রীকে
ভালোবাসে না।’ এটা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন। আজ সেকথা স্পষ্ট হয়ে উঠল নীরার
কাছে। আসলে তপুর মত ছেলেরা বিয়ের নামে নারী কিনতে আসে। নারীকে তারা ঠিকই
কিনে নিয়ে যায় । কিন্তু তার মূল্য পরিশোধ না করেই। পুরোটাই থাকে তাদের ধোকা
। মন ভোলানো কথা।
ক’দিন বাদেই নীরার জন্য আবার বিয়ের প্রস্তুাব আসতে থাকে। কেউ কেউ ঠিক হয়ে
থাকা বিয়ের কথা জানতে চায় । নীরার বাবা বলে , পাত্রপক্ষ যৌতুক চেয়েছিল বলে
সম্বন্ধ ভেঙে দিয়েছি।
এটুকু শুনে মানুষ তৃপ্ত থাকতে পারে না। তাদের আরো কিছু শুনতে ইচ্ছা করে।
মানুষ আসলে অল্পতে তুস্ট হতে রাজি নয়। সবটুকু খবর তলানি থেকে কুড়িয়ে আনতে
হবে তাদের। কি আছে অন্দরের রহস্য, সেটাই তাদের জানতে হবে। নিজের ঘরের খবর
না জানুক,পরের আলোচনা সমালোচনা করতে মানুষের কোন ক্লান্তিবোধ নাই।
বিয়ের প্রস্তাব আসলে এবার আর নীরা চুপ করে বসে থাকে না। এতদিন বিয়ের
বিষয়টাকে বাবা মায়ের হাতেই ছেড়ে দিয়েছিল। তারা যখন বলবে ,যাকে বলবে বিয়ে
করবে চোখ বুজে। এবার নীরা মাকে স্পস্ট করে বলে দিয়েছে এম এ পাস করার আগে সে
বিয়ে করবে না। আর কোন পাত্র তাকে দেখতে চাইলেই দেখতেও পারবে না। আগে সে
পাত্র দেখবে ,যদি তাকে নীরার পছন্দ হয়,পছন্দ মানে পাত্রের স্যুট টাই পড়া
ঝকঝকে চকচকে ঘষা মাজা চেহারা,জেল মাখানো চুলের স্টাইল,আর পায়ে আয়নার মত
স্বচ্ছ জুতা নয়। পছন্দ মানে সেই পাত্র হবে,যে শুধু নীরাকে দেখে বিয়ে করবে।
যার মনটা হবে আয়নার মত স্বচ্ছ । এক টাকা যৌতুক বা এক টাকার কোন জড় বস্তু
নীরার সাথে যাবে না। নীরার সাথে তপুর অতীতের সম্পর্কের কথা জেনে শুনে যে
নীরাকে বিয়ে করবে তাকেই সে বিয়ে করতে রাজি থাকবে এবং পাত্র পাত্রী দেখার
আগেই অভিভাবকদের যত দেন দরবার আছে সব ঠিক করে নিয়ে তারপর পাত্র দেখবে নীরা।
হ্যা নীরাই দেখবে । একথা স্পস্ট করে জানিয়ে দিয়েছে বাবা মাকে।
এই সমাজে এমন অনেক রীতি- নীতি, সংস্কৃতি প্রচলিত রয়েছে ,যা যুগ যুগ ধরে
বহমান। বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যায় সেসব সংস্কৃতিতে নারীকে পণ্য ছাড়া আর
কিছুই ভাবা হয় না। ‘কনে দেখা’ নামে যে অনুষ্ঠানটি প্রচলিত আছে তার পুরোটাই
হল দোকানে যেয়ে শাড়ী কেনা বা কোরবানীর গরু কেনার মত ঘটনা। বিয়ে নামে
সামাজিক প্রতিষ্ঠানে সম্পর্কটি সৃষ্টি হয়ে দুজন নর নারীর মধ্যে। এই দু’জন
থেকে একই সাথে দু’পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও আত্মীয়তার বন্ধন সৃষ্টি হয়।
যেখানে নারীকে তার বাবার ঘর ছেড়ে স্বামীর ঘরে যেতে হয়। নারীটিই তার জন্ম
থেকে বেড়ে ওঠা স্থান,পরিবেশ ,আপনজন ছেড়ে ভিন্ন এক পরিবেশ ,ভিন্ন মানুষদের
কাছে যায়। তো সে হিসেবে নারীকেই তো দেখতে যেতে হবে সেই পরিবেশ ,
পরিবার,পরিবারের মানুষ, বাসস্থান, তাদের কৃষ্টি-কালচার। কারন নারী যদি
নিজেকে সেখানে খাপ খাওয়াতে না পারে তো নারীর জীবনে বিড়ম্বনার শেষ নেই। তাই
নীরা ঠিক করেছে এর পর থেকে যখন বিয়ের প্রস্তাব আসবে,তাকে পাত্র পক্ষ নয়,সে
ই পাত্র এবং তার পরিবার পরিবেশ দেখতে যাবে। সে পাত্র,পাত্রের বাড়ি
ঘর,পরিবেশ,জীবন যাপন, দেখে যদি মনে করে বিয়ে করা যাবে তো তখনি বিয়ের সম্মতি
দেবে। আর নয় মন ভোলানো কথা,আর নয় ধোকাবাজি ।
জীবনে একবার খোঁকা খেয়ে নীরা যেন ভেঙ্গে চুড়ে আবার নতুন রূপে তৈরি হল। এ
নীরাকে কেউ আগে কখনো দেখেনি। নীরার কথার সাথে একমত হয় তার বাবা মা। তারা
মেয়েকে পড়াশুনা করে স্বাবলম্বী হতে উৎসাহ দেন। বলেন, আগে তুমি মানুষ হও।
পরে বিয়ে শাদির কথা ভাবা যাবে। আসলেই তো নীরাকে মানুষ হতে হবে। কিন্তু
নীরাকি স্বাবলম্বী হলেই ‘মানুষ’ হতে পারবে ? এ সমাজে নারী কি কখনো মানুষ হয়
? অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতা নারীকে পঙ্গু করে রাখে অনেকাংশে। তাই সবার আগে
নীরাকে অর্থনৈতিক ভাবে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে।
সেদিন মা হাসপাতাল থেকে রাসেলকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেই ঘরের সামনে রূপাকে বসে
থাকতে দেখেন । দূর থেকে দেখেই মায়ের অকস্মাৎ কেঁপে ওঠে আতংকে। রূপাতো এমন
কতই বসে থাকে। কিন্তু আজকের এই বসে থাকাটা যেন একটু অন্যরকম। সন্তানের কোন
অমঙ্গল হলে মা যেন সেই অমঙ্গলের বার্তা পেয়ে যান মনে মনে।
বাড়িতে ঢুকতেই রূপা দৌঁড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে।
কি হয়েছে রূপা ? একি তুই কাঁদছিস কেন ? কি হয়েছে বল না ।
মায়ের মনের মধ্যে তুফান বইছে। মেয়ের কোন বিপদ আপদ হল না তো ? বুকে জড়িয়ে
নিয়ে বলেন ,কি হয়েছে মা ,আমাকে বল। স্যার পড়াতে এসেছিল ?
মা তুমি আমাকে রেখে কেন গেলে ?
কেন মা কি হয়েছে ? কাঁদছিস কেন ? মাকে বল কি হয়েছে ?
মা স্যার আজ আমার সাথে খারাপ কাজ করেছে । আমি আর এই স্যারের কাছে পড়ব না।
যেন পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠল । মা মেয়ের মুখটা দু হাতের তালুতে ধরে
বলছেন,কি বলছিস তুই ? স্যার কি করেছে তোর সাথে ? কি খারাপ কাজ করেছে রূপা ?
মা স্যার আমাকে জোর করে হাত ধরে টেনে তার কোলে বসিয়ে আমার সারা গায়ে কেমন
করে চেপে ধরছে । আমাকে বলে ..
কি বলে ?
বলে ,অনেক মজা দিব চুপ করে বসে থাকো।
বলতে বলতে রুপা স্বজোরে কেঁদে উঠল।
রূপার কাঁপা কাঁপা কথায় মায়ের মাথাটা দুনিয়া নিয়ে ঘুরছে যেন।
তারপর ? তারপর কি করেছে রূপা ? সব বল ,আমাকে সব খুলে বল মা। মজিলা কোথায়
ছিল ? তাকে যে বসিয়ে রেখে গেলাম।
তখন রূপা সবকিছু মাকে খুলে বলল।
প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বসে আছেন রূপার বাবা মা ,প্রধান শিক্ষক আর ম্যানেজিং
কমিটির সভাপতি । বিষয়টা তাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না কারো। এত দিনের পুরনো
শিক্ষক। কতদিন থেকে স্কুলে এবং স্কুলের বাইরে একজন ভাল শিক্ষক হিসেবে তার
সুনাম রয়েছে। সংসার জীবনেও একজন সুখি মানুষ হিসেবে সবাই তাকে জানে। তার
স্ত্রীও প্রাইমারী স্কুলের একজন শিক্ষক। সেই শিক্ষক রূপার মত ছোট্ট একটি
মেয়ের সাথে অসৌজন্য আচরণ করবে ! পিতার মত শিক্ষক ! এটা কি বিশ্বাস করা যায়
? তারপরেও ঘটনা যে সত্য সে ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ নেই। প্রধান শিক্ষক
চাচ্ছেন ঘটনাটি যেন স্কুলের ছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ে। তাহলে স্কুলের
বদনাম হয়ে যাবে। অভিভাবকরা এ স্কুলে আর মেয়েদের ভর্তি করাতে চাইবে না।
কিন্তু ওই শিক্ষকের তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে সে রূপার মত আরো
অন্য ছাত্রীদের সাথেও এমন আচরণ করতে পারেন। কিংবা এতদিনও করে আসছিলেন যা
কারো অজানাই রয়ে গেছে।
ক’জন মেয়ে আছে তার উপর পর্যবসিত এমন জঘণ্য অপকর্মের বিরূদ্ধে মুখ খুলে ?
বেশির ভাগই তো লজ্জায় অপমানে এসব যন্ত্রনাময় ব্যাপারগুলি নিজের মধ্যেই চেপে
রাখে। প্রকাশ করতে গেলে তাদের নিয়েই সমাজে কানাঘুষা চলে। কেন তাকে পর পুরুষ
ছুঁয়ে দেখল। এটা যেন তারই অপরাধ। আবার শিক্ষকদের এসব কার্যকলাপ সম্পর্কে
স্বভাবতই অনেকে মুখ খুলে না। কারন সেখানে ছাত্রীর মনে সাহস এবং
নিরাপত্তাজনিত একটা ব্যাপার থাকে। শিক্ষকের হাতে ছাত্রীর পরীক্ষার খাতা
থাকে। শিক্ষককে সব সময় ছাত্রছাত্রী শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তাদের কর্মকান্ড
সম্পর্কে মুখ খুলতে ছাত্রীদের সাহস হয় না। পাছে স্যার তাদেরকে পরীক্ষায় ফেল
করিয়ে দেন। আর যদি স্যার কে সুযোগ দেন তো ছাত্রীরা প্রতি ক্লাসে স্যারের
বিষয়ে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে যায়।
কেমন করে যেন ঘটনাটি আর চাপা থাকল না। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে এখন তা বাইরেও
মৌ মৌ করছে। রূপাকে নানান জনে প্রশ্ন করছে। উপরের ক্লাসের মেয়েরা হাত ধরে
নিয়ে গিয়ে জানতে চাইছে স্যার কিভাবে ধরেছিল,কি বলেছিল,কোথায় কোথায় হাত
দিয়েছিল, রূপা কি করেছিল । অন্য মেয়েদের মায়েরা এসে ব্যাপারটি রূপা এবং
স্কুলের নারী শিক্ষকদের কাছে জানতে চাইছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভীষণ ঘোলাটে
হয়ে গেল। সেই শিক্ষককে ক’দিনের ছুটিতে পাঠিয়ে দিলেন প্রধান শিক্ষক।
পরিস্থিতি শান্ত হলে তাকে আবার আসতে বলা হল।
এসব ঘটনা এবং ঘটনা পরবর্তী ঘটনা রূপাকে আরো পরিপক্ক করে তুলল। সে এখন
রীতিমত একটা আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল সব খানে। স্কুলের বাইরেও তাকে নিয়ে আলোচনা
হচ্ছে। স্কুলে আসার পথে এবং বাড়ি যাবার পথে কেউ কেউ তাকে ডেকে জানতে
চাচ্ছে। রূপা আর এ নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী না। তবে সে শিক্ষকের এমন কাজকে
অবশ্যই অপরাধ মনে করে । সবার কাছে বলে স্যার অন্যায় করছেন । স্যারের যেন
শাস্তি হয়। এটুকু মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে কেউ কেউ রূপাকে বাহ্বা দেয়,কেউ
উৎসাহ দেয়,কেউ আবার বলে ,মেয়েটা বেশি বাড়াবাড়ি করছে। স্যার তো আদর করেও
কোলে বসাতে পারে।
তুলি স্কুলে যাবার সময়ে নীরা একদিন বলে, আজ রূপাকে একটু আসতে বলিস তো তুলি।
কেন বড় আপু? রূপাকে কি দরকার ?
দরকার আছে,তুই ওকে বলিস যে বড় আপু যেতে বলেছে। ওর সাথে কথা আছে আমার।
খবরটি পেয়েই রূপা চলে আসে নীরার কাছে। তুলির বড় আপুকে রূপারও বেশ পছন্দ।
বিয়ে ভেঙ্গে যাবার পর ক’দিন নীরা যখন মনমরা হয়ে থাকত, তখন রূপার কেমন মায়া
হত। মন চাইত নীরা আপুর সাথে বসে গল্প করে। কিন্তু নীরা আপু কত্ত বড় আর সে
ছোট। তার সাথে নীরা আপু কেন গল্প করবে ? তারপর নীরা আপু যখন আবার স্বাভাবিক
জীবনে ফিরে এল এবং নিজেকে অন্যরকম ভাবে তৈরি করে নিল,তখন রূপার আরো আগ্রহ
বেড়ে গেল। মনে মনে সে নীরা আপুর মত হতে চায়। নীরা আপুর চোখের দিকে তাকিয়ে
থাকে। কেমন বুদ্ধিদীপ্ত দুটি আঁখি। চলনে বলনে কেমন আত্মবিশ্বাসী একটি মেয়ে।
নীরা যা বলে তাই যেন ঠিক।
স্কুল থেকে ফিরে পোশাক পাল্টে খেয়ে দেয়ে রূপা বিকেলে তুলিদের বাড়ি যায়।
মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ না কেউ একটা কিছু যেন বলতেই হবে। না হয়
তাদের জন্ম স্বার্থক হয় না। একটা ছেলে রূপাকে দেখে গেয়ে উঠল,চুমকি চলেছে
একা পথে ,সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে । আর একজন বলে ওঠে,এই থাম থাম,আরে সে তো
চুমকি নয় রে দোস্ত ,সে তো রূপালী জোছনা। পিছন থেকে এসে আর একজন ফিসফিস করে
বলে,তোদের আক্কেল জ্ঞান কিছুই নাই দেখছি। যাকে দেখিস তার পিছনই লাগিস। এটা
হল রূপকের বোন। রূপক শুনতে পারলে হাড্ডি গুড়ো করে দিবে তোদের।
ARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|