[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ (পর্ব-১৮)

  

- শাশ্বত স্বপন -

 

গাড়ি এসে একেবারে গ্যারেজের সামনে থামল। আমি নামলাম। দোতলায় তাকালাম। ন্যান্সি হাতে টেপ-রেকর্ডার নিয়ে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। মনে হচ্ছে নিচে ফেলে দেবে। আমি লজ্জার মাথা খেয়ে ডাকলাম, ন্যান্সি’। ডাক শুনে তার চোখ-মুখ খুশিতে চিকচিক করে উঠল। সে টেপ-রেকর্ডার তার পায়ের কাছে রেখে দিল। আমার কাছে আসতে বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৌঁড়ে আমার কাছে ছুটে আসল। হাতে একটা প্যাডের কাগজ ভাঁজ করা। সামনে এসে আমার দিকে তাকাল, হাসল। ভাঁজ করা কাগজটা আমার ডান হাতে দিয়ে বাম হাত ধরে ফুলের বাগানের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। দোতলার জানালা দিয়ে মিসেস চৌধুরী ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল। কাজের বুয়াও খুশিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুইমিং পুলের সামনে আমাকে বসাল, নিজেও বসল। কাগজটা পড়তে বলল, ভাঁজ করা কাগজটা পড়লাম। “ফ্রান্সিস, তুমি চলে গিয়েছিলে কেন? আমি তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তোমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছি। কি দেখেছি জান? বলব না। টেলিফোন করি, কেউ ধরে না। মাথা ঘুরছে, কিছুই ভালো লাগে না।

তারপর, কাঁটাছিঁড়া। কিছুই বুঝা গেল না। বানান ভুল। বাংলা হাতের লেখা খুবই খারাপ। আমার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে দেখে সে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
--সাঁতার কাটবে?
--দুপুরে--
--দুপুরে?
--হ্যাঁ।
--নাস্তা করেছ?
মুখ গোমড়া হয়ে গেল। বুয়া পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে এসে আমাকে জানাল যে, ন্যান্সি সকাল থেকে এ পর্যন্ত কিছুই খায়নি। আমি আবার ওর দিকে তাকালাম।
--খাওনি কেন?
--তুমি খাওনি কেন?
--আমি খেয়েছি তো।
--কখন? আমি দেখেনি তো।
ন্যান্সি বাংলার চেয়ে ইংরেজিতেই বেশি কথা বলে। তাই আমাকেও তার মতো ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। সে যখন বাংলায় বলে আমিও তখন বাংলায় বলি।

খাবার টেবিলে বসে তার মায়ের কাছ থেকে শুনলাম, ফ্রান্সিস ছাড়াও তার আরো বন্ধু ছিল। যদিও তারা তেমন ঘনিষ্ঠ ছিল না; হয়তো ফ্রান্সিসের কারণে। দু’জনের গল্পের ফাঁকে হয়তো অন্যান্য বয় ফ্রেণ্ডদের সময়ই দিতে পারত না। ন্যান্সির জন্য আমাকে খেতে হচ্ছে। তবে এবার দুই প্লেটে। সে খাচ্ছে আর কি এক গানের সুর ধরে গুনগুন করছে। তার মা মাঝে মাঝে স্মৃতিকথা উঠালে ন্যান্সি মনোযাগ দেয়। হঠাৎ সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর শুরু হলো মাথার যন্ত্রণা। কি যেন তার মনে হলো। পাগল জীবনে অনেক দেখেছি কিন্তু এমন পাগল কোনদিন দেখিনি। খাবারগুলো তার মায়ের দিকে ছুঁড়তে লাগল। পাশে আয়নার সামনে রাখা বিদেশি খেলনা গাড়িটা ভেঙ্গে ফেলল। আমি কিছুই বলছি না। দর্শকের মতো শুধু দেখছি। ব্যাপারটা অবাক লাগছিল। একটু আগে যাকে সুস্থ্য মনে হলো, এখন সে অসুস্থ। ন্যান্সি আমার হাত ধরল। নিয়ে গেল নিজের রুমে। ভয় ছিল, আমাকেই আঘাত করে বসে কিনা। না, সে রকম কোন লক্ষণ দেখা গেল না। আমাকে আসলে সে কি ভাবে, ফ্রান্সিস না অন্য কিছু। ফ্রান্সিস সদৃশ্য ভেবে সে কি দইয়েল স্বাদ ঘোলে মিটাচ্ছে?

ন্যান্সির রুম পাঁচটা। অর্থাৎ পুরো একটা দোতলা বিল্ডিং তার নিজের জন্য। বিছানা মোট চারটা। যখন যেখানে ইচ্ছা সে আগে শুতো। অসুস্থ হওয়ার পর তিনটি রুম বন্ধ করে দেয়া হয়। নিচ তলার অডিটোরিয়াম একেবারেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কাজের বুয়া আমাকে সব দেখাচ্ছে। ন্যান্সি আমার হাত ধরে আছে। যেন, সে একটা শিশু। শিশুর মতো গাল ফুলে আছে। শিশুর মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। যেন, এইসব জায়গা সে আগে কখনও দেখেনি। বুয়া চাবি দিয়ে নিচ তলার তালা খুলল। দু’জনে রুমে ঢুকলাম। অন্ধকার কক্ষ। সুইচ টিপ দিয়েই বুয়া অন্য কক্ষে চলে গেল। বাতি জ্বলতেই দেখি বেশ বড় এক অডিটোরিয়াম। ন্যান্সি এমনভাবে তাকাল যেন সে কিছুই চেনে না--আগে কখনো এখানে আসেনি--এ জায়গা কখনও দেখেনি। এক্সিডেন্ট দেখার পর তার স্মৃতিশক্তি কি পুরোপুরি লোপ পেয়েছে? এখানে যে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। চারদিকে বেশ গুছগাছ, বিভিন্ন মহামনীষীর ছবি, নিচে কার্পেট বিছানো অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মনে হয়, সকালবেলা কে যেন গুছগাছ করে রেখে গেছে। বড় এক ছবি, মঞ্চের একপাশে টানানো। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম ছবিটা ন্যান্সির। জীবন্ত হাসি, মনে হয়, এইতো সেদিনের ছবি। বুয়ার কাছ থেকে জানতে পারলাম, ছবিটি ন্যান্সির অষ্টম শ্রেণিতে থাকা অবস্থার তোলা। অন্য পাশে মা-বাবার সাথে আরেকটি বড় ছবি। পাশের এক কক্ষে গেলাম। এখানে রাখা আছে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। বোঝা যায়, সংগীতের নানান স্রোতধারা একদা এখানে বয়ে যেত। এখানেও নানা প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর ছবি টাঙানো। অন্য কক্ষগুলোতে গেলাম। কোনটা নৃত্যের, কোনটি সাজগোজের। পাশে ছোট দু’টি বাথরুম আছে। এখনও টেপ থেকে পানি পড়ছে। সব দেখে মনে হলো, আজ বিকালে বোধহয়, কোন অনুষ্ঠান আছে।
ন্যান্সির ছবির কাছে আসলাম, ওকে জিজ্ঞেস করলাম--“ছবিটি কার? তার হাসি দেখে মনে হয়, সে যেন চিনেছে। আবার মনে হয়, সে এমনি হাসছে। এখানে কারা অনুষ্ঠান করত? এখন বা তারা কোথায়? বুয়াকে জিজ্ঞাসা করতেই দেখি মিসেস নজরুল হাজির। নিচ তলার এই অডিটোরিয়ামে পুরো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কথা বললেন। এখানে মাসে চার-পাঁচটি অনুষ্ঠাত হত। অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা হতো ন্যান্সি। প্রথমে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারত না। জড়তা থেকে যেত। পরে ন্যান্সি আর ফ্রান্সিস মিলে উপস্থাপনা করত। মিসেস চৌধুরীর চোখ ছলছল করছে। একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, এখানে ন্যান্সি বসত। পাশের চেয়ারটিতে ফ্রান্সিস। আর অন্যগুলোতে আমরা বসতাম। এখনো এই জায়গাটা জাঁকজমক রাখার কারণ হলো--ন্যান্সির স্মৃতিতে ধীরে ধীরে এই মঞ্চের ইতিহাস ফিরে আসে কিনা। যারা আগে এখানে আসত, অর্থাৎ গানের শিক্ষকরা, গুনগ্রাহীরা, বন্ধুরা--এরা ন্যান্সির পাগলামীর কারণে কেউ আসে না। একমাত্র ফ্রান্সিসের চেহারা ছাড়া সব চেহারা সে ভুলে গেছে। ফ্রান্সিসকে সে আমাদের চেয়ে বেশি ভালোবাসত। এখানে এসে মিসেস নজরুল থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার বললেন, যারা ন্যান্সিকে ভালোবাসত তারা ওর এই মানসিক অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ুক--এ আমি চাই না। অনেকে আমার অগোচরে বলেই ফেলত, খ্রীস্টান একটা ছেলেকে ন্যান্সি এত ভালোবাসত! মা-বাবার চরম উদাসীনতার কারণেই এ অবস্থা হয়েছে। মাঝে বেশ কয়েকবার এখানে অনুষ্ঠান হয়েছিল। ন্যান্সিকে তার চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। তার প্রিয় গান, কবিতা, কৌতুক শোনানো হয়েছিল কিন্তু তার কোন পরিবর্তন হয়নি। শুধু ফ্রান্সিস, ফ্রান্সিস, ফ্রান্সিস...।

ন্যান্সি এখনও আমার হাত ধরে আছে। এদিক-ওদিক শিশুর মতো তাকাচ্ছে। সে জোর করে এখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে চাইছে। এক জায়গায় সে বেশিক্ষণ স্থির থাকতে পারে না। মিসেস নজরুল তাকে স্থির হতে বলল। সে মায়ের কথায় আরো রেগে গেল। এবার আমাকে বাইরে নেবার জন্য আরো বেশি জোর করতে লাগল। কেউ কর্তৃত্ব দেখালে সে এখনো রাগ করে। এই স্বভাবটা তার এখনো রয়ে গেছে। আমি বাইরে যেতে চাইছি না বলে চিৎকার শুরু করল। মনে হয়, এ ঘরে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাইরে এলাম। সে বাইরে এসে এমনভাবে একটা নিঃশ্বাস নিল--মনে হলো, এতক্ষণ তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আমাকে সাথে নিয়ে সে দৌঁড়াতে চায়। আমার বেশ লজ্জা লাগছে। সে দৌঁড়ে বাগানে চলে গেল। হাসতে হাসতে আবার ফিরে এলো। শিশুর মতো খেলা করতে লাগল আমাকে ঘিরে। মনে হচ্ছে, এতদিনে সে বন্ধুর মতো একজন বন্ধু পেয়েছে। সে দৌঁড়ে চলে যায়। আবার ফিরে আসে। যেন--‘এই গাঙ্গে কুমীর নাই, নাইয়া ধুইয়া বাড়ি যাই।’ আবার যেন, সে ভয় পেয়েই আমার কাছে ছুটে আসে। ক্রমে ক্রমে তার প্রতি আমার মায়া বাড়তে লাগল।

পরাজিত সৈনিক আমি। পরাজয়ের কোন ভয় আমার নেই। নেই কোন লজ্জা। তবে পরাজয়ের মাঝেও যদি সারা ভূ-খণ্ডের কিছু অংশ দখল করতে পারি তবে তাও হবে জিরো থেকে সম্মুখের কোন সংখ্যা। আর যদি পারি বিজয়ের বেশে সবটুকু দখল করতে তবে তা হবে দুর্লভ পাওয়া। এ পৃথিবীতে অসম্ভব বলতে কিছু নেই। গত দিন যা অসম্ভব ছিল--আজ তা সম্ভব হয়েছে। আজ যা অসম্ভব হয়তো কাল তা সম্ভব হতেও পারে।

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ