[প্রথমপাতা]
|
ধারাবাহিক উপন্যাসঃ হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ (পর্ব-১২)
- শাশ্বত স্বপন
-
রুমে ঢুকার সাথে-সাথে আমার প্রিয় গান
কানে ভেসে এল। ‘আমি জেনে-শুনে বিষ করেছি পান...।’ হ্যাঁ, আমি জেনে-শুনেই
বিষ পান করতে যাচ্ছি। সেলিম তার বিছানায় শুয়েছিল। আমাকে দেখেই চিৎকার করে
উঠল। আমাকে জড়িয়ে ধরে দু’গালে চুমো বসিয়ে দিল। চিৎকার করে বলল, শিউলীর চিঠি
এসেছে। হায়রে সেকি আনন্দ! রসগোল্লা পর্যন্ত কিনে এনেছে। সবকিছু ভুলে ওর
আনন্দে যোগ দিলাম। ও ক্যাসেট চেঞ্জ করে ইংরেজি গান ছাড়ল। নৃত্য শুরু করল।
শিউলীর পাঠানো চিঠিটা চারবার আমাকে পড়ে শোনাল। তারপর বুকের বোতামটা খুলে
গেঞ্জির নিচে চেপে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। এরকম পাগল না দেখলেও এদের পরিণাম
সম্পর্কে আমার ধারণা স্পষ্ট। আমি বললাম--
--এত সুখ তোর সইবে নারে।
--দোস্ত, দোয়া কর। আমি এখনই নামাজ পড়ব।
--আরে বারটায় কিসের নামাজ?
-- আরে তুই বুঝবি না।
-- তবে এইটুকু বুঝি নামাজ কেন তুই পড়িস।
-- দেখ, কি করা যায় সেই চিন্তা কর। আগামী মাসে শিউলী আসবে।
সেলিম নামাজ-রোজা করে। আমি কিছুই করি না। ও স্রষ্টাকে ভয় পায়--আমিও ভয় পাই।
সারা দিন পর রাতে যখন ডায়েরীতে কিছু লিখি তখন দুই-একটা মিথ্যা কথা ছাড়া আর
কোন পাপ আমি দেখতে পাই না। হয়তো অজান্তে অনেক পাপ করি--যা বিবেচনায় ধরি না।
অথচ সেলিম অলরেডি ঘুষ খাওয়া শুরু করেছে। সে এটাকে ঘুষ না বলে ‘উপরি’ বলে। ও
আস্তিক আমিও আস্তিক। আস্তিকের সংজ্ঞায় আমরা দু’জনেই পড়ি। ও মুসলমান বলে
নিজেকে মনে করে কিন্তু আমার সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। ও আসলে ধার্মিক, না
ভণ্ড ধার্মিক, নাকি ধর্মের আবরণে ব্যবসা করছে--আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি না।
মানুষের বাহ্যিক আচরণ দিয়ে তার অন্তর বিচার করা যায় না। সে তাবলীগে
ছুটোছুটি করে। অথচ আমি কোন ধর্মের ছায়াঘেষাও নই। আমি চন্দ্রগুপ্ত এর প্রধান
মন্ত্রী চাণক্য পন্ডিত (বিষ্ণুপদ দত্ত) এর অমর বাণী সব সময় মনে রাখি, ‘মন
পবিত্র থাকলে পবিত্র স্থানে গমন অর্থহীন’। আমি মনে করি, অপবিত্র মনের
মানুষেরাই পবিত্র স্থানে বেশী ছোটাছুটি করে, এত স্রষ্টা সন্তুষ্ট হয় বলে
আমার মনে হয় না। নিজের স্বার্থে, স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নিষ্পাপ
ব্যক্তির চেয়ে পাপী ব্যক্তিরা অন্ধের মত মসজিদ-মন্দির-মাজার-পীর
আওলিয়া-পুরোহিদ সহ আরো নানা স্থানে এবং নানা ব্যক্তির কাছে ছুটছে। যেখানে
মানুষ না খেয়ে মরছে--জীবন যেখানে মৃত্যুতুল্য--মানুষ যেখানে বেড়েই
চলেছে--অন্যায় যখন স্রষ্টার মসজিদ-মন্দিরেই ঘটছে--সেখানে টিকি, দাঁড়ি, টুপি
দিয়ে এসব সমস্যার সমাধান হবে না। সমাজ পরিবর্তনশীল, মানুষের মন-মানসিকতা
পরিবর্তনশীল। এ স্বাধীন হৃদয়কে পুরনো খাঁচায় মিছে আবদ্ধ করে লাভ কি? সে যখন
খাঁচায় থাকছে না--থাকতে চাচ্ছে না, তখন বাইরের মুক্ত আলোতেই সত্য তুলে ধরা
উচিত। সেলিম জেনে শুনেই পাপ করে। আবার নামাজ-রোজাও করে। তার কাছে এটাই
আজকের নিয়ম। একেবারে সাধু হয়ে বর্তমানে টেকা যায় না। কথা ঠিকই। কিন্তু
বর্তমান এমন হল কেন? এতো একদিনে হয়নি। ধর্ম যখন ব্যবসার দ্রব্য হয়ে যাচ্ছে
তখন কি লাভ এসব ঠেকিয়ে? এতো স্রষ্টা ছাড়া মনুষ্যজাতীর পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা
তাকেই ডাকি।
শিউলী আসবে আগামী মাসে। বদরুন্নেসা ও ভিকারুন্নেসা কলেজে ভর্তি টেস্ট দেবে।
থাকবে ঢাকাতে--তার এক কাকার বাসায়। শিউলীকে দেখানোর জন্য তার ভাষায় হাইফাই
একটা ফ্লাট দেখতে হবে। বিগত আট বছর ধরে সে এই মেয়েটির পিছনে লেগেছিল।
এস.এস.সি পরীক্ষার পর সে সেলিমের স্বপ্নও থেকে বাস্তবে ধরা দিয়েছে। অতএব,
কেন সে এত পাগল--তা আমি উপলব্ধি করতে পারি। আজ ন্যান্সির ব্যাপারে ওকে কিছু
বললাম না। ওর যা অবস্থা তাতে বমি করার সম্ভাবনা আছে। হয়তো চিৎকার শুরু করে
দেবে। সেলিম নামাজের ভঙ্গিতে কি যেন প্রার্থনা করল। তারপর টেপটা বুকের কাছে
এসে গান ছাড়ল--“ওগো মোর মধুমিতা...।” নতুন রেকর্ড করা ক্যাসেট। গান শেষ
হওয়ার সাথে সাথে আমাকে জানাল, শিউলী ফ্লাট রুমে ঢুকার সাথে সাথে যেন, এ
গানটা আমি ছাড়ি। আমি সায় দিলাম। সে কখনো একাত, কখনো ওকাত হচ্ছে। বালিশটা
বুকের কাছে নিয়ে শিউলী প্রতীক ভেবে জড়িয়ে ধরছে। গ্লাসে গ্লাসে ওরস্যালাইন
খাচ্ছে। সন্ধ্যা হতে তার ডায়রিয়া। বারবার পায়খানায় যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর
তার মনের মত সাজানো জিনিসের নাম বলছে। কি কি দিয়ে রুম সাজাবে তার লিস্ট
আমাকে শোনাচ্ছে। এখনও একমাস বাকী। যেভাবে লিস্ট শুরু করেছে-- সেভাবে
প্রতিদিন যদি করতে থাকে তাহলে পঞ্চাশ বাই চল্লিশ ফুট রুমে, সেগুলোর জায়গা
সংকুলান হবে কিনা সন্দেহ। হায়রে প্রেম! আমার কাছে ‘পুতুলের বিয়ে’ খেলার মতো
মনে হয়। সে আনন্দে আছে। সে তার শিউলীকে পাবে--এই চিন্তায় সে বিভোর। তার
ভালোবাসা তার বিশ্বাসকে খাট করে দেখার অধিকার আমার থাকা উচিত নয়। বারবার
বিরক্তির ফলে ডায়েরী পড়তেও পারছি না। তাই অনেকটা জোর করে তার ছোট্ট
ডিসপেনসারী থেকে ঘুমের একটা ট্যাবলেট খাওয়ালাম। তার মামার ঔষধের দোকান। সে
দোকান থেকে প্রায়ই ঔষধ এনে এই ছোট ডিসপেনসারীতে রাখে। সে ঘুমাতে চেষ্টা
করছে। টেপে বেজে চলেছে জগন্ময় মিত্রের গান। আমি কাত হয়ে ডায়েরীর প্রথম একটা
পাতা মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করলাম।
নূসরাত চৌধুরী (ন্যান্সি)
৬৬, কামাল আতাতুর্ক রোড, বনানী
ফোন নং:৯৮৯৪৬০৬, ৯৬৬৬২০৪
প্রায় সবই ইংরেজিতে লেখা। মাঝে মাঝে বাংলা। বুঝা যাচ্ছে, সে ইংলিশ
মিডিয়ামের ছাত্রী ছিল। বাংলা হাতের লেখা মোটেই পরিস্কার না। প্রথম পাতার
উপরে তারিখ দেওয়া ০১.০২.৮৪। মানে আজ থেকে দশ বছর আগে। ডাক্তার বলেছেন তিন
বছর যাবৎ মেন্টাল পেসেন্ট। তার মানে ’৯১-’৯২ থেকে ’৯৪। হঠাৎ সেলিম ঘুম থেকে
জেগে উঠল। তার পায়খানা ধরেছে। চোখে তার রাজ্যের ঘুম। ট্যাবলেটটা খাওয়ানো
ঠিক হয়নি। কি করব? যেভাবে পাগলামী শুরু করেছে তাতে সারা রাতেও ঘুমাতে পারত
কিনা সন্দেহ। বাথরুম থেকে ফিরে এসে বলছে, আবার যেতে হবে। আবার বাথরুমে গেল।
ফিরে এসে বলল, মাথা ভার ভার লাগছে। আমি ওকে শোয়ালাম। ওরস্যালাইন খাওয়ালাম।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। না, উঠছে না। বিছানায় পায়খানা করলে করুক। সকালে
ওকেই ধুতে হবে। তবুও ঘুমাক। একটি মেয়ে গ্রাম থেকে শহরে আসবে ভর্তি পরীক্ষা
দিতে। চান্স পাবে কিনা কে জানে। ভর্তি পরীক্ষার কারণে সে সেলিমের সাথে দেখা
করবে। তাতেই সেলিম কি মহাখুশি। আর যদি অন্য কিছুর অফার দেয়, দ্যাট মিনস
পালিয়ে যাওয়া, বিয়ে--তাহলে নির্ঘাৎ উন্মাদ হয়ে যাবে। এই মেয়ে তার
আশা-আকাক্সক্ষার সাথে নাও মিলতে পারে। ভাল লাগা, ভালোবাসা, বিয়ে--তিনটাই
ভিন্ন বিষয়। নারী কি চীজ, সেলিম হয়তো জানে না। আমি জানি, ও না জেনে বিষপান
করতে যাচ্ছে। আর আমি জেনে শুনে বাস্তবকে বুকে আঁকড়ে ধরে বিষপান করতে
যাচ্ছি। আমি জানি, এখানে আমার জয়-পরাজয় দু’টাই অপেক্ষা করছে। সেলিম জয় ছাড়া
এখন আর পরাজয়ের কথা ভাবছে না। সে জানে, যাদুর ফলে শিউলী তার জীবনে বন্দি।
যে বিশ্বাসে সে পূজা করে--তা করুক না--তাতে আমার কি? তবে এ বিশ্বাস যেন
অন্যতে সঞ্চালিত না হয়--এ বিশ্বাস যাতে খুনা-খুনির পর্যায়ে না যায়-- সে
জন্যই আমার মাথা ব্যথা।
ARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|