[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ (পর্ব-১৬)

  

- শাশ্বত স্বপন -

 

সেলিম বেশ লেট করে ঘুম থেকে উঠে অফিসে গেছে। আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি দশটা বাজে। সেলিম আমাকে না উঠিয়ে কাগজে লিখে গেছে, আজ রুমে ফিরবে না। অফিসের কাজে অনেক দূরে যাবে। চোখ-মুখ ধুয়ে চিন্তা করতে বসলাম। নাস্তা খেলাম। আবার চিন্তা করতে শুরু করলাম। কিছুই ভালো লাগে না। এখন সম্মুখে শুধু ন্যান্সি আর ন্যান্সি। বাইরে যাওয়া উচিত, দেহ ও মনের জড়তা কাটানোর জন্য। কিন্তু কোথায় যাব--তা জানি না। গস্তব্যহীন এ জীবনে কোন স্বপ্নই দীর্ঘ ছিল না। সব স্বপ্নই ছিল সরু আর নাতিদীর্ঘ। যেদিন রাতে কিংবা ভোর রাতে আল্পনাকে স্বপ্নে দেখি, সেদিন ঘুম থেকে দেরী করে উঠি। তারপর একটা চিঠি লিখতে চেষ্টা করি। কাটি আর লিখি। কিছুদূর লিখে ভাবি, এ চিঠি তো আল্পনার কাছে কোনদিন যাবে না। কি লাভ লিখে? তবু মন মানে না। লিখি, তবু লিখি। আত্মতৃপ্তির জন্য মানুষ তো কত কিছুই করে। আমরা অনেক কিছুই কোন কারণ ছাড়াই করি। কারণ নিয়ে এখন আর মানুষ ভাবে না। একদিন, ম্যাক্সিম গোর্কী তার ধনী মার্কিন বন্ধুর খাবার তালিকা শুনে মাথায় হাত দিলেন। তিনি ধনী বন্ধুকে বললেন, তিনি এত যৎ সামান্য আহার গ্রহণ করেন, তাহলে এত টাকা দিয়ে কি করেন? বন্ধু উত্তর দিয়েছিল, টাকা দিয়ে আরো টাকা গড়ি। কেন গড়েন? তার কোটিপতি বন্ধু বোধহয় ভাবেন না, ভাবতে চান না। তারা সবাই কিসের পিছনে ছুটে চলেছেন, তা বোধহয়, তারা নিজেরাও জানার সময় পান না বা জানতে চান না। আমাদের দেশের নজরুল চৌধুরীরা জানেন না, তারা কোথায় যাচ্ছেন। বিধাতা বিভিন্নভাবে তাদের বোঝাচ্ছেন কিন্তু বুঝেও বুঝতে চাইছেন না। টাকা দিয়ে তারা সব কিনতে চান। একটা সই দিয়ে একশত কোটি টাকা তারা ডান-বাম করতে পারেন। কিন্তু হাজার সই দিয়েই ন্যান্সিদের সুস্থ্য করতে পারেন না। তারা নিজেরাও জীবন্মৃত, ন্যান্সিরাও জীবন্মৃত। আমার জীবনে এক সময় একটা লক্ষ্য ছিল। আজ আর কোন লক্ষ্য নেই । এখন জীবন যেদিকে চলে, চলুক না। দরজায় হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল।
--কে?
--স্যার আমি।
--ও সিঁদুর, ভিতরে এসো।

দু’দিন সিঁদুরকে পড়াতে যাওয়া হয়নি। তাই হয়তো দেখতে এসেছে অসুখ হলো কিনা। এর আগেও সে একবার এসেছিল। তখন রুমে সেলিমও ছিল। আজ সেলিম নেই।
--স্যার, আপনার কি হয়েছে?
--তেমন কিছু না। দু’দিন যাবৎ খুব টেনশনে ভুগছি।
--কিসের টেনশন?
--ব্যক্তিগত।
--ও--
সিঁদুর সেলিমের টেবিলের দিকে গেল। একটি কবিতা লাল কালি দিয়ে লেখা--টাঙানো রয়েছে টেবিল সংলগ্ন দেয়ালে। সিঁদুর কাছে গিয়ে পড়তে শুরু করল।
“কবিতা, তোমার কি কখনও মরতে ইচ্ছে করে?
করে না? আমার মাঝে মাঝেই মরতে ইচ্ছে করে
মাঝে মাঝে খুবই ইচ্ছে করে...।”
--স্যার, কে লিখেছে? নাম যখন নেই, তখন নিশ্চয়ই আপনি। আপনি এত ভালো কবিতা লিখতে পারেন। স্যার, আমার কবিতাটা কেমন হয়েছে?
--তুমি কি স্কুলে যাবে?
--হ্যাঁ, স্কুলে যাব। ভাবলাম, যাওয়ার পথে আপনার সাথে দেখা করে যাই। স্যার বললেন না কেমন হয়েছে?
--সুন্দর, খুব সুন্দর। একেবারে তোমার মতো ভালো ও সুন্দর।
--যা--।
--তুমি এমন কবিতা লিখেছ, মনে হচ্ছে, পৃথিবীর কেউ তোমাকে কোন দিন ভালোবাসেনি--ভালোবাসেও না। তাই?
--স্যার, আমি যাই। আপনি কখন পড়াতে যাবেন?
--ঠিক সময়ে।
--আসি স্যার।
--সিঁদুর, তোমাকে আমি পড়াই। আমি জানি, তোমার বিদ্যা কত দূর। এ কবিতা তুমি লেখনি, আমি নিশ্চিৎ।

সিঁদুর অবাক হল না। আড়চোখে তাকাল। যেন এমন ঘটবে--তা সে জানে।
--টাঙানো কবিতাটা তোমার ভালো লাগে?
--হ্যাঁ, খুব।
--নিয়ে যাও ওটা; নইলে দু-এক দিনের মধ্যে কুটিকুটি হয়ে যাবে।
--কেন স্যার?
--আমার একটা বদ অভ্যাস আছে। আমি কবিতা, গান লিখি আর ছিঁড়ে ফেলি। এটাও ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। আমার রুম-ম্যাট এর ভালো লেগেছে, তাই ও ছিঁড়া কাগজ থেকে লিখে নিয়ে টাঙিয়ে রেখেছে।
--সে যদি এসে না দেখে?
--কিছুই বলবে না। সে এখন কবিতার জগতে নেই--আছে গদ্যের জগতে।
--মানে--?
--কিছু না, তুমি নিয়ে যাও।
--স্যার, আমাকে আরো কবিতা দেবেন। কবিতা আমার ভালো লাগে।

কবিতা ভালো লাগে এমন পাঠক-পাঠিকার সংখ্যা আমার চোখে খুব কমই পড়েছে। যদিওবা দু’একজন পাঠক-পাঠিকার ভালো লাগে। তাও বিশেষ বিশেষ জনের বিশেষ বিশেষ কবিতা--তাও আবার তাদের বিশেষ বিশেষ সময়। এখন হয়তো সিঁদুরের কবিতা ভালো লাগে। আর কয়দিন পর ভালো কবিতাও ভালো লাগবে না। চারদিকে এখন গদ্যের জয় জয়কার।
--সিঁদুর, ‘‘কবিতার শেষ হল--শুরু হলো গল্পের
রাত পেরিয়ে শুরু হলো দিনের।” এই সময় কবিতা ভালো লাগে?
--জানি না স্যার, আগে ভালো লাগত না, এখন ভালো লাগে।
--তোমার কবিতার কবি বুঝি ভালোবাসার কাঙাল? খুব কবিতা লেখে?
--স্যার, আমি আসি--
--কবিতা নিলে না?

সিঁদুর কবিতা নিয়ে চলে যেতে লাগল। দ্রুত হাঁটতে গিয়ে দরজায় ধাক্কা খেল। ফিরে আমার দিকে তাকাল। কি ভাবল কে জানে? এদের ভাবনার শেষ নেই। এদের চেনা বড় কঠিন। এরা সময়ে মায়াবী, সময়ে হিংস্র। এমন নারীদের সাথে আমার পরিচয় ছিল, যারা ঘন ঘন প্রেম করত। আবার দু’একটা মেয়েকে তাদের প্রেমিকের জন্য আধা পাগল হতে দেখেছি। বিয়ে হলে দেখা যায়, সব ভুলে গেছে। আবার এমন সব মেয়ে দেখেছি, যারা সাত-আট বছরের জীবন-মরণ প্রেমকে বিসর্জন দিয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বা কোন সচ্ছল বরের হাতে হাত রেখে সব ভুলে গেছে। তবে একটা বিবাহিতা বান্ধবী আমাকে অবাক করেছিল। বিয়ের পর তাকে প্রশ্ন করি,
--লাকী, দেলোয়ারকে মনে পড়ে?
--কি যে বলিস শোভন, যাকে বিয়ে করেছি, সে আমার স্বামী--শুধু স্বামী, স্বামী বলতে যা বোঝায়। আমার প্রেম-ভালোবাসা সমৃদ্ধ হৃদয়ের সবটুকু জায়গা জুড়ে তো দেলোয়ার দখল করে আছে।

বলতে বলতে লাকী আবেগ প্রবণ হয়ে উঠল। আমি জানি, সে বেশ সচ্ছল পরিবারে ভালো ছেলের ঘর করছে। দেলোয়ারকে ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু একি ডায়ালগ। কিছু কিছু ব্যতিক্রম স্বীকার করে নিতেই হয়। তবে এ ব্যতিক্রমও পরবর্তী পর্যায়ে আস্তে আস্তে চলে যায়। কিন্তু আমার বিষাক্ত স্মৃতি কি ধীরে ধীরে মুছে যাবে? অসম্ভব। হিন্দু মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম। বিয়ের আগের দিন তাকে জোর করে তুলে আনতে চেয়েছিলাম। অস্ত্র দিয়েও কিছু করতে পারিনি। আল্পনাকে আনতে পারিনি। সমাজের হাতে বন্দি হয়ে যে আঘাত সয়েছি--তা কি সহজে ভুলে যাব? প্রেম পাগল একটা কিশোর ছেলেকে সবাই জেলে ঢুকিয়ে দিল। দুই বছর তিন মাস পর জেল থেকে ফিরলাম। ধর্মের জিকির তুলে যে সব দাঁড়িওয়ালারা ও টিকিওয়ালারা আমাদের মিলনে বাঁধা দিয়েছিল--তাদের প্রকৃত রূপ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। ধর্মের সাথে স্রষ্টার ব্যবধান যে এরাই বাড়িয়েছে--তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। আমি কি এত কষ্টের স্মৃতি ভুলে যাব?

সিঁদুর চলে গেছে। বাসায় গিয়ে আজ তাকে বলতে হবে, সিঁদুর তোমাকে আর পড়াতে পারব না। সপ্তাহে দুই-এক দিন হয়তো আসতে পারব। টেপ-রেকর্ডার চালু করলাম। কোন গান ভালো লাগছে না। রেডিও-এর চ্যানেল ঘুরাতেই শাহনাজ রহমত উল্লাহর গাওয়া একটা গান বেজে উঠল--‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়--যে ছিল হৃদয়ের আঙিনায়--সে হারাল কোথায়--কোন দূর অজানায়--সেই চেনা মুখ কতদিন দেখিনি...।’ সারা দেহ থর থর করে কেঁপে উঠল। চোখ দু’টি নিদ্রার ভান করল। বিছানায় শুয়ে পড়লাম। নেশাগ্রস্ত রোগীর মতো নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে লাগলাম। মনে মনে বলে উঠলাম--‘‘আল্পনা...আল্পনা...তুমি আজ কোথায়? ‘‘আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি--তুমি একবার এসে দেখে যাও--একি মানব জন্ম! এভাবে কি মানুষ বাঁচতে পারে!” হায়রে হৃদয়, তুমি কত খারাপ! যারা আমাকে জন্ম দিয়েছে--তাদেরকে কদাচিৎ স্মরণ করি। করলেও তেমন দুঃখ অনুভব করি না। বাবাকে তো মুক্তিযোদ্ধা, কমরেড ভেবে ঘৃণা করি। অথচ আল্পনাকে কিছুতেই ভুলতে পারি না। বড় যন্ত্রণা দেয় এ হৃদয়। এতিম হওয়ার যন্ত্রণার চেয়ে ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণা আরো গভীর। হৃদয়কে বুঝাই, “হৃদয়, তুমি যা চাও--তা দেবার যোগ্যতা, ক্ষমতা, সময় আমার নেই।” সে বুঝে না--বুঝতে চায় না। ছোট শিশুর মতো আপেলের জন্য বায়না ধরে আছে। অথচ ঘরে অর্থ নেই, বাইরে কার্ফ্যু চলছে--কি করে জীবন বাজী রেখে বাজার থেকে ওর জন্য আপেল আনব? মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে শিশুটাকে হত্যা করে ফেলি। কিন্তু পারি না--কেউ তা পারে না। শিশুটা আপেলের জন্য কাঁদছে। আমি ক্রমাগত আম, আঙ্গুর, বিভিন্ন খেলনা দিয়ে তাকে বুঝাচ্ছি কিন্তু তার কান্না থামছে না। সে অবিরাম কেঁদে চলেছে। জানি না, কবে তার কান্না থাকবে।

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ