[প্রথমপাতা]

 

 

 

হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ
 
 

- শাশ্বত স্বপন -

 

[ আমার কিছু কথা: উত্তম পুরুষের বাচন শৈলীতে রচিত ‘হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ’ উপন্যাসটি ব্যক্তিগত জীবনের পাওয়া না পাওয়ার এই লেখার নায়ক শোভন--যাকে চারপাশের সহস্র জ্বালা-যন্ত্রণা জমাট পাথরের মত আঁকড়ে ধরেছে। মা-বাবা হারিয়ে আত্মীয়-স্বজনহীন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সে এক টুকরো লাল ফিতের মত আহত ভালোবাসা নিয়ে তুষের আগুনে জ্বলে-পুড়ে বিরহের বিষাক্ত স্রোতে ভেসে যাচ্ছে লক্ষ্যহীন পথে। সময় আর ধর্মের শক্ত শিকলে বাঁধা বিধর্মী এক কিশোরীকে ভালবাসার অপরাধ সন্ত্রাসে রুপ নিলে, তাকে জেল খাটতে হয়। রক্ত সম্পর্কহীন এক চাচার বাসায় আশ্রিত থাকাকালীন সে জানতে পারে--চাচা পিতা হত্যাকারীদের একজন। রাগে, ক্ষোভে এক ফোঁটা ভালবাসা, এক টুকরো শান্তির জন্য আপন বিবেককে বিসর্জন দিয়ে গন্তব্যহীন শ্যাঁওলা পথে পা বাড়ায়। বিখ্যাত ধনীর একমাত্র মানসিক বিকারগ্রস্ত কন্যাকে নিয়ে আগুন খেলায় সে মেতে উঠে। বিধর্মী মেয়েকে ভালবাসা অসম্পূর্ণ রেখে ব্রেইন ক্যান্সারে মারা যায় তার একমাত্র ছোট ভাই। কেউ কথা রাখেনি তার জীবনে। তার জন্য নিষিদ্ধ, অশান্তির এই বিষাক্ত পৃথিবীতে আহত হৃদয়ে এতিম এই পরাজিত সৈনিক ক্রমাগত দুঃখ-জ্বালা, স্মৃতিগত যšত্রণায় জ্বলতে জ্বলতে নিষিদ্ধ বৃত্তের সীমান্তে পৌঁছে যায়, হয়ে উঠে জীবন্ত লাশ। চুক্তি অনুযায়ী হারাতে হয় মানসিক রোগ হতে সুস্থ, সুন্দরী যুবতীকে। কিন্ত ভালবাসা কি চুক্তি মানে? ভালবাসা যা দেয়--তার চেয়ে অনেক বেশী কেড়ে নেয়। তবুও মানুষ ভালবাসার জন্য সহস্র শিকলের ত্রিভূজ ভেঙ্গে বাইরে বেড়িয়ে আসতে চায়। আর তাইতো ভালবাসার নীল দংশনে বিষাক্ত হয়ে উঠে হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ।
১৯৯২ সালে এই উপন্যাসটি ‌‌‌‌‌‌‌'দৈনিক সকালের খবর' পত্রিকায় এবং ১৯৯৪ সালের বই মেলায় প্র্রকাশিত হয়েছিল। বুর্জোয়া সমাজের বেকার যুবকদের মাঝে উপন্যাসটির আবেদন এখনও অটুট আছে। আর তাই...

উৎসর্গ
বাংলাদেশের বেকার যুবকদের--
যারা ভুল করে, ভুল করে এবং
সেই ভুলের যন্ত্রণা সারাজীবন বয়ে বেড়ায়।]

 

 

পর্ব-১


দেড় বছর ধরে ছোটখাট একটা চাকুরী খুঁজছি। এমন কোনদিন নেই, যেদিন আমি চাকুরীর জন্য ছুটোছুটি না করি। আজ এমন একটা অফিসের ওয়েটিং রুমে বসে আছি--যেখানে চাকুরীর পদসংখ্যা বারটি আর আবেদন পত্র জমা পড়েছে তিন শত সাতাত্তরটি। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ধরেই নিয়েছি--আমার চাকুরী হবে না। তবুও আল্লাহ্র মহান অদৃশ্য শক্তির প্রতি দুর্বলতার কারণে ধৈর্য্য ধরে বসে আছি। দেখি, অদৃশ্য শক্তি আমার ব্যক্তিগত জীবনের পঁচিশ বছরের আশাহত মনের সমস্ত দুঃখ-কষ্টের মাঝে একটা বনফুল ফোটান কিনা। জীবনে সুখ নামক অদৃশ্য পাখিকে আপন করতে গিয়ে এমন সব বেদনার সম্মুখীন হয়েছি--যে বেদনা সুখ নামক আকাংখিত পাখীকে ক্রমাগত চাপা দিতে দিতে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল মাটির নিচে পুতে রেখেছে। সুখ কি জিনিষ--আমি জানিনা। তবে জানতে চাই। আমি জানি, আমার হৃদয় খনিতে সুখ আছে--সুখ আছে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল মাটির গভীরে--যা আবিষ্কার করার জন্য অথবা খুঁজে বের করার জন্য, যেসব বিজ্ঞানীদের প্রয়োজন, যেসব সুস্থ্য মস্তিষ্কের মানুষ প্রয়োজন-- তারা নেই; আছে অসুস্থ্য মস্তিস্কের মানুষ--যারা নিজেদেরকে কেউ আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা, কেউ বুদ্ধিজীবী, কেউ দেশসেবক হিসাবে মনে করে। এরা দলীয়ভাবে আপেক্ষিক ভাল, আপেক্ষিক পূজনীয় কিন্তু পরম পূজনীয় নয়। আপেক্ষিক পূজনীয় বলেই হিংসা-বিদ্বেষ এদের রক্ত প্রবাহে বয়ে চলে অবিরাম। আর এর ফলেই সুখের খনির আর আবিষ্কার করা হয় না বরং সুখ আরো গভীরে চাপা পড়তে থাকে। আমরা দুঃখের মাঝেই সুখের নীড় খুঁজে বেড়াই। পায়ে জুতা নেই বলে খুব একটা আফসোস করি না; কারণ আমাদের আশে পাশে অসংখ্য পঙ্গুরা ভিক্ষা করে, যাদের পা-ই নেই। যদিও বা হঠাৎ করে ধনসম্পদসহ কেউ সুখের ছোঁয়া পায়; তবে পরম আল্লাহ্কে অসংখ্যবার ধন্যবাদ জানায়; ঠিকমত নামাজ-রোজা কায়েম করে। তারপর আসতে আসতে নিজেকে বেহেস্তের যাত্রী প্রমাণ করতে গিয়ে ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। আর যদি সুখ না পায়, অর্থ-সম্পদ কপালে না জুটে, তবে একজন আরেকজনকে দোষারোপ করে; নয়তো আপন ভাগ্যের কপালে হাজারটা গালি দেয়।

আমাকে ‘ভাইভা’তে ডাকবে--সেই আশায় বসে আছি। আমার সিরিয়াল নং একাত্তর। একেবারে স্বাধীনতা যুদ্ধের সন। মাত্র বার জনকে ভাইভা নেওয়া হয়েছে। দু’একজন ছাড়া সবাই গম্ভীরভাবেই ভাইভা কক্ষ থেকে বের হচ্ছে। বিরাট বড় অফিস। মনে হয়, ওয়েটিং রুমটাই সবচেয়ে বড়। না জানি, প্রতিদিন এখানে কত লোক ওয়েট করে। একটা রুম পূর্বদিকে--যা অন্যান্য রুমগুলি থেকে বেশ হাইফাই মনে হয়। জানতে পারলাম, ওটা মালিকের কক্ষ। বাইরে থেকেই যে ফিটফাট দেখা যচ্ছে, ভিতরে না জানি কি স্বর্গীয়রুপ! আমার দেখারও ইচ্ছে নেই, জানারও ইচ্ছে নেই। আলু ভর্তা আর ডাউলের মেনুটা যদি মাছ আর নানান সব্জিতে ভরপুর থাকে--তবেই আমার পরম পাওয়া। তবে অবশ্য এটা আপাতত। বড় হবার ইচছা সবারই আছে। একটা গরুও চায়, ময়লা গোয়াল ঘর ছেড়ে একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পাকা করা মেঝের উপর থাকতে। মাঝে মাঝে আমার অনেক বড় হতে ইচ্ছে করে--অনেক বড়। জানি, এটা কোনদিনই সম্ভব না। আবার নিজেকেই বোঝাই, অতি বড় হইও না; ঝড়ে পড়ে যাবে। কিন্ত এটাওতো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, ছোট হয়ে থাকার ফলে প্রতিদিন ছাগলেরাও আমাকে মারিয়ে যাচ্ছে। আমি মাঝারি থাকতে চাই।

প্রার্থীরা একজন আরেক জনের সাথে কথা বলছে। জাহাজে বারটি পোস্ট খালি। প্রতিটি পোস্টই সাধারণ কেরাণী গোছের। এখানে যারা এসেছে তাদের কেউ এম.এ পাস, কেউ অনার্স পাস, কেউ ডিগ্রী পাস, কেউবা এইচ.এস.সি, এস.এস.সি পাস। একটা বাবুর্চি চাওয়া হয়েছে--যার শিক্ষাগত যোগ্যতা অন্ততঃ অষ্টম শ্রেণী হতে হবে। আমি বি.এ. পাস করেছি দেড় বছর আগে। অভাবের কারণে সামনে পড়ার ইচ্ছা জাগেনি। আর সাধারন কেরাণী মাপের চাকুরীর জন্য এম.এ.পাস প্রার্থী দেখলে সামনে পড়ার যেটুকু ইচ্ছা থাকে, তাও বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যায়। প্রার্থীদের একজন একজন করে পশ্চিমের একটা কক্ষে ডাকা হচ্ছে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে অফিসটা দেখছি। অনেক জায়গায় চাকুরীর জন্য ধন্না দিয়েছি কিন্তু এত হাইফাই, এত সুন্দর অফিস কখনও দেখিনি। যেন, পৃথিবীর আর এক নতুন রূপ। বাইরে এত গরম অথচ এখানে এ.সি’র গুণে কত আরাম! মালিক কক্ষে মালিক ব্যাটা না জানি কি সুখেই আছে। স্বর্গের যদি চোখ থাকত আর এই রূপটা দেখত; তবে নিশ্চয় লজ্জা পেত; নয়তো অন্তঃসার শূন্যের মত আরো গলাবাজি করত। আমাদের সমাজে জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী বলে আখ্যায়িত অনেকেই বেশ গলাবাজি করতে পারে। এরা একজন আরেক জনের জ্ঞানকে তুচ্ছ ভাবে, নিজেকে আরো জ্ঞানী ভাবে। শিক্ষকরা যেমন সবাইকে ছাত্র ভাবে; এরাও তেমনি সবাইকে তাদের বুদ্ধি বা জ্ঞানের অনুগত কিংবা অনুসারী মনে করে।

মালিক কক্ষ থেকে কোর্ট-টাই পরিহিত একজন লোক বের হল। তার পিছু পিছু আরো চার-পাঁচজন। এই প্রথম ব্যক্তি নিশ্চয়ই মালিক। আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম। তিনি সবার দিকে তাকালেন তাচ্ছিল্যভাবে। একজন লোক বেশ তোষামোদী ভঙ্গীতে মালিকের কাছাকাছি গেল।
- কয়টা দরখাস্ত জমা পড়েছে, জলিল?
- তিন শত সাতাত্তরটি স্যার।
- বল কি!
-হ্যাঁ, স্যার―
- ঠিক আছে। কেউ আসলে বসতে বলো। আমি মিনিষ্ট্রি-তে যাচ্ছি। ফোন আসলে দুইটার পরে করতে বলো। আমার ফিরতে একটা-দেড়টা বেজে যাবে।
- জ্বী স্যার―

নেম প্লেট-এ দেখেছি, তার নাম নজরুল চৌধুরী। আমি তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, “ভাই, বেহেস্তে কেমন আছেন?” হঠাৎ তার চোখ আমার দিকে পড়ল। আমি ঢোক গিললাম। মনে মনে যে কথা বললাম―তা শুনেছে নাকি? প্রথমবার সম্বিলিতভাবে সালাম দিয়েছিলাম। এখন আরেক বার দিলাম। তিনি মনে হয়, মনে মনে সালাম নিয়েছেন। ধনীরা গরীবদের সালাম মনে মনেই গ্রহণ করে। গরীবদের এরা তোয়াক্কাও করেন না। গরীবরা হল এদের অনুগত, আদেশের দাস। তিনি আমার সামনে আসলেন। আমাকে চিনেন নাকি? এর মত লোক আমাকে চিনবে? অসম্ভব। আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সবাই আমার আর তার দিকে তাকাচ্ছে। তিনি এবার সবার দিকে তাকালেন। তার চার-পাঁচ জন অনুসারীদের গাড়ীতে উঠতে বলে তিনি নিজ কক্ষে আবার চলে গেলেন। ঢুকার সাথে সাথে রিং বাজল। আমার বয়সী একজন পিয়ন, অফিসে কাজ করে, ভিতরে ঢুকল। ফিরে এসে আমাকে ঢুকতে বলল। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। অনেকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেছে। তারা কি যে বলছে--তা আমার মাথায় ঢুকছে না। আমার একমাত্র চিন্তা কেন তিনি...? ভিতরে ঢুকলাম। সালাম দিলাম। এই নিয়ে তিনবার। আগে যে দু’বার সালাম দিয়েছি―তা স্পষ্ট মনে নেই। বসতে বললেন। আমি বসলাম। তিনি সিগারেট ধরালেন। বা! কত আরামের জায়গা। ওয়েটিং রুম থেকে আরো আরাম। স্বর্গের আরাম কি আরো বেশী? আমি ঐরকম স্বর্গ চাই না―এ রকম আরাম হলেই চলবে। সিগারেটে দুই-তিনটা টান দিয়ে এস্ট্রেতে ফেলে রাখলেন। আমি তার সামনের অপরূপ টেবিলটার দিকে তাকিয়ে আছি। আশে পাশে তাকাতে ইচ্ছে করছে। মানুষের তৈরি স্বর্গটা দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু উচিত হবে না। চুপচাপ বসে রইলাম। আমার চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসছে। দু’এক মিনিট অতিবাহিত হয়েছে। তিনি এবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ালেন।
- কি নাম তোমার?
- শোভন মৃধা।
- কি কর?
- জ্বী, চাকুরী খুঁজছি।
- অবাক হয়েছ?
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সম্মতি দিলাম। উনি আমাকে একটা কার্ড দিলেন। ঠিকানা অনুযায়ী বিকালে যেতে বললেন। পরে উনি আলাপ করবেন। মিনিস্ট্রি-তে যাবেন বলে তার হাতে সময় নেই। কার্ডটা আমি না পড়েই পকেটে ঢুকালাম। তিনি উঠলেন। আমাকে নিয়েই বের হলেন। আমি মাথা নিচু করে তার পিছু পিছু হাঁটলাম। নিচে নেমে ড্রাইভারকে বললেন, আমি যেখানে যেতে চাই, সেখানে যেন নামিয়ে দেওয়া হয়। একটা গাড়িতে তিনি উঠলেন। তার সাথে পিছনের সীটে আরো দু’জন উঠল। বাকীরা আরেকটা গাড়ীতে উঠল। না জানি, কয়টা গাড়ী তার । আমি আমার ভাইভা’র কথা বললাম। তিনি বললেন, ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌এ চাকুরীর দরকার নেই। এখানে চাকুরী হবে না। যার হবার তার হয়েই আছে। ভাইভা দেওয়া হল না। গাড়িতে উঠতেই আরেক শান্তি। এসি করা গাড়ী। ড্রাইভার আমার সাথে কোন কথা বলল না। আমি তার সায় শব্দ না পেয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। কার্ডটা পড়লাম। ৬৬ নং কামাল আতাতুর্ক রোড, বনানী। নিশ্চয়ই ওখানে বাড়ি। আমাকে তার বাড়িতে যেতে বলল কেন? বেশ চিন্তায় পড়লাম।

( চলবে)

 

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ