[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ (পর্ব-১০)

  

- শাশ্বত স্বপন -

 

আবেগ মানুষকে কত কি ভাবায়। সব কি সত্য হয়? মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। ভালোবাসার কথা ভাবলাম। মাত্র একদিনেই ন্যান্সির জন্য মনটা কেমন করছে। আমি কি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি? এ কি করে সম্ভব!। শোষক আর শোষিতের মধ্যে যে সেঁতু থাকে সেতো ভালোবাসার নয়--ঘৃণার, হিংসার। গাড়ি ছেড়ে দেবার মুহূর্তে মিসেস নজরুলকে সালাম দেইনি। নিজের চিন্তা-ভাবনা আর আবেগের উপর দশটা গালি দিলাম। মনে মনে থুথুও ছুঁড়ে মারলাম। আমার বিবেক আমাকে বলছে--
-- তুমি জান না, তুমি কি আগুন নিয়ে খেলতে যাচ্ছ।
-- না, আমি জানি, সব জানি। পরাজিত সৈনিকের বিজয় দেখতে চাই।
-- টাকা, সম্পত্তি, সম্মান, ভালোবাসা তোমাকে ভালোবাসলেও সুখ-শান্তি তোমাকে কোনদিন ভালোবাসবে না।
-- আমি সুখ চাই না, শান্তি চাই না--আমি বড় হতে চাই।
-- তুমি কি সত্যিই যাবে?
-- হ্যাঁ, যাব।
-- আল্পনাকে ভুলে গেছ?
-- অসম্ভব, কোনদিনই না।
-- আজ রাতটা ভেবে দেখ।

হ্যাঁ, ভাবব, তবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না কারণ পঁচিশ বছরের পরবর্তী বছরগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি সন্দিহান। পায়ের নিচে মাটি নেই। ছোট ভাইটাকে পারি না খরচ দিতে। নিজের পেটটাকে পারি না দু’বেলা খুশি করতে। মৃত্যুর পূর্বে তখন সম্মুখের কাউকে লক্ষ্য করে বলব, ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে আমার জন্য, আমার অধিকারের সাড়ে তিন হাত ভূমিও নেই। এসবই তো মানুষের জন্য--সৃষ্টিকর্তা মানুষের জন্যই তো এসব কিছু সৃষ্টি করেছেন। এসব কিছু তো মানুষের জন্যই সিদ্ধ--তবে আমার জন্য কেন এসব নিষিদ্ধ? আমি কি মানুষ নই?
আমার বিবেক আমার যুক্তির কাছে হার মেনে চুপ করে আছে। যুগে যুগে প্রত্যেকের বিবেক প্রত্যেকের কাছে হার মানতে মানতে এক সময় বিবেকই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সবাই হবে তখন বিবেক বর্জিত। বিবেক বর্জিতদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়বে--কমবে না। বিবেক দিয়ে মনুষ্যত্ব বাড়ানো যায় কিন্তু আজকের যুগে মানুষ নামক প্রাণিটিকে টিকিয়ে রাখা যায় না।

সিগারেটের দোকান চোখে পড়তেই হঠাৎ গাড়ি থামাতে বললাম। ড্রাইভারকে বড়লোকী স্টাইলে ৫৫৫ সিগারেট কিনতে বললাম। ম্যাচও আনতে বললাম। পকেটের পুরো টাকা খরচ করলাম। বিবেককে হারিয়েছি। বড় আনন্দ লাগছে। আমি বড়লোক হব কিনা জানি না, তবে ধনী হতে পারব। কাল থেকে হবে যাত্রা শুরু। গাড়ি ইত্তেফাকের মোড়ে আসতেই তাকে থামতে বললাম। ‘‘আমি হেঁটেই যেতে পারব”--একথা বলে ড্রাইভারকে বিদায় করলাম। ড্রাইভার আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। আজও সিঁদুরকে পড়াতে যাওয়া হয়নি। দুই মাস না যেতেই এত বন্ধ! টিউশনিটা বোধহয় বন্ধ হয়ে যাবে। যাক না বন্ধ হয়ে। টিউশনি করার দরকার নেই। এখন শুধু ন্যান্সি আর ন্যান্সি। এটই আমার এম.এ কোর্স। এখান থেকে হয় এম.এ পাস করব, নয়তো ফেল করব। লক্ষ্য আমার এখন বড় হওয়া। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ নেতা, কেউ ব্যবসায়ী হয়ে, কেউ মানুষের ভালোবাসা ও বিশ্বাস কিনে বেঁচে বড় হয় বা হতে চায়। আমি বিশ্বাস এর শিকড় ধরে ভালোবাসার সেঁতু বেয়ে বড় হতে চাই। এখানে আমার অর্থগত মূলধন নেই; অথচ পাব খাদ্য, ভালোবাসা, বেতন আর রিটায়ার্ট শেষে বিরাট সম্পত্তি ও সম্পদ। বড় হওয়ার জন্য সম্মুখে প্রশস্ত পিচ্ছিল পথ। সাবধানে পথ চলতে হবে। বেশি আশা করা বোধহয়, ঠিক হচ্ছে না। ভাগ্য বিধাতা ক্ষেপে গেলে শেষে দুঃখ ছাড়া কিছুই ঘটবে না। স্বপ্ন দেখতে বাঁধা কোথায়? আমাদের হা-হুতাশ জীবনে স্বপ্নের চেয়ে সান্ত্বনার মতো বড় আপন আর কে আছে? সবাই বড় হবার স্বপ্ন দেখে। দেখতে দেখতে এক শত তলা বিল্ডিং গড়ে। সেটা ঘুম ভাঙ্গলেই ভেঙ্গে যায়। তাই আবার গড়ে। ভাঙ্গা আর গড়া নিয়েই আমাদের স্বাপ্নিক জীবন। জীবনের অর্ধেক, হয়তো অর্ধেকের বেশি (যদি এ দুঃসহ জীবন চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর লাস্টিং না করে) সময় সততা, বিদ্যা, দুঃখ-কষ্ট আর টিউশনি নিয়ে কাটিয়েছি। সেই সততা, বিদ্যা, দুঃখ-কষ্ট যখন আগত ভবিষ্যতের সুখ-শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে না, তখন ঘৃণা করি সততা আর বিদ্যাকে। আমি ভালোবাসি বাস্তব, বিশ্বাস করি চক্ষু সম্মুখের বাস্তবকে। অবাস্তব আর অবিশ্বাসকে একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছি না। কারণ আমি জানি, অবাস্তব আর অবিশ্বাসকে একেবারে উড়িয়ে দিতে গেলে বাস্তবের আর বিশ্বাসের মূল আর শাখা-প্রশাখায় টানা-হেঁচড়া শুরু হয়ে যাবে।

যারা বেশি জানে, বেশি বুঝে--তাদের বেশি ভুল হয়। কারণ তারা যেহেতু বেশি বুঝে--তাই তারা তাদের ভুল বেশি ধরতে পারে। আর যারা কম জানে, কম বুঝে--তারা কম ভুল করে। কারণ তারা তাদের ভুলগুলোকেও সঠিক মনে করে--যেহেতু তাদের বিচার, বোধ শক্তি কম। আমি বেশি বুঝি, না কম বুঝি--তা জানি না। তবে এইটুকু বুঝি, মাঝে মাঝে সময়ের প্রয়োজনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানুষকে ভুল করতে হয়--আমিও করি। জেনে শুনেও মানুষ যুগ যুগ ধরে মিথ্যাকে প্রতিপালন করে আসছে। মিথ্যা হচ্ছে সত্য আর সত্য হচ্ছে মিথ্যা। আমি জানি, আমার বিচার শক্তি কম আর বিবেক শক্তি তো হেরেই যায়। তাই আমি সত্য আর মিথ্যার মাঝামাঝি। সত্য আমাকে ঠাঁই দিতে পারছে না বলে কখনও মিথ্যার কাছে ছুটে যাই। আর মিথ্যা না পারলে সত্যের কাছে। সুবিধাবাদী হয়েও সুবিধা করতে পারছি না। তাই নতুন নতুন কৌশল নিয়ে এগোচ্ছি সামনের দিকে, যেখানে মিথ্যার ভীড়ে সত্য কাফনের কাপড় পড়ে ঘুমিয়ে আছে।

আমি আগামীকাল এমন এক কাজে যাচ্ছি, যে কাজ থেকে আর হয়তো ফিরব না। পিপীলিকার পাখা গজালে যেমন আগুন খেতে চায়--আমিও তেমনি এক পিপীলিকা সদৃশ। আমিও আগুন খেতে চাই--হজম করতে চাই। পারব কিনা জানি না। মাটির মানুষ আমি। মাটিই পারে আগুন চাপা দিয়ে রাখতে। আবার মাটিই পারে তার বুকে আগুন জ্বালিয়ে রাখতে। এদেশে অসংখ্য পরাজিত সৈনিক। পরাজিত সৈনিকের পরাজয় দেখার মতো মানুষ এদেশে খুব কমই আছে। না খেয়ে মরে গেলেও আজকাল কেউ সাহায্য দেয় না। আর যদিও বা দেয়, তাও পার্থিব বা আধ্যাত্মিক স্বার্থে।

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ