[প্রথমপাতা]

 

 

 

সিঁদুর রাঙা স্মৃতি
 
 

- শাশ্বত স্বপন -

 

আমি যখন বিয়ে করি তখন আমার বয়স সাত-আট হবে। যার সাথে আমার বিয়ে হয়, সে আমার চেয়ে তিন মাসের ছোট। তার নাম সিঁদুর। তখন বিয়ে জিনিসটা নিয়ে সিরিয়াস কিছু বুঝতাম না। বিয়ে সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল; বিয়ে করলে বউকে ঘোমটা দিতে হবে; স্বামীর পায়ে সালাম করতে হবে; তাকে রান্না-বান্না, কাপড়-চোপড় ধোয়া ইত্যাদি করতে হবে। রাতে একসাথে ঘুমালে সকালে বাচ্চা হবে। আমাদের পাড়ার অনেকেরই সকালে জন্ম হয়েছিল। এমন কি আমিও নাকি সকালে জন্মেছিলাম। সিঁদুরও সকালে জন্মেছিল। এর মধ্যে আমাদের একটা বধ্যমূল ধারণা ছিল---স্বামী রৌদ্র থেকে ফিরে এসে স্ত্রীর নাম ধরে ধমক দিয়ে ডাকবে। খেতে বসে খাবার ভাল না লাগলে থালাসহ স্ত্রীর দিকে ছুঁড়ে মারবে। আমাদের পাড়ায় এগুলো খুব বেশি হত। আমার বাবা ও মা প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া করত। সিঁদুরের মা-বাবার মধ্যে অবশ্য এত বেশি ঝগড়া হত না। এ পাড়ার সব স্ত্রীরাই স্বামীদের হাতে মার খেত।

আমাদের খেলার সাথীদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আমাকে জামাই হতে হল আর সিঁদুর খুব সুন্দরী এবং আমার সাথে মানানসই বলে, ওকে বউ হতে হল। আমরা সবাই মিলে ধঞ্চে, পলিথিন, চট, দড়ি, মানকচু পাতা, নানা রংয়ের কাগজ ইত্যাদি দিয়ে একটা ঘর বানালাম। এ ঘরে বিয়ে করার পর আমি আর সিঁদুর উঠব। বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের বাড়ী হিসাবে এ ঘর থেকে আরো দূরে দুটি ঘর তৈরী করা হল। আমাদের ঘরটা সুন্দর সুন্দর ফুল, পাতা ও কাগজ দিয়ে সাজানো হল। দেখতে যেন, বাসর ঘরের মত মনে হয়। আমরা দু’জন যখন কাছাকাছি হতাম তখন সবাই হাসাহাসি করে বলত--‘বিয়ের আগে বউ-জামাই এক সাথে কেন?’ দু’জনে বেশ লজ্জা পেতাম। সরে যেতাম অন্য জায়গায়। বিয়ে হবার পর বাচ্চা হবে বলে ঘরটা একটু বড় করে তৈরী করেছি--যাতে চার-পাঁচটা বাচ্চা রাখা যায়। আমার পক্ষে ছিল জোনাকী, মায়া, রতন, শিপন ও প্রদীপ। সিঁদুরের পক্ষ্যে ছিল রিপন, তপন, মুক্তি, লুৎফর ও সিঁদুরের ছোট ভাই গোবিন্দ। এ ছাড়া পাড়া-প্রতিবেশী হিসাবে আরো অনেক ছেলেমেয়ে ছিল। যে জায়গায় আমাদের বিয়ে হচ্ছে সেটা এক জনশূন্য বাড়ী। আশে পাশে অনেক গাছ-পালা, ঝোপঝাড়।

খুব ঘটা করে না হলেও মোটামুটি হৈ-হুল্লোরের মধ্যেই আমাদের বিয়ে হল। রিপন ও শিপন কলমীফুল দিয়ে মাইক বানিয়েছিল। কাগজ মুড়ে স্পীকার বানিয়ে বিয়ের গান গেয়েছিল ‘হলুদ বাট, মেন্দি বাট...। সিঁদুর ওর দিদির শাড়ী চুরি করে এনেছিল। ফ্রকের উপর দিয়ে শাড়ীটা পড়ে, অনেক বড় ঘোমটা দিয়ে, কান্নাকাটি করে, যখন সিঁদুর আমার ঘরে ঢুকল তখন ওর চেয়ে আমিই বেশি লজ্জা পেলাম। ঘরে ঢুকতেই ওর ছোট ভাই গোবিন্দ চিৎকার জুড়ে ছিল। সেও দিদির সাথে ঘরে যাবে। মুক্তি তাকে জোর করে দূরে নিয়ে গেল। বিয়ের দাওয়াত খেতে অনেকে এসেছে। মাটির তৈরী খাবার আর কচুরী পানার ডগা দিয়ে মাংস মিছামিছি খেয়ে সবাই ঢেঁকুর দিল। আমি রুমাল মুখে দিয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম। সবাই বউ জামাইকে দেখল। কেউ সুন্দর সুন্দর পাতা, কেউ সিগারেটের প্যাকেটের ভিতরের ঝিকমিক কাগজ, কেউ ফুল ইত্যাদি উপহার দিল। সিঁদুর ঘোমটা দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। উপহারগুলি রতন ঘরে সাজিয়ে রাখল। কিছুক্ষন পর রাত হবে। যদিও প্রকৃতির নিয়মে সেদিন দিন তবুও আমাদের নিয়মে রাত। বাসর ঘরে ঢুকলাম। বাইরে থেকে ওরা দরজা বন্ধ করে দিল। আমরা দু’জনে মিটিমিটি হাসলাম।

এখন বাসর রাত। অল্প সময় ব্যয় করতে হবে। কারণ এরপর বাচ্চা-কাচ্চা জন্ম, লালন-পালন পর্ব এবং দুপুরে খাবারের আগে মা-বাবা ডাকতেই সবাইকে যার যার বাড়ী যেতে হবে। সমস্যা হয়েছে, বাইরে থেকে বিয়াই-বিয়াইন সম্পর্কীয় আত্মীয়রা আমাদের লজ্জা দিতে লাগল। আগেই বলে রাখা ভাল; আমাদের কারো বয়স দশ এর বেশি নয়। বাইরে থেকে কটুক্তি শুরু হয়ে গেছে। মুক্তি বলল,
--জামাই-বউ কি করে? হে:হে:হে:
রতন আবার দুষ্টামী করে বলছে,
--ও বিয়াইন, তুমি কি দেখ?
--আহারে বিয়াইরে, বিয়াইর সামনের দাঁত পোকে খাইছেরে...।
বাসর শয্যা ভাল করে হল না। দু'জনে একসাথে মুখোমুখি হয়ে শুয়েছিলাম। আমার পা শাড়ীতে লাগতেই রাগ হয়ে বলল,
--ঐ কাপড়ে ময়লা লাগালে দিদি বকবে?
--পরে পানিতে ধুয়ে দিবি। বাচ্চা-কাচ্চা পালতে ময়লা লাগবে না?
সিঁদুর লজ্জা পেয়ে আমাকে চিমটি কাটল। বিকালে দিদিমণির কাছে পড়তে যেতে হবে। কত পড়া এখনো মুখস্ত করিনি। সিঁদুর, আমি দু’জনেই ২য় শ্রেণীতে পড়ি। পড়ার প্রসঙ্গ তুলতেই ও হাত দিয়ে ধাক্কা দিল।
--রাখ ওসব, বাচ্চা বানাবে কি দিয়া?
--জোনাকী পুতুল আনতে গেছে।
-- তোর ভয় করছে না?
-- না, লজ্জা করছে।
-- চল, বাসর ঘর হয়ে গেছে।
-- হ, চল।

জোনাকী চারটা পুতুল নিয়ে এসেছে। সিঁদুর আমাকে মাটির ভাত খেতে দিল। আমি মিছিমিছি ভাত খেয়ে রতন, তপন, শিপনদের নিয়ে ফসলের মাঠে গেলাম। মেয়েরা বাড়ীর কাজ নিয়ে ব্যস্ত রইল। কাজ থেকে ফিরে শুনি সিঁদুরের দুইটি বাচ্চা হয়েছে--একটি ছেলে, একটি মেয়ে। মুক্তি দুষ্টামী শুরু করেছে, মিষ্টি আনতে হবে। আমি আর রতন মিলে চিনি আর লবণ নিয়ে এলাম। রতন বিয়াই-বিয়াইনদের লবণকে চিনি হিসাবে খাওয়ায়ে আনন্দ করতে লাগল। আমি চিনিই খাওয়ালাম। কিছুক্ষণ পর রাত হয়ে এল। ঘুমিয়ে গেলাম, মিছিমিছি ঘুম। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মাঠে গেলাম। দুপুরে ক্লান্ত শরীরে ফিরে এসে দেখি রান্না করতে দেরী হয়েছে। রাগলাম, বকাবকি করলাম। সিঁদুরও মুখে মুখে খুব ঝগড়া করতে পারে। ওর সাথে ঝগড়ায় না পেরে শুরু করলাম লাঠি দিয়ে আঘাত। বাচ্চা দু’টিকে থাপ্পর দিলাম কাঁদছে বলে। দু’একটা আঘাত সত্যি সত্যি সিদুঁরের গায়ে লেগে যাওয়াতে সে আমার লাঠি কেড়ে নিয়ে আমাকেই সত্যি সত্যি আঘাত করতে লাগল। ওর সাথে ঝগড়া লাগলে আমি কখনও জিততে পারতাম না। শাড়ীটার পাড় একটু ছিঁড়ে গেছে। সে তাই দেখে আরো বেশি আমাকে আঘাত করতে লাগল। ঐ দিনের মত খেলা শেষ। সবাই আমার দলে চলে এলো। আমি তখন কাঁদছি, সিঁদুরও কাঁদছে। ওর দলে শুধু ওর ভাই গোবিন্দ রইল। সবার কথা হল, স্বামী স্ত্রীকে মারবে--এটাই নিয়ম; স্ত্রী স্বামীকে মারবে কেন? সিঁদুর কাঁদতে কাঁদতে ভাইকে নিয়ে বাড়ি চলে গেল।

আমার জীবন থেকে সে একদিন এভাবেই চলে গিয়েছিল। তখন অবশ্য ঝগড়া হয়নি। সামাজিক নিয়মেই তার বিয়ে হল সাত গ্রাম পরে বালিগাঁও গ্রামে। দু’জনে একই ক্লাশে পড়তাম। ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠার পর তার বিয়ে হয়ে গেল। আমি অবশ্য বিয়েতে খুব ফুর্তি করেছিলাম। শ্বশুর বাড়ী যাওয়ার কোন এক মুহুর্তে আমি সিঁদুরকে বললাম, ‘সিদুঁর জামাইকে আবার মারিসনে।’ ও কথা বলেনি। লজ্জা পেয়ে মুচকি হেসেছিল। পাশা পাশি দু’বাড়ি। পরদিন থেকে যখন ওকে আর দেখলাম না তখন বুঝলাম; বিয়ে বিয়ে খেলা নয়; সত্যি ওর বিয়ে হয়ে গেছে। তখন ওর বয়স হবে বার-তের। দেহের গঠনে অবশ্য পনর-ষোল ধরা যায়। গলা জড়িয়ে হাঁটার দিন যে শেষ হয়ে যাবে, কল্পনাও করতে পারিনি তখন। যে পরিবারে ওর বিয়ে হল, তারা ছিল রক্ষণশীল। ফলে বিয়ের পর ওর সাথে খুব ভালভাবে কথা হয়েছিল বলে মনে পড়ে না। ও আজ কলকাতা থাকে। ওর তিন ছেলে-মেয়ে। হিন্দুদের অনেকেই কলকাতা চলে গেছে। ছোটবেলায় হিন্দু-মুসলমান বুঝিনি। আমাদের ঈদ আর ওদের পূজা আলাদা করে আমরা ভাবিনি। দু’টাতেই সমান আনন্দ করতাম আমরা। মনে হয়, পূজাতেই আমি বেশ আনন্দ করতাম। সিঁদুর ঘর থেকে নাড়–-মোয়া চুরি করে আনত। আর আমরা বন্ধুরা মিলেমিশে খেতাম। বন্ধুদের সবার একটু ক্ষোভ ছিল আমার আর সিঁদুরের প্রতি। কারণ আমি কিছু আনলে সিঁদুরকে বেশি দিতাম। আর সিঁদুরও তাই করত। ও না খেয়েও আমাকে দিয়ে বলত--আমি অনেক খেয়েছি তুই খা অথবা আমার খেতে ভাল লাগেনা, তুই খা।’ আমি জানতাম, এটা মিথ্যা কথা। আমাকে বেশি খাওয়ানোই ছিল ওর উদ্দেশ্য। আজ সেসব কথা খুব কষ্ট দেয়। কোথায় গেল সেই দিনগুলো। বড় হতে হতে বুঝলাম, ধর্ম আমাদের দু’জনার মাঝে কত বড় দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল অথচ তখন আমরা টেরও পাইনি।

গত বছর সিঁদুর কলকাতা থেকে মা-বাবার কাছে এসেছিল। প্রায় আট বছর পর ওর দেশে আসা হল। সাথে বড় মেয়ে ললিতা এসেছে। দেশে ললিতাকে অবশ্য চার-পাঁচ মাসের দেখেছিলাম। এখন অবশ্য বয়স নয় এর মত হবে। আজ আমি বুয়েট এর প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমাদের খেলার সাথীদের মধ্যে যে কয়জন মেয়ে ছিল প্রত্যেকের বিয়ে হয়ে গেছে। কারো সাথেই তেমন যোগাযোগ নেই। সিঁদুর ওদের বাড়ীতে এসেছে শুনে আমি ওদের বাসায় যাই। ও আমাকে দেখে চিৎকার করে উঠল--‘কিরে তুই এত বড় হয়েছিস!’ বলতে বলতে খুশীতে প্রায় কেঁদেই দিল। প্রায় আট বছর পর দেখা। অথচ সামান্য জড়তাও নেই। ও তাহলে আমাকে মনে রেখেছে। বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, সিঁদুর, তুই কত আগে বড় হয়েছিস আর আজতো কত বড়। আর আমি এই যে, বড় হলাম মাত্র। কুতকুত খেলার সময় রাগে ওর কপালে ভাঙ্গা কলসীর খেলার চাড়া ছুঁড়ে মেরেছিলাম। আজো সে দাগ কপালে রয়ে গেছে। আর ও বুকে দিয়েছিল কামড়। মাংস শুদ্ধ উঠিয়েছিল। বুকের সে কষ্ট আজ আবার গর্জে উঠল। আমার সেদিন ছিন্ন মাংস দেখে ও নিজেও ভয়ে চিৎকার করেছিল। আমার মায়ের বকা খেয়েও প্রতিদিন দেখতে আসত। মাথায় পানি ঢালত জ্বর কমানোর জন্য। আমি ওর কপালের কাঁটা দাগে তাকালাম। ও আমার শার্টের বোতাম খুলে সেই চিহ্ন দেখল। হাসলাম কিছুক্ষণ।

আমরা ললিতাকে সঙ্গে নিয়ে পদ্মার তীরে বেড়ালাম। কত স্মৃতির কথা স্মরণ করলাম! দু’জনে কাঁদলাম। ললিতাকে আমার বুকের কাছে রাখলাম। সিঁদুর বারবার একটি কথাই বলছিল, ‘সুমন, কেন আমাদের কলকাতা যেতে হয়? কোলকাতা যেতে আমার ইচ্ছে করে না। তোদের মাঝে, আমার জন্মভূমির বুকেই থাকতে ইচ্ছে করে।’ আমি ওকে আমার ঠিকানা দিলাম। ললিতাকে আমার গলার স্বর্ণের চেইনটা পড়িয়ে দিলাম। একদিন অশ্রু ভরা নয়নে, ওদের বিদায় দিলাম। কিন্তু কলকাতা যাবার পর আজো সিঁদুর একটা চিঠি লিখেনি। কেন লিখেনি--জানি না--জানতে চাইও না। আমি জানতে চাই, কেন ওরা কলকাতা চলে যায়? কেন দেশ বিভাজন হল? এরই মাঝে শুনলাম, সিঁদুর এর মা-বাবা সবাই কলকাতা চলে গেছে। এই বাংলাদেশে স্মৃতি ছাড়া সিঁদুরের আর কিছু রইল না। ও আর হয়তো কোনদিন মাতৃভূমিতে আসবে না। কলকাতায় গিয়ে দেখা করব? কিন্তু কি হবে দেখা করে। কষ্ট বাড়বে। পৃথিবীতে অনেক কিছুই আছে--যা চাইতে নাই। আমি কি সিদুঁরকে চাই--কিভাবে চাই--কেন চাই--জানি না। নিঃস্বঙ্গতার মাঝে হোস্টেলে শুয়ে শুয়ে শুধুই পুরানা দিনের কথা ভাবি। হৃদয়ের মাঝে ভালোবাসার পবিত্র মন্দির গড়ে সেই মন্দিরে সাজিয়ে রেখেছি আমার প্রথম প্রেম, প্রথম বিয়ে, প্রথম বাসর রাতের নিষ্পাপ পবিত্র স্মৃতি।

 

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ