[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ (পর্ব-৬)

  

- শাশ্বত স্বপন -

 

তিনি আমাকে চাকুরির ব্যাপারটা বলেও বলছেন না। আমি কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছি। তবুও নিশ্চিত হতে পারছি না। পঁচিশ বছরের জীবনে যা ভাবি--তা কখনও হয়নি বরং যা আমি কল্পনাও করতে পারিনি--তাই আমার জীবনে ঘটে। তার মেয়েটা অন্ধ হলে বুঝতাম চোখ সমস্যা--কিডনী সমস্যা হলে, কিডনী ভাবতাম। মেয়েটির সারা অবয়ব স্বাভাবিক। তবে তারা আমাকে....? চাকুরির জন্য ধন্না দিতে হয় চাকুরি প্রার্থীকে আর উনি ধন্না দিচ্ছেন আমার কাছে। যদি কিডনী চায় এবং তা ম্যাচ হয় আমি দেব। যদি একটি চোখ চায়, তাদের কারো জন্য--আমি দেব। কারণ উনারা আমার দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়েই চাওয়া ও পাওয়ার ব্যাপারে আশা পোষণ করছেন। আমি রাজী হব। তবে বিনিময়ে অনেক টাকা দাবী করব অথবা সম্পত্তি। আমার বাবা পরাজিত সৈনিক। আমিও পরাজিত সৈনিক। জীবনের অর্ধেক যদি বিদ্যার্জনের জন্য ব্যয় হয় এবং সেই বিদ্যা যদি জীবনের বাকি অর্ধেককে টানতে না পারে--তবে ঘৃণা করি এ বিদ্যাকে, এ জীবনের মানচিত্রকে। জীবন যুদ্ধে আমি পরাজিত আর ভবিষ্যতে জিতারও কোন সম্ভাবনা নেই। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ-এ নাটকীয়ভাবে যদিও বা বিজয় আসে, সেই বিজয়ের কোন মানে হয় না। শেষ ভাল যার, সব ভাল তার--কথাটার মূল্যায়ন করার মত মন-মানসিকতা আমার নেই। কথাটা কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আমি জানি না। আমার ক্ষেত্রে, আমি এই কথাটাকে থুথু দেই। জীবনের ভাটায় জীবনের মূল্য ধীরে ধীরে কমতে থাকে। অবশ্য বিখ্যাত লোকদের ক্ষেত্রে মরে গেলেও তাদের দাম বেড়ে যায়। আমাদের বার্ধক্য জীবনে আমাদের দাম--সাড়ে তিন হাত মাটির সমান। ক্রমাগত আমরা মৃত্যুর দিকে যাচ্ছি। কখন মরে যাই--তাও ঠিক নেই। জীবনে, সুখ নামক বস্তুটা কি--আমি অনুভব করতে চাই। সেই আবহমানকাল থেকে আমরা সবাই দুঃখের মাঝেই সুখের নীড় গড়ে যাচ্ছি। স্বাধীন দেশেও দুঃখের মাঝেই বসবাস। আমি সুখের মাঝে সুখের নীড় বা সুখের মাঝে দুঃখের নীড় গড়তে চাই। সুখের মাঝে দুঃখের নীড়ের মূল্য আছে--কিন্তু দুঃখের মাঝে সুখের নীড়ের কোন মূল্য নেই।
--বাবা, তুমি আমার সাথে চল--
-- কিন্তু আমি, মানে আমার মনে হচ্ছে, আমাকে আপনি কি যেন বলতে চাইছেন। বলেও বলছেন না। আমি কিছু মনে করব না।
-- না, না কিছুই বলতে চাচ্ছি না। তোমার চাকুরি--
-- হ্যাঁ, চাকুরি--
-- রকিব মানে ডাক্তার তোমাকে সব বলবে। তুমি আমার সাথে চল।

আমি কিছু খাওয়াতে চাইলাম। উনি খেতে চাইলেন না। শুধু সৌজন্যতা রক্ষার্থে এক গ্লাস পানি পান করলেন। তারা দু’জনে গাড়ির সামনে গেলেন। আমি শার্ট-প্যান্ট পড়ে তাদের সাথে গাড়িতে উঠলাম। উনি তার সাথে আমাকে বসালেন। আমি ইতস্তত: অনুভব করছি। তার পাশে জড় পদার্থের মত বসে রইলাম। তার বাহ্যিক চেহারার কোন বিরক্তি বা জড়তা দেখলাম না। না থাকারই কথা। চলতে পথে তারা কত রকমের মানুষের সাথে গা ঘেষাঘেষি করে। এটাই তাদের কালচার। আমার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করলেন। ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমি হতাশাগ্রস্ত--যা শুনে উনি বেশ খুশিই হলেন। হয়তো ভাবছেন, ঠিক জায়গাতেই বড়শী ফেলেছেন। মাছ টোপ গিলবেই। টাকা দিলে বাঘের চোখ মিলে আর আমি তো কোটি কোটি দরিদ্রদের ভীড়ে এক নগণ্য দরিদ্র ব্যক্তি। মরে গেলে এক ভাই ছাড়া আর কেউ কাঁদবে বলে মনে হয় না। আমি এমন খ্যাতনামা ব্যক্তি নই, সমাজ সেবক নই, যে দেশের কোন সম্ভাবনা ধুলিসাৎ হয়ে যাবে। বরং মরে গেলেও দেশের একটা বেকার সমস্যা কমবে। একটা সাধারণ পিয়নের চাকুরিতে দু’হাজার দরখাস্ত জমা পড়ার সম্ভাবনা থাকলে অন্তত: একটা বাদ পড়বে। আমার জন্য ব্যবহার্য সামগ্রী অন্য খাতে ব্যয় হবে। বন্ধু মহলে কেউ বলে এত উদাসীন হওয়া ঠিক না। সেটা আমিও বুঝি। কিন্তু সাপে যাকে কামড়ায় সেই বুঝে সাপের বিষের কি জ্বালা! নেই মা, নেই বাবা, নেই কোন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন। বাবা তার পরিবারের একমাত্র সন্তান ছিলেন। অতএব কাকা-ফুফু তো না থাকারই কথা। মা ছিলেন হিন্দু। যুদ্ধের আগে-পরে তার পরিবারের সবাই কোলকাতা চলে গেছে । অতএব, বাংলাদেশে মামা-কাকা নেই। নেই ভিটে-মাটি। যেটুকুও ছিল তাও বেপারী, শিকদার, মোড়ল প্রতাপশালীদের দখলে চলে গেছে। অবশেষে, আমার মাঝে যেই সাইজের বিদ্যা--তা নিয়ে আজকের যুগে মন্দির আর মসজিদ ছাড়া আর কোথাও যাবার সামর্থ্য আছে বলে, মনে হয় না। মসজিদ-মন্দিরে চাকুরির জন্য নয়--প্রার্থনা করার জন্য--‘‘হে বিধাতা, তুমি আমাকে চাকুরি দাও; নয়তো দুনিয়া থেকে বিদায় কর।”

গাড়ি বাসার ভিতর ঢুকে গেল। মিসেস নজরুলের সাথে তাদের ড্রয়িং রুমে গেলাম। দেখলাম, শুধু ডাক্তার বসে আছে। হাতে একটা ম্যাগাজিন। বসতে বললেন, বসলাম। অল্প সময়ের মধ্যে দেখি, চপ, চা, বিস্কুট, ফলমূল, পানীয় ইত্যাদি বিশ-পঁচিশ রকমের খাবার এসে গেছে। বেশ সজ্জিত ড্রয়িং রুম। দুই দেয়ালে দুইটা দামী পেইন্টিং ঝুলছে। ডাক্তার সম্মুখে বসে থাকায় আড়চোখে আশপাশটা দেখলাম। উনি খেতে বললেন। মিসেস নজরুল পাশের রুমে চলে গিয়েছেন। তার কথাবার্তা শুনা যাচ্ছে। তার মেয়ের সাথেই বোধহয় কথা হচ্ছে। আমি ডাক্তারকে আগে খাবার গ্রহণ করতে বললাম। তারপর আমিও খেতে শুরু করলাম। বেশ কিছু খাবার খাওয়ার পর মহিলা একটা ডায়েরী নিয়ে ডাক্তারের পাশে আসলেন। ডায়েরীটা তার হাতে দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। চপটা নেবার জন্য আমাকে অনুরোধ করলেন। তিনি তার ভাইকে বললেন, ‘রকিব, তোরা কথা বল, আমি আসছি--।’

আমি যে কোন প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য প্রস্তুত আছি। আমার ভিতরে কোন ভয় নেই। জীবনের মূল্য এখন আমি অন্য ভাবে ভাবী। মাঝে মাঝে ভাবী, আমি বোধ হয় বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। আমি স্বাভাবিকভাবেই একটু একটু করে একটা চপ খাচ্ছি। চপের অর্ধেক শেষ হতেই দেখি সেই মেয়েটি। একেবারে সেজেগুঁজে হাজির। আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। আবার কি জড়িয়ে ধরবে নাকি? না, তেমন কোন লক্ষণ দেখা গেল না। বরং অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। মুখটা গম্ভীর হয়ে আছে। তবুও দেখতে দারুণ চমৎকার। না জানি, সুস্থ অবস্থায় দেখতে কত সুন্দরী ছিল! অবশ্য ধনীদের অধিকাংশ মেয়েরাই সুন্দরী হয়। জন্মটা কালো হলেও কসমেটিক্স, পারলার আর পোশাকের গুণে সুন্দরী না হয়ে উপায় নেই। আর যে খাবার-দাবার--তা বস্তির কালো হেঙলা-পাতলা মেয়ে খেলেও নাদুস-নুদুস হয়ে উঠবে। সুখাবয়বও চিকচিক করবে। ডাক্তার কি যেন ইশারা করল। সে আমাকে সালাম দিল। আমি অবাক। কি সুন্দর মুখের সাউণ্ড। ডাক্তার ডাকতেই সে তার একেবারে কাছে বসে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ মোটেও অন্য দিকে যাচ্ছে না। এই মুহূর্তের পরিবেশটার জড়তা কাটানোর জন্য ডাক্তার একটা কৌতুক বলা শুরু করলেন। বলার আগে মেয়েটির সম্মতি নিয়েছিলেন। কৌতুকের কথা শুনে মেয়েটি খুবই খুশি হল। গল্পটা এরকম--“এক হাতুড়ে ডাক্তার বাইরে বের হবার আগে তার সহকারিকে বলে যান--যদি পেট ব্যথার রোগী আসে তবে যেন, সাত নাম্বার বোতলের ঔষধ দেয়। আর যদি মাথা ব্যথার রোগী আসে, তবে যেন, আট নাম্বার বোতলের ঔষধ দেয়। আর যদি পাতলা পায়খানার রোগী আসে, তবে যেন, পনর নাম্বার বোতলের ঔষধ দেয়। ঐ গায়ে তখন এই তিনটি রোগই প্রকট ছিল। হাতুরে ডাক্তার চলে যাবার পর এক পাতলা-পায়খানার রোগী এলো। সহকারী পনর নাম্বার বোতল খুঁজে বের করে দেখে, খালি বোতল। ঔষধ নেই। আরো কয়েকটা পনর নাম্বার বোতল খুঁজেও ঔষধ পাওয়া গেল না। অগত্যা সে কি করে? রোগী তো অলরেডী পায়খানা করেও দিয়েছে। অবস্থা সিরিয়াস!”

মেয়েটি ‘সিরিয়াস’ শব্দটি শুনা মাত্রই হাসতে শুরু করল। কি সুন্দর হাসি! আমি তাকাতেই সে হাসি থামিয়ে দিল। আবার আমার দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ডাক্তার মেয়েটির মাথায় হাত দিয়ে বলতে লাগল--‘‘তারপর অবস্থা বেগতিক দেখে সহকারী একটা বুদ্ধি বের করল। সে পেট ব্যথার সাত নাম্বার আর মাথা ব্যথার আট নাম্বার বোতল দুইটার অর্ধেক অর্ধেক পরিমাণ পনর নাম্বার বোতলে ঢেলে রাখল। তারপর কয়েকবার ঝাঁকিয়ে রোগীকে খাওয়াতে লাগল। সাথে সাথে তার নিজের সুবুদ্ধির প্রশংসা করতে লাগল। রোগী এরই মধ্যে আরো একবার পায়খানা করে ফেলেছে। ঔষধ খাওয়ার কিছুক্ষণ পর রোগী অক্কা পেল।”
সবাই একসঙ্গে হাসতে শুরু করলাম। আমার হাসি শেষ হবার আগেই সে তার হাসি থামিয়ে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আসন থেকে মুহূর্তের মধ্যে যেন উঠতে পারি--তার প্রস্তুতি নিলাম। যা ভেবেছি--তাই হল। সে প্রচণ্ড গর্জনে ফ্রান্সিস ফ্রান্সিস...বলে চিৎকার করে আমার কাছে আসতে চাইল। ডাক্তার তাকে অন্য রুমে নিয়ে গেল। আরো দু’জন মহিলাও মেয়েটিকে ধরল। ডাক্তার ফিরে এসে আমার খুব কাছে আসলেন।
-- কিছু বুঝতে পারছ? ন্যান্সি সম্পর্কে তোমার ধারণা কি?
-- জ্বী, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। কিছুক্ষন আগেও স্বাভাবিক দেখলাম।

( চলবে...)

 

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ