[প্রথমপাতা]
|
ধারাবাহিক উপন্যাসঃ হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ (পর্ব-৭)
- শাশ্বত স্বপন
-
তিনি আমার পিছনে চলে গেলেন। অন্যদিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলেন। আমি মেয়েটির
ন্যান্সি নামটি নিয়ে একটু ভাবলাম। এতক্ষণে নামটা জানা গেল। খুব সুন্দর নাম,
ন্যান্সি। এতক্ষণ গল্পে মেয়েটি বলতে বলতে আমি নিজেই বিরক্ত হয়েছি। এখন
ন্যান্সি বলা যাবে। ডাক্তার ডায়েরীটার কয়েকটা পাতা নাড়াচাড়া করলেন। আমি তার
দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমার সম্মুখে ভাবাবেশে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বলতে শুরু
করলেন, ‘মাই নাইস মিনস ন্যান্সি ইজ মেন্টাল পেসেন্ট
একর্ডিং টু মেন্টাল
সাইন্স এন্ড ট্রিটমেন্ট। সী ইজ নাইটিন ইয়ারস ওল্ড এণ্ড অনলি সিঙ্গেল ডটার
অফ দা ফ্যামিলি। সী লাভ এ বয় নেমড ফ্রান্সিস...।’
ডাক্তার বেশ কিছুক্ষণ ইংরেজিতে কথা বলতে লাগলেন। যার সারমর্ম হল--ন্যান্সি
খ্রীস্টান এক ছেলেকে ভালোবাসত। ছেলেটির নাম ফ্রান্সিস রোজারিও। তারা
জার্মানীর অধিবাসী। তার বাবা বাংলাদেশে অবস্থিত জার্মান কালচারাল সেন্টারে
কাজ করত। ফ্রান্সিসরা দুই ভাই, এক বোন। তার মা বাঙালি। ফ্রান্সিস-এর চেহারা
বাঙালীদের মতই বেশ হ্যাণ্ডসাম, দেখতে আমার মত, তবে আরো ফর্সা। উচ্চতা আমার
মতই। কথাবার্তা খুবই মার্জিত। বাংলা বেশ বুঝত। ন্যান্সিদের বাসার সামনের
একটা ফ্ল্যাটে তারা থাকত। দু’জনে ইংলিম মিডিয়ামে পড়ত। এই পর্যন্ত বলেই
ডাক্তার থেমে গেলেন। ডিটেলস্ আর কিছু বললেন না। ঠিক এ সময়ে মিস্টার নজরুল ও
মিসেস নজরুল রুমে ঢুকলেন। যেন, আগেই সিদ্ধান্ত ছিল। মিসেস নজরুল আমার পাশেই
বসলেন।
-- আপনারা সরাসরি বলুন আমার চাকুরিটা কি?
মিসেস নজরুল আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
-- বাবা, তুমি ওকে নরমাল হতে সাহায্য কর। তোমার মাঝে ও ফ্রান্সিসকে দেখেছে।
তাই
নজরুল চৌধুরী বললেন,
-- বিনিময়ে তুমি যা চাও--তাই পাবে এবং এটাই তোমার চাকুরি।
ডাক্তার আমার কাঁধে হাত রাখলেন।
-- মনে কিছু কর না। আংকেল হিসেবে বলছি না। ন্যান্সির ডাক্তার হিসেবে আই
ওয়ান্ট ইউর হেলপ্। ইউ হেলপ্ মী টু কাম রাউন্ড, ন্যান্সি।
-- কিভাবে সাহায্য করব?
-- আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। অনেক মেন্টাল পেসেন্ট সুস্থ করেছি কিন্তু ওকে
পারছি না। তোমাকে আমি সব বুঝিয়ে বলব, কিভাবে কি করতে হবে।
আমি জানি, আমি একটা বোকা। বোকাদের প্রায় কাজেই ভুল হয়। যেহেতু আমি জানি,
আমি একটা--বোকা তাই খুব চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করি। উন্নতি কিছু না হলেও
কোথাও হাসির বস্তু হিসেবে বিবেচিত হইনি; বরং আট-দশ জনে সম্মান, স্নেহ রেখেই
কথা বলে। কিন্তু আগে বেশি চালাক ছিলাম আর সে কারণেই ভুল বেশি হত। সেই
ভুলগুলোকে তখন ঠিক বলে মনে হত এবং মেনে নিতাম। কিন্তু বর্তমানে সেই সব
ভুলগুলো আমাকে প্রায়ই কাঁদায়, ভাবায় কখনও অজান্তেই হেসে উঠি। একমাস আগেও
এমন কিছু কাজ করেছি, যা বর্তমানে অনেকটা বোকামী করেছি বলে মনে হয়। এই যে
তারা আমাকে ইউজ করতে চাইছে তাদের কন্যাকে ভাল করার জন্য, এদের কাছে আমরা
ভিক্ষুক। অসময়ে এরা লাথি মারে, সময়ের প্রয়োজনে গায়ে হাত দিয়ে আদর করে। এটাই
নিয়ম, এটাই বাস্তব। যে সাংবাদিক আজ অছি, ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘুষখোর,
দুর্নীতিবাজ বলে পত্রিকায় কলামের পর কলাম লিখে যায়--সেই সাংবাদিক, অছি
কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট পদে থাকলে একই কাজ করত। মুখে যতই মোটামোটা কথা বলা হোক
না কেন, কার্যক্ষেত্রে তার একাংশও ফলে না। যে, যে পদে থাকে, তার কাজ সেই
পদের বৃত্তেই থাকে এবং এই বাস্তবতা স্মরণ করেই তাদের এই নারী কেন্দ্রিক
চাকুরির অফার এড়িয়ে যেতে চাইলাম। মুখের ভঙ্গীমায় তাই বুঝালাম। মিসেস নজরুল
কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলতে লাগলেন, তুমি জান না বাবা, গতকাল তোমাকে দেখার
পর থেকে ও কেমন জানি অন্যরকম হয়ে গেছে। তুমি আজ আসবে বলেই বুয়ারা ওকে
সেজেগুঁজে দিয়েছে। নিজেও সাজগোজ করেছে। দুই বছর পাবনা রেখেও কিছু হল না।
ধানমণ্ডি মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। তাও কিছু হল না। বিদেশেও
রাখা হয়েছে। একটু ভাল হলেও পরে আবার একই অবস্থায় ফিরে আসে। তোমার মাঝে ও
ফ্রান্সিসকে দেখেছে। ভাল হলে হতেও পারে। তুমি সারাদিন ওর সঙ্গী হবে।
নজরুল চৌধুরী ভেবেছিল, সে বলা মাত্রই আমি সহাস্যে রাজী হয়ে যাব। আমার অনীহা
ভাব বুঝতে পেরে সে রাগতস্বরে টাকার গরম দেখাতে লাগল। মেয়ের মানসিক রোগের
কারণে সে খুবই সিরিয়াস হয়ে আছে। যে কোন মূল্যে সে মেয়েকে আরোগ্য দেখতে চায়।
-- তুমি মাসে কত টাকা চাও বল?
-- আমি পরে আপনাকে জানাব। আগে ভাবতে দিন। পরে একদিন দেখা করে...
-- শুন, তোমার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, তোমাকে প্রতি মাসে দশ হাজার করে দেওয়া
হবে। ডাক্তার মানে রকিব যা বলবে তুমি তাই করবে। ওকে যদি ভাল করতে পার,
চিটাগাং-এর ট্রাভেলস্ লাইসেন্স তোমাকে দিয়ে দেব। আর যদি নাও পার তবুও একটা
চাকুরি অন্তত: আমার আন্ডারে পাবে। তবে ভাল করার জন্য চেষ্টা দেখাতে হবে।
কাজ দেখাতে হবে। ভেবে দেখ। আমার কথাবার্তায় হয়ত দুঃখ পেয়েছ । ডন্ট মাইন্ড।
আই নো হাউ আই এ্যাম? ইউ ডন্ট নো, ইউ ডন্ট আন্ডার স্ট্যান্ড হাউ সরো ইন
মাইন্ড অফ মাইন! আমার স্থলে তুমি হলে বুঝতে।
নজরুল চৌধুরী তার কক্ষে অশ্রু সিক্ত নয়নে চলে গেলেন। মিসেস নজরুল আমাকে
নিয়ে খাবার টেবিলে চলে এলেন। খাবার টেবিলে রাজকীয় খাবার দেখে আমি হতবাক।
এগুলো খেলে হজম হবে কিনা সন্দেহ। আলু ভর্তা জাতীয় খাবার যাদের প্রতিদিনের
প্রধান আইটেম তাদের পাকস্থলীতে হঠাৎ এসব রাজকীয় খাবার সইবে কি করে। তিনি
জোর করেই আমাকে খেতে বসালেন। রাত আটটা বেজে গেছে। খেয়ালই করিনি। কথা বলতে
বলতে আর ভাবতে ভাবতে কত সময় পার হয়ে গেছে। আমি আবার হাত ঘড়িটার দিকে
তাকালাম। হ্যাঁ, আটটা বাজে। এসি করা ডাইনিং। পুরো বাড়িটাই এসি করা। রুমের
ভিতরে রাত-দিন সমান। ঘুম ঘুম নিঃশ্বাস এসে গেছে। সাধারণত: বারটা-একটার আগে
খুব একটা ঘুমাই না। অথচ এসি করা এই বাসস্থলে ঘুমে চোখ বুজে আসছে। এতসব
রাজকীয় খাবার আর আবাসস্থল দেখে আমি এটাকে স্বর্গ ভাবতে শুরু করেছি। এর চেয়ে
বড় স্বর্গ চাই না। ধর্মান্ধ বন্ধুদের বললে, বলবে, ‘এইটুকু দেখেই অবাক! আরে
ব্যাটা স্বর্গে এর চেয়ে হাজার গুণ হাইফাই, হাজার গুণ সুখ-শান্তি, হাজার গুণ
ভাল খাবার...।’ মনে হবে, বন্ধু যেন স্বর্গ দেখে এসেছে, কিছু দিন বা কিছু
কাল বেড়িয়ে এসেছে। ওয়াজ ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ওয়াজ শুনলে তাই মনে
হয়। তার ওয়াজ শুনলে মনে হয়, উনি দুনিয়াতে নাই, আখেরাতে চলে গেছে। উনার মরার
সময় উনি বোধহয়, বিবর্তনবাদ এর জনক ডারউইন এর মত বলবে, মৃত্যুতে আমার ভয়
নেই, আমি বেহেস্তে যাচ্চি। যাই হোক, আমি সেই অবিশ্বাস্য কাল্পনিক স্বর্গ
চাই না, আমি এরকম স্বর্গ চাই। চাই বাঁচার মত বাঁচতে। যে লোক আজীবন বস্তিতে
থেকেছে, সে হঠাৎ আমার ধর্মান্ধ বন্ধুর কাল্পনিক স্বর্গে গেলে কেমন করবে,
আমি ভেবে পাই না। এই যে, আমি চাচার বাসায় বেশ ছিলাম। মধ্যবিত্ত সংসার।
মধ্যবিত্ত পরিবারে সমস্যা বেশি হলেও আমার মনে হয়, ক্ষুধা আর আনুসাংগিক
ব্যাপারে তেমন ভাবতে হয়নি।
এই যে, যা আজ আমি স্বর্গ বা স্বর্গতুল্য ভাবছি, যা টিকি ও দাঁড়িওয়ালা
বন্ধুর কাছে নগন্য--সেটাই আমি সইতে পারছি না। আর হাজার গুণ উন্নত ঐ
কাল্পনিক স্বর্গে গেলে হাজার বার মরব। তখন স্রষ্টাও আমাকে বাঁচাতে বাঁচাতে
ক্লান্ত হয়ে যাবে। যারা সব সময় ভেজাল দ্রব্যাদি খেয়ে অভ্যস্ত--তাদের পেটে
হোটেল শেরাটনের খাঁটি দ্রব্যাদি সইবে কি করে। আমি ঐ স্বাপ্নিক স্বর্গ চাই
না, চাই পার্থিব এই সাধারণ স্বর্গ। চাই সুখ, চাই এক টুকরো শান্তি, চাই
বাঁচার মত বাঁচতে, তিন বেলা পেট ভরে খেতে। এই যে উনারা ধনী বলে এতসব রাজকীয়
খাবার খাচ্ছেন। আমি গরীব বলে আলু ভর্তা ভাত আর মরিচ খাচ্ছি। উনারা স্বর্গে
গিয়ে কি খাবেন? আমার বন্ধুর স্বাপ্নিক খাবার নিশ্চয়। তবে তাদের এখানে-ওখানে
দুই জায়গায়ই লাভ। আমি ভাবতে চাই না। এখনো গায়ে জোর আছে, অবলম্বন আছে, এখনো
বৃদ্ধ হইনি, দুর্বল হইনি, টুপি, দাঁড়ি কিংবা টিকি এখনো আমাকে গ্রাস করেনি।
যুদ্ধ ক্ষেত্রে বীর সৈনিক নিশ্চিত পরাজয় জেনেও যেমন বীরের মত যুদ্ধ করে
নিজেকে শক্তির অবিনাশিতাবাদ সূত্রের মত আপাত ধ্বংসে বিলিয়ে দেয়, আমিও তেমনি
যুদ্ধ করে যাব। নিশ্চিত পরাজয় জেনেও যুদ্ধ করে যাব। সংগ্রাম ছাড়া জীবনের
চাহিদা কখনও পূরণ হয় না। তিলে তিলে না মরার চেয়ে; তেলাপোকার মত না বেঁচে;
বাঘের মত বাঁচাই শ্রেয়ঃ। মানুষ সিগারেটের প্যাকেটে ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’
দেখেও ধূমপান করে; প্রেমের পরিণাম জেনেও প্রেম করে। আমিও একই রক্তমাংসে গড়া
একজন মানুষ। তারা যদি মৃত্যুর পর নরকম ভোগ করে আমিও করব। তবুও আপন বিবেকের
সামনে বাস্তব প্রমাণ সাপেক্ষ্য অকাট্য যুক্তিকে গলা টিপে ধরব না।
( চলবে...)
ARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|