[প্রথমপাতা]
|
সময়ের লাশ
- শাশ্বত স্বপন
-
দরজার বাইরে বাবার হাসির শব্দ শোনা গেল।
বাবার সাথে আরেক জনের হাসিও শুনতে পেলাম। আমি রাম প্রসাদের মাথায় জল ঢালতে
ঢালতে রামকে জিজ্ঞাসা করলাম--‘রাম, আরো জল ঢালব?’--না, শব্দটি বলেই দৌঁড়ে
দরজা খুলতে গেল। আনন্দে নেচে নেচে বলতে লাগল, ‘বাবা আসছে, বাবা আসছে।’ আমি
প্রায় অপ্রস্তুত ছিলাম। রামকে ডেকেও আর থামানো গেল না। জল বেয়ে পড়ছে সারা
শরীরে। জ্বর অথচ দুষ্টামীর শেষ নেই। রাম দরজা খুলে দিল। আমি তো হতভম্ব!
কারণ বাবা প্রায়ই দুপুরবেলা একজন অতিথি নিয়ে আসেন। ঘরের ভিতরে আমি না যেতেই
রাম দরজা খুলে দিল। তখন আমার শরীরে ছিল পাতলা ধুতি--যা জড়িয়ে কোন রকমে
লজ্জা নিবারণ করেছি। রামকে মাথায় জল দেবার আগে দুপুরে প্রতিদিনের মত
লক্ষ্মী দেবীর পূজাটুকু মাত্র সেরেছি। পূজা শেষ হতেই মা ডেকে বলল--‘হাত
ব্যথা হয়ে গেছে কল্যাণী, এবার তুই ওর মাথায় আর কতক্ষণ জল দে--।’ সব
জামা-কাপড় ছিল অশুদ্ধ। আলমারীতে শুদ্ধ কাপড় থাকলেও মার ধমকে বের করতে
পারিনি। তাই ধুতি পড়েই পূজা দিলাম। ধুতি না ছাড়তেই মার ডাকে রামের মাথায় জল
দিতে লাগলাম। ভালই লাগে ধুতি পড়তে; কোন রকমে লজ্জা নিবারণ মাত্র। কিন্তু
আমার মনে হয়, আমি যেন নগ্ন হয়ে আছি। বারবার কাঁধের আঁচলটা মাটিতে পড়ে যায়।
রাম দরজা খুলতেই দেখি, বাবার আগে একটি ছেলে ঘরে ঢুকেছে। আমি লজ্জায় ড্রয়িং
রুম লাগোয়া ছোট ঠাকুর ঘরে ঢুকে পড়েছি। একটু পরে বাবা ঘরের ভিতরে ঢুকেই মাকে
ডাকতে ডাকতে ভিতরে চলে গেলেন। রামকে কোলে নিয়ে বাবা মাকে বলছে, ‘একি অবস্থা
লক্ষ্মী! ওর মাথাটা মুছে দাওনি?’ মা বলছে, ‘কল্যাণীতো মাথায় জল দিয়েছে,
মেয়েটা মুছেও দেয়নি?’ বোধহয়, মা আঁচল দিয়ে মুছে দিচ্ছে।
এদিকে ছেলেটি ঠাকুর ঘরে ঢুকে প্রণাম করল। পরিধানের কারণে লজ্জায় কিছু বলতেও
পারছি না। ছেলেটা বলতে লাগল, মা দেবী, তোমার পূজা যদি স্বল্প পোশাকেই করতে
হয়, তবে পোশাক না পরলে হয় না? এরপর আমার দেহের বর্ণনা দিতে দিতে যা
বলেছে--তা আর বলার মত না। একটু পরে সরস্বতী দেবী মূতির্র দিকে তাকিয়ে বলতে
লাগল--‘সরস্বতী মহাভাগে--বিদ্যে কমললোচনে--বিশ্বরূপে
বিশালাক্ষি--বিদ্যাংদেহী নমস্তোতে--। আহা! দেবী, এই মন্ত্র পাঠ করিলে যদি
তুমি বিদ্যাই দিতা, তবে এই কিশোরী আর যাই হোক ধর্মে আর অংকে ফেল মারিত না।’
বুঝতে আর বাকী রইল না, ছেলেটা আমাকে দেখেছে। ঠাকুর ঘরের দরজার কোনায় রোদে
শুকানো মায়ের শাড়ী টেনে দিয়ে নিজেকে পর্দার আড়াল করেছি। হঠাৎ করেই সে শাড়ী
টান দিয়ে ফেলে দিল। অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে চেয়ে রইল আমার চোখ আর মুখের দিকে।
আমি এমন হতভম্ব হয়েছি যে, কাঁধের উপর ধুতির অংশটুকু কখন যে পড়ে গেছে আমার
পায়ের কাছে, টেরও পাইনি। নবম শ্রেণীর ছাত্রীর বুকের আকাশটা কি রকম আকর্ষণীয়
হতে পারে--সে অভিজ্ঞতার দৃশ্য তখন বুঝিনি। আজ নাতনীর বুক দেখে সে দিনকার
কথা মনে পড়ে। আমার মনে পড়ে, ছেলেটা শুধু তাকিয়ে ছিল; হাত দিয়ে কোথাও ছুঁয়ে
দেখেনি। শুধু বলেছে, ‘তুমি এত সুন্দর! ইচ্ছে করে রক্ত দিয়ে তোমাকে
সাজাই--দেখি, আরো কত সুন্দর দেখায়।’ কি আশ্চর্য! যে বটি দা দিয়ে পূজার ফল
কেঁটেছিলাম, সে দা দিয়ে সে তার আঙ্গুল কাঁটা শুরু করতেই হঠাৎ বাবার
কণ্ঠস্বরে সে দৌঁড়ে চলে যায়। সে যাত্রা আমার জীবনের...। ছেলেটা বাবার সাথে
আবার বাইরে চলে গেল। অবাক হলাম, কি করে জানল, আমি অংকে আর ধর্মে ফেল করেছি।
নিশ্চয়, বাবা বলেছে।
এই সেই ছেলে--এই সেই যুবক--এই সেই শহীদ, সুমাদ জাকারিয়া। দাদুর কাছে পড়তে
গেলে ওকে প্রতিদিন পলাশ গাছের গোড়ায় বসতে দেখি। প্রায়ই দেখতাম, মায়াময় চোখে
আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। বিগত ষাট বছরে স্বামী তথা সকলের ভয়ে, লোক লজ্জায় এ
লেখা প্রকাশ করতে পারিনি। জীবনের গভীর মায়াময় স্মৃতিটা আজো বুকের ভিতর
লুকিয়ে রেখেছি। ছেলেরা বড় হল, বিয়ে করল, মেয়েদের বিয়ে দিলাম। আজ নিঃসঙ্গ
চিত্তে নাতী-নাতনীদের ভিড়ে খুঁজে বেড়াই সুমাদকে। প্রতিবছর খুঁজি বই
মেলায়--শহীদ মিনারে--পথে পথে; কোথাও ওকে খুঁজে পাইনি; পাইনি ওকে নিয়ে লেখা
কোন গদ্য বা পদ্য। জানিনা, এ লেখা প্রকাশ হবার পর ছেলে-মেয়েরা কি ভাববে।
আমি বলব, সবাই আমরা মানুষ। সবারই জীবনে ঘটনা আছে, স্মৃতি আছে। কারোটা গভীর
ক্ষত হয়ে আছে, কারোটা ভাসা-ভাসা। আগে একুশের মাঝে ওকে খুঁজে পেতাম; এখন
কেমন যেন, ঝাপসা দেখায়। বয়সের ভার বোধহয়, এ নশ্বরদেহ আর বইতে পারছে না।
স্বামীর মৃত্যুর পর কি যেন, হারালাম। আমি শুধু স্বামীই নয়, সুমাদের স্মৃতিও
যেন, হারাতে লাগলাম। নিজেকে বড় শূন্য লাগে। বাড়ীতে অনেক লোক থাকা সত্ত্বেও
মনে হয়, কেউ নাই। এরকম মনে হয়েছিল সুমাদের মৃত্যুর কয়েক মাস আর বিয়ের পর
বিমল বোম্বে চলে গেলে। শূন্যতা যে কি অসহায় অবস্থা--তা আমার মত বৃদ্ধরাই
জানে। সময়ের কাছে জীবনের পরাজয় মেনে নিলেও সময়ের সাথে সুমাদের স্মৃতি
বিস্মৃত হবে, এ আমি মেনে নিতে পারি না; আর পারি না বলেই, গদ্যের এই
স্মৃতিগত ক্ষুদ্র প্রয়াস।
২য় পর্ব
দাদুর কাছে পড়তে গেলে আগে দু’একদিন বন্ধ দিতাম। এখন পারলে দিনে দু’বার যাই।
কারণ যখনই পড়তে যাই, তখনই ওকে দেখি। হয়, মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছে; নয়তো,
অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। দু’মাস বয়ে গেছে শুধু
দেখা-দেখি। আমাদের বাসা থেকে খানিক দূরে দাদুর বাসা। দাদু, দীননাথ
চক্রবর্তী আমার বাবারও শিক্ষক, তাই মায়ের কথামত দাদু বলি। আজ মা দাদুর জন্য
পিঠা দিয়েছে। আমি পিঠা নিয়ে যাচ্ছি। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বুকটা
কেঁপে উঠল। যাকে দূর থেকে আড়চোখে দেখতাম, সে আজ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কি
করছে? ভয়ে ভয়ে এগোতে লাগলাম। দেখি, একটা কাগজ ইট দ্বারা চাপা দিয়ে ও সরে
গেল। বুঝতে আমার বাকী রইল না। হেঁটে সোজা দাদুর বাসায় চলে গেলাম। চিঠির
দিকে ভ্রুক্ষেপও নেই আমার। পরের দিনও দেখি চিঠি একই অবস্থায় ইটে চাপা পড়ে
আছে। কিছুক্ষণ কাগজটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ কি যেন অনুভূতি জাগল মনে।
ভয়ে ভয়ে কাগজটি উঠায়ে চারদিকে তাকালাম। না, কোথাও কেউ নেই। বেশ পাকা হাতে
বুকের ভিতর কাগজটা লুকিয়ে রাখলাম। যেন, কেউ না দেখে।
রাত তখন বারোটা। রাম আমার পাশে শুয়ে আছে। চারদিক নিস্তব্ধ। কেউ জেগে নেই।
ভয়ে ভয়ে বুকের ভিতর থেকে কাগজটি বের করলাম। খুলতে দারুন ভয় করছে, হাত
কাঁপছে। সবুজ জমিনের উপর লাল বৃত্তের একটি কাগজ সুন্দর করে ভাঁজ করা। পুরো
কাগজটা খুলতেই আরো দু’টি কাগজ বের হয়ে এল। একটা কাগজের ভিতর ওর নিজের আঁকা
ছবি। কি সুন্দর হাসছে! আর একটা কাগজে আঁকা একটা মানচিত্র, পূর্ব বাংলার।
আরেকটা কাগজে ছোট ছোট করে লেখা। কিন্তু হায়! সব উল্টা করে লেখা। একেবারে
উপরে লেখা--take a mirror and...|। আমি আমার পড়ার টেবিল থেকে আয়না আনলাম।
বুঝলাম, ও আমাকে কষ্ট দিতে চায়। ও চায়, ওকে নিয়ে আমি ভাবি। আমি আয়নার
সাহায্যে পড়তে শুরু করলাম--‘রূপশ্রী, তোমাকে প্রথম থেকেই আমি চিনেছি। আমি
কে? তুমি আমাকে চিনবে না। আমাকে চিনতে তোমার অনেক সময় লাগবে। আমি মহাকাশের
কোন এক বিদ্রোহী উল্কাপিন্ড। না, এ পৃথিবীরই শুধু আমি বাসিন্দা নই, আমি
মহাবিশ্বের। পৃথিবীর মত আরো পৃথিবী আছে, এ মহাবিশ্বে--যেখানে সংঘাত,
বিশৃংখলা, দূর্নীতি, জালিয়াতি, অত্যাচারের ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়, সেখানকার
অধিবাসী হয়ে জন্ম নিই আমি বারে বারে। তোমাদের এ ভারতবর্ষে আমাকে অনেক বার
জন্ম নিতে হয়েছে। ভয় পাচ্ছ? ভয় নেই, তোমাকে মুক্ত করতেই এ মর্ত্যে আমার
জন্ম। তোমাকে স্বাধীনতা দেব। তোমার বুকে একটা মানচিত্র আঁকব আর রক্ত দিয়ে
মেখে মানচিত্রের পাকা দলিল তোমার হাতে দিয়ে যাব। তুমি সুন্দর। তুমি বাংলার
মানে পূর্ববাংলার এক বিমূর্ত প্রতীক। পাগল ভাবছ? সব নারীরা পুরুষদের একটু
পাগল ভাবে কারণ নারীরা পুরুষ জাতিকে গর্ভে ধারণ করে এবং তাদের
স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রশ্রয় দেয়, ফলে পাগল সম্বোধনটা আদর অথবা ভালোবাসার
কারণে চলে আসে। কিন্তু তাই বলে তুমি আমার মা, বোন কিবা প্রেমিকা না।
তোমাদের কুসংস্কারচ্ছন্ন সমাজে যাদের তোমরা পিসি, মাসী, কাকা, মামা ইত্যাদি
ডাক--আমি সে দলের কেউ নই। আমি অন্য রকম আত্মীয়; এ আত্মীয়ের স্বরূপ মধুসূদন,
বঙ্কিম কিবা রবীন্দ্র--কেউ বর্ণনা দিয়ে যায়নি। রহস্য লাগছে, থাক পড়তে হবে
না আর। কোথাও লুকিয়ে রাখ অথবা ছিঁড়ে ফেল, তারপর ঘুমিয়ে পড়। আমি গভীর রাতে
সব বুঝিয়ে দেব। আমাকে বুকে রেখ না, তাহলে হৃদয়ে চলে যাব।’ ইস্! এত সহজ,
দুষ্টু, এতক্ষণতো বুকেই ছিলে। যাও বুকেই থাক; হৃদয়ে যাওতো দেখি।
বালিশে মাথা রেখে চিন্তা করতে লাগলাম। চিন্তার ঘোরে একসময় ঘুমিয়ে গেলাম।
হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। সারা দেশ কাঁদছে আমার জন্য।
কিন্তু এখানে কারা হাসছে? ওদের হাতে লাঠি, পিস্তল, বোমা, বন্ধুক কেন? আমার
হাত যুদ্ধ বিমান হচ্ছে, পা ছুটে চলেছে ট্রেনের গতিতে, মুখ চিৎকার করছে--কেউ
শুনছে না। আমার একটা কলঙ্ক আছে। একদল পাখি আমাকে শুনিয়ে দিয়ে গেল। কি সেই
কলঙ্ক! আমার হৃদয় সমস্ত দেহের ভালোবাসা চায় অথচ অঙ্গ-পতঙ্গ আমাকে ছেড়ে দূরে
চলে যাচ্ছে কেন? আমার বুকে প্রবাহিত নদীগুলি শুকিয়ে যাচ্ছে। মাথার উপরে
পাখিরা কাঁদছে। কাঁদছে আমার হৃদয়। হঠাৎ কোন এক অপরিচিত মহিলা--নিজেকে কবি
পরিচয় দিচ্ছে, অনেকটা আমার মত দেখতে। তার লেখা ‘না গদ্য না পদ্য’ আমাকে
শুনাচ্ছে--‘একটি মরুভূমি ভালবাসার প্রত্যাশায় যেমন সুদীর্ঘকাল অপেক্ষা করে
সাগরের ছোঁয়া পেতে। সময়ের রুদ্র প্রখরে তীব্র তাপে তার হৃদয় যখন গলতে শুরু
করে শ্মশানের জ্বলন্ত লাশের মত; তখন সে পাগলিনীর মত ডাকে--সাগর, সাগর--।
কেউ তার ডাক শুনে না। শুনতে পায় না কোন মরুযাত্রী। সে ডাক বাজপাখী কিবা
বাদুর পাখির ডাকের মত--যে ডাক বারবার প্রতিফলিত হয় খেঁজুর গাছের মাথা
থেকে--সে ডাক আকাশকে কম্পিত করে--আকাশের বুকে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা
পাহাড়কে ভীতি সঞ্চার করে জাগায়ে তোলে। সময়ের তীব্র ক্রোপানলে, আগুনের মতো
জ্বালাময় কষ্টে মরুভূমির বুক খসে খসে ধূলো হয়ে যায়। ধূলো উড়ে যায় আকাশের
বুকে, পাহাড়ের শিখরদেশে, বাতাসের নাসারন্ধ্রে, কালো মেঘ কন্যার কাছে।
ধূলো-বাতাস পৌঁছে দেয়, মরুদুলালী হতভাগিনীর ব্যর্থ ভালবাসার শ্মশান জ্বালার
করুণ হৃদয়স্পর্শী চিত্র; পৌঁছে দেয়, নির্মম বেদনার লেলিহান প্রখর দৃষ্টির
ছোবল কাহিনী। আকাশ-বাতাস সবাই শুনে--সবাই দেখে--তারপর বিরহ বেদনায়
খানিকক্ষণ আফসোস করে। বেদনা বেদনাই রয়ে যায়। কেউ তাকে ভালবাসে না। তার
জ্বালা, তার বেদনা তার নক্ষত্রসমদূর কষ্ট ক্রমোত্তর বাড়তে থাকে। তবুও এক
টুকরো জোনাকী আলোর মত ভালবাসা কারো কাছে প্রত্যাশা করেও আশাহত হয় বারবার।
সাগর-নদ-নদী-শাখা নদী সবার কাছে সে ভালবাসা চায়, এক টুকরো লাল ফিতা কিবা এক
টুকরো ওড়নার মত ভালোবাসা কিন্তু তার কলঙ্ক জীবন যাকে ছুঁতে চায়, সেই তার
মতো মরুময় হয়ে যায়। নদীর বুকে জেগে উঠে চর। তার কলঙ্ক ছোঁয়ায় জেগে উঠে
সাগরের বুকে দ্বীপ। তাহলে কোন শতাব্দিতে, কোন সত্য যুগে সে ভালবাসা
পেয়েছিল। আবার কত সহস্র কলিযুগ পরে সত্যযুগ আসবে--সে ভালবাসা পাবে। যখন
সাগর তাকে বুকে আঁকড়ে ধরবে। সে তখন হবে সাগরিকা কিংবা সাগর কন্যা। তখন নদী,
গাছপালা, পথ-প্রান্তর, পশুপাখী সবাই তাকে মুঠি মুঠি ভালোবাসা দেবে। তার
বুকের স্রোতে ভাসবে জাহাজ, পাল তোলা নৌকা। তার পায়ে বাজবে ঘুঙ্গুর। তার
হৃদয় কণ্ঠ থেকে শিবের শঙ্খ বাজবে। তখন তার প্রেমের গভীরতা সবাই বুঝবে; তার
সুদীর্ঘ পরাধীনতার কলঙ্ক চিরতরে দূর হবে।’ কাঁধের পাটের ব্যাগ আমার বিছানায়
রেখে মহিলা কবি কি যে বুঝাল--তার কিছুই বুঝলাম না। তবে উক্তিগুলি কেমন যেন
রহস্য সৃষ্টি করল। বড় জটিল এর অর্থ কিন্তু শেষ উক্তিটির ‘পরাধীনতা’--শব্দটি
আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলল। বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে চোখ চুলকাতে গিয়ে দেখি আঙ্গুল
জলবিন্দুতে ভিজে গেল। আশ্চর্য! চোখে জল কেন! তাহলে এ গদ্যের অর্থ আর যাই
হোক, সম্পূর্ণটা বুঝলে যে চোখে ঝর্ণা ঝরবে--এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল--একটি মানুষ। সে প্রতিনিয়ত--সেই কবি হচ্ছে--আবার
সুমাদ জাকারিয়া হচ্ছে--কখনো অবিকল আমারি মতো কিশোরী হচ্ছে। ক্রমাগত এই তিন
রূপে একটি মানুষ পরিবর্তন হচ্ছে। সুমাদ একজন নেতা, সে আমাকে রক্ষা করার
জন্য দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আশ্চর্য! দলে এখন কবি, সুমাদ আরো অনেকে। আর আমি
পরাধীনতার শিকলে বন্ধি। কত মিটিং, কত মিছিল, কত রক্ত বয়ে যাচ্ছে আমার জন্য।
হঠাৎ গুলিবর্ষণ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ শুরু হয়ে গেল। দলের সবাই মরে
যাচ্ছে। সুমাদের বুকে গুলি ...। না--, বলে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে
উঠলাম। মা-বাবা দু’জনে দৌঁড়ে এল। ভাগ্যিস, চিঠিটা রামের পিঠের নীচে চাপা
পড়ে ছিল; তা না হলে, মা কি যে ভাবত! মা লবণ জল নিয়ে এল, আমাকে পান করাল।
তারপর মা-বাবার কাছে সব বললাম। মা বলল, ‘তোমাকে কতবার বলছি, ভাল একটা ছেলে
দেখ, মেয়ের বিয়ে দেই। না, মেয়েকে পড়াবে, পড়াও। মেয়েটি এত বড় হল। এখনো একা
একা...।’
দু’জনেই চলে গেল। বাবা অবশ্য আদর করে বলেছিল, ‘এগুলো কিছু না, মা। কালই আমি
সুমাদকে নিয়ে আসব।’ স্বপ্নের কথা বললেও চিঠির কথা গোপন রেখেছিলাম। আবার
ঘুমিয়ে ভাবতে লাগলাম আর মনে মনে বলতে লাগলাম--আমি কে?--না, আমি দিলীপ দাসের
মেয়ে কল্যাণী। আমার বয়স চৌদ্দ। বাবা-মা আমার জন্য বর দেখছে। আমি শিক্ষিতা,
সুন্দরী (সবাই বলে)--আমার হবু স্বামী নিশ্চয়ই খুব সচ্ছল হবে। তবে সুমাদ একি
বলছে, আমি একটা মানচিত্র! রাত তিনটা বাজে। আমি আবার চিঠি পড়তে শুরু করলাম।
‘তোমার সারা দেহের লোমে লোমে ছড়িয়ে আছে আ- ই- ক- ম...। ওরা তোমাকে দলিত
মথিত করে তোমার লোমগুলি একটি একটি করে তুলে নকল উর্দু অক্ষরযুক্ত লোম
লাগিয়ে দেবে। তুমি অপসংস্কৃতি আর পরাধীনতার শৃংখলে আটকে যাবে। তোমার ভাষা
হবে দেহের সাথে সম্পর্কহীন। তোমার কথা এত মধুর শুনাবে না। বুঝতে পারনি?
পাকিস্তানীরা তোমার ভাষা কেড়ে নেবে। ভয় নেই, আমি তো আছি। আমি এসিড হয়ে
ক্ষারের সাথে বিক্রিয়া করে উৎপাদন করবো লবন ও পানি। লবণ দিয়ে দেশের
জোঁকগুলোকে মারব। আর পানি দিয়ে তোমার বুকের উত্তপ্ত মরুভূমি ভরে
দেব--পদ্মা, মেঘনা, যমুনাতে--এঁকে দেব তোমার ঠিকানা। অবাক হচ্ছো। বার
তারিখে বিকাল তিনটায় আমাদের সমাবেশ হবে তোমাদের ঐ পশ্চিমের মাঠে। তুমি
জানালা দিয়ে দেখ এবং সবার বক্তৃতা শুনিও। তুমি তথা তোমরা কোথায়, কেমন আছ,
সব বুঝবে। এবার রাখি। কষ্ট দিলাম। দিদি, এর চেয়েও ভয়ংকর কষ্ট সম্মুখে
তোমাদের...ইতি '৫২।
বার তারিখে সমাবেশ হল। সব শুনলাম, বুঝলাম, আমরা কেমন আছি, কোথায় আছি? যে
ভাষায় আমরা কথা বলি--যে ভাষা রক্তের সাথে আছে মিশে--সে ভাষা পাকিস্তানীরা
কেড়ে নিয়ে নিক্ষেপ করবে সমুদ্রে আর তার পরিবর্তে পাকিস্তানীদের উর্দু ভাষায়
কথা বলতে হবে। তার মানে আমাদের দেহের রক্ত পরিবর্তন করে ওদের রক্ত আমাদের
দেহে ভরে দেবে। মিটিং এর শেষটা অত্যন্ত লজ্জাস্কর পরিস্তিতিতে শেষ হল। তখন
সুমাদ বক্তব্য রাখছে--‘মাতৃভাষাকে কেড়ে নেওয়া মানে আমার মাকে তথা আমাদের
মাকে কেড়ে নেওয়া। আজ আমাদের যুদ্ধের যাবার সময়--আজ আমাদের মিছিলে যাবার
সময়। আমরা যুদ্ধে যাব--আমরা মিছিলে যাব। মাননীয় অধ্যাপক সাহেব,
সম্মানিত...ওদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। আমাদের ভাষা কেড়ে
নিতে দেব না। আমরা স্বাধীনতা চাই...।’ হঠাৎ কাঁদুনে গ্যাস আর লাঠি চার্জ
সেদিন সমস্ত মিটিং পন্ড করে দিল। ছত্রভঙ্গ হলো সবাই।
যাই হোক, আরেকদিন দাদুর কাছে অংক পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি সেই আগের মত ইটের
নিচে চিঠি রেখে চলে গেল। সেদিন আর ভয় পেলাম না। ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে
চিঠিটা উঠালাম। পা দিয়ে ইট সরাতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠলাম। সুমাদ
দৌঁড়ে এল, ‘--দেখি দেখি।’ পায়ের আঙ্গুল আলতো ভাবে ছুঁইয়ে দিল। গোড়ালী থেকে
নখ পর্যন্ত ম্যাসাস করতে লাগল। ‘-- ব্যথা কমেছে?’ আমার কি যে ভালো লাগলো।
সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। পায়ে চুমু দিতেই আমি দৌঁড়ে চলে এলাম। পথে
দু’একজন ছোকরা দেখেছে । বাড়ী ফিরে ড্রইং রুমে আসলাম। বাবা-মা-রাম তিন জনেই
রামকৃষ্ণ মিশনে গেছে। অতএব, চিঠিটা খুলতে শুরু করলাম। পুরো চিঠিতে প্রকৃতির
আবছা চিত্র। আর চিত্রের উপর দিয়ে নিপূন হাতে লেখা--‘কল্যাণী দি, কেমন আছো?
নিশ্চয়ই স্নান সেরেছ? চুলগুলি নুয়ে পড়েছে বিছানায়। কি দেখছ? এ লেখা। তোমার
অস্তিত্বের কাল্পনিক মানচিত্র এখানে লুকিয়ে আছে। তুমি ওকে খুঁজে পাবে না
কারন তুমি এখনও তোমাকে চিনতে পারনি। চুলের গুচ্ছ থেকে দু’এক ফোঁটা জল ফেলে
দেখ, কাগজটি কাঁদবে। এ কাগজ আমার শত জনমের না পাওয়ার ব্যর্থ প্রয়াস; হারিয়ে
যাওয়া লক্ষ বছরের বেদনাময় স্মৃতির গন্তব্যহীন ঠিকানা। কাগজের প্রান্তগুলো
দেখ। বামদিকে সিঁদুরের স্পর্শ দেখেছ? ডানদিকে সবুজ রং? সূক্ষ্ণ কতগুলো সূতা
চুল হয়ে ছড়িয়ে আছে। নদীর মত প্রশান্ত জলরেখার দাগ সবুজ আর সিঁদূরের প্রান্ত
ছুঁয়ে যায়। নিচে তাকাও--চঞ্চল, নৃত্য পটিয়সী, লাস্যময়ী ঝর্ণার নৃত্য শুনতে
পাও। ভয় পেয়েছ? পায়ের ঘুঙুর বাঁধানো পদধ্বনি শুনেছ? আবার ভয় পেয়েছ? ভয় নেই,
এতো তুমি আর আরেক জন--যে তোমারি মত--ঠিক তোমারি মত। তাই তোমাকে এত ভালবাসি।
আমার প্রেমিকার রূপ খুঁজতে খুঁজতে একটা প্রতীক, একটা সুন্দর ছবি হিসেবে
তোমাকে পেয়েছি। আমার সেই প্রেমিকা তোমারি মত। বুঝতে পারনি কিছু? লুকিয়ে রাখ
হৃদয়ের গভীরে, স্মৃতির সাগরের হাজার ফুট নিচে। মরুভূমির ছোঁয়া পেলে এ লেখা
আবার আসবে--তখন বুঝবে কি এর অর্থ। খারাপ লাগছে? আজ আর নয়, এটুকুই থাক।
স্বাধীন হোক, তোমার জীবন।’
সরস্বতী পূজার পরের দিন দাদুর জন্য লুচি, চিড়া, নাড়ু– আর মোয়া নিয়ে দাদুর
কাছে যাচ্ছি। পথে হঠাৎ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কোকিল সুরে একটা ধ্বনি দিল।
পাশে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলাম। সুমাদ হাসছে। অথচ ওর কপাল আর মাথায় ব্যান্ডেজ।
‘--আমাকে সারা রাত বুকের কাছে নিয়ে শুয়েছিল। এখন আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছ। আমার
চোখের কাছে তার চোখ রেখে বলল, ক্ষুধা পেয়েছে, মিছিল করে আসলাম তো। পথে যেতে
দেখি, তুমি আসছ। ভাবলাম টিফিনে নিশ্চয় খাবার আছে। দেবে খেতে? জান, মিছিলে
মার খেয়েছি... তারপর হাসপাতালে...।’ আমি টিফিন বাটি ওর হাতে দিয়ে মাথা কাঁত
করলাম। টিফিন বাটি খুলেই একটা নাড়ু আমার মুখে দিল। আমি মুখে নাড়ুটা নিয়ে
মুখটাকে স্থির করে রেখেছি। বাম হাতে একটা লুচি আর ডান হাতে একটা মোয়া, একটা
নাড়ু নিল।
--কি গো, খাবার সব অশুদ্ধ হয়ে গেল, তাই না ?
আমি মাথা নাড়লাম।
--বা! তুমি তাহলে তোমাদের সংস্কার নামক কুসংস্কার মান না।
আবার মাথা নাড়লাম।
--এই মেয়ে, কথা বল না কেন? ও মা! মুখে এখনো নাড়ু? কষ্ট দিলাম, যাই আবার
দেখা হবে।
আবার পেছন ফিরে আমার মাথায় হাত রেখে বলল,
-- আমি কে জানতে ইচ্ছে করে না?’
কিছু বললাম না। ও চলে গেল। মাথা কতটুকু ফেটেছে, কিভাবে ফাটল কিছু জিজ্ঞাসা
করলাম না। কারণ আমি কখনও ওর সাথে কোন কথা বলিনি। বাড়িতেও খুব কম কথা বলি।
খুব সুন্দর দেখতে। নাকটা তীরের মত চোখা; বিশাল বুক যেন, মাঠ। বোতাম খোলা
শার্টটা যা ময়লা! হোস্টেলে থাকে, কে ধুইয়ে দেবে। টিফিনের বাটি আলগা করে
রেখে গেছে। আমি শক্ত করে আঁটকাতে গিয়ে দেখি লাল আর সাদা কি যেন। উপরের
বাটিটা উঠালাম। ওমা! রক্ত মাখা কাগজ। দ্রুত বুকের ভিতর কাগজটা লুকিয়ে
রাখলাম। দাদুকে টিফিন বাটিসহ খাবার দিয়ে চলে এলাম বাড়ীতে। বাথরুমে ঢুকলাম।
চিঠিটা খুলে পড়ছি। একি! সারাটা চিঠি রক্ত মাখা। আবছা একটা মানুষের
ছবি--হাতে ফেস্টুন--গুলিবিদ্ধ হয়ে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। আমার সারাটা শরীর
কেঁপে উঠল। পড়তে শুরু করলাম--‘হ্যাঁ, সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন আমি
গর্ভবতী হব। আমার গর্ভ থেকে জন্ম হবে একজন মহাবিদ্রোহীর--যে সারা বিশ্বকে
শোষণ জুলুমের বিরুদ্ধে মুঠি মুঠি বিদ্রোহী ভালবাসা উপহার দেবে। বিভক্ত
ভারতবর্ষকে আবার একত্র করবে। আতুড়ে ঘরে প্রসূতি যেমন অব্যক্ত যন্ত্রণা,
অসহ্য বেদনায় সমস্ত দেহ-মন নিয়ে বিদ্রোহ করে নারী জাতির প্রতি ঘৃনা অথবা
ভালবাসা ঢেলে দেয়; মা, মা বলে চিৎকার করে; সাগর যখন সমস্ত জল শুকিয়ে
মরুভূমি হবার সীমাহীন বেদনার শেষ গোধূলীর ছায়া আঁকড়ে ধরবে--তেমনি কোন এক
সময়ে আমার মৃত্যু হবে বড় নির্মমভাবে--যা দেখে যত ধাই, যত দর্শক আছে, সবাই
কাঁদবে, বিলাপ করবে কিন্তু বিশ্ব কাঁপানো ভবিষ্যৎ মহাবিদ্রোহী বেঁচে থাকবে
বেদনার উল্টোপিঠে। যতদিন জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ হবে, যতদিন অন্যায়-অবিচার,
বিশৃংঙ্খলা থাকবে--ততদিন সে আমারি আজ্ঞাবাহী, বিদ্রোহ করে যাবে অনন্তকাল।
সে অমর-অক্ষয়-অবিনশ্বর। অপেক্ষা করো কল্যাণী, সেই দিনের আশায়। আজকের রক্তের
কাছে এই আমার প্রদীপ্ত অঙ্গীকার...।’ পাগল, কি সাব লিখেছে? গর্ভবতী হবে? ও
কি নারী নাকি? কিছু বুঝি না। হ্যাঁ, সেদিন কিছু বুঝি নাই। আজ বুঝি, সব
বুঝি।
মনে পড়ে, আর একদিনের কথা। সেদিন পুকুরে এক ঘটি জল আনতে গিয়েছিলাম লক্ষ্মী
পূজাটা সম্পন্ন করার জন্য। অনেকটা ইচ্ছে করেই গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ও স্নান
করছে। পায়ের কাপড়টুকু উঠিয়ে যেই ঘটিটা পানিতে ডুবিয়েছি অমনি সে বলতে আরম্ভ
করল, আমি যাকে ভালোবাসি তার পা আমি কোনদিন দেখিনি। তার বুকে হেঁটেছি,
শুয়েছি। একদিন হয়তো তার কোলে ঘুমিয়ে যেতে হবে। আমি বেশ লজ্জা পেয়েছিলাম।
কোন কথা না বলেই সেদিনও চলে এলাম। ঘাটের সিঁড়ির চারটি ধাপ পার হতেই ও আমাকে
পানি ছিটিয়ে দিল। বলল, ‘তুমি সুন্দর, আমার সেই প্রেমিকার মত--ঠিক প্রেমিকার
মত!’ কে ওর প্রেমিকা? সেদিন বুঝতে পারিনি। অনেক পরে বুঝতে পেরেছি। আরেকদিন
কোন এক কথা প্রসঙ্গে বাবাকে বলেছিল, ‘জানেন স্যার, এই বাংলার সবাইকে আমার
বড় আপন মনে হয়। আমার তো মা--বাবা কেউ নেই। তাই এ দেশ, এই মাটিই আমার
মা-বাবা।’ ওর সাথে কখনও কথা বলিনি। কেন? লজ্জা হয়? না, অন্য কিছু--আমি জানি
না। আমাদের ব্যাপারটা মা-বাবা-রাম সবাই জেনে গেছে। তাই আমাকে প্রায়ই মায়ের
বকা শুনতে হয়। সুমাদকেও একবার বকা শুনতে হয়েছে। একদিন দূর থেকে ওকে
দেখেছিলাম। ও কাঁদছে। কেন কাঁদছে? কেন? সেদিন চিন্তায় চিন্তায় সারা রাত
ঘুমাতে পারিনি। শেষ রাতে ঘুমিয়ে গেলে স্বপ্নে দেখি সুমাদ আমাকে ছেড়ে দূরে,
বহুদূরে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে চলে যাচ্ছে। আমি কাঁদছি--সেই স্বপ্ন থেকে আজও
কাঁদছি। আমার কান্না বোধ হয়, মৃত্যুতেও শেষ হবে না। মা যে বলেছিল, যবন
নাস্তিক ছেলেকে ভালোবেসেছি বলে ভগবান নরকে নিয়ে আমাকে কাঁদাবে। তবুও নরকে
গিয়ে যেন, ওর দেখা পাই। কত চিঠি ও আমাকে দিয়েছিল--তা গুনে দেখিনি। যে কয়টা
সংরক্ষণে ছিল--তা এই লেখনিতে সাজালাম। ধর্ম নিয়ে কথা উঠলে মাকে সুমাদ
বলেছিল, ‘কাকীমা, আমি ও স্যার, আমরা কোন নির্দিষ্ট ধর্মের শিকলে বন্ধি নই;
আমার সকল ধর্মের উর্ধ্বে।’ মা অবশ্য রেগেছিল। সুমাদ গরু, কাছিম, শুকর,
ছাগলের মাংস খেত; সামান্যও ঘৃনা নাকি তার হত না। আমি কোনদিন মাংস খাইনি,
আজো খাই না। না খেতে খেতে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ। বিকাল বেলা রামকে নিয়ে ঘাটে গেছি জল আনতে। জল ভরে
আমি সিঁড়ির উপর উঠে দেখি কৃষ্ণচুঁড়া গাছের গোড়ায় বসে অশ্রু নয়নে হাত-পা
কাটছে। আমি ভয়ে ঝোপঝাড়ের পথ দিয়ে আসতেই সে পথ আটকাল। ‘কল্যাণী, তুমি কি
আমাকে ভালবাস না?’ কোন কথা বললাম না। ভয় পেয়ে কাঁদতে লাগলাম। সুমাদ হাত
কেটে রক্ত দিয়ে আমাকে সাজাতে লাগল। রাম দৌঁড়ে বাসায় চলে গেল। ঘটি পড়ে গেল
হাত থেকে। ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম তবুও কোন কথা বললাম না। মনে মনে বলেছিলাম,
হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালবাসি। আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগল সারা শরীরে।
আমি আবেগের বশবর্তী হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে লতা পাতার মাঝে শুয়ে পড়েছিলাম। রক্ত
সিঁদুর দিয়ে কপালে টিপ দিল--চুলের সিঁথিতে রেখা একে দিল। আমি ওর বুকে আবেগ
ভরা হৃদয়ে খানিকক্ষণ মুখ গুঁজে রইলাম। সেদিন সময়ের কাছে আবেগ আর জীবনের
পরাজয় হয়েছিল। মা এসে আমাকে নিয়ে গেল। সুমাদকে বকে গেল। আজ বুঝতে পারছি
সেদিন হয়তো আমার গর্ভেই জন্ম দিতে চেয়েছিল বিশ্ব কাঁপানো মহাবিদ্রোহীকে। আজ
সব বুঝি, সব...। ২১ তারিখের বিকাল বেলা। একটা ছেলে আমাদের বাসায় এসে দরজায়
নক করছে। মা দরজা খুলে দিল।
-- কি চাই ?
--কল্যাণী দিদি আছে ?
-- কেন ? তাকে কেন ?
--এই চিঠিটা তাকে...।
মা চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলেন। সব উল্টা করে লেখা। অতএব, মা কিছুই বুঝলো না।
আমার মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বলে গেলেন, তোকে কোলকাতা পাঠিয়ে দেব অজয়ের কাছে।
অজয় আমার মেজো মামা। আমি আয়নার সাহায্য নিয়ে চিঠি পড়তে শুরু
করলাম--কল্যাণী, অনেক কষ্ট নিয়ে পরপারে চলে যাচ্ছি। দুঃখ, একটিবার বললে না,
আমি তোমায় ভালবাসি। আমি আবার আসব। তোমাদের স্বাধীনতার জন্য যুগে যুগে আমি
অবতীর্ন হব এ ভারতবর্ষে। বিশ্বাস করো, আমি হিন্দু নই, আমি মুসলমান নই, আমি
সকল ধর্মের উর্ধ্বে। আমি তোমাদের এ কুসংস্কার সমাজের কেউ নই। আমার জন্মও
কেউ জানে না, মৃত লাশও কেউ পাবে না। আমি সময়--আমি ’৫২--আমি স্মৃতি। তোমাকে
বাংলাদেশ ভেবে ভালবেসেছি, অন্য কিছু নয়। সময়ের উজানে এসেছি--সময়ের ভাটায়
চলে যাচ্ছি। না, পরাজয় নয় বরং জয় তোমার-আমার। এদেশকে একদিন নারীরাই শাসন
করবে, সেবা করবে। আমি হয়তো সময়ের দৃষ্টি দিয়ে দেখব। তবু থাক না হয়--দু’তীরে
দু’টি মন। হে কল্যাণী আমার, ঠিকানা আমার--মুক্ত আকাশ; বিন্দু থেকে
সিন্ধু--সিন্ধু থেকে আবার বিন্দু। চিরবিদায়...।’
সন্ধ্যার পর বাবা তার ছাত্র মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহকে নিয়ে বাসায় আসলেন।
মাহফুজ ভাই প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। তিনি কবিতা, গল্প লিখেন
পত্র-পত্রিকায়। আমি সেই বিকাল থেকে কান্নার্ত চোখে শুয়েছিলাম। বিছানা থেকে
উঠে দরজায় আসতেই মাহফুজ ভাইয়ের মুখ থেকে ছাত্র হত্যার ঘটনা শুনতে পেলাম।
উনি বলতে লাগলেন, “আগের দিন থেকেই একটা আশঙ্কা ছিল--আগামীকাল মারাত্মক কিছু
ঘটে যেতে পারে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্র ভাষার দাবীতে কোন মিছিল হলে
সরকার কঠিন ব্যবস্থা নিতে পারে। অবশ্য মিছিলের উপর গুলি বর্ষিত হতে পারে
এমন আশঙ্কা আমার মনে ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাই ঘটলো। সংবাদ অফিসে
থাকতেই শুনলাম, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের অবস্থা খুবই খারাপ। ১৪৪
ধারা ভেঙ্গে মিছিল শুরু হয়েছে, যে কোনো সময় মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি হতে
পারে। আমি শংকিত চিত্তে আবার আজিমপুরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম, সারা পথেই
স্থানে স্থানে মানুষের জটলা। সবাই শংকিত, কি ঘটে না ঘটে। আজিমপুরে পৌঁছেই
শুনলাম, মেডিকেল কলেজের মোড়ে পুলিশ ছাত্র জনতার উপর গুলি করেছে, বহু মানুষ
তাতে মারা গেছে। এই খবর শুনে আমিও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে দৌঁড়ে পলাশী
ব্যারাকের মোড়ে গেলাম। তখন ভয়ে আমার হাত-পা সিঁধিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এই
শোকাবহ ঘটনার পরই মেডিকেল কলেজের দিকে অসংখ্য মানুষের যাত্রা শুরু হয়। এরই
মধ্যে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ও আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ভবনে মাইক
লাগিয়ে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও জ্বালাময়ী বক্তিতা শুরু হয়ে গেছে। শোকের
গভীর ছায়া ছড়ানোর পাশাপাশি মাইক থেকে সংগ্রামের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ ঝরে পড়ছে।
জালিম মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হচ্ছে প্রচন্ড ঘৃণা ও ধিক্কার।
পলাশীর ব্যারাকের মোড়েই জনতার ভীড়ের মধ্যে মোহাম্মদ আজিজুল হকের সঙ্গে দেখা
হল। সে মিছিলে ছিল। গুলি তার গায়ে লাগেনি। তবে ঐ গুলাগুলির পর সুমাদকে
আজিজরা কেউ খুঁজে পায়নি। পরে আমি...।”
-- স্যার--
--হ্যাঁ, বল। না থাক, তুমি চা খাও। লক্ষ্মী-
--না স্যার, আমি আসি-
--সুমাদের কোন খবর পেলে-
-- আমি অবশ্যই আপনাকে জানাব
আমাকে দেখে বাবা মাহফুজ ভাইকে থামিয়ে দিলেন। কিন্তু আমি সব শুনে ফেলেছি।
আমার মাথা ঘুরতে লাগল, বিছানা পর্যন্ত না যেতেই পরে গেলাম রামের গায়ের উপর।
আমার আর কিছু মনে নেই। সুমাদকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমি জানি, ওকে আর
কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীতে অনেক কিছুই আছে, সময়ে আসে, সময়ে হারিয়ে
যায় আর ফিরে পাওয়া যায় না। শুধু জানি, সুমাদকে আমি খুব ভালবাসতাম কিন্তু
বলতে পারিনি। ভালবাসার শিকলে, সময় অথবা যৌবন কাউকেই বেঁধে রাখা যায় না।
সময়ের কি লাশ হয়? হয় না? তাইতো সুমাদের লাশও হয়নি, সুমাদ সময়। সেই সময়টাকে
আজ ষাট ধরে হৃদয়ের হাজার ফুট গভীরে লুকিয়ে রেখেছি। এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম
নারী বলে। আজ আমি বৃদ্ধা। সকল বয়সের বাইরে আমার জীবন। জীবনের এই ভাদ্র
বেলায়, সকল মানুষের কাছে সেই সময়ের করুণ সুর শঙ্খের আওয়াজে না পারলেও
বাঁশের বাঁশিতে বাজিয়ে দিলাম। সুর ভেসে যাক, প্রত্যেক নারী-পুরুষে। হাজার
মানুষের স্মৃতির ভীড়ে, এ স্মৃতি হোক সকলের আপন।
ARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|