|
এ কে খন্দকারের স্মৃতিচারণ মূলক বই এবং কিছু কথা
মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম
বাঙ্গালী
জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামের এক পর্যায়ে অনিবার্য ভাবেই সশস্ত্র
যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় । আর এই যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমেই বাঙ্গালী জাতি
পাক বর্বরদের শাসন শোষনের যাঁতাকল থেকে মুক্ত হয়, অর্জন করে রক্ত খচিত লাল
সবুজের পাতাকার স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ।
আর এই স্বাধীনতার এই ৪৩ বছরের বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গিয়ে
বা স্মৃতি কথা লিখতে গিয়ে গুটিকয়েক লেখক জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাঙ্গালী
জাতির এই মহান অর্জনকে খন্ডিত আকারে উপস্থাপন করেছেন, বিতর্ক ছড়িয়েছেন সমাজে
। মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার দুঃসাহস
দেখিয়েছেন । দুঃখজনক হলেও সত্য, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে অংশ
গ্রহনকারীদের দ্বারাই এই কাজটি বেশী হয়েছে ।
সম্প্রতি এই সশস্ত্র যুদ্ধের একজন অন্যতম প্রধান সমর নায়ক একটি স্মৃতিচারণ
মূলক বই লিখে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন । উনার লিখাকে কেউই
পুরোপুরি সমর্থন করছেন না, সমর্থন করছেন সেইটুকু, যেটুকু যার পক্ষে যাচ্ছে
অথবা যেটুকুতে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর বিব্রত হওয়ার উপাদান আছে । তাতে
এতোটুকু বলা যায় বইটিতে আংশিক সত্য ওঠে এসেছে, পুরোপুরি সত্য বইটিতে প্রকাশ
পায়নি । বইটি যদি পুরোপরি স্মৃতিকথার বই হতো, এতে ক্ষুব্ধতা প্রকাশের জায়গা
থাকতো না । সমস্যা হচ্ছে উনি এই বইটিতে ইতিহাসের অনেক বিতর্কিত তথ্য তুলে
ধরেছেন এবং কিছু প্রতিষ্ঠিত সত্য তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়েছেন, কিন্তু উনি এসব
তথ্যের অনুকূলে ইতিহাস অনুসৃত যথোপযুক্ত তথ্য-উপাত্তের সন্নিবেশ ঘটাননি ।
কোথাও বলেছেন শুনেছেন, কিন্তু কার কাছে কোথায় শুনেছেন তা নেই, আবার কোথাও
বলেছেন উনি মনে করেন । যাহোক শুনা কথা, কান কথা বা উনি মনে করেন এমন যুক্তি
দিয়ে ইতিহাসের বিতর্কিত তথ্য উপস্থাপন ঠিক না ।
ইতিহাসের অন্যতম সমর নায়ক, মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান এ কে খন্দকার (বীর
উত্তম) সাহেবের এই ধরনের স্পর্শকাতর ইতিহাস চর্চা, তথ্য উপস্থাপনে
খামখেয়ালীপনা এবং মনগড়া তথ্য উপস্থাপনে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন । এই বইটি
উনাকে বর্তমানে বিতর্কিত অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে সত্য । কিন্তু এজন্য উনার
অতীত বীরত্বপূর্ন অবদানকে খাটো করে দেখাও ঠিক হবে না, যারা খাটো করে দেখার
চেষ্টা করছেন, তারা অন্যায় করছেন । ইতিহাসকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় ছেড়ে দেয়া
উচিত । ইতিহাস নগ্নসত্য বা অমোঘ সত্য বা অবধারিত সত্যকেই স্বীকৃতি দেয় ।
অসত্য তথ্য সম্বলিত ইতিহাস একদিন না একদিন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত
হবেই ।
এ কে খন্দকারের ১৯৭১ ভেতরে বাহিরে স্মৃতিচারন মূলক বইটি ইন্টারন্যাটের
মাধ্যমে ডাউনলোড করে পড়েছি । মোদ্দাকথায় বলতে গেলে বইটিতে উনি যে শুধু কিছু
বিতর্কিত তথ্যকে পুনরায় টেনে এনেছেন তা নয়, উনি কিছু নতুন বিতর্কও জন্ম
দিয়েছেন । উনি বলেছেন সশস্ত্র যুদ্ধের পরিকল্পনা রাজনীতিকদের ছিলনা,
রাজনৈতিক নেতারা পাকিস্তান সরকারের দুরভিসন্ধিকে বুঝতে পারেননি এবং
রাজনৈতিক নেতাদের অদূরদর্শীতা এবং যুদ্ধ ঘোষনা করতে ব্যর্থতার কারনে দেশের
অনেক ধ্বংসযজ্ঞ ও অধীক সংখ্যক প্রাণহানী ঘটেছে, ৭ মার্চ যুদ্ধ ঘোষনা করলে
কম ক্ষয়ক্ষতি ও অল্প সময়ের ব্যবধানে আমাদের স্বাধীনতা আসতো । তাছাড়া ২৫
মার্চ বঙ্গবন্ধু বাসায় থেকে স্বেচ্ছায় এ্যারেষ্ট হওয়া ঠিক হয়নি, আত্মগোপনে
গিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করা উচিত ছিল । বইটির বিভিন্ন অংশে সমালোচনার তীর্যক
তীড় বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য রাজনীতিকদের ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে ।
সশস্ত্র যুদ্ধের সেনা উপ-প্রধান বীর উত্তম এ কে খন্দকারের মত একজন
শ্রদ্ধাভাজন প্রবীণ লেখা নিয়ে সোস্যাল মিডিয়াতে স্বাধীনতা যুদ্ধের সরাসরি
বিরোধীতাকারী জামাত-শিবিরের এই প্রজন্মের কর্মী সমর্থকদের উচ্ছাস দেখে,
উনার লেখার কোন অংশে ওদের জন্য প্রশংসাসূচক বক্তব্য নেই । অথচ ওরা বগল
বাজিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করছে এবং মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, প্রবাসী সরকার,
বঙ্গবন্ধু এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার মত মন্তব্য
ছুঁড়ে দিচ্ছে ।
যাহোক, ইতিহাসের সত্যতা ঝাচাই বাছাই ঐতিহাসিকরাই করবেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু
জয় বাংলার পরে জয় পাকিস্তান বলেছিলেন কী বলেননি, সেই বিতর্কের সমাধান হয়তঃ
বক্তব্যের রেকর্ড অর্থাৎ তৎকালিন পাকিস্তান রেডিওর আর্কাইভে খুঁজলে পাওয়া
যেতে পারে । তবে ঐ সময়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে মঞ্চে থাকা আ স ম আবদুর রব,
তোফায়েল আহমেদ ও নূরে আলম সিদ্দিকীসহ বেশ কয়েকজন টিভি টকশো এবং পত্রিকায়
লিখিত প্রতিবাদ জানিয়েছেন । তাছাড়া বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনের নিকট কেন
স্বাধীনতার ঘোষনা রেকর্ডে সম্মতি দেননি এবং না পালিয়ে গিয়ে বাসায় থেকে
এ্যারেষ্ট হওয়াতে স্বাধীনতা যুদ্ধের কী লাভ-ক্ষতি হয়েছে, তা ইতিহাসের
বিশ্লেষকদের উপর ছেড়ে দিয়ে সাধারণ দৃষ্টিতে যে অসংগতি ও স্ববিরোধী
বক্তব্যগুলো দৃষ্টিগোচর হয়েছে, তা সামান্য আলোকপাত করবো । এক) ভূমিকাতেই
লিখেছেন মার্চ মাসের দিকেই বুঝা যাচ্ছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর
হচ্ছে, অথচ উনিই অন্য জায়গায় লিখলেন রাজনীতিবিদদের স্বাধীনতার পরিকল্পনা
ছিলনা । স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে তাহলে কারা দেশকে স্বাধীনতার দিকে
অগ্রসর করছিলো ? দুই) উনি লিখেছেন ফেব্রয়ারী-মার্চ মাসের দিকে পাকিস্তানী
সেনা কর্মকর্তারা বাঙ্গালী সৈনিক অফিসারদের বিশেষ নজরে রাখছিলেন, তাই উনি
ভয়ে অপরিচিত বাঙ্গালী সদস্যদের সাথেও আন্দোলন সম্পর্কে কোন কথা বলতেন না ।
আবার অন্য জায়গায় লিখেছেন উনাদের সাথে রাজনৈতিক নেতারা যোগাযোগ রাখলে সেনা
সদস্যদের সংগঠিত করে অল্প সময়ে দেশকে স্বাধীন করতে পারতেন । প্রশ্ন আসে,
যিনি অপরিচিত বাঙ্গালী সেনা সদস্যদের সাথে ভয়ে আন্দোলন প্রসঙ্গে কথাই বলতেন
না, উনি কিভাবে অপরাপর বাঙ্গালী সেনা সদস্যদের যুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতেন !
তাছাড়া উনি বলেছেন রাজনৈতিক নেতাদের স্বাধীনতার প্রস্তুতি ছিলনা, তাহলে
প্রশ্ন জাগে, তৎকালিন ছাত্রনেতারা যে ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন, জাতীয় সংগীত গাইলেন এবং ৩রা
মার্চ পল্টনে বিশাল ছাত্র সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে শাহজাহান সিরাজ
স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ করলেন, ২৩ মার্চ পল্টন ময়দানে তৎকালিন ছাত্রনেতারা
বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং বাঙ্গালী জাতির জনক হিসেবে
ঘোষনা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সামরিক ঢংয়ে কুচকাওয়াজের মাধ্যমে অভিবাদন জানালেন
এবং বঙ্গবন্ধুর হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিলেন, তারও অনেক আগে
৫৮ সালে সিরাজুল আলম খান, শেখ মনি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদদের
নেতৃত্বে স্বাধীনতার লক্ষ্যে সশস্ত্র প্রস্তুতির জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের
নিউক্লিয়াস ও বি এল এফ গঠন করে অস্র সংগ্রহ ও অস্র প্রশিক্ষন দিচ্ছিলো,
তাছাড়া ৬৯ সালে কম বয়সী তরুনদের দিয়ে ভিত্তি ফৌজ নামক বাহিনী গঠন করে
আগরতলায় অস্ত্র প্রশিক্ষন দিচ্ছিলো, এসব কী স্বাধীনতার প্রস্তুতি ছিল না !
তাছাড়া পাকিস্তানিরা যে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
দিয়েছিল, তার কি কোন বাস্তবতাই ছিলনা ! ৭০ এ নির্বাচনে বিশাল জয়ের পর
বঙ্গবন্ধু এম এ জি ওসমানীকে তাঁর সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন,
তাতে কী কোন ইঙ্গিত ছিলনা ! মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে তোফায়েল আহমেদ
ও আবদুর রাজ্জাক ও আ স ম আবদুর রবদের বঙ্গবন্ধু কলকাতার একটি ঠিকানা মুখস্ত
করিয়ে বলেছিলেন- সব ঠিক করা আছে, তোরা সময় মত ঐখানে গেলেই সব পাবি । এই সব
কী স্বাধীনতার প্রস্তুতির অর্থ বহন করে না !
বাস্তবতা হচ্ছে, খন্দকার সাহেব বিমান কর্মকর্তা হিসেবে ৫১ থেকে ৬৯ পর্যন্ত
পশ্চিম পাকিস্তানে স্বপরিবারে থেকেছেন । উনার বইতে উনি পাকিস্তানে
থাকাকালিন সময়ে পাকিস্তানিদের আন্তরিকতায় মুগ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন । উনি
পশ্চিম পাকিস্তানে বিমান কর্মকর্তা হিসেবে আয়েশি জীবন এবং ওদের আতিথেয়তার
মুগ্ধতায় মোহাবিষ্ট থাকলেও ঠিক একই সময়ে যে পূর্ববাংলার জনগন বাংলার
জন-মানুষের অধিকার আদায়ে ৫২ ৬২ ৬৬ ৬৯ এ বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত
করেছিল, সেই মর্মস্পর্শী হৃদয় বিদারক কষ্টের দিনগুলির ছোঁয়া উনার বইয়ে
সম্পূর্ণ অনুপস্থিত । তাই স্বভাবতঃই বলা যায় বিমান বাহিনীর ব্যারাকে থাকার
কারনে শ্রদ্ধাভাজন এ কে খন্দকার সাহেব ছাত্র-জনতার আন্দোলনের গতি প্রকৃতি ও
যুদ্ধের প্রস্তুতিকে ভালো ভাবে উপলব্ধিতে আনতে পারেননি । তাই উনার কাছে
মুক্তিযুদ্ধকে প্রস্তুতিহীন যুদ্ধ মনে হয়েছে এবং এর দায়ভার রাজনীতিবিদ ও
সর্বোপরি বঙ্গন্ধুর উপর চাপিয়েছেন । তবে উনার মতামতটা ঠিক না,
রাজনীতিবিদরাই জাতিকে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতার
জন্য প্রস্তুত করিয়েছে । তারই অংশ হিসেবে উনি নিজেও যুদ্ধ প্রক্রিয়ায় যুক্ত
হতে পেরেছিলেন এবং অধীকতর বাস্তবতা হচ্ছে উনি নিজেও রাজনীতিবিদদের দ্বারা
গঠিত মুজিব নগর সরকারের অধীনে সেনা উপ-প্রধানের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে ।
অধিকন্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে একটা জনযুদ্ধ ছিল, তা তুলে ধরতে ব্যর্থ
হয়েছেন ।
এছাড়াও উনি মুজিব বাহিনীর সরাসরি সম্মূখ যুদ্ধে অংশ গ্রহন নিয়েও সন্দেহ
পোষন করেছেন এবং মুজিব বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর
বিভিন্ন গন্ডগোল ও গোলাগুলির কথাও লিখেছেন এবং মুজিব বাহিনীকে লুটপাটকারী
হিসেবে তুলে ধরেছেন । মুজিব বাহিনীর স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের
পাশাপাশি ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি স্বীকার করেই বলছি উনি বইটিতে পাক
হানাদার ও ওদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের নৃশংসতাকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন । এ
কেমন স্মৃতিচারণ ! যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন, ওরাই আপনার স্মৃতিতে ধরা
পড়ছেনা, ওদেরকে নিরাপদে রাখলেন, ওদের কোন নৃশংসতাই তুলে ধরলেন না অথচ কলমের
খোঁচায় আহত করলেন স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান প্রানপুরুষ বঙ্গবন্ধুকে ।
লেখকঃ জাপান প্রবাসী।
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|