[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

খেলা চলছে হরদম

 

 

মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম

রাজনীতিতে একাধীক রাজনৈতিক দলের মধ্যে জনস্বার্থে তাদের গৃহীত নীতিমালা ও কর্মপন্থার শ্রেষ্টত্ব প্রমানে লড়াই হবে, এটাই স্বাভাবিক । জনমত অর্জনে এই লড়াইয়ে সব দল তাদের নিজস্ব কর্মপন্থাকে বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে হৃদয়গ্রাহী ও বাস্তব সম্মত ভাবে উপস্থাপন করবেন এবং চুড়ান্ত বিবেচনায় জনগনই ঠিক করবেন কোন দলকে তারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার দিবেন । অর্থাৎ জনগন যে দলকে মনোনীত করবেন, তারাই দায়িত্ব পালন করবেন । তবে এইসব এখন আর বাস্তবে নয়, সবই বই-পুস্তকের বিষয়ে পরিণত হয়েছে । বাস্তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে রাজনীতির নামে চলছে নীতি-আদর্শ বিবর্জিত এক জুয়া খেলা । এ নিয়ে যে যার মত খেলছেন । এই খেলায় সবই চলে জনগনের নাম করে, কিন্তু বাস্তবে জনগনের অবস্থান কতটুকু আছে তা কমবেশী সবারই জানা, দলগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে যেভাবেই হোক রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্জন করা । আর এই টার্গেটে সবদলই কমবেশী খেলছেন, এই খেলায় নিরীহ আম জনতা ফুটবল হয়ে কখনো রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি-জামাতের পায়ে আবার কখনো সরকারী দল আওয়ামীলীগের পায়ে আর এরশাদ খেলার মধ্যে বারবার ফাউল করেও লালকার্ড না পেয়ে পুরস্কৃত হলেন, মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েছেন এবং রওশন এরশাদ সংসদে প্রধান বিরোধীদলের নেত্রীত্ব পেয়েছেন । কোন দল কীভাবে কেন এই নীতিহীনতার চর্চা করছেন, তা সমালোচনার দাবী রাখে । বর্তমানে রাজনীতির ছদ্মাবরণে যে খেলা চলছে, তারই সামান্য আলোকপাতের চেষ্টা করব ।
যাহোক, এই নীতিহীন রাজনীতির খেলায় অপ্রতিদ্বন্ধী কুশীলব হচ্ছেন দীর্ঘ নয় বৎসরের স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট এরশাদ, এই মানুষটি তার দীর্ঘ নয় বৎসরের শাসন আমলের পুরষ্কার হিসেবে আমৃত্যু কারাবাসেই থাকার কথা ছিল । কিন্তু আওয়ামীলীগ বিএনপির ভোটের রাজনীতির অনৈতিক টানাটানিতে এই খলনায়ক স্বাভাবিক রাজনীতিতে অবস্থান করছেন । সমস্যা হচ্ছে স্বাভাবিক গনতান্ত্রিক রাজনীতিতে অবস্থান করলেও কতটা গনতান্ত্রিক আচরন করেছেন বা কতটা উম্মাদসূলভ আচরন করছেন, তা সবারই জানা ।
এরশাদের সাম্প্রতিক দু/চারটি কথা না বলে পারছিনা, তিনি মুখে যখন যা আসে তাই বলেন, কথাবার্তা ও সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে সকাল বিকাল দুপুর হরহামেশা করে থাকেন । নিজের কথার সাথে নিজেই বৈপরীত্ব সৃষ্টি করে নাটকের পর নাটকের সূত্রপাত করেন । প্রথমে বললেন নির্বাচনে অংশ গ্রহন করলে জনগন থুথু দিবে । এই কথার রেশ কাটতে না কাটতে নির্বাচনে অংশ গ্রহনের ঘোষনা দিয়ে নির্বাচনকালিন সরকারেও যোগ দিলেন, আবার বিএনপিকে নির্বাচনে আসার আমন্ত্রণ ও হেদায়েত করলেন । আবার কিছুদিনের মধ্যে নির্বাচন ও নির্বাচনকালিন সরকার থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষনা দিলেন, অতঃপর সরকার এরশাদকে লাগাম টেনে ধরার নিমিত্তে অসুস্থ্যতার অজুহাত দেখিয়ে র্যাবের সাহায্যে সিএমএইচে নিয়ে যান এবং ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন বাবলুর মাধ্যমে রওশন এরশাদকে ম্যানেজ করে নির্বাচন, এমপিদের শপথ গ্রহন এবং মন্ত্রী পরিষদের শপথ গ্রহন অনুষ্ঠান পর্যন্ত সমাপ্ত করেন । মন্ত্রীদের শপথ গ্রহন নাটকের এ পর্যায়ে এরশাদকে র্যাবের গাড়ীতে করে সিএমএইচ থেকে সরাসরি অনুষ্ঠানে নিয়ে আসেন । সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ অনুষ্ঠানে ঢুকতেই ওনার যথোপযুক্ত প্রাপ্তিটা পান, দরবার হলে ঢুকতেই বিদ্রুপাত্মক হাসির রোল পড়ে যায় । এতে বিশ্ববেহায়া এরশাদ লজ্জা পেয়েছে কিনা জানিনা, তবে অনুষ্ঠানের পুরো সময়টা প্রথম সারিতে স্ত্রী রওশন এরশাদের পাশে নির্বাক ও বিমর্ষ চাহনিতে বসে অনুষ্ঠানটি গিলতে হয়েছে এবং অনুষ্ঠান শেষে সরকার এরশাদকে র্যাবের গাড়ীতে করে নিজ বাস ভবন প্রেসিডেন্ট পার্কে পৌঁছে দেন ।
প্রধান বিরোধীদল বিএনপি কৌশলের খেলায় আওয়ামীলগের কাছে ধরাশায়ী হয়ে রাজনীতির মাঠে অনেকটা মৃয়মাণ । এরই মাঝে গোঁধের উপর বিষফোঁড় হয়ে এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত, যাতে বলা হয়েছে বিএনপি সহিংস রাজনীতির হোতা জামাত হেফাজতকে ছাড়তে হবে । ইইউর সুপারিশের পর নির্বাচনোত্তর সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির প্রথম সমাবেশে জামাত-শিবির ও হেফাজতের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বিএনপি নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি বিএনপিকে উজ্জীবিত করেছে এবং সুশীল সমাজের প্রশংসা কুড়িয়েছে ।
যাহোক, আওয়ামীলীগের শাসন আমলে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি জনগনকে সম্পৃক্ত করার মত অনেক জনগুরুত্ব সম্পন্ন ইস্যু (শেয়ার বাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি, পদ্মা সেতু এবং দ্রব্যমূল্য ইত্যাদি) পেয়েই সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর আন্দোলন না করে অলস রাজনীতিতে কাটিয়েছিল । আর সরকার যুদ্ধে মানবতা বিরোধীদের বিচারকে সামনে এনে নাগরিকদের দৃষ্টিকে নিজেদের অনুকূলে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল । স্বাভাবিক ভাবেই পত্রিকা ও টিভি মিডিয়ার টকশো গুলো প্রাধাণ্য পেয়েছে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আলোচনা । আর জামাত নেতারা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে এ্যারেষ্টে থাকায় বিএনপি নেতারা জোটমিত্রের পক্ষে দু/চারটি কথা বলা বা চুপ থাকায় বিএনপিকে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষকের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে । বিএনপি যদি নাগরিক জীবনের সমস্যা ও সরকারের দুর্নীতি-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারত, বিএনপিকে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষকের দায়ও নিতে হতো না এবং সরকারও জামাতকে এতোটা কোনঠাসা পর্যায়ে নিতে পারত না । বিএনপির অলস রাজনীতি বিএনপি জামাত উভয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে । বিএনপি ভেবেছিল সরকারের কার্যক্রমই সরকারকে অজনপ্রিয় করে তুলবে, এতে করে বিএনপি অনায়াসে নির্বাচনী বৈতরনী পাড়ি দিয়ে সরকার গঠন করবে-এই ভাবনা বিএনপিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ।
সরকারের শেষ ছয় মাসে বিএনপি তত্ত্বাবধায়কের দাবীতে গড়া আন্দোলনটিও বুদ্ধি ভিত্তিক চর্চা ও কৌশলগত দূর্বলতার কারনে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং শেষোবধি নির্বাচন বয়কট ও প্রতিরোধের ঘোষনা দেন । কিন্তু আওয়ামীলীগ এসবকে উপেক্ষা করে যেনতেন প্রকারে একটি নির্বাচন করিয়ে সরকারও গঠন করে ফেলেন । ফলে বিএনপি নিশ্চিত ক্ষমতার দোরগোড়ায় এসেও ছিটকে পড়তে হয়েছে, ফলশ্রুতিতে খালেদা জিয়া বিরোধীদলের নেত্রীর আসনটিও হারিয়েছেন । এখন বিএনপি রাজপথের প্রধান বিরোধীদল আর সরকারের বিরোধীদলের নেত্রীর আসনে জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ । আর বর্তমান সময়ে টিভি টকশো, কলামিষ্টদের কলাম, আওয়ামী বুদ্ধিজীবি সুশীল ও উদারপন্থী বিএনপি মনা বুদ্ধিজীবি সুশীলদের একাংশ বলতে শুরু করেছে-বিএনপি যদি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিয়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করত বিএনপির জয় সরকার ঠেকাতে পারতো না । এসব দেখলে ও পড়লে খালেদা জিয়ার অন্তর্জ্বালা নিশ্চিত ভাবে বাড়বে বৈ কমবেনা, দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ২৩ বৎসরে খালেদা জিয়া এবারই প্রথম এতোটা ক্ষমতাহীন অবস্থায় । বিএনপির কৌশলিক দূর্বলতা, একগুয়ে আচরন বা জামাতের প্রভাব বা সরকারের অনৈতিক কৌশল-যে কারনেই হোক না কেন বিএনপির মত এতোবড় একটি জনমত সমৃদ্ধ দল রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার বা প্রধান বিরোধীদলে থাকতে না পারাটা বাংলাদেশের গনতন্ত্রের বিকাশ ও ধারাবাহিকতা রক্ষায় অন্তরায় ।
সরকারীদল আওয়ামীলীগ দীর্ঘ গনতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের ঐতিহ্যের অংশীদার হিসেবে যেই পন্থায় নির্বাচনী বৈতরনী পাড়ি দিয়েছেন তা ভবিষ্যত আওয়ামীলীগকে কলংকবানে জর্জরিত করবে । অনেকের মতে বিএনপির ১৫ ফেব্রয়ারী নির্বাচনের মত আওয়ামীলীগ ৫ জানুয়ারী নির্বাচনে অনুরুপ একটি কলংক তীলক কপালে পড়েছেন । তাছাড়া বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে বাসভবনে পুলিশ, বালির ট্রাক ও জলকামান দিয়ে অবরুদ্ধ করে এবং জাতীয় পার্টির প্রধান এরশাদকে জোরপূর্বক সিএমএইসে শুঁইয়ে রেখে যে নিন্দনীয় কূটকৌশলের নির্বাচন ও সরকার গঠন সমাপ্ত করলেন, তা কোন ভাবেই আওয়ামীলীগের কাছে জনগন প্রত্যাশা করেননি । আওয়ামীলীগ আদালতের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক বাতিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সংলাপ কেন্দ্রিক অসমাপ্ত নাটকের শেষ পর্যায়ে এসে এক তরফা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করেন এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন পেয়ে এখন বেশ কনফিডেন্ট মনে হচ্ছে । যদিও নির্বাচনের পূর্বে শেখ হাসিনা অনেকটা সফটলী বিহ্যাভ্ করে বলেছিলেন-দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে নিয়ম রক্ষা ও সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন এবং নির্বাচনের পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদলের সাথে সংলাপে বসবেন । কিন্তু আশাতীত ভাবে বিশ্ব জনমত কাছে পেয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও কথাবার্তার সুর পাল্টে গেছে, সুরপাল্টে যাওয়ার আরেকটা কারন বিএনপি নেতাদের আন্দোলন পরিচালনায় লেজে-গোবরে অবস্থা এবং জামাত-শিবিরের অব্যাহত সহিংসতায় কূটনৈতিকদের নেতিবাচক মনোভাব ।
যাহোক, প্রতি পাঁচ বৎসর পরপর একদিনের নির্বাচনী গনতন্ত্রের নামে জনগন যেভাবে ফুটবল হয়ে এপায়ে ওপায়ে ঘুরছে এবং প্রধান দুই দল ও জোটের ক্ষমতার আগুনে অকাতরে জ্বলে-পুড়ে মরছে, এই খেলার অবসান হওয়া উচিত । সরকারীদল আওয়ামীলীগ ও রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি যেহেতু এখন মোটামুটি লম্বা সময় পেয়েছেন, তড়িঘড়ি নয়-ধীরে সুস্থ্যে সুস্থির চিন্তা-ভাবনা ও গবেষনাধর্মী পর্যালোচনার মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান আনতে হবে এবং সুশাসনের বিষয়ে রোডম্যাপ নির্ধারন করতে হবে, রাষ্ট্রের অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, শিক্ষানীতি, সমাজনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে পরিচালনায় ঐক্যমতে পৌঁছাতে হবে ।


লেখকঃ জাপান প্রবাসী

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ