|
ঘর ভাঙ্গা ঝড়
আকাশ মামুন
মোহাব্বত শেখের
টানাটানির সংসার। পা ভাঙ্গা কুকুর যেমন লেংচিয়ে লেংচিয়ে চলে ঠিক তেমন করেই
সংসার চলে। আজ চাল আছে তো ডাল নেই, নুন আছে তো তেল নেই, ঘরের ছাউনি আছে তো
বেড়া নেই। ফু্টো চালে যেমন চৈত-বৈশাখে চাঁদের আলো আসে তেমনি শাওন-ভাদ্দরে
বৃষ্টির জল গড়ায়। পাট খড়ির ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁকে রাত দিন ঘরে বিড়াল-কুকুর আসা
যাওয়া করে। গঞ্জের পুরনো কাপড়ের দোকান থেকে যতটা রোজগার হয়_তাতে দুমুঠো
ভাতের জোগাড় করাটাই রাজ্য জয় করার মতো। এমন অবস্থায় লুফে নেয়ার মত একটা খবল
এলো বটে, কিন্তু খবরটা শুনে মোহাব্বত গোখরোর মত ফুসে উঠলো। না খায়া মরুম।
বউ কামাই করবো হেই টেহায় খামু-পিন্দিমু? মাগীর শখ দেখছো! ভাতার ধরবো-নাং
কইর্যাা বেরাবো। ফুস করে ফনা তোলা গোখরো যেমন শিকড় দেখে মাথা নুইয়ে ফেলে
তেমনি পাড়া-পড়শি, আত্মীয়-স্বজনের অভিযাচিত কথাবার্তায় দমে গেল মোহাব্বত।
ঠিকইতো_এহন দুজনের সংসারই চলে না। পুলা-মেয়া যহন হবো-তহন ক্যামনে চলবো।
বিদেশি এনজিওতে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে যোগদান করলো বিন্তি বেগম। চৈতা পুড়া
গাছ যেমন বৈশাখের বৃষ্টিতে লকলকিয়ে উঠে ঘন সবুজ পাতায়_তেমনি
মোহাব্বত-বিন্তির সংসারে সুখের ডগা লকলকিয়ে মাথা তুলতে লাগলো। এখন আর চালের
ফুটোয় চাঁদের আলো ঘরে আসে না, বৃষ্টির জলে মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে বসে থাকতে
হয় না। হাতের ডগায় চুন আর মুখ ভর্তি পানের ঘনঘন পিক ফেলতে ফেলতে মোহাব্বত
ক্রেতাদের বোঝায়; কাপড় ভালা, বাইছ্যা লন বিশ ট্যাকা। এক অভাবের সাগর থেকে
আরেক অভাবের সাগরে এসে পড়েছিল বিন্তি। পুষ্টির অভাবে বয়স বৃদ্ধির সাথে
দৈহিক বৃদ্ধি তাল মেলাতে পারেনি। তাইতো নারী শোলভ দৈহিক শৈষ্ঠব যতটা বাড়ার
কথা ছিল ততটা বাড়েনি। সেই লিকলিকে দেহ সুখের ছোঁয়া পেয়ে যেন হয়ে উঠছে
বিকশিত অঙ্গনা। কাল বিবর্ণ চেহারায় ঠিকরে পড়া রূপ যা বোঝায় তা না হলেও কেমন
একটা বান ডেকেছে। দেহে স্পষ্ট হয়ে উঠা নানা বাঁক নারীর বয়স সুলভ সৌন্দর্য
জানান দিচ্ছে। আর সেটাই যেন কাল হলো বিন্তির। দিনকে দিন মোহাব্বতের সন্দেহ
বাড়তে লাগলো বিন্তিকে নিয়ে।
ঘটনার সূত্রপাত সেদিন দুপুরে। পৌষের শীতে জড়সড় প্রকৃতি। সূর্যের দেখা নেই।
তাই বলে দিন আর বসে থেকেনি। সূর্যকে ছাড়াই গন্তব্যে ছুটে চলছে। গঞ্জে
যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। শীতে জড়সড় হয়ে গঞ্জে যাওয়ার যোগাড়-যন্ত করছিল
মোহাব্বত। কাপড়ের গাট বেঁধে সাইকেলে একা তোলার কসরত করতে গিয়ে সাইকেলসহ পড়ে
গেল হুড়মোড় করে। উত্তর পাড়ার হাসনা বেওয়া তা দেখে টিপ্পনি কেটে বললো, কিগো
মোহাব্বত; বউতো কামাই করতাছেই। তুমি এবার ছাইরা দেও না। টাং করে বিণার তার
বেজে উঠার মত দেমাগে লাগলো মোহাব্বতের। ক্যা; তর কী মনে অয় আমি বউয়ের কামাই
খাইতে বইয়া থাহি? শালির যা কামাই, তাইতে ওরই শ্যাঠা ভরে না! হ, আমিও তাই
কই, মোহাব্বতের মত মানুষ বউয়ের কামাই খায় কিবা কইরা! হেই দিন দেখলাম ডিস্কু
মাইর্যা দহিন পারার মতলুর লগে যে পরিমাণ হাসাহাসি করতাছে; আল্লাই মালুম!
সত্যি কইরা ক হাসনা কি দেখছস। রাগে ফুসতে ফুসতে নিজেই এবার গাটসমেত
সাইকেলটা ফেলে দিল মোহাব্বত। হাসনা মোহাব্বতের রুদ্র মূর্তি দেখে ভিরমি
খেয়ে স্বগতোক্তি মত বলতে লাগলো কি জানি ভাই, আমি কি কমু আবার হাইকোট দেহন
লাগবো। আমি কিছু জানি ন্যা। তোমাগো ভালা তোমারাই দেহগা। আমি ক্যাচালে নাই।
গঞ্জে না গিয়ে বিন্তির বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় ছিল মোহাব্বত। আজ হেস্তনেস্ত
কিছু একটা হয়ে যাবে তা মোহাব্বতের রূঢ় মূর্তি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। সন্ধ্যা
হয় হয় করে যখন বিন্তি বাড়ি ফিরলো_তখনি তার উপর গরু তাড়ানোর লাঠি নিয়ে চড়াও
হলো মোহাব্বত। কিছু বোঝে উঠার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো বিন্তি। শুনতে পেলো
খিস্তি দিয়ে মোহাব্বত বলছে, শালি কার লগে নাং কইর্যাত বেরাস ক? কারেনিগা এত
হাইজ্যা-পুইর্যাি যাস? তর চারকি আজ আমি ছুইট্যাইয়া দিমু। আজক্যার থিকা তর
চারকি বন্দ। এবার মুখ খুললো বিন্তি। কি এমন সুখে রাখছ। জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ
কি পুইর্যা করছ? তোমার কাছে আইয়া জীবনডারে তিলে তিলে ধ্বংস করছি। এহন যহন
নিজ হাতে জীবনডারে সুন্দর করবার লাগছি_তহন তোমার সহ্য হয় না; না? জিদ্দে
জইল্যা-পুইর্যা। মরতাছ। এবার যেন দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গেল মোহাব্বত।
তার উপর্যুপরি আঘাতে সন্তান সম্ভবা বিন্তি জ্ঞান হারিয়ে ফেললো বিন্তি।
ততক্ষণে চিৎকার চেঁচামেচিতে জটলা বেঁধেছে। এবার হারুর মা এসে মোহাব্বতের
লাঠি ফেলে বিন্তিকে মুক্ত করলো। কিন্তু বিন্তির শরীর রক্তে ভিজে গেছে। শত
চেষ্টাতেও আর বিন্তির জ্ঞান ফিরেরে এলো না। মোহাব্বতকে প্রতিবেশি অনেকেই
পালানোর পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু নির্বিকার মোহাব্বত কারো কথাই না শুনে
পুলিশের অপেক্ষায় বসেছিল। সকাল নাগার পুলিশ এসে মোহাব্বতকে থানায় নিয়ে গেল
আর পোস্টমর্টেম করতে বিন্তির লাশ মর্গে পাঠালো।
ARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|