|
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)
মূর্তি-ভাস্কর্য বিতর্ক এবং আমাদের রাজনীতি
মুজিববর্ষ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মানে সরকারী উদ্যোগে মুফতি
মামুনুল হক, মুফতি ফয়জুল করীম এবং বাবুনগরীদের তর্জন গর্জনে স্থবির
রাজনীতির মাঠে উত্তাপ ছড়িয়েছে । হঠাৎ করে হেফাজতের এই হুংকারে সরকারীদল
রহস্যজনকভাবে বেশ কিছুদিন নীরব থাকলেও অবশেষে মুখ খুলেছেন, কিন্তু মাঠের
রাজনীতির প্রধান বিরোধীদল বিএনপি অদ্যবদি নিরব নিশ্চুপ । মূর্তি এবং
ভাস্কর্য প্রসঙ্গে হেফাজত নেতাদের ধর্মীয় ফতোয়া এবং বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে
বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার হুংকারেও সরকারীদলের প্রাথমিক নিরবতা এবং ভাস্কর্যের
পক্ষে আওয়ামীলীগ নেতাদের ধর্মীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষন এবং মুসলিম বিশ্বে
ভাস্কর্যের উপস্থিতিকে তুলে ধরে কৈফিয়তি রাজনীতির কারনেই লালনের চারণ ভূমি
কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য রাতের অন্ধকারে ক্ষতিসাধনের
দুঃসাহস দেখিয়েছে ওরা, সিসি টিভি ফুটেজে দেখা গেছে কওমী ছাত্র সদৃশ দুই
দুষ্কৃতকারীর ছবি, যারা ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে । বাংলাদেশ কোথায় যাচ্ছে?
ভবিষ্যত বাংলাদেশের রাজনীতির উপজিব্য বিষয় কি হবে? আমরা এগিয়ে যাবো নাকি
হারিয়ে ফেলব মুক্তিযুদ্ধের অর্জন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদার গনতান্ত্রিক
ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশকে ।
যারা এখন বলছেন নব্বই ভাগ মুসলিমের দেশে ইসলাম বিরোধী মূর্তি-ভাস্কর্য
নির্মাণ করতে দেবো না, ভেঙ্গেচুড়ে নদীতে ফেলব । ইতিহাস বলে পাকিস্থান আমলে
ওরা সংখ্যাগরিষ্টের কথা বলে হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথের- রবীন্দ্র সঙ্গীত
নিষিদ্ধের আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টে ভোট দিলে বিবি তালাকের ফতোয়া, ৫২ ভাষা
আন্দোলনে উর্দু হরফে বাংলার পক্ষালম্বন, সর্বোপরি ইসলাম রক্ষায় অখন্ড
পাকিস্থানের পক্ষালম্বন করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা, আর তৎকালিন কৃতকর্ম !
আজ নাইবা বললাম । যারা এখন বলছেন-আমরা ভেসে এসেছি নাকি ? নিশ্চয় না, আগেও
ছিলেন এখনো আছেন, তবে বিভিন্ন সময়ে (মিলিটারি শাসনামলে) বানের জলের সাথে
ভেসে এসেছে একাত্তরে পরাজিত, পরিত্যক্ত ধর্মীয় রাজনীতিটা । এজন্যই আজ ধর্ম
নিরপেক্ষ উদারনৈতিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে কওমী হুজুরদের অসহ্য
আস্ফালন শুনতে হয় । কথায় কথায় বলেন নব্বই পার্সেন্ট মুসলমানের দেশে
ভাস্কর্য নির্মান করতে দেবো না । এই নব্বই ভাগের ঠিকাদারি আপনাদের কে দিয়েছে
? সাধারন হিসেবে এই হেফাজতিরা এক পার্সেন্টেরও নিচে, জামাত-শিবির ৬
পার্সেন্ট, আওয়ামীলীগ ৩৫ থেকে ৪০ পার্সেন্ট, বিএনপি ৩২ থেকে ৩৫ পার্সেন্ট
জনগনকে প্রতিনিধিত্ব করে ।
আজ যারা বঙ্গবন্ধু প্রেমি সেজে বঙ্গবন্ধুকে দেশ দরদী এবং স্বাধীনতার
স্থপতির স্বীকৃতি দিয়ে মুসলিম নেতা বলছেন আবার ভাস্কর্যের বিরোধীতা করছেন,
তাদের কাছে জানতে চাই- একাত্তরে আপনারা এবং আপনাদের পূর্বসূরিরা কি
বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন ? নিশ্চয় না, মুফতি মামুনুল হকের বাবা শায়খুল হাদিস
মুফতি আজিজুল হক ছিলেন স্বাধীনতা বিরোধী এবং ঘৃণিত পাক হানাদার বাহিনীর
দোসর, সাংবাদিক গোলাম মুর্তজার গৃহিত সাক্ষাৎকারে আজিজুল হক নিজেই স্বীকার
করেন, যা ১৯৯৭ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয় । বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে
ওদের এই মায়াকান্না ছলচাতুরী বৈ কিছুই নয় । বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের মাঝে
একাত্তর ফুটে উঠবে, যা ওদের গাত্রদাহের কারন । আপনারা কওমীপন্থি হুজুরদের
মাঝে খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বা সাধারন মুক্তিযোদ্ধাও খুঁজে পাবেন না,
উল্টো তাদের অবস্থান রাজাকার তালিকায় । তাছাড়া এই যাবতকালে দেশ মাতৃকার যে
কোন দূর্যোগ-দুর্বিপাক, মহামারী বা কোন গনতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম বা
উন্নয়ন সংগ্রামে জনগনের পাশে ওদের অবস্থান ছিল কি? নিশ্চয় না । সাম্প্রতিক
সময়ে মুসলমানদের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবে না বলেছিল, হলে কোরআন মিথ্যা
হয়ে যাবে বলে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল । জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং উন্নয়ন
প্রগতির বিরোধীতাই ওদের মূল কাজ । কৃষিকাজে গভীর নলকূপে পানি উত্তোলনকে
খোদার উপর খোদগিরি বলে নলকূপ ভেঙ্গে দেয়া, জন্ম নিয়ন্ত্রণে সরকারী উদ্যোগের
বিরোধীতা করে বলেছিল মুখ দিয়েছেন যিনি আহার দিবেন তিনি, আর টেলিভিশনকে
দোজকের বাক্স বলে বিরোধীতাকারীরাই এখন টেলিভিশন এবং ইউটিউবে বেশী ব্যস্ত ।
মূলতঃ সমাজ সভ্যতার অগ্রগতিকে টেনে ধরাই ওদের কাজ ।
বর্তমানে মূর্তি-ভাস্কর্য বিতর্কে ধর্মকে টেনে এনে বিরোধীতা করছেন, ধর্মীয়
স্কলারদের একাংশ ভাস্কর্যের সাথে ধর্মের বিরোধ নাই বললেও অন্য অংশ বিশেষতঃ
কওমীপন্থি হেফাজতিরা বিরোধীতা করছেন । সৌদি আরবসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে
ভাস্কর্যের সাথে ধর্মের বিরোধ না দেখলেও ওনারা দেখছেন । ওনারা বলেন আমরা
সৌদি আরবসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ইসলাম অনুসরন করি না, আমরা কোরআন-হাদিস
অনুসরন করি । সমগ্র বিশ্বে কোরআন-হাদিস এক এবং অভিন্ন হলে ওনারা ভীন্নতা
দেখছেন কেন ? এক্ষেত্রে মতলববাজি অর্থাৎ ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিটাইতাই
বিরোধীতার মূল কারন । যাহোক, মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মীয়
স্কলারদের মতামতটি যৌক্তিক মনে হয়েছে, মামুনুল হকরা তা জেনেও নিজেদের
ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাব বলয় দেখানোর জন্যই এই অহেতুক বাড়াবাড়ি করছেন । আল
আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মীয় স্কলারদের মতে, সৌন্দর্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং
নান্দনিকতার জন্য তৈরী ভাস্কর্যের সাথে ধর্মের বিরোধ নাই, তবে পূজা অর্চনা
অর্থাৎ প্রার্থনার নিমিত্তে তৈরী ভাস্কর্য হারাম আর মুসলমানরা তা করলে শিরকী
গুনাহ হবে । আমার প্রশ্ন এই যাবতকালে তৈরীকৃত কোন ভাস্কর্যকে ঘিরে কোন
মুসলমান কি প্রার্থনা করেছেন? স্পষ্ট করেই বলি প্রেসিডেন্ট জিয়া কিংবা
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে ঘিরে ওনাদের অনুসারি ভক্তরা কি তাদের যে কোন সমস্যা
থেকে মুক্তি বা নাজাত চেয়েছেন নাকি পরকালে বেহেস্ত প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা
করেছেন? নাকি হিন্দু, বৌদ্ব, খৃষ্টানসহ অন্য জাতি-গোষ্টির মানুষরা করেছেন?
নিশ্চয় না । তাহলে শিরক বা বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্মার আজাবের প্রশ্নই আসে
কেন? আর মূর্তি-ভাস্কর্যের পার্থক্য আছে কি? আছে আবার নাই, প্রার্থনা বা
পূজা-অর্চনা না করলে এক এবং অভিন্ন । পার্থক্যটা কাঠামোগত নয়, পার্থক্যটা
শুধুই প্রার্থনাগত ।
বর্তমান ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলনরত কওমী হুজুররা বলছেন প্রার্থনার উদ্দেশ্য
ছাড়াও সৌন্দর্য বা ইতিহাস ঐতিহ্যের স্বার্থে তৈরীকৃত ভাস্কর্যও হারাম, অথচ
ছবি তোলাও যে সমপরিমান হারাম বা গুনাহের কাজ, তা বলছেন না, কারন এই কাজটি
যে ওনারা হরহামেশা করে বেড়ান, প্রতিদিন ফেইসবুকে নিত্যনতুন ছবি আপলোড করেন
। আর টেলিভিশন বা ইউটিউব স্ববাক, সচিত্র উপস্থিতির মত গুনাহের কাজও করছেন
প্রতিদিন, এইসব দ্বিচারিতাকে কি বলবেন ভন্ডামি নাকি মতলববাজি । ছবি/ভাস্কর্য/টেলিভিশন/ইউটিউববে
সচিত্র স্ববাক উপস্থিতির মধ্যে মানব জাতি প্রান দিতে পারবেন না, তাই গুনাহ
। জানিনা, কওমী হুজুরদের গুনাহ হচ্ছে কিনা আর ইউটিউবে শফি হুজুরের ভিডিও
গুলির জন্য কবরে ওনার কি হচ্ছে! শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, নিজেদের নিয়েও একটু
ভাবুন ।
বিশ্বনবী হযরতঃ মোহাম্মদ (সাঃ) এবং ইসলাম ধর্মের পবিত্র জন্মভূমি সৌদি আরবে
প্রানীর ভাস্কর্যে আমাদের কওমী হুজুররা নির্বাক, ধর্মহীন রাষ্ট্র ফ্রান্সে
ধর্মের অবমাননায় চাইতে ধর্মের জন্মভূমিতে ধর্মের অবমাননা অধিকতর সংবেদনশীল
হলেও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিবিদদের কিছুই যায় আসে না । কারনটা সহজ বিভিন্ন
ইসলামিক এনজিওর মাধ্যমে সৌদি পেট্রো রিয়েলের যোগান যদি বন্ধ হয়ে যায় ।
অন্যদিকে ভারতের শত্রু পাকিস্থানের বন্ধু রাষ্ট্র চীনের রাষ্ট্রীয় টিভিতে
পবিত্র কোরআন এবং নবীর অবমাননাসহ উইগুরের মুসলিমদের উপর চরম অত্যাচার
নির্যাতনেও কওমীরা নিরব । কারন পাকিস্থানের নিরবতা । একই কারনে কোথাও নরম
কোথাও গরম, এটাই ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির মতলবিকান্ড ।
আওয়ামীলীগ হেফাজতের কথায় থেমিসের ভাস্কর্য সরানো, রেলের জমি দান, কওমী
সনদের স্বীকৃতি, জাতীয় পাঠ্যক্রমে পরিবর্তনসহ কথিত গোপন লেনদেনে করেও জাতির
জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের যথাযথ মর্যাদা সমুন্নত রাখতে
পারেননি । বিএনপিকে কোনঠাসা করতে সরকার ক্রমাগত ভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তি
হেফাজতকে লালনের মাশুল গুনছে এখন । অন্যদিকে ভাস্কর্য ইস্যুতে বিএনপির
নিরবতার সুযোগে রাজনীতির স্পেসটা হেফাজতের পক্ষেই যাচ্ছে, বিএনপি কতটুকু
উপলব্দি করছে, তা জানিনা । মূলতঃ যেনতেন উপায়ে আওয়ামীলীগ বিএনপির ক্ষমতায়
যাওয়া এবং ক্ষমতা ধরে রাখার নীতিহীন অপকৌশলের সুযোগে একাত্তরে পরাজিত,
পরিত্যক্ত ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিটাই ফুলে ফেঁপে ওঠছে, নিঃশ্বাস-বিশ্বাসে
বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে আফগানীয় তালেবানি রাজনীতির এবং ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে
স্বাধীনতার অর্জন অসাম্প্রদায়িক উদার গনতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র
বাংলাদেশের ।
মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম
ওয়ারাবি,সাইতামা,জাপান।
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|