|
করোনা কালে একজন সাহেদের গল্প
দৈবদুর্বিপাক, প্রাকৃতিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়-সাইক্লোন, টর্নেডো-বন্যা,
অগ্নিকান্ড ও স্হল-জলপথের যে কোন দুর্ঘটনায় অসহায় মানুষের সহযোগিতায় এক সাথে
ঝাঁপিয়ে পড়া আমাদের ঐতিহ্য । তাই দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতায় আমরা বিশ্ব
স্বীকৃত । কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি করোনার কাছে বিশ্ববাসির মত আমরাও অসহায় ।
অদৃশ্য শত্রু করোনা মোকাবেলায় বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় তরুণসমাজ এবং সমাজের
সামর্থ্যবানরা সরকারের পাশাপাশি কমবেশী এগিয়ে এসেছেন । আবার গুটিকয়েক ত্রাণ
আত্মসাৎকারী চেয়ারম্যান-মেম্বারের ঘৃণিত কর্মও দেশবাসী দেখেছে । কিন্তু
একজন সাহেদের গল্প ছিল অজানা । তাঁর একই অঙ্গে অনেক রুপ । কী না তিনি ?
রাজনৈতিক নেতা, রাজনৈতিক বিশ্লেষক তথা বিশিষ্ট টকশো বিশারদ, সামরিক
কর্মকর্তা, প্রকাশক-সম্পাদক, স্কুল-কলেজ, আবাসিক হোটেল, ঠিকাদারি
প্রতিষ্ঠান, এমএলএম,প্যাথলজি এবং হাসপাতালের মালিক-চেয়ারম্যান ! আর কিছুটা
সময় পেলে উনি আইন ব্যবসায়ের ফার্ম খুলে দেশ-জাতিকে তথাকথিত সেবাও দিতে
পারতেন ।
মফস্বল শহর সাতক্ষিরায় জন্ম নেয়া মাত্র এসএসসি পাশ করা সাহেদ রাজধানী শহর
ঢাকায় এসে রিকসাওয়ালা থেকে শুরু করে সচিব, এমনকি নেতা-মন্ত্রী, আমলা,
বুদ্ধিজীবি. সুশীল-কুশিল সবাইকে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছেন । কোথায় তাঁর অবস্থান
ছিল না ? রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে ধারন করা সহাস্য ছবি এখন
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল । তবে কোমরে দড়ি পরার পর আজ কেউ সাহেদকে
চিনছেন না । ইনিয়ে বিনিয়ে নিজেদের আড়াল করছেন এবং দোষ চাপাচ্ছেন একে অন্যের
ওপর । কী তাঁর কীর্তি ছিল, যা রথী-মহারথীরা জানতেন না । আবার কেঊ জানতেন না
! এ কথা শুনলে গাধাও মিটিমিটি হাসবে । আইন-আদালত কি গোপন বিষয় ? দশ বৎসর
পূর্বে তার বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির মামলায় আদালতের ছয় মাসের জেলের রায়
কীভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ? ২০১৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রানালয়ে পুলিশের
গোয়েন্দা রিপোর্টে সাহেদকে প্রতারক হিসেবে চিহ্নিত করার পরও কীভাবে গণ ভবন
এবং বঙ্গ ভবনে ঢুকতে পারেন এবং রাজধানীর বাহিরে পুলিশী প্রটোকল এবং
গ্যানম্যান রাখতে পারেন, তা রীতিমত ভাবার বিষয় । সাহেদদের মত লোক রাষ্ট্রের
সংবেদনশীল এলাকায় ঢুকতে পারলে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত ভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ
হয় ।
কেউ জানুক আর নাইবা জানুক । বর্তমানে গনমাধ্যমের কল্যানে সবাই সাহেদকে জানছে
। যতই জানছে ততোই মানুষ অবাক হচ্ছে । প্রতারণায় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী
এই সাহেদ একজন বিস্ময়কর প্রতিভা । এই অল্প বয়সে কম শিক্ষিত সাহেদ অনেক গুলো
সেক্টরে প্রতারণায় সফলতা দেখিয়েছে, হয়েছে কোটি কোটি টাকার মালিক । মোটকথা,
বর্তমানের প্রতারকরা সাহেদের কাছে নস্যি, তবে আগামীর প্রতারকদের জন্য
নিশ্চয় গুরু বা আইডল হিসেবে বিবেচিত হবেন আর অপরাধ বিজ্ঞানের ছাত্রদের
পাঠ্যসূচিতে সাহেদ-কর্মকে অন্তর্ভূক্ত করা উচিত, আর কেউ যদি পিএইচডি
থিসিসের বিষয়বস্ত হিসেবে নেয়, নেহায়েত মন্দ হবে না । ধরা পড়ার পরও
ভয়-শংকাহীন ভাবলেশমুক্ত, ডোন্ট কেয়ারসূলভ সাহেদের মুখাবয়ব জাতিকে বিস্মিত
করেছে । সত্যিই সাহেদ প্রতারণা জগতে একজন দক্ষ মেধাবী এবং উঁচু মানের
কারিগর, যিনি প্রতারণাকে শৈল্পিক রুপদানে সক্ষম হয়েছেন । প্রতারণা শিল্পে
অভিনয়ের স্বীকৃতির জন্য- যা কিছু মন্দ তা চিহ্নিত করণে তিরস্কার কমিটি গঠন
করে প্রতারণা ক্যাটাগরিতে তাঁকে তিরস্কারের জন্য বিবেচনায় নিতে পারেন (দুঃখিত,রূপক
অর্থে) ।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাহেদ সুই হয়ে ঢুকতেন এবং কুড়াল হয়ে বের হতেন । কোন একটি
সেক্টরের প্রতারণায় সাহেদ সীমাবদ্ধ ছিল না । যখন যেই সেক্টরে প্রতারণার
সুযোগ আসত, সেই সেক্টরেই ঢুকে পড়তেন । রীতিমত তিনি একজন ডাইনামিক এবং
প্রত্যুৎপন্নমতি প্রতারক । করোনা কালে হাসপাতাল সংকটের সময় বিনা টাকায়
করোনার টেষ্ট এবং চিকিৎসার নামে ঢুকে জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটে
নেন । বিনা টেষ্টে ইচ্ছাকৃত ভাবে পজিটিভ-নেগেটিভ সার্টিফিকেট প্রদানের
মাধ্যমে ব্যাপক ভাবে করোনা বিস্তার এবং মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন ।
এছাড়াও এলএমএম খুলে গ্রাহকদের ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, ভুয়া রিকসার লাইসেন্স
প্রদান, ইট বালি সিমেন্ট এবং কাঠ ব্যবসায়ীদের টাকা, চাকুরী প্রাপ্তি এবং
বদলীর তদবির, ব্যাংকের টাকা লুটে খাওয়া, জাল টাকার ব্যবহার, নিন্ম মানের
মাস্ক এবং পিপিই সরবরাহ, স্কুল কলেজের জাল সার্টিফিকেট প্রদান, দালাল
ড্রাইভার দিয়ে পথচারীকে চাপা দিয়ে রিজেন্ট হাসপাতালে নিয়ে লক্ষাধিক টাকার
বিল ধরিয়ে দেয়া, বিনিময়ে দালাল ড্রাইভার পেত ৮০০০ টাকা, প্যাথলজির অনুমতি
নিয়ে হাসপাতাল খুলে বসা- যা আবার ২০১৪ সালে থেকে মেয়াদ উত্তীর্ণ , ভুয়া
ডাক্তার দিয়ে সার্জিক্যাল অপারেশনে রোগীর মৃত্যু, মৃত রোগীকে আইসিইউতে
ঘন্টার পর ঘন্টা রেখে দিয়ে বাড়তি বিল সহ অন্যন্য অপরাধ ছিল তার নিত্যদিনকার
ঘটনা ।
রিজেন্ট এবং জেকেজির মত ভুয়া টেষ্ট প্রদানকারীদের কারনে ইটালি আমাদের
প্রবাসীদের ফেরত পাঠিয়েছে এবং জাপান সহ অনেক দেশ আমাদের নাগরিকদের ঢুকতে
দিচ্ছে না । বিশ্ব মিডিয়ায় রিজেন্ট এবং জেকিজির করোনা টেষ্টের ভুয়া
সার্টিফিকেটের সংবাদ দেশের ভাবমূর্তিকে ভীষন ভাবে হেয় করেছে, প্রবাসীদের
ভবিষ্যতকে অনিশ্চয়তায় ফেলেছে, নিঃস্ব এবং ভিখারী করেছে অসংখ্য সৎ ব্যবসায়ীর
জীবনকে, জীবন গেছে অসংখ্য করোনা রোগীর । যে সাহেদরা শুধু মাত্র সামান্য
টাকার জন্য অসহায় মানুষের অমূল্য জীবন কেঁড়ে নিতে পারে । সেই মানুষরূপী
হায়েনাদের বাঁচাতে উকিল- মোক্তার, ব্যারিষ্টারের অভাব নেই, অভাব নেই টকশোতে
কূটকৌশলী তথাকথিত রাজনীতিবিদদের । টকশোতে সাহেদের আসনে বসে যাঁরা বলছেন
সাহেদ আমাদের দলের কেউ ছিল না, তাঁদের বলছি- এই অসত্য কথা দল নাকি দেশকে
ভালবেসে ? যে কেউ কি নিজে-নিজেই জাতীয় গনমাধ্যমে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয়
উপকমিটির সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন ? তাও আবার দিনের পর দিন ।
আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা সাবেক কূটনৈতিক জনাব মোঃ জমির স্বীকার করেছেন তাঁর
সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গত কমিটি মিটিংয়ে সাহেদের উপস্থিতির কথা । এই ভুল বা
অন্যায় টুকু স্বীকার করলে দল কি ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে ? নিশ্চয় না, বরং দল
ভবিষ্যত ভুলের হাত থেকে রক্ষা পাবে । সাহেদ থেকে সুবিধা নিয়ে যাঁরা
আওয়ামীলীগের উপকমিটিতে স্থান দিয়েছেন, টকশোতে আওয়ামীলীগের প্রতিনিধিত্বের
অন্তরালে কাজ করেছেন, বিনা লাইসেন্সে ব্যবসা এবং অন্যান্য অপকর্মের সুযোগ
করে দিয়েছেন, তারাই নিজেদের বাঁচাতে সাহেদের অপরাধ কর্মে ব্যবহৃত লাস্যময়ী
নারীদের নিয়ে পত্রিকার পাতায় মুখরোচক গল্প তৈরীতে ব্যস্ত আছেন । দেশবাসী
সাহেদের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং সাহেদ তৈরীর নেপথ্যে থাকা কারিগরদের দেখতে চায়,
নচেৎ যে লাউ সেই কদু । দুই দিন পর আমরা সবই ভুলে যাব, পর্দায় হাজির হবে
অন্য এক সাহেদ ।
মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম
ওয়ারাবি,সাইতামা,জাপান।
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|