[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ (পর্ব-১১)

  

- শাশ্বত স্বপন -

 

স্বার্থ ছাড়া পৃথিবীর কোন কাজ হয় না। এই যে, মা-বাবা-সন্তান--এখানেও স্বার্থ আছে। একজন নারী মা হওয়ার জন্য সন্তান গর্ভে ধারণ করে। তারপর সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে লালন-পালন করে। আবহমান কাল ধরে পৃথিবীতে এ প্রথা চলে আসছে। সমাজে নারী সন্তানহীন হলে, তার কোন মূল্য নেই। বৈয়াকরণবিদরা ব্যাকরণে সন্তান না হলে, নারীকে বিশেষিত করেছেন বন্ধ্যারূপে। সন্তান জন্ম হয়ে মারা গেলে (অর্থাৎ যে নারীর সন্তান বাঁচে না) বিশেষিত করেছেন মৃতবৎসারূপে। আর, একটি মাত্র সন্তান হওয়ার পর জীবনে যদি আর কোন সন্তান না হয় তবে সেই নারীকে বিশেষিত করেছে কাকবন্ধ্যারূপে। পুরুষের কারণে সন্তান না হলে বা পুরুষের সন্তান না থাকলে কি বিশেষণ আছে--তা আমার জানা নেই। তবে সন্তান জন্মের ব্যাপারে পুরুষ অক্ষম হলে, সে সমাজের চোখে হাস্যকর কোন বস্তুরূপে বিবেচিত হয়। অতএব, মা-বাবার স্বার্থ পুত্র-কন্যার উপস্থিতি, তাদের সুপ্ত ভালোবাসা ঢেলে দেওয়া। তারপর বার্ধক্যে সেবা-যতেœর স্বার্থ থাকে। জন্মের পর শিশুর স্বার্থ মা-বাবার সন্তান বাৎসল্যতা। যে স্বার্থ ছাড়া সে বাঁচতে পারে না। সন্তানহীন নারী পারে না, পূর্ণাঙ্গ নারীরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। পুরুষ পারে না, নিজেকে পুরুষ ভাবতে। অতএব, জন্মে স্বার্থ--জন্মান্তে স্বার্থ। স্বার্থ ছাড়া পৃথিবী অচল, মানুষ অচল। আমি এই মহা মূল্যবান স্বার্থকে উদারনীতিতে ভাবব কেন? আমার স্বার্থও আমি দেখব, দশজনে যেমন দেখে। ক্ষমতার জন্য যেখানে নেতা-নেত্রীরা মানুষকে মানুষ ভাবে না। যেখানে তারা মানুষকে ভাবে উপরে উঠার সিঁড়ি। যাদের উপর ভর করে ক্ষমতায় যাওয়া--তাদের জীবন নিয়ে তারা করে ছিনিমিনি খেলা। আমি কারো জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলিনি। বরং আমাকে নিয়েই অনেকে খেলেছে। রাষ্ট্রও আমাকে তথা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আমি একটা মেন্টাল পেসেন্টকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনব। ভালোবেসে তার হৃদয় জয় করব। ভালোবাসায় স্বার্থ থাকুক তাও ভাল; তবুও সন্ত্রাস ভাল না--দুর্নীতি ভাল নয়--কালোবাজারী ভাল নয়।

রাত এগারটা বেজে গেছে। ইত্তেফাকের মোড় থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত হাঁটলাম। তারপর ভাবতে ভাবতে মেসে আসতে লাগলাম। রুমে এসে চিন্তা করতে পারব না। সেলিমের বকবকানি আর টেপের গান--দু’টাই চিন্তা কেড়ে নেবে। সেলিম একটা মেয়েকে ভালোবাসে। আগে মেয়েটি তাকে মোটেও ভালোবাসতো না। এখন ভালোবাসে। তার বিশ্বাস, সে ফকির-টকিরের মাধ্যমে মেয়েটির মন জয় করেছে। আমার এসবে বিশ্বাস নেই। আমি তার কথায় শুধু সায় দিয়ে গেছি। ঢাকাতে এক বিখ্যাত রাজনীতিবিদের মেয়ের সাথে তার পরিচয় আছে। দু’জনে গান শিখত কোন এক সংগঠনে। মেয়েটির বাবা মন্ত্রী হবার পর এখন তাদের সাথে শুধু টেলিফোনে যোগাযোগ। তার কথাবার্তায় বুঝা যেত মেয়েটির সাথে তার ভাল টার্ম ছিল। কারণ দু’জনেই বস্তুবাদী ছিল। এই মেয়ের সাহায্যেই সে চাকুরি পেয়েছে। চাকুরি পাবার তিন-চার মাস পরে সে হঠাৎ একদিন বলল, এই মেসে সে থাকবে না। একটা হাইফাই ফ্লাট ভাড়া নেবে। গ্রামের সেই বিশ্ব সুন্দরীকে সে ফ্লাট দেখাবে। বিশ্ব সুন্দরী এই কারণেই বললাম, তার কাছে সেই মেয়ে নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সুন্দরী মনে হয়। আমি অবশ্য প্রশ্ন করেছিলাম,
-- মন্ত্রীর মেয়ের চেয়ে সুন্দরী?
-- না, তা নয়।
-- তবে বিশ্ব সুন্দরী হলো কি করে?
-- তা তুই বুঝবি না।
-- এই মেয়ে ছেড়ে মন্ত্রীর মেয়েকে ধর।
-- বলিস কি, এটা সম্ভব?
-- কেন তোরা দু’জনেই তো বস্তুবাদী।
-- বস্তুবাদী হলেই হল? এটা সম্ভব নয়।
-- তাহলে শিউলী কি করে সম্ভব হল?
-- বাদ দে, তুই যখন তাবিজ-কবজ বিশ্বাস করতে চাস না--করিস না।
-- না করি তো, তোর তাবিজ-কবজ দিয়ে আমাকে একটা চাকুরি দে না।
-- চাকুরি-বাকুরি তাবিজ-কবজ দিয়ে হয় না।
-- শুধু ভালোবাসা হয়?
-- হ্যাঁ।

তাঁর সাথে যখন রুমে উঠি তখন সে নিজেকে নাস্তিক বলে বেশ জ্ঞানী ভাব দেখাত। অবশ্য সব নাস্তিকরাই নিজেদেরকে জ্ঞানী ভাবে। ভাবে, সে যা বুঝে যা সে বিশ্বাস করে--সেটাই সত্য--সেটাই সঠিক। ব্যাঙ যেমন কুয়াকে পৃথিবী ভাবে--তারাও তেমনি। তখন শিউলী সেলিমকে ভালোবাসত না। যেই না মেয়েটি তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে, তখনি সে সিগারেটসহ সকল ধূমপান ছেড়ে দিল। আধূনিক-এর সদস্য হল। কারণ শিউলী তাকে এসব খেতে নিষেধ করেছে। অথচ এক সময় সৃষ্টি আর সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে এমন সব নাস্তিকবাদী কথা বলত--যা শুনলে কট্টর নাস্তিকও হাসত। আর আজ মসজিদ আর জায়নামাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠে। আমি অবশ্য তেমন কিছু মনে করিনি। এরকম বহু নাস্তিক দেখেছি, শুনেছি--যারা যৌবনে কিংবা কৈশোরে বেশ গলাবাজি করে কিন্তু বার্ধক্যে কোরান, গীতা আঁকড়ে ধরে কাঁদে। জায়নামাজ, গীতার পাতায় চোখের জল ফেলে। সেলিমের বেলায় অবশ্য একটু অবাক লেগেছিল। এত তাড়াতাড়ি সে মসজিদে ফিরে আসবে, ভাবিনি। আমি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম--
-- কি রে তুই না নাস্তিক?
-- তাতে কি? নামাজ পড়তে অসুবিধা নেই। মুসলমান হয়ে জন্ম নিয়েছি তো।
-- মুসলমান হয়ে জন্ম নেওনি, মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েছ।
-- ঐ একই কথা।
-- নাস্তিকের কোন ধর্ম নেই। নাস্তিকরা তো নামাজ পড়ে না।
-- বাদ দে ওসব। এমন অনেকেই বলে। বার্ধক্যে এরাই বেশি নামাজ পড়ে।
-- তুই তো এখনও বার্ধক্যে আসিসনি।
-- হতে আর কয়দিন। যে কোন মুহূর্তে মরে যেতে পারি।
-- বলিস কি! তাহলে তোর শিউলী?
-- ঠাট্টা রাখ, ভালোবাসার তুই কিছু বুঝিস না। ভালোবাসিসনি তো?
--আমার চেয়ে বেশি ভালো কে বাসতে পারে? তুই জানিস না সেলিম, আমি কি রকম ভালোবাসতে পারি।
--রকম ভালোবাসা বুকে নিয়ে আজো বেঁচে আছি। সে আমি জানি--আর জানে প্রেম-স্রষ্টা।
-- তুই কি আমার কথায় দুঃখ পেয়েছিস? আরে আমার কথা আর পাগলের কথার মধ্যে কোন পার্থক্য আছে?
রোজার মাসে সে এমন সংযমী হল--যা চিন্তাও করা যায় না। তিরিশটা রোজা নিখুঁতভাবে রাখল। দান-খয়রাত, নামাজ-রোজা, তপজী জপা--যেভাবে চলল তাতে আমার মনে হল--‘উনি বোধহয় পৃথিবীতে আর থাকবেন না’। এক মাস সে কোন গান গাইলও না, কোন গান শুনল না। তার বড় সখ হল, সে হজ্জ্ব করবে। তার নামের আগে আলহাজ্ব শব্দটা থাকবে। তার নাম হবে আলহাজ্ব মোঃ সেলিম সিকদার। অবশ্য টাকার অভাবে তার আশা দীর্ঘনিঃশ্বাস হয়ে রইল।

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ