[প্রথমপাতা] |
হেমন্তের লোকায়ত মিথ
-শাশ্বত স্বপন-
‘ভাইয়ের কপালে দিলাম
ফোঁটা--যমের দূয়ারে পড়ল
কাঁটা, যমুনা দেয় যমকে
ফোঁটা--আমি দিলাম ভাইকে
ফোঁটা।--ভাইয়ের কপালে বোন
এই ছন্দ বা মন্ত্র পাঠ করে
চন্দন, ঘি, মধু দিয়ে ফোঁটা
দেয়; ভাই যেন বিপদ মুক্ত
থাকে। ভাইও বোনকে সামর্থ্য
অনুযায়ী কিছু দিয়ে আশির্বাদ
করে।’--কবে যে এই ভাই ফোঁটা
উৎসব শুরু হয়েছে--তা কেউ
বলতে পারে না। বলা হয়ে থাকে,
এটা অনার্যদের আচার
অনুষ্ঠান; কেউ বলে, অনার্য
নারী-পুরুষ উভয়েই জঙ্গলে
শিকারে যেত, চাষবাস করত আর
আর্যদের মধ্যে সাধারনত
পুরুষরা যুদ্ধ করত বা শিকারে
যেত, তাই বোনরা ভাইদের বিপদ
মুক্তির জন্য এই অনুষ্ঠান
করত, তাই এটা অনার্যদের চেয়ে
আর্যদের আচার অনুষ্ঠান বলাই
যুক্তিযুক্ত। তবে সব অনার্য
নৃগোষ্ঠির মধ্যে
মাতৃতান্ত্রিক ধারা ছিল না,
কোন কোন গোষ্ঠীর মধ্যে
পিতৃতান্ত্রিক ধারাও ছিল।
অনার্যদের কোন কোন জাতির
পুরুষেরা শিকারে বা যুদ্ধে
যেত। তাই তাদের বোনেরাও হয়তো
ভাই ফোঁটা প্রথম শুরু করে
থাকতে পারে।
আর্যরা এই অঙ্গ,বঙ্গ,
কলিঙ্গ, সমতট, রাঢ় দখল করার
পর আর্য-অনার্য মিশ্রণের ফলে
লোকায়ত পূজা-অর্চণা এবং
সাংস্কৃতিক ধারায়ও মিশ্রণ
ঘটে। পিতৃতান্ত্রিক আর্য
সমাজে ধর্মীয় প্রথায় পুরুষ
পুরোহিত প্রাধান্য পেলেও
মাতৃতান্ত্রিক অনার্য সমাজে
নারী পুরোহিতের প্রাধান্য
ছিল। যদিও ধীরে ধীরে নারী
পৌরোহিত্যের প্রভাব কমতে
কমতে এখন গৃহের ছোট ছোট পূজা
অর্চনায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
আদিকাল থেকেই অনুকূল আবহাওয়া
এবং নানা রকমের শস্য
উৎপাদনের মাসগুলোতেই
বাঙ্গালীর নানা আনন্দ উৎসব
হয়ে আসছে। প্রাচীনকাল থেকে
অগ্রহায়ণ মাসেই সবেেচয়ে বেশী
ফসল উৎপাদন হয়, মানুষের মন
থাকে উৎফুল্ল, ঘরে ঘরে
আনন্দ বয়ে যায়। আর তাই হয়তো
সম্রাট আকবর এই মাসকেই
বছরের প্রথম মাস বা খাজনা
তোলার মাস ঘোষণা দিয়েছিলেন।
আমার গ্রাম্য বেলার জীবনে
আমি দেখেছি হেমন্তের ফসল
আঁকা মেঠো পথ ধরে কত আনন্দ
উৎসবের ধারা বয়ে যেত।
কার্তিকে শুরু হত নতুন
ফসলের উৎসবের প্রস্তুতি
পর্ব। কার্তিকের শেষ দিন
কার্তিক পূজা, বুড়া-বুড়ীর
পূজা, সন্তোসী মায়ের পুজা
দিয়ে মাস শেষ হতেই
অগ্রহায়ণের প্রতি রবিবার হতে
শুরু হত খেতের বত্ত ;
শনিবার থাকত শনিপুজা, তারপর
ভাই ফোঁটা উৎসব, গোবাচ্চার
জন্য গোরক্ষনাথের পূজা--সারা
মাসই দেব-দেবতাকে খূশী করতে
নতুন নতুন শস্যের নানা
উপাদেয় খাবার তৈরী হত।
কার্তিক দেবতার মত বীর
যোদ্ধা, সুন্দর অবয়বের বর
পাবার আশায় কার্তিক মাসের
শেষ দিন সনাতন নারীরা
কার্তিক পূজার আয়োজন করে।
নতুন বিবাহিত অনেক নারীর
নতুন বর দেখলে আমরা যেমন বলে
উঠি, মেয়েটি কার্তিকের মত
বর পেয়েছে। ব্রাক্ষণ
বালকদের মস্তক মুন্ডু করে,
কানে ছুঁচ ফুটো করে
হেমন্ত-অগ্রহায়ণ মাসেই
উপনয়ন বেশী হত। উপনয়নের পর
থেকে বালকরা ব্রাক্ষণ হতেন।
যদিও সরকারী পঞ্জিকা আর
সনাতন পঞ্জিকার দিন তারিখ
এক রকম হয় না। কোথাও কোথাও
সরকারী পঞ্জিকা অনুযারী,
কোথাও সনাতন পঞ্জিকা অনুযায়ী
উৎসব হয়। তিথি-নক্ষত্রের
শুভক্ষণ অনুযায়ী পূজার দিন
স্থির করা হয়। তাই সরকারী
ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দেখা
যায় আশ্মিনের দূর্গাপূজা হয়
কার্তিকে, কার্তিকের
কার্তিক পূজা হয় অগ্রহায়ণে।
আসলে তিথি-নক্ষত্র অনুযায়ী,
সনাতন হিন্দুরা দূর্গা
পূজার ঘট (মহালয়া) আশ্বিনেই
বেদীতে বসায়, কার্তিক পূজার
ঘট কার্তিক মাসেই বেদীতে
বসায়।
খেতের বত্ত এক এক অঞ্চলের
এক এক জাতি গোত্রের মধ্যে
ভিন্নতা দেখা যায়। অগ্রহায়ণ
মাসের প্রতি রবিবার সন্ধার
পর নতুন চাল দিয়ে ছোট ছোট
পিঠা (লবণযুক্ত ও লবণছাড়া),
ধান-দূর্বা, তুলসীপত্র,
কর্পূর, চালকলার নৈবেদ্য,
ধূপধূয়া দিয়ে উঠোনে পুজা হত।
উঠোনের মাঝখানে ছোট্ট গর্ত
(আয়তাকার পুকুর আকৃতির) করা
হত। খেত দেবতার কিচ্ছা
শুনানো হত। পাড়ার সব
ছেলেমেয়েরা উঠোনে ছোট্ট
পুকুরের চারপাশে বসে মা,
কাকীমা, ঠাকুমার মুখে কিচ্ছা
শুনত। পিনপতন নিরবতার মধ্যে
ছোট ছোট বাচ্চারা গল্পের
রাজ্যে ঘুমিয়ে যেত। আমাদেরকে
বলা হত, খুব ভোরে উঠে যে
পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া পিঠা
খাবে, বিশেষ করে প্রথমে যে
লবণযুক্ত পিঠা খেতে পারবে,
সৌভাগ্যবান হিসাবে দেবতা
তার প্রতি অধিক সন্তুষ্ট হবে।
তার গোলা ফসলে ভরে যাবে,
তার ঘরে ভাল গৃহস্ত, লক্ষ্মী
বউ আসবে। খেতের দেবতাকে খুশী
রাখতে অনার্য নৃগোষ্ঠি সেই
কবে খেতের বত্ত শুরু করেছিল,
আজও তার মিথ স্রোত বয়ে চলেছে
এই মিশ্র জাতির মধ্যে।
বাস্তপূজা শীতকালে হলেও
কোথাও কোথাও পুরোহিতের
পরামর্শ নিয়ে, বিশেষ করে
আমাদের বিক্রমপুর এলাকায়
কার্তিক-অগ্রহায়ণেও
বাস্তুপূজা হত। বিল থেকে
হিজল গাছের কচি ডাল এনে,
যেখানে ঘর তৈরী হবে সেখানে
মাটির তৈরী বেদীর উপর পুঁতে
দেওয়া হত। এটিই
বাস্তুদেবতার প্রতীক। চাল,
গুড় ও দুধ দিয়ে তৈরী পায়েস
পুরোহিতের সাহায্যে
কলাপাতায় এমনভাবে ঢেলে হিজল
গাছের ডালের কাছে রেখে দেওযা
হত--যাতে পায়েস গড়িয়ে মাটিতে
পড়ে, মাটিতে শোষিত হলেই ধরা
হত দেবতা ভোগ গ্রহণ করেছেন।
এবার ঘর তৈরীতে বাঁধা নেই।
পুরোহিত থেকে আমরা জেনেছি,
এই পূজা না করে ঘর বানালে,
সংসারে অশান্তি হবে, ঘর
কালবৈখাখী ঝড়ে গৃহস্তের উপর
ভেঙ্গে পড়বে।
গাভীর বাচ্চার বয়স একুশ দিন
হলে গাভীর দুধ দিয়ে নাড়–
তৈরী করে গোরক্ষনাথ দেবতার
উদ্দেশ্যে ভোগ দিয়ে সবাই
সমস্বরে বলত, গোরখার নাড়ু,
হেউচ্চ...। পূজার পর থেকে
গৃহস্তরা গাভীর দুধ খেত। এই
পূজা করলে গাভী প্রচুর দুধ
দেবে, প্রতি বছর সুস্থ্য
বাচ্চা জন্ম দেবে। এই পূজার
দিবস নানা গোত্রের সনাতন
গৃহস্তরা গাভীর বাচ্চা
জন্মের ৭/১৪/২১/২৮ এর মধ্যে
রাখেনি, নিয়মের পরিবর্তন
এমন হয়েছে যে, সামান্য
নিয়মাদি পালন করে প্রথম দিন
থেকেই গৃহস্তরা গাভীর
বাচ্চার সাথে নিজেরাও দুধ
খেত, হেমন্তকালের
কার্তিক-অগ্রহায়ণে অথবা
নিজেদের ভাল সময়ে গোরক্ষনাথ
পূজার অনুষ্ঠান করত।
পরিবর্তনের যুগে এই পূজা
এখন বিলুপ্তির পথে।
রাখীবন্ধন, মনসাপূজা,
দূর্গাপূজা, লক্ষ্মী পূজা,
কার্তিক পূজা, কালীপূজা,
দীপাবলী পূজা, অমাবস্যার ১ম
বা ২য় তিথিতে দুই রংয়ের
মুখওয়ালা হরিপরমেশ্বর পূজা,
পূর্ণিমাতে রাধা কৃঞ্চের
জন্য কীর্তন সহকারে রাসলীলা
পূজা, বনের অধিবাসীর জন্য
বনদেবীর পূজা--নানা
পূজা-অর্চণার মাধ্যমে
বিপদ-আপদ-মঙ্গল কামনায়
শরৎ-হেমন্তের গ্রাম্য
বাংলার শাশ্বত সাংস্কৃতিক
রূপের সাথে অগ্রহায়ণ-পৌষ
মাসে যোগ হয় নানান পাগলের
মেলা, পীর-মুর্শীদের ওরস,
ওয়াজ মাহফিল। এ সময়ে ফসলে
ফসলে ছড়িয়ে থাকে
মাঠ-ঘাট-পথ-আঙ্গিনা-ঘর-গোয়াল।
মানুষের দ্বারে দ্বারে
ভাগ্যলক্ষ্মী
কার্তিক-অগ্রহায়ণের কাঁধে
চড়ে ঘুরে বেড়ায়, মাঠ-ঘাট
শস্য শ্যামলায় ভরে দেয়। আর
তাইতো, সনাতন জাতি, উপজাতি
ও অন্যান্য ধর্ম জাতির মধ্যে
অসীম রহস্যের প্রতি
কৃতজ্ঞতায় নিজেদের তৈরী
বিশ্বাসের মিথগুলোকে গড়ে
তোলে নিজেদের মতো করে,
পরিবর্তনও করে নিজেদের
সুবিধা মতো।
হেমন্তের নবান্ন উৎসবে নতুন
ধানের চালের গুড়ি আর গুড়
দিয়ে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে
তৈরী হয় নানা রকমের
পিঠা,পায়েস। মাটির সরাতে,
বেতের থালে, কলাপাতায় অথবা
পিতলের প্লেটে সাজানো থাকে
গ্রাম বাংলার বাহারি রকমের
পিঠা--পাকান পিঠা, ভাপা পিঠা,
কুসলি পিঠা, চিতই পিঠা,
পাটিসাপটা পিঠা, নকসা পিঠা,
পাতা পিঠা, জামাই পিঠা, কাটা
পিঠা, চুটকি পিঠা, মুঠা পিঠা,
চ্যাপা পিঠা, জামদানী পিঠা,
হাঁড়ি পিঠা, ঝুড়ি পিঠা,
ফুলঝুরি পিঠা, বিবিখানা পিঠা,
মাছ পিঠা, হৃদয় পিঠা, গোলাপ
ফুল পিঠা, পেঁচানো পিঠা,
ফুল পিঠা, শাহী বিবিখানা
পিঠা ইত্যাদি আরো অসংখ্য
নামের নানা রকমের পিঠা। মা,
বোন, বউদের পিঠাশৈলী আর
রাত-দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম
সকলের স্বাদ, তৃপ্তি আর
স্বস্তির মধ্যদিয়ে পিঠা
শিল্পের পরিশ্রম সার্থক হয়।
জামাইয়ের সাথে শালা-শালী,
বিয়াইয়ের সাথে বিয়াইনরা মেতে
উঠে গ্রাম-বাংলার মুখে মুখে
প্রচলিত ‘ধাঁধা মিলাও--পিঠা
খাও’ উৎসবে। এসব পিঠা নিয়েও
গ্রাম বাংলায় আছে নানা
রকমের মুখরোচক মিথ। অকল্যাণ
থেকে রক্ষার জন্য সনাতন
হিন্দুরা দেবতা সূর্যকে,
কোথাও গরু দেবতাকে আগে পিঠা
দিয়ে, মেয়ের জামাইকে (দেবতা
রুপে) কলাপাতায় বা বেতের
থালাতে পিঠা পরিবেশন করত।
বউ-জামাইয়ের আলাদা থালার
সাথে পাড়ার সবাই একসাথে পিঠা
খেতে বসত। তবে আর্যধারা (সনাতন
হিন্দু ?) মতে, আগে
জামাইয়ের খাওয়া শেষ হবার পর
বউঝিরা খেতে বসত।
একান্নবর্তী পরিবার প্রথায়
মানুষের বন্ধন এক সময় দৃঢ়
ছিল। উৎসব মুখর সমাজে সবাইকে
সবার প্রয়োজন হত। মানুষে
মানুষে সম্পর্ক ছিল সহজ-সরল।
ভাইয়ে-ভাইয়ে, বোনে-বোনে
সম্পর্ক ছিল আত্মার বন্ধনে।
আজ, এখন সে সম্পর্কগুলো
শিথিল হয়ে যাচ্ছে। অন্য
ধর্মের কথা না হয় বাদই
দিলাম, সনাতন হিন্দু
জাতিরাই জানে না হাজার
বছরের শক্ত বন্ধনের এই ছোট
ছোট উৎসবের কথা--যা মিথ হোক
আর গল্প-কাহিনী হোক,
মানুষের শাশ্বত প্রেম-প্রীতি
ভালোবাসাকে বিনা সূতার
মালায় হাজার হাজার বছর ধরে
বেঁধে রেখেছিল--যা এখন
শিথিল হয়ে হিংসা-বিদ্বেষের
রুপ ধারণ করেছে।
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
>>হেমন্তের
রাজদরবারে শীতরাজের আগমণ বার্তা অথবা শীতরাজের হেমন্তরাজ্য দখলের আগাম
হুংকার!
>>কোরবানী ঈদের সময়ের সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখা গল্পঃ
আলোকিত অন্ধকারের জনপথ
>>দূর্গা পূজার ইতিহাস
>>রোহিঙ্গা
সমস্যা এবং রামু সহিংসতা..../কেন ঘটল রামুর ঘটনা...?
|