[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ (পর্ব-৯)

  

- শাশ্বত স্বপন -

 

এত সহায়-সম্পত্তি অথচ শান্তি নাই। স্রষ্টা এখানে স্বর্গ দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু শান্তি দেন নাই। তার বিচার বুঝা খুবই কষ্ট! কেন যে তিনি মানুষ নামের এই পুতুলকে নিয়ে খেলেন--বুঝি না। আমি বুঝি না--বুঝতেও চাই না। আমি বুঝি মানুষকে এ পৃথিবীতে বাঁচার মত বাঁচতে হলে, আগে পায়ের নিচে মাটি, তারপর টাকা-পয়সা, স্ত্রী-পুত্র--এরপর ক্রমান্বয়ে প্রাসংগিক যা প্রয়োজন হয়। ন্যান্সি তার বিছানা নিজ হাতে ঠিক করল। মাঝখানে কোল বালিশটা দিয়ে আমাকে একপার্শ্বে শুতে বলল। ও অন্য পাশে শুবে। একই বিছানায়! এবার আমি ঢোক গিলতে শুরু করলাম। যদি শোয়া অবস্থায় জড়িয়ে ধরে আর সেই মুহূর্তে মিসেস নজরুল বা বুয়া এসে হাজির হয় তবে--। কি লজ্জা! না, না শোয়া যাবে না। আমি মাথা ব্যথার একটিং শুরু করলাম।
-- কি হয়েছে? মাথা ব্যথা?
-- হ্যাঁ, খুব, তুমি ঘুমাও--আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।
-- আমার ঔষধ আছে, দাঁড়াও এনে দিচ্ছি।

ছোট বালিকার মত কথাবার্তা। কে বলবে, এর বয়স উনিশ। কিশোরী অবস্থায় মেন্টাল পেসেন্ট হওয়াতে সেই স্বভাবই রয়ে গেছে। হঠাৎ ডাক্তার এসে হাজির। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সে এসেও একটিং শুরু করল। ন্যান্সির কাছে মাথা ব্যথা শুনে সে আমাকে মিছিমিছি একটা ইনজেকশন দিল। সেই সুযোগে ন্যান্সিও ইচ্ছে করে ইনজেকশন নিল। ডাক্তার আমাকে ওর সাথে ঘুমের ভান করতে বলল। ও একটু পরেই নাকি ঘুমিয়ে যাবে। লজ্জা আর ব্যক্তিত্বের কাছে হার মেনে, আমি তাই করলাম। ভেবে নিলাম, এটা জীবনের কোন এক রঙ্গমঞ্চে অভিনয়। নাটকের অভিনয় থেকে এটা অবশ্য বাস্তব ধর্মী এবং অনেক বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া যাবে। ন্যান্সিকে বিছানায় শুইয়ে মাথায় হাত বুলালাম। আগামীকাল কোথায় কোথায় ঘুরতে যাব--তা নিয়ে গল্প করলাম। তার একটা হাত আমার একটা হাত ধরে আছে। সে কথা শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমিয়ে গেল। আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে পড়লাম। এক দৃষ্টিতে ন্যান্সির দিকে তাকালাম। বড় মায়া লাগল। মনে হল, বন্ধন বোধহয় এতক্ষণে বেঁধে গেছে। হঠাৎ মন বলে উঠল, ঘুমাও ন্যান্সি ঘুমাও--আমি আসব--অবশ্যই কাল আসব। তোমাকে আমি ভাল করবই। যে বিষাক্ত স্মৃতিগত জ্বালায় আমি জ্বলছি, তা তোমার কাছে আসলে যদি প্রশমিত হয়--তবে আমি অবশ্যই আসব। তোমার মাঝে যদি আমার সমস্ত প্রেম-ভালোবাসা খুঁজে পাই--তবে অবশ্যই তোমার কাছে আসব। ন্যান্সি ঘুমিয়ে আছে। আমার দিকে কাত হয়ে শুয়েছিল। সেভাবেই আছে। কি সুন্দর চেহারা! পেসেন্ট হবার আগে না জানি কত সুন্দর ছিল। তার মুখের উপর আল্পনার স্মৃতি-ছায়া ফেললাম...। চোখ আর্দ্র হয়ে এলো। ডাক্তার পিছন থেকে ডাকলেন। তার সাথে চললাম খাবার টেবিলে। উনি খেতে বসলেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম তার পাশে। দেহে-মনে ক্লান্তি অনুভব করলাম।
-- আমি আসি।
-- এক্ষুণি যাবে? ও হ্যাঁ, অনেক রাত হয়ে গেছে।
মনে মনে ভাবলাম, জন্ম আমাদের অন্ধকারে। অন্ধকারের সরু ভয়ঙ্কর পথ ধরেই আমাদের যাতায়াত। রাত আর দিন--দু’টাই আমাদের কাছে সমান। ডাক্তার মিসেস নজরুলকে ইশারা করতেই সে আমাকে তার হাতের ডায়েরীটা দিল। ডাক্তার খাবার রেখে আমাকে বলল,
-- তুমি কি মনস্থির করেছ?
-- না-হ্যাঁ এর মাঝামাঝি আছি। ভেবে দেখি, আজ রাতটা।
-- ডায়েরীটা তুমি পড়বে। ন্যান্সি আর ফ্রান্সিস--ওদের সম্পর্কের সব জানতে পারবে। ডায়েরীর ভিতরে ছয় পৃষ্ঠার একটা নিবন্ধ দেওয়া আছে। এখান থেকে ওর জন্ম ও তার পরবর্তী সময় সম্পর্কে বুঝতে পারবে।
গম্ভীর হয়ে রইলাম। উনি আরো কিছু কথা বললেন। যা আমার মাথায় ঢুকল না কানের ভিতর ঢুকল বুঝলাম না। বিদায় নিলাম। মিসেস নজরুল হাসি মুখে আমাকে নিয়ে নিচে নামলেন। ড্রাইভারকে ডাকলেন। গ্যারেজ থেকে নতুন মডেলের একটা গাড়ি বের হল। গাড়িতে উঠতে বলল। একটা বক্স আমার হাতে দিলেন তিনি। ‘এটা রাখ। বাবা, আমি জানি তুমি পারবে। আজকের ঘটনা দেখে ও শুনে আমি বিশ্বাস করি ও ভাল হবে। ও তোমার মাঝে ফ্রান্সিসকে দেখেছে।’ আমি কিছুই বললাম না। শুধু মনে মনে অনুচ্চারিত কিছু কথা হৃদয় থেকে কর্ণকুহরে সঞ্চালিত হল। মিসেস চৌধুরী, আপনি জানেন না, আমার বাবা একজন পরাজিত সৈনিক, আমি একজন পরাজিত সৈনিক। আমার নিজের প্রতি যেখানে সামান্য বিশ্বাস নেই, সেখানে আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা কি করে দেব? আরশোলা হয়ে যদি ঢুকি, তবে বাঘ হয়ে বের হব। সময়ের কাছে পরাজিত হয়ে আজ আমি হয়ে উঠেছি অর্থলোভী, হিংসুটে। প্রতিটি মানুষ সুখী হতে চায় কিংবা চেষ্টা করে। আমি চাই--চাই একটা পছন্দসই মন, সম্পত্তি, প্রতিপত্তি, সম্মান--সর্বোপরি আজকের যুগে যারা অমানুষ হয়েও মানুষ হিসেবে সম্মানিত, পূজনীয় তাদের মতো একজন মানুষ হতে চাই। আমি মহৎ হতে চাই না। আর মহৎ ব্যক্তি হওয়া কোনদিনই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার এমন মেধা নেই যে, যা দিয়ে কিছু করব। টাকা নেই, সম্মান নেই, পেটে অন্ন তথা পায়ের নিচে মাটিই নেই। চোখ বুঁজে এখন পারি, বড় কোন রাস্তায় ট্রাকের আশায় শুয়ে থাকতে। জানি, এটা মহাপাপ, কাপুরুষতা। কিন্তু আত্মহত্যা করাও তো কম সাহসের কথা নয়। আমার জীবনের দুঃখ স্মৃতির একশত ভাগের দশ ভাগ যদি স্মরণ করি তখনি আমার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। সামনের জীবনের দিকে তাকিয়ে তখন শুধু পানি আর পানি দেখি--মাটি নাই--আশা নাই। পরজীবীর মতো ঘৃণা সইতে সইতে চাচার বাসায় কতটা বছর ছিলাম। তিক্ততায় মুখ ভরে আসে। দেড় কোটি বেকারের এদেশে, চার-পাঁচ বছরের শিশু শ্রমিকের এদেশে, ভাওতাবাজি রাজনীতির এদেশে, ইতিহাস বিকৃতির এদেশে, হা-ভাতের এদেশে, দুর্নীতির এদেশে--এখন শুধু পারি, ধনী কোন ব্যক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করতে। প্রতিদিনের আত্মপ্রচার করা ভণ্ড মিছিলের সম্মুখে থেকে বোমার আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারি। তাতে পত্রিকার পাতা ভরবে দলের সদস্যরা আরো হৈ চৈ বাঁধাতে পারবে। সুযোগ সন্ধানী নেতা তথা তার দল আমার মৃত লাশ আর রক্তের উপর সিঁড়ি বানিয়ে ক্রমাগত উঠতে থাকবে তার তথা তাদের কাঙিক্ষত লক্ষ্যে। একটি লাশ নিয়ে হয়তো দুই-তিনটি দল করবে টানাটানি। কেউ আমার মাথা নেবে, কেউ পা নেবে, কেউ হাত নেবে। আর যে দল পাবে না--তারা আমার ছবি দিয়ে তাদের খায়েস মিটাবে। এভাবে আবহমানকাল ধরে যা চলছে তাই চলবে। এর কোন বিরাম নেই। আমি এভাবে মরব না। আর যদি মরি, তবে আমাদের ঐ শিশু শ্রমিক, কুলি-মজুর, রিকসাওয়ালা, বেকারদের নিয়ে যারা ব্যবসা করে তাদের একটাকে অন্তত: শেষ করব। আর যদি বাঁচি, তবে বাঘের মত বাঁচব। জনারণ্যেই হাঁটব, যদি কেউ বাঘ বলে গুলী করে--মরব। তবুও বাঁচার মতো দু’দিনই বাঁচব। রাজধানী দখল করলে যেমন পুরো দেশই দখল হয়; আমি তেমনি এ বাড়ির রাজধানী দখল করব।

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ