[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ (পর্ব-৮)

  

- শাশ্বত স্বপন -

 

রাজকীয় খাবারের প্রথমে পোলাও এর সাথে রোস্ট। এটা অবশ্য বিয়ে বাড়িতে অনেক খেয়েছি। তারপর নাম-না-জানা এমন কিছু খাবার খেলাম--যা জীবনেও খাইনি। মুখে দেওয়া মাত্র গলে গেল। সাথে সাথে পাকস্থলীতে চলে গেল। আহা! শরীরে কি শিহরণ! স্বর্গে এর চেয়ে ভাল, এর চেয়ে স্বাদের খাবার আছে। এখানেই মুখ গহ্বর, চোখ, জিহ্বার আর পাকস্থলীর পরাজয় দেখে আমি দেহ সর্বস্ব লজ্জা পাচ্ছি আর ওখানে...।

কাজের বুয়া মিসেস চৌধুরীকে জানাল ন্যান্সি খুবই পাগলামী শুরু করেছে। চেয়ার-টেবিল উল্টে ফেলেছে। যে আয়না দিয়ে সে কিছুক্ষণ আগে সাজ-গোজ করে মুখ দেখেছে, সে আয়না ভাঙ্গতে গিয়ে হাত কেঁটে ফেলেছে। ডাক্তার ও মিঃ চৌধুরী কিছুক্ষণ আগে কি কাজে যেন বাইরে গেছে। মিসেস চৌধুরী এতক্ষণ আমাকে অতি য সহকারে আপ্যায়ন করছিল। তিনি দৌঁড়ে ন্যান্সির রুমে চলে গেলেন। আমি ন্যান্সির চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। কেউ তাকে স্থির করতে পারছে না। মিসেস নজরুল ক্লান্ত হয়ে কিছুক্ষণ পরে ফিরলেন। আমি প্লেটে দেওয়া পুরো খাবার না খেয়েই হাত ধুয়ে ফেলেছি। তিনি আমার সামনে এসে কিছু বলেও বললেন না। আমি বুঝতে পারলাম, উনি আমার হেল্প চাচ্ছেন। আমি মিসেস নজরুলের মুখের দিকে তাকিয়ে সোজা ন্যান্সির রুমে চলে গেলাম। তিনিও আমার পিছু পিছু গেলেন। তিনি ন্যান্সির রুমে আগে ঢুকলেন। দেখা গেল চিৎকার আরো বেড়ে গেছে। আমি মিসেস নজরুলের পিছনে ছিলাম। ন্যান্সি দেখতে পায়নি। একটা মোটা বই মায়ের দিকে ছুঁড়ে মারতে আসছে। আমি প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই সে আমাকে দেখে থেমে গেল। আমি তাকিয়ে রইলাম ন্যান্সির দিকে। বইটা হাতেই রয়েছে ছুঁড়ে মারার ভঙ্গীতে। মিসেস নজরুল আমার আমার পিছনে চলে গেলেন। তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। রুমের চারপাশে তাকালাম। এসি করা সত্য, তবে রুম না বলে ইউনিভার্সিটির কোন বিধ্বস্ত হোস্টেল কক্ষ বলা যায়--যেখানে কিছুক্ষন আগে দু’পক্ষের মারামারি হয়ে গেছে। এখানে দামী কোন সরঞ্জাম নেই। বুঝতে পারলাম যুদ্ধে ক্ষতি হবে বলে, হয়তো রাখা হয়নি। চেয়ার-টেবিল উল্টানো। বই, টুকরো পেপার আর কাগজে রুমের ফ্লোর ভরে আছে। টুকরো কাগজের পরিমাণ এত বেশি যে, ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। বুয়া জানাল, কিছুক্ষণ আগে সব গোছ-গাছ ছিল, শুধু কাগজের টুকরো ছাড়া। এগুলো পরিষ্কার করা নিষেধ আছে। তাই পরিষ্কার করা হয়নি। কে নিষেধ করেছে প্রশ্নও করলাম না।

ন্যান্সির দিকে তাকালাম। সে তখনও বই ছুঁড়ে মারার বিশেষ ভঙ্গীতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ডান হাত বেয়ে রক্ত ঝরছে। আমি বুয়াকে ডেটল আনতে বললাম। মায়ের সামনে কিছু করতে লজ্জা লাগছিল। তাই সবাইকে যেতে বললাম। আমি জানি, মিসেস নজরুল ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করবেন। আমি কি করি না করি? বুয়া ডেটল দিয়ে চলে গেল। আমি একটা সাধারণ ঠোঁট কাঁপানো হাসি দিয়ে হাতের বইটা নিলাম। বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে তাকে বিছানায় বসতে বললাম। সে হরিণ চোখা দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার মাথায় হাত রাখলাম। আদর করলাম। সে তাকিয়েই আছে। হয়তো ভাবছে, এরপর কি করি। হয়তো আমার মাঝে ফ্রান্সিসকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি ওর ডান হাত মুখের কাছে নিয়ে এলাম। কাঁটা স্থানে চুমো দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করতেই দেখি, সে হাসছে। ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করে পকেটে

রাখা রুমাল দিয়ে হাত বাঁধলাম। সে হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও হাসছি।
--ক্ষুধা লেগেছে?
-- হু।
-- খাবে?
-- হু।
-- চল--

বা! আমার সাথে হাঁটতে শুরু করল। খাবার টেবিলে গিয়ে দু’জনে বসলাম। ন্যান্সি চেয়ার টেনে আমার পাশে বসল। মিসেস নজরুল হাসছেন। মনে হচ্ছে, তিনি যেন, নতুন কোন আশার বাণী পেলেন। আমার প্লেটের খাবার আবার খেতে শুরু করলাম। সে তার প্লেটের খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিল। আমার মাখা খাবার খেতে চাইল। মনে হচ্ছে, সে যেন একটি শিশু। ভাত মেখে খেতে জানে না। ছোট বেলায় মায়ের কাছে, দাদীর কাছে আমিও এমন বায়না ধরতাম। হাত দিয়ে পর্যন্ত খেতে চাইতাম না। আমাকে মা, দাদীর হাত দিয়ে খাওয়াতে হত। ন্যান্সিও সে রকম বায়না ধরবে নাকি? সর্বনাশ! সেও বায়না ধরেছে। তাকে আমার হাত দিয়ে খাওয়াতে হবে। সে তার হাত দু’টি গুটিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তার পা দিয়ে আমার পা আঘাত করল। আমি বুঝামাত্র আশে পাশে তাকালাম। কোথাও কেউ নেই। মিসেস নজরুল বুঝতে পেরেই কেটে পড়েছেন। উপায়ান্ত না দেখে হাসি মুখে আমার মাথা খাবার তাকে খাওয়াতে লাগলাম। একটা ছোট কামড়ও বসিয়ে দিয়েছে আঙুলে। আমি উঃহু করে উঠতেই সে হাসতে শুরু করল। হঠাৎ কি মনে করে তার মুখ কালো হয়ে গেল। সে তার হাত দিয়ে আমাকে খাওয়াতে চাইল। আমি হাত ধোয়ার জন্য পানি দিলাম। ও হাত ধুয়ে নিল। আমাকে খাওয়াতেই বেশ করে দিলাম এক কামড়। সে তার বাম হাত দিয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে উঃহু করে উঠল। তারপর আর খাওয়াতে চাইল না। তার হাত দিয়ে সে নিজে নিজেই খেতে লাগল। আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। ভাবলাম, এত সুন্দর একটা মেয়ে অথচ মানসিক রোগী। আমার বেশ মায়া লেগে গেল। আমার কারণে সে যদি ভাল হয়, তাহলে অবশ্যই তাকে সাহায্য করা উচিত। এমনিতে বয়সটাও খারাপ, নিজের উপর নিজের তেমন বিশ্বাস নেই। মাঝে মাঝে নিজেকে পাগলও ভাবী। আমি কি পারব তাদের সম্মান রাখতে। অন্তত: চেষ্টা করে দেখি না। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি বলে সে আমার মুখমণ্ডল অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল। শেষের দিকে তাকেও খাওয়ালাম--সেও আমাকে খাওয়ালো। তারপর খাওয়া শেষ করে হাসতে হাসতে তার হাত ধুয়ে দিলাম। পানি পান করালাম। সেও একই কাজ করল। তারপর যা করল তার জন্য আদৌ আমি প্রস্তুত ছিলাম না। কানের কাছে ফিসফিস করে কি যেন বলতে চাইল। আমি কান পাততেই গালে চুমো বসিয়ে দিল। আই ইক্সক্লেইমড্ উইথ জয়।

বুঝলাম, ঘটনাগুলো ঘটত ফ্রান্সিসের সাথে। সে আমাকে তাই ভেবে এই অবস্থায় যা মনে পড়ছে, তাই করছে। আমিও চুমো দিতে চাইলাম। সে লজ্জা পেল। চুমো দিতে দিল না। হাত ধরে তার রুমে নিয়ে গেল। একটা মোড়ানো কাগজ খুলে দেখাল। দু’একটা লাইন ভালোভাবে লেখা, তারপর সব হিজিবিজি--যা বুঝা সম্ভব নয়! চিঠিতে দুইটা লাইন সে লিখেছে। ফ্রান্সিস, ইউ আর বিট্রেয়ার। ইয়েট আই লাভ ইউ...।

মনে হচ্ছে, কোন চিঠি তার মন মত হয় না বলেই সে শত শত চিঠির প্যাড টুকরো করে মুড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে এখানে-সেখানে। কয়েকটা চিঠি দেখাল। প্রত্যেকটা চিঠিতে দু’এক লাইন লিখা, তারপর কাটাকুটি। তবে একটা জিনিস বেশ লক্ষ্য করলাম প্রত্যেকটি চিঠিতে কমন একটা লাইন আছেই, তা হল--‘আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ ভেরী মাচ।’ ফ্রান্সিসকে যে খুব ভালোবাসত--তা বুঝা যায়।

 

( চলবে...)

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ