[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ (পর্ব-৩)

  

- শাশ্বত স্বপন -

 

গোপীবাগের এক ছোট্ট ভাড়া করা বাসায় আমি থাকি, সাথে আরেক জন চাকুরীজীবী বন্ধু থাকে। ছোট ভাইটা ঢাকা কলেজে পড়ে, কলেজ হোষ্টেলেই থাকে। ও নিজে টিউশনি করে। সে টাকায় ওর খরচ চলে না। আমি মাঝে মাঝেই কিছু টাকা ওকে দেই। গাড়ী আমার নির্দেশ মত গোপীবাগের প্রথম লেনে আসতেই থামতে বললাম। সে গাড়ীটা রাস্তার একপাশে থামিয়ে আমার সাথে চলতে শুরু করল ।
- স্যার, বিবি সাব আপনের বাসাটা চিনে যাইতে কইছে।
- ও, আচ্ছা আসুন আমার সাথে।
আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে তাদের প্রয়োজনে ডাকার সম্ভাবনা আছে। আমি কথা না বাড়িয়ে ড্রাইভারকে আমার রুমে নিয়ে আসলাম। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, নজরুল চৌধুরী বিরাট ব্যবসায়ী। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় তার তিনটে অফিস। একটা জাহাজ ও মালামাল সংক্রান্ত ব্যবসা, একটা ট্রাভেলস্ সংক্রান্ত ব্যবসা এবং অন্যটি রপ্তানী ও আমদানীমূলক ব্যবসা। তার প্রাইভেট গাড়ীর সংখ্যা ও বাড়ির সংখ্যা ড্রাইভার নিজেও জানে না। তবে তার ধারণা আট-নয়টা প্রাইভেট কার আছে। দেশে বাড়ির সংখ্যা ও দোকানের সংখ্যা দুইশত পঞ্চাশটারও বেশী হবে। বিদেশেও বাড়ি আছে। আমার আর শুনতে ইচ্ছে করল না। আমার জীবন যেখানে ক্ষুধার রাজ্যে গদ্যময়, সেখানে এসব রূঢ় বাস্তব গল্প শুনা মানে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। নজরুল চৌধুরীর মত আরো অনেক আছে এদেশে। পাকিস্তান আমলে নাকি বাইশ পরিবারের কাছে এদেশ জিম্মি ছিল। বর্তমানে কয় শত বা কয় হাজার পরিবারের কাছে জিম্মি―তা পর্যবেক্ষণ করলেও সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে না। আমি ড্রাইভারকে মেয়েটি সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই সে চমকে উঠল।
- হায়! হায়! এতক্ষণ আমি কি বললাম!
- কেন কি হয়েছে?
- আপনি কোন প্রশ্ন করলে উত্তর দেওয়া নিষেধ ছিল।
- কেন?
- জানি না। তয় কারণ নিশ্চয়ই আছে।
আসার সময় মহিলা মানে মিসেস নজরুল চৌধুরী তাকে কোন কিছু বলতেও নিষেধ করেছে। কিন্তু ব্যাপারটা কি? ড্রাইভার চলে গেল। চা খাওয়ার কথাও বলা হল না। চা খাওয়া আর না খাওয়া―অন্ততঃ বলাটা সৌজন্যতা। কিন্তু ড্রাইভারকে খাওয়ানোর সৌজন্যতা আমার মনে আসেনি। মানুষ সব সময় তার চেয়ে অপেক্ষকৃত ছোট লেভেল এর মানুষকে সৌজন্যতা দেখাতে চায় না, যদি সেখানে স্বার্থ না থাকে। ড্রাইভার আর আমি অবশ্য সমান স্তরেরই। শিক্ষা ও ভাষাগত কারণে হয়তো সে নিচু কিন্তু তার চাকুরী আছে, আমার তাও নেই। তবুও তাকে ছোটই মনে হল। ড্রাইভার যদি অনেক সময় গল্প করত, তবে তাকে কিছু না কিছু খাওয়ানো হত। অনেকক্ষণ গল্প করলে অন্ততঃ চা, সিগারেট পান করার কথা মনে পড়ে।

বিছানায় শুয়ে পড়লাম। খাওয়ার কথা এতক্ষণ ভুলেই ছিলাম। ক্ষুধা জিনিসটা বেশ বুদ্ধিমান। এই ভাবনার সময়ে তার উদয় হওয়া উচিত নয়―সে হয়তো বুঝতে পেরেছে। তবে শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছিল। ভাবতে চাই না ঘটে যাওয়া ঘটনাকে। তবুও এসে পড়ে, আসে। মুরাদের আসার কথা ছিল। এসেছে কিনা জানি না। হাত ঘড়ির কথা এতক্ষণ মনেই ছিল না। তাকিয়ে দেখি, সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। টেবিলের উপর ঘড়িটা রাখতেই দেখি, একটা সাদা কাগজ ভাঁজ করা। খুলে দেখি মুরাদ লিখে গেছে ‘পরীক্ষা সামনে, ফর্ম ফিলাপ করতে হবে। এক হাজার টাকা লাগবে।’ ট্রাংকে খুব বেশী হলে তিনশত টাকা আছে। কয় তারিখের মধ্যে টাকাটা লাগবে, তাও লিখে যায়নি। পাতিলের দিকে তাকালাম। হ্যাঁ, বুয়া ভাত রান্না করে দিয়ে গেছে। আলু ভর্তা আর ডিম। দুইটার দিকে ভাত খেয়েছি। ক্ষুধাতো লাগবেই। নজরুল চৌধুরীর লনে এককাপ চা আর এক টুকরো ফল মুখে দিয়েছিলাম। কারো বাসায় নতুন আসলে একটু খাবার মুখে দিয়ে সৌজন্যতা দেখাতে হয়। বেশী খেতে নেই। গৃহকর্ত্রী-গৃহকর্তা আনকালচার ধারণা পোষণ করতে পারে। কোনমতে আলু ভর্তা, ডিম দিয়ে ভাত খেয়ে শুয়ে পড়লাম। মেয়েটির চেহারা চোখের পর্দায় ভেসে উঠল। সাথে সাথে আল্পনার চেহারাও। চোখের দুই মেরুতে দু’জন। একজন মেন্টাল পেসেন্ট―সে কখনো কেঁদে, কখনও হেসে আমার দিকে আসছে। অন্য জন কিশোরী থেকে বধু হয়ে ক্রমাগত অদৃশ্য জগতে মিশে যাচ্ছে। আল্পনা...। সারাটা দেহ অসার হয়ে উঠল। দশ বছরের প্রেম। বিয়ের দৃশ্যটা চোখে ভাসলেই রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায় চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠে। একটা ’৭১ আমাদের পুরো সংসার, আমাদের জীবন তছনছ করে দিয়েছে। এতিম হওয়ার পর থেকে ধুকে ধুকে মরতে মরতে জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি। মানুষের সবচেয়ে বড় শাস্তি হল শান্তি থেকে বিচ্যুত হওয়া; আমি সেই অশান্তির মধ্যে নিমজ্জমান।

আমি ভুলে যেতে চাই, যা কিছু অতীত―ভুলে যেতে চাই ’৭১,’৭৪। ভুলে যেতে চাই মা-বাবাকে। ভুলে যেতে চাই আল্পনাকে। কিন্তু পারি না। মনে হয়, একটা বিশাল আকৃতির বেলুনকে চাপ দিচ্ছি। ফলে আরো প্রবল বেগে পানি ঝরছে। ছিদ্রের সংখ্যা আরো বাড়ছে। না, আমি এই বেলুনটাকে আর চাপ দেব না। এভাবেই পানি পড়তে থাক। এক সময় নিশ্চয় খালি হবে। কবে হবে জানি না। হৃদয়ের উপর চাপ দেওয়া বোকামী। মানুষের জীবনে এমন কিছু স্মৃতি থাকে, যা সে কখনও ভুলতে পারে না। আমিও পারব না। উপমা দিয়ে হৃদয়কে বোঝানা যায় না। কন্ট্রোল করতে গেলেও সমস্যা। হে আল্লাহ, যদি কষ্টই দিয়েছ―তবে তা বহিবার শক্তি দাও। যে মানুষ অন্য মানুষকে উপদেশ দেয়, সে নিজেও সেই সব উপদেশ মানতে পারে না। আমি অনেককে বোঝাই, যুক্তি দেখাই, অথচ নিজে বুঝতে চাই না―বুঝি না।

আমার রুমমেট সেলিম, আজ আর রুমে আসবে না। গতকাল বলে গেছে। কোথায় তার বন্ধুর বিয়ে হচ্ছে, সেখানে দু’দিন থাকতে হবে। রুমে শুধু আমি একা। ‘আমি বাঁচতে চাই’ উপন্যাসের শেষ অংশটা লিখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু যে আগুন আর বরফ মিশ্রিত ভাষা দিয়ে লিখতে চাই―সে ভাষা এখনো হৃদয়ে আসে নাই। আমি আমার রক্ত দিয়ে, সূর্যের চোখের জলে প্লাবিত করে উপসংহার টানতে চাই―পারি না। শত চেষ্টা করেও পারি না। একটা কবিতা লিখব বলে ভাবলাম। কিন্তু হায়! শুরু হয় চিঠির মত; না হয় ছন্দ কবিতা, না হয় গদ্য কবিতা। এ যে বেদনার আত্মবিলাপ। রক্ত নদীর মোহনায় দাঁড়িয়ে হৃদয়ের বিস্ফোরিত কণ্ঠস্বর শুনি। এই মিলন মোহনায় দাঁড়িয়ে কি করে বিচ্ছেদ ঘটাব অনুপম আর কল্পনার শাশ্বত ধারার প্রেম। লেখা সামান্য এগোতেই সেই আল্পনা আর আল্পনা...। এখন আবার যুক্ত হয়েছে মানসিক রোগী। সন্ধ্যায় একটা টিউশনি আছে। এক হিন্দু মেয়েকে পড়াই। ভিকারুন্নেসা স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী--নাম সিঁদুর। দুই মাসও হয়নি অথচ মেয়েটি বলে আমি তার এক শত বছরের চেনা। অলরেডী সে আমাকে একটা কবিতাও লিখে দিয়েছে। বলেছে, কেমন হয়েছে বলবেন? কবিতাটি এরকম―
“আমাকে একটু ভালোবাসা দেবে?
এক টুকরো লাল ফিতের মতো ভালবাসা।
কি বললে ! তোমার কাছে ভালবাসা নেই?
আমি হচকিত হয়ে পাহাড়ের কাছে ছুঁটলাম
পাহাড়কে শুধালাম, পাহাড়, আমাকে একটু ভালোবাসা দেবে
অতি দূর নক্ষত্র থেকে ছুটে আসা
আমি এক শুষ্ক মরুভূমি
যার বুকে ভালোবাসার এক ফোঁটা জল নেই...। ”
এরকম কবিতা ভাল না বলে উপায় আছে? সে নিশ্চয় চেয়েছে, আমি কবিতাটি খুব ভাল বলি। আমি নিশ্চয় ভাল বলব। খারাপ হলেও ভাল বলতাম। কারন কবি চান তার কবিতা পাঠক ভাল বলুক। অন্ততঃপক্ষে সবাই একটা ধন্যবাদের আশা করে। আমি সিঁদুরকে নিশ্চয়ই ধন্যবাদ জানাব। আমিও কবিতা লিখি, তবে তা খুব বেশী হলে তিন-চার দিন থাকে। কখনও লিখি আর ছিঁড়ে ফেলি। কখনও কবিতাগুলি আহত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। কিন্তু উপন্যাস, গল্পগুলি যত্ন করে রেখে দিই। কেন? জানি না। কবিতা ভাল লাগে না; লাগলেও দু’একটা ভাল লাগে। তাও বেশী দিন নয়। সিঁদুর কবিতা লিখে। তার ভাল লাগা যেমন আপেক্ষিক, ভাল লাগার সময়টাও আপেক্ষিক।


( চলবে...)

 

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ