[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ (পর্ব-৫)

  

- শাশ্বত স্বপন -

 

ফেলে আসা জীবন নদীর নানা বাঁক নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত হয়ে গেছে খেয়ালও করিনি। ঘড়িতে চেয়ে দেখি বারটা। বিছানা থেকে জেগে উঠলাম। সেলিমের টেপ রেকর্ডার চালু করতে ইচ্ছা হল। সন্ধ্যায় টিউশনিতে যাওয়া হয়নি। সিঁদুর তার কবিতার গুণ গান শুনার জন্য নিশ্চয় অপেক্ষা করছিল। ক্যাসেট বের করে অন্য ক্যাসেট দিলাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা পড়তে শুরু করলাম--‘কেউ কথা রাখেনি...।’ এভাবে রাত গড়াতে লাগল। প্রায়ই আমার ঘুম হয় না। জীবনে কত স্মৃতি আছে। সেগুলো তেমন একটা মনে পড়ে না। মা-বাবাকে মনে পড়লে দুঃখ লাগে না অথচ আল্পনা...। হায়রে হৃদয়, প্রেমিকা তোমার কাছে মা-বাবার চেয়ে বড়। হৃদয়ের সাথে কথা বলে কোন লাভ হয় না। সে ঈশ্বরের মত, কথা বলে না। মাঝে মাঝে আমার মুখ দিয়ে তত্ত্ব কথা বের করে। “নীল আকাশ সে তো কাছেই আছে। আমার মন বলে, ইচ্ছে করলে আমি ছুঁতে পারব। এইটুকু সান্ত্বনাই থাক। মিছিমিছি বিড়ম্বনা বাড়িয়ে কি লাভ...।” অথচ এ হৃদয় আবার কেঁদেও মরে। সেও মেনে নিতে চায় না--মেনে নিতে পারে না। সে খুব বেশি বুঝে অথচ ভালোবাসার ক্ষেত্রে অবুঝ শিশু। সে ক্ষণে প্রেমিক, ক্ষণে মানসিক রোগী, ক্ষণে হিংস্র, ক্ষণে পাগল, ক্ষণে বুদ্ধিমান--বড় জঘন্য আমার এ হৃদয়!

পর দিন বিকাল বেলা। রুমে বসে সেই মেয়েটার কথা ভাবতে লাগলাম। কি চাকুরি ওখানে পাওয়া যাবে? যে চাকুরিই হোক, অন্তত: কয়েকটা মাস করা লাগবে। অগ্রীম দুই হাজার টাকা চাইতে হবে। মুরাদকে এক হাজার টাকা দেওয়া লাগবে। প্রেম-টেম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে চলবে না। এ নিয়ে আমি আর ভাবতে চাই না। এ বিষয়ে নিশ্চিত, এই বেকার সময়ে কোন সুস্থ মেয়ে আমার সাথে প্রেম করতে আসবে না। যদি বা আসে--যখন জানবে, মাই পকেট এম্টি, সি গোজ এওয়ে। অতএব, লাভ ইজ ফলস্ অফ মাইন। আমি এখন চাকুরি চাই। চাই বড় হতে--বড় লোক হতে। সবাই চায়--আমিও চাই। আজ বাবা বেঁচে থাকলে, সুস্থভাবে জীবন-যাপন করলে, সুবিধাবাদী রাজনীতি করলে--আমাদের অবস্থান নিশ্চয়ই অনেক উপরে থাকত। এলাকার কোন কোন বাড়িতে খাবার গুদামজাত করে রাখা হত, পরে বেশি দামে বিক্রি করা হত। অথচ অসংখ্য মানুষ না খেয়ে মরে গেলেও গুদামজাত খাদ্যের মালিকরা ফিরে তাকাত না। ভাবত মরুক, হাহাকার বাড়লেই মালের দাম বাড়বে। মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা ডাকাতি করে যা কিছু আনতেন--তার সবি দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। বাবার কথা অনুযায়ী, ডাকাতিটা ন্যায় সঙ্গত হলেও মা-দাদী কিছুতেই মেনে নিত না। কিন্তু সে মা-দাদীকে এমন সব দেশপ্রেম, সমাজতন্ত্রের কথা বলত--যা শুনলে ভালই লাগত তাদের। কিন্তু মা দেশ প্রেমিকের চেয়ে বেশি ভালবাসত তার স্বামীকে, দাদী বেশি ভালোবাসত তার পুত্রকে। আমি ভালোবাসতাম আমার বাবাকে। অন্য হাজার ছেলের মত আমিও দেশের চেয়ে মা-বাবাকেই আজ বেশি অনুভব করি। এতিম হওয়ার চেয়ে দেশ পরাধীন থাকাই ভাল ছিল। যারা শূন্য ছিল, অথবা স্বল্প সম্পত্তির মালিক ছিল, তারা আজ রাষ্ট্রের পরিচালক আর আমরা জীবন্ত লাশ হয়ে দেশের বোঝা হয়ে আছি। আমরা কেউ সেদিন বাবাকে সেই পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারিনি। বাবাকে ধরে রাখতে পারিনি আমাদের জীবনের সাথে। আজ ঘৃণা করি দেশপ্রেম, সমাজতন্ত্র। আস্তখুঁড়ে আজ হতাশাগ্রস্ত রোগীর মত সমাজতন্ত্র কাঁদছে। বড় বড় জ্ঞানীদের দ্বারা গঠিত এবং পরিচালিত সমাজতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা দেখলে অবাক হতে হয়। অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, দেশপ্রেমিকরা এটাকে পূজা করত। অথচ এটা আজ এক বিরাট বিস্ময়! আমার বাবা এই তন্ত্রকে পূজা করত। এই তন্ত্রের জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। আজ বেঁচে থাকলে আমাদের সামনে বড় গলায় বলতে পারতেন না।

দৈনিক ইত্তেফাকের আবশ্যক কলাম বুকে নিয়ে শুয়েছিলাম। ঐ কোটিপতির কাছে চাকুরি না পেলে, অথবা পছন্দ না হলে এ আবশ্যক বিজ্ঞপ্তি ধরে দৌড়া দৌড়ি করতে হবে। দরজার কড়া নড়ে উঠল। কে?--বলতে বলতে ছিটকিনিটা খুললাম। ড্রাইভারের আস্সালমালাইকুম সম্বোধনটা হজম না করতেই দেখি সেই ভদ্র মহিলা। তাকে আমি আশা করিনি। ভেবেছিলাম, গতকাল ড্রাইভারকে চিনতে পাঠিয়েছে এজন্যই যে, দরকার হলে ডেকে পাঠাবে। মাত্র একদিনের ব্যবধানে গৃহকর্ত্রী হাজির। আজ অবশ্য একটু পরেই আমার নিজেরই যাওয়ার কথা ছিল। অনেকটা তোষামোদের ভঙ্গীতে তাকে সালাম দিয়ে রুমে আসতে বললাম। ভাল একটা চেয়ারের জন্য ছুটোছুটি করতেই দেখি, উনি আমার বিছানায় বসে পড়েছেন। ড্রাইভার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। কোটিপতির স্ত্রী আজ, এখন আমার রুমে। কোটিপতি মানে যাদের কোটি কোটি টাকা আছে, কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আছে। কোটি টাকা তো দূরের কথা দশ হাজার টাকাও এক সঙ্গে কখনও দেখিনি। তবে দেখার ইচ্ছা জাগে, মাঝে মাঝে প্রবলভাবে জেগে উঠে। জাগবে না কেন? আমাদের সহায়-সম্পদ বলতে আমরা দু’টি ভাই ছাড়া আর কিছুই নেই। আর যেটুকু বিদ্যা--তা দিয়ে আজকের যুগে ঠেলাগাড়ি ঠেলতে পারছি না।
-- কেমন আছ?
-- জ্বী, ভাল।
-- এখানে কয় জনে থাক?
-- আমি আর আমার এক বন্ধু।
-- তোমার ভাই?
-- ঢাকা কলেজ হোস্টেলেই থাকে।
-- তুমি তো বি.এ পাস করেছ?
-- হ্যাঁ।

কিছুক্ষণ তিনি আর কথা বললেন না। তার চোখ বেশ ভারী হয়ে উঠছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে রইলাম। তিনি আমাকে আদর করতে করতে বললেন, ‘বাবা, তুমি আমার ছেলের মত, তুমিই পার--।’ উনি আর কিছুই বললেন না। থেমে গেলেন। কিছু বলতে চেয়ে বুঝে নিলেন, কিভাবে বলবেন। হয়তো গুছিয়ে উঠতে পারছেন না। আমি সময়ের জড়তা কাটাবার জন্য কথা বলতে শুরু করলাম--‘আপনারা আমাকে এটা চাকুরি দেবেন বলছিলেন। কি চাকুরি? মানে--।’

মিসেস নজরুল প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললেন। এখানে কে রান্না করে দেয়, কিভাবে খাই, টাকা-পয়সার উৎস--ইত্যাদি সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন। আমার মনে হল, নোট বই থাকলে নোট করে নিতেন। কারণ তার মনে থাকছে না। একই প্রশ্ন সময়ের ব্যবধানে তিনবারও করেছেন। ধনী পুরুষ বা মহিলাদের স্মরণ করার জন্য নিশ্চয়ই লোক থাকে। নতুবা একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনলে শ্রোতা নিজেও বিরক্ত হবেন। তার বয়স পঁয়তাল্লিশ-ছিচল্লিশ হবে। অবশ্য বেশিও হতে পারে। ধনী লোকদের স্ত্রীদের বয়স কসমেটিক্স আর সাজ-গোজের ফলে বেশ নিচে নেমে আসে। খালাম্মা, চাচী না বলে আপা বললে তারা বেশি খুশি হন। যত ঝড়-তুফান যাক তাদের সংসারে, তারা গয়নাগাটি পরিধান করতে ভুল করেন না। নিজের অবয়বের ব্যাপারে তারা খুবই সচেতন। এই যে আমার সম্মুখে মহিলা বসে আছে, তিনি তার কন্যার কারণে হতাশাগ্রস্ত। তার কন্যা মেন্টাল পেসেন্ট। দুশ্চিন্তা হবার কথা। অথচ তার বেশ-ভূষা দেখে মনে হচ্ছে, কোন পার্লার থেকে এসেছেন। অবশ্য তিনি আমাকে বলেছেন, ইত্তেফাকের কোন এক সম্পাদকের সাথে তিনি একটা জরুরি বিষয় নিয়ে বলতে এসেছিলেন। সেই সাথে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যাবার জন্যও ভাবছিলেন।

( চলবে...)

 

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ