প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

 

একটি মুমূর্ষ শহরের জন্য প্রার্থনা

 


আবদুল মান্নান
 

 

আমার জন্মস্থান চট্টগ্রামের সাথে আমার প্রায় সাত দশকের বন্ধন । পেশাগত কারণে বেশ কয়েকবছর ধরে রাজধানীতে অবস্থান করলেও নাড়ির টানে প্রায় প্রতিমাসে একবার হলেও হলেও আমার প্রায় শতবর্ষী মাকে দেখতে যাই । মাঝে মধ্যে পেশার কারণেও যেতে হয় । এই শহরের বয়স ঐতিহাসিকদের মতে প্রায় বারশত বছরেরও বেশী । ইতিহাসবিধরা হিসাব কওে দেখিয়েছেন খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক হতে আরব আর ইউরোপিয় বণিকরা চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর ফেলেছিল । বিশে যে ক’টি চলমান বন্দর আছে চট্টগ্রাম বন্দও তার একটি । অনেক বন্দরের মৃত্যু হয়েছে কালের পরিক্রমায় ইতিহাস ঐতিহ্যের দিক হতে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা হতে অনেক বেশী স্বতন্ত্র । চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা অন্য জেলার মানুষের কাছে দূর্বোধ্য কারণ এই ভাষায় অনেক শব্দ এসেছে আরবি, ফার্সি, পর্তুগিজ, আরমেনিয়, গ্রীক, বার্মিজ প্রভৃতি ভাষা হতে । পঞ্চাশ ষাটের দশকে এই শহরের যৌবন কাল দেখেছি । বর্তমানে শহরটি নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিট বা আইসিইউতে আছে । মৃত্যু হতে পারে যে কোন মুহূর্তে । ঐতিহাসিকরা এক সময় বলবেন একধা এই স্থানে অপূর্ব এক শহর ছিল যা চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ঘুমন্ত পরীর সাথে তুলনা করেছিলেন । সেই ঘুমন্ত পরীটাকে কিছু মানুষ নামের অমানুষ হত্যা করেছে । এই শহওে পা ফেলেছিলেন মরক্কো হতে আসা পরিব্রাজক ইবনে বতুতা, পত’গিজ বণিক আর মোগল স¤্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনী । কিন্তু যে হত্যাকন্ডটি ঘটতে যাচ্ছে তার জন্য সকলে সরকার, মেয়র, সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করে কিন্তু নিজেরা কোন দায় দায়িত্ব নিতে চায় না । গত কয়েকদিন একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানের কারণে আমাকে আমার এই প্রিয় শহরটিতে কাটাতে হয়েছে । ফী বছরের মতো এবারও হঠৎ বৃষ্টির কারণে শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা একেবারে পানির নীচে তলিয়ে গেল । মানুষ পরে গেল চরম দূর্ভোগে । সকলে সরকার ও সিটি কর্পোরেশন মেয়রকে এক চোট নিল । কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য প্রকৃত অর্থে যারা দায়ী, এই শহরের বাসিন্দাদের কথা কেউ মুখেও আনলো না । হাঁ এই শহরকে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে পাঠানোর জন্য যারা প্রকৃত অর্থে দায়ী তারা হচ্ছে সম্মিলিত ভাবে এই শহরের বাসিন্দারা । এই ঘাতকরা যতক্ষণ পর্যন্ত এটি বুঝতে পারবে না ততক্ষণ পর্যন্ত কোন মেয়রের বাপেরও সাধ্য নাই এই শহরকে রক্ষা করে । সরকারও অসহায় ।
বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই বুঝতে পারবেন না একধা কেমন ছিল বাংলাদেশের এই বাণিজ্যিক রাজধানী । বাংলাদেশের এটি একমাত্র জেলা অথবা শহর যেখানে নদী, সমূদ্র, পাহাড় আর সমতল ভূমি আছে বা ছিল । জলাবদ্ধতা কী তা এই শহরের মানুষ জানতোই না কারণ শহরের পানি কর্ণফূলী নদীতে গিয়ে পরার জন্য শহরের উত্তর দক্ষিণ আর পূর্ব পশ্চিমে একাধিক খাল, নূন্যতম ত্রিশ হতে চল্লিশ ফিট প্রশস্ত ছিল, যার অন্যতম চাক্তাই খাল । আমার নানা বাড়ি ছিল চাক্তাই খালের পাড়ে । সেই খালে আকিয়াব আর রেঙ্গুন হতে লবণ, চাল আর কাঠ বোঝাই বড় বড় গয়ণা নৌকা এসে নোঙ্গর ফেলতো । চট্টগ্রামের ভূমিদস্যূরা সেই খাল বহু আগেই দখল করে ফেলেছে । দখলের রাজনীতিতে সব রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের এক অপূর্ব ঐক্যমত্য আছে । চট্টগ্রামে পঞ্চাশ ষাটের দশকে যে পাহাড় গুলো ছিল সেগুলো এখন আর নেই কারণ বিত্তবানদের জন্য হাউজিং আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানাতে হলে এই সব পাহাড় কাটতেই হবে । সেই কাটা পাহাড়ের মাটি একটু বৃষ্টি হলেই পানির সাথে মিশে নালা নর্দমায় এসে জমা হয়, পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয় । এই দখলদাররাই পরবর্তিকালে জলাবদ্ধতা নিয়ে মেয়রদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে । একসময় পলিথিন ব্যাগ বন্ধ করতে সরকার কিছুটা হলেও সফল হয়েছিল কিন্তু পরবর্তিকালে সরকার তার সেই সফলতা ধরে রাখতে পারে নি । কাঁচা বাজারে গেলে আড়াইশগ্রাম তরকারি নিলে দোকানদার না চাইতেই তা এটি পলিথিন ব্যাগে ভরে দেয় । ভারতের যে কোন শহরেই একটি পলিথিন বা যে কোন ধরণের শপিং ব্যাগের দাম নূন্যতম পাঁচ রুপি । কিছু দিন আগে কোলকাতার পার্ক ষ্ট্রিটের অক্সফোর্ড বইয়ের দোকান হতে প্রায় সাত হাজার রুপির বই কিনেও দুটি পলিথিনের শপিং ব্যাগ কিনতে হয়েছে দশ রুপি দিয়ে । কোলকাতার মানুষ এখন সকালে বাজারে যাওয়ার সময় কাপড় বা চটের ব্যাগ নিয়ে যায় । এই রেওয়াজটা আমাদের দেশে এক সময় চালু ছিল । বাংলাদেশে ঢাকা চট্টগ্রামের মতো বড় বড় শহরে এই সব পলিথিন ব্যাগের শেষ গন্তব্য নালা নর্দমায় । এটি বললে অত্যুক্তি হবে না যে আমরা শহুরে অনেক মানুষ এখনো ডাস্টবিন এবং নালা নর্দমার মধ্যে পার্থক্য বুঝিনা । চট্টগ্রামের মেয়র নিখরচায় কর্পোরেশনের লোকদের দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিনের আবর্জনা নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছেন । তার জন্য প্রত্যেক বাড়িতে একটা করে প্লাস্টিকের বাস্কেটও বিনা খরচায় দেওয়া হয়েছে । অধিকাংশ মানুষ দেখা গেছে সেই বাক্সটা অন্য কাজে ব্যবহার করে বাড়ির আবর্জনা সেই ড্রেনেই ফেলছে । জলাবদ্ধতাতো হবেই ।
চট্টগ্রামের মতো এত অপরিকল্পিত শহর এই অঞ্চলে আর দ্বিতীয়টা আছে বলে মনে হয় না । ড্রেনের উপর মার্কেট, দোকান পাট লোহালক্কড় অন্য কোন শহরে দেখা যায় না । মার্কেট আর দোকান পাটগুলি বিভিন্ন সময় সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে হয়েছে । এক সময় চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে ক্রিকেট আর ফুটবলের জমজমাট আসর বসতো । স্টেডিয়ামের বাইরে চারটি খেলার মাঠ ছিল যেখানে আমার শৈশব কেটেছে । বর্তমানে আর কোন খেলার মাঠ অবশিষ্ট নেই । পুরানো সার্কিট হাউসের পূর্বদিকে নূতন সার্কিট হাউস নির্মাণ করে প্রথম খেলার মাঠটির মৃত্যু ঘটানো হয় । তারপর এক মেয়র এসে তার পাশে একটি শিশু পার্ক নির্মাণ করে দ্বিতীয় মাঠ এবং অপূর্ব এক খোলা মাঠের কবর রচনা করেন । পূর্বদিকে ছিল আউটার স্টেডিয়াম । সেখানে বসতো ষ্টার সামার ক্রিকেট । নান্নু, নোবেল, আকরাম, তামিম, নাফিজ সহ অনেকেই এই মাঠে খেলে জাতীয় দলে খেলেছেন এবং কেউ কেউ এখনো খেলছেন । ১৯৯১ সন হতে এই মাঠে বছরে একবার বিজয় মেলা বসতো । ১৯৮৯ সালে প্রথমটা বসেছিল বর্তমার শিশু পার্কের জায়গায় । এখন সারা বছর সেখানে নানা কিসিমেরে মেলা হয় । খেলা আর হয় না । চট্টগ্রাম ক্লাব সংলগ্ন মাঠটিতে রাতারাতি উঠে গেল একটা তারকা খচিত হোটেল । আর এই সব কিছুকে কেন্দ্র করে পুরো স্টেডিয়াম পাড়াটা হয়ে গেল রেষ্টুরেন্ট পাড়া । সব কিছু একসাত করলে মনে হবে এটি কোন একটি গঞ্জ । একই অবস্থা আন্দরকিল্লা, নিউমার্কেট এলাকা, ষ্টেশন রোড, চকবাজার আর টেরিবাজার এলাকার । এমন একটা জঞ্জাল পূর্ণ শহরে জলাবদ্ধতা হওয়াতো অনিবার্য ।
চট্টগ্রামের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বিশেষ মমত্ব আছে । বঙ্গবন্ধু পরিবারের এক ঘোর দূর্দিনে অত্যন্ত অনাড়ম্বর পূর্ণ এক ঘরোয়া পরিবেশে বঙ্গবন্ধু কন্যার সাথে ডঃ ওয়াজেদ মিয়ার বিয়ে হয়েছিল । পরবর্তিকালে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা চট্টগ্রাম রাইফেল ক্লাবে তাঁদের বিবাহোত্তর সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন । শেখ হাসিনা যখনই চট্টগ্রামের কোন সভা সমাবেসে বক্তৃতা করেন তিনি তাঁর জীবনের এই স্মৃতির কথা বলতে ভুলেন না । ২০০৮ এর নির্বাচনের আগে তিনি চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানের এক বিশাল জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন এই শহরের উন্নয়নের দায়িত্ব তিনি নিজ হাতে তুলে নিচ্ছেন । উন্নয়ন বরাদ্দ দিতে তিনি কার্পণ্য করেন নি । কিন্তু সর্বক্ষেত্রে অযোগ্য ও অপদার্থ লোকজন পদায়িত থাকার কারণে তাঁর এই সকল প্রচেষ্টা নিষ্ফল হয়েছে । শহরের দুটি পরিসেবার কথা উল্লেখ না করলেই নয় । প্রথমটি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড আর দ্বিতীয়টি ওয়াসা । বর্তমান সরকার বিদ্যূৎ উৎপাদনে রেকর্ড গড়েছে । কিন্তু অধিকাংশ সময় তা চট্টগ্রামবাসি উপলব্দি করতে পারে না । প্রায় সন্ধ্যায় মাগরিবের আজানের সময় শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিদ্যুৎ থাকেনা এবং এর ফলে মানুষ যে সরকারের উপর বিরক্ত হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না । ওয়াসার অবস্থা চার দশক আগে যা ছিল এখনো তা আছে যদিও এরই মধ্যে মোহরায় একটি বড় ধরণের পানি শোধনাগারের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । এই সবের উপর আছে শহরের দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের কৃতকর্ম । চট্টগ্রাম শহরের সমস্যা দূর করা কোন একজন মেয়রের পক্ষে সম্ভব নয় যদি না এই শহরের সাধারণ নাগরিকরা তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না হন । শুরুটা হোক চাক্তাই খাল পুনরুদ্ধার দিয়ে । এটি করা সম্ভব হলে তখন বুঝা যাবে এই শহররের বাঁচার একটা সম্ভাবনা আছে । না হলে বলতে হবে একধা এখানে একটি বর্ধিষ্ণু জনপদ ছিল যা এই শহরের সকল বাসিন্দা মিলে হত্যা করেছে । আসুন সকলে মিলে এই শহরটির জন্য দোয়া করি ।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক। এপ্রিল ২৮, ২০১৭
 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

 

 

 [......লেখক আর্কাইভ]