প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

@

@

@

@

@

@

২৫ মার্চ 'গণহত্যা দিবসf


আবদুল মান্নান
@

@

eআমার মতো জুনিয়র অফিসারদের সংগ্রহ করে রাত দশটায় eখf অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতরে (দ্বিতীয় রাজধানীতে, বর্তমান সংসদ ভবন এলাকা) আনা হলো । তারা লনে সোফা ও আরাম কেদারা টেনে এনে বসলো । রাত্রির শেষ যাম (প্রহর) পর্যন্ত যাতে চলে, সেই পরিমান চা ও কফির ব্যবস্থা করে কাজে মনোনিবেশ করলো । eএকমাত্র উপস্থিতf ছাড়া আমার আর বিশেষ কোন কাজ ছিল না । এই eআউট ডোর অপারেশন কক্ষেরf সামনে বেতার যন্ত্র বসানো একটি জিপ দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল । আকাশে তারার মেলা । শহর গভীর ঘুমে নিমগ্ন । বসন্তের ঢাকার রাত যেমন মনোরম হয়, তেমনই ছিল রাতটি । একমাত্র রক্তক্ষয়ী হত্যাযজ্ঞ ছাড়া অন্য সব কিছুর জন্যই পরিবেশটি ছিল মোহনীয় ।f এই বর্ণনাটি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের, লিখেছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালেক তার ডরঃহবংং ঃড় ঝঁৎৎবহফবৎ (নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল, ভাষান্তর মাসুদুল হক) গ্রন্থে । কিছু পরে শুরু হবে বিংশ শতাব্দীর এক ভয়াবহ গণহত্যা, পাকিস্তানি সেনা বাহিনী যার নামকরণ করেছে ঙঢ়বৎধঃরড়হ ঝবধৎপয খরমযঃ । মোদ্দা কথা এই রাতেই শুরু হবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা বাঙালি নিধনের প্রথম পর্ব । বাঙালিদের অপরাধ তারা বঙ্গবন্ধুর অধীনে সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে নিয়ম অনুযায়ী পাকিস্তানের সরকার গঠন করতে চেয়েছিল । বাঙালিরা পাকিস্তান শাসন করবে তাতো কিছুতেই মানা যায় না । সুতরাং তার সহজ সমাধান হচ্ছে প্রতিটি বাঙালিকে হত্যা করে পূর্ব বাংলাকে বাঙালি শূণ্য করে দাও । পূর্ব বাংলার সামরিক গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান হুকুম দিয়েছেন সেই রাতে বাঙালি নিধনের চিত্রটা এমন হাওয়া চাই যেন তিনি আর তার ইয়ার দোস্তরা চা-কফিতে চুমুক দিতে দিতে সংসদ ভবন এলাকা হতে সদরঘাট পর্যন্ত দেখতে পারেন । সেই রাতের এই হত্যাযজ্ঞের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব । কথা ছিল রাত বারটায় হত্যাযজ্ঞ শুরু হবে । ঢাকার চার পাশে তখন শুধু eজয় বাংলাf শ্লোগান । আরবাবের কাছে এই শ্লোগান অসহ্য । টিক্কার কাছে আরবাব অনুমতি চাইলেন রাত বারটার আগেই শুরু হোক অপারেশন । eজয় বাংলাf শ্লোগান আর সহ্য হচ্ছে না । ১১.১৫ মিনিটে আরবাবের নির্দেশে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর অত্যাধুনিক ট্যাংক, কামান, রেকয়েললেস রাইফেল সহ যত ধরণের অস্ত্র তাদের ভান্ডারে আছে তা গর্জে উঠলো রাতের অন্ধকারকে আলোকিত করে । নরক গুলজার এদেশের মানুষ আর কখনো দেখেনি । সেই এক রাতে কত মানুষ শুধু ঢাকা শহরে প্রাণ দিয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন । তবে গবেষকরা মনে করেন সেই এক রাতেই ঢাকা শহরে ত্রিশ হতে পঞ্চাশ হাজার নিরীহ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল । পাকিস্তান সরকার সেই রাতে মাত্র চল্লিশজন নিহত হবার কথা স্বীকার করেছিল । সেনাবাহিনীর মতে একশত। সালেক লিখেছেন eজেনারেল টিক্কা খান ভোর পাঁচটায় সোফা ছেড়ে উঠলেন এবং নিজের অফিসে ঢুকলেন । কিছুক্ষণ পর রুমাল দিয়ে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন । ভাল করে চারিদিকে দেখে বললেন, ওহ! একটা মানুষও নেই !f
সিদ্দিক সালেক আরো লিখেছেন eবিশ্ববিদ্যালয় ভবন ভোর চারটায় দখলে এলো । বছরের বেশিরভাগ সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রচার হয়েছে যেখানে, সেটাকে দমন করতে প্রচুর সময় নেবে । সম্ভবত আদর্শ অজেয় । ...ভুট্টো সশস্ত্র প্রহরীদের প্রধান ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে বললেন, gআল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ, পাকিস্তানকে রক্ষা করা গেছেh। যখন ভুট্টো এই আশাব্যঞ্জক মন্তব্য করেন তখন আমি (সালেক) বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার গণকবরগুলো দেখছিলাম । পাঁচ থেকে পনের মিটার ব্যাসার্ধের তিনটি গর্ত দেখতে পেলাম । ...বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব থেকে বেরিয়ে আমি ঢাকা নগরীর প্রধান প্রধান রাজপথ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়ালাম । নজরে এলো বিসদৃশ মৃত দেহগুলি পড়ে আছে ফুটপাতের ওপর কিংবা মোড়ের রাস্তার কোণে । f
বিংশ শতাব্দীর একটি ভয়াবহ গণহত্যার শুরুটা কেমন ছিল তা পাকিস্তানের এই সেনা কর্মকর্তার লেখা বই হতে নেওয়া কয়েকটি লাইন পড়লেই বুঝা যায় । এই শতকে এর পূর্বে এর চাইতে বড় গণহত্যা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে জার্মানিতে যা বিশ্বে স্বীকৃত eহলোকস্টf নামে । সেই গণহত্যায় জার্মানির নাৎসি বাহিনীর হাতে ষাট লক্ষ মানুষ, যার অধিকাংশই ইহুদি, নিহত হয়েছিল । আর একাত্তরের বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে কমপক্ষে ত্রিশ লক্ষ বাঙালি নিহত হয়েছিল, যাদের একমাত্র অপরাধ ছিল তারা সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সমর্থন করেছিল । ত্রিশ লক্ষ সংখ্যাটি নিয়ে বেশীর ভাগ পাকিস্তানি এখনো সন্দেহ করে যেমন করে বাংলাদেশে পাকিস্তানের রেখে যাওয়া তাদের তাবেদার সমর্থকরা । এমন কী বিএনপি প্রধান বেগম জিয়া আর দলের কেন্দ্রীয় নেতা বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সহ দলের অনেকে এই সংখ্যাকে বির্তকিত মনে করেন । আজকের দিনটি সরকারি ভাবে বাংলাদেশে eগণহত্যা দিবসf হিসেবে পালিত হচ্ছে । ইতোমধ্যে দিনটি eগণহত্যা দিবসf হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে । মন্ত্রীসভায়ও তা অনুমোদিত হয়েছে । আজকের এই দিনটিতে ত্রিশ লক্ষ শহীদদের প্রতি বিনম্্র শ্রদ্ধা । একাত্তরের যুদ্ধ শেষে পাকিস্তান পিপল্স পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো, ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক আইন প্রশাসকের পদ দখল করে। পরবর্তিকালে তিনি বিচারপতি হামুদুর রহমানকে দিয়ে একাত্তরে পূর্ব বঙ্গে কী ঘটেছিল এবং তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য একটি কমিশন গঠন করেছিলেন । সেই কমিশন দীর্ঘ সময় অনেক সাক্ষ্য সবুদ জোগাড় করে বলেছিল বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছিল এবং তাতে প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি হয়েছিল । ভুট্টো হামুদুর রহমান কমিশনের এই প্রতিবেদন কখনো প্রকাশ করে নি । তবে কমিশনের রিপোর্টের অংশ বিশেষ ভারতের eইন্ডিয়া টুডেf, সাপ্তাহিক পত্রিকায় পরবর্তিকালে প্রকাশিত হয় । পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন সময় তাদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য ভাড়াটে লেখক জোগাড় করে । এমন এক লেখক হচ্ছেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর পরিবারের সদস্য শর্মিলা বসু । তিনি ২০১১ সনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অর্থানুকূল্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ভিত্তিক উইথড্র উইলসন সেন্টারের ফেলো হিসেবে বাংলাদেশের একাত্তরের গণহত্যার উপর উবধঃয জবপশড়হরহম নামে একটি গ্রন্থ রচনা করে তুমুল বিতর্কের সম্মুখীন হন । তার মতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ত্রিশ লক্ষ বাঙালি নিধনের ঘটনা নিছক কল্পনা প্রসূত এবং তথ্য নির্ভর নয় । পরবর্তিকালে তাঁর এক সহযোগী গবেষক পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত আয়শা জালাল এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেন eআমি জানিনা শর্মিলা কেন এই কাজ করেছে । তবে দেখেছি তিনি নিয়মিত পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন, তাদেও সাথে পনাহার করেছেন।f ভারতের পাঠক নন্দিত সাপ্তাহিক eইকোনমিকস এন্ড পলিটিক্যাল উইকলিতেf শর্মিলার গ্রন্থ নিয়ে বাংলাদেশী সাংবাদিক নাইম মুহাইমিনের একটি সমালোচনামূলক লেখা প্রকাশিত হলে আয়শা জালাল তাঁর মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে এই কথাগুলো লিখেন । পাকিস্তানে এখনো কিছু বিবেকবান মানুষ আছেন যারা মনে করেন একাত্তরে তাদের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে একটি গণহত্যা ঘটিয়েছিল এবং তার জন্য পাকিস্তান সরকারের উচিৎ বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া । তবে যে যাই বলুক এটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে একাত্তরে বাংলাদেশে একটি গণহত্যা ঘটেছিল এবং তা বিশ্বের অনেক সরকার ও গণমাধ্যম ইতোমধ্যে স্বীকার করেছে । আন্তর্জাতিক নথিপত্রেও তা উল্লেখ করা আছে । একাত্তরে ব্যতিক্রম ছিল পাকিস্তানের সিভিল সোসাইটি । বাস্তবে পাকিস্তানে সিভিল সোসাইটির অস্তিত্ব তেমন একটা নেই । যে দুfএকজন একাত্তরে পূর্ব বাংলায় চলমান গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলার চেষ্টা করেছেন তারা সেনা বাহিনীর হাতে নিগৃহীত হয়েছেন ।
স্বীকৃত সংজ্ঞা অনুযায়ী কোন একটি জনগোষ্ঠীকে তার ধর্মীয় বিশ্বাস, ভাষা, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, জাতীয়তা, গাত্রবর্ণ ইত্যাদির কারণে রাষ্ট্র বা অন্য কোন গোষ্ঠী হত্যা অথবা খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করে তাকে গণহত্যা বলা হয় । বাংলাদেশে একাত্তর সালে গণহত্যার শুরুতে নির্বিচারে বাঙালি নিধন অনুষ্ঠিত হয়েছে । এটি জুলাই মাস পর্যন্ত চলে । এরপর শুরু হয় বেছে বেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যা । তারপর আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী আর সমর্থকদের হত্যার পালা । সব শেষে শুরু হয় পুরুষ ও উঠতি বয়সের তরুণদের হত্যা । শুরু থেকেই পাশাপাশি চলতে থাকে গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আর লুটতরাজ । যুদ্ধশেষে বর্তমান বাংলাদেশ একটি ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়েছিল । বর্তমানে এমন একাধিক গণহত্যা চলছে বার্মার আরাকান রাজ্যে আর প্যালেষ্টাইন সহ একাধিক আরব রাষ্ট্রে । বিশ্বের সব চাইতে বড় গণহত্যা হয় আফ্রিকার কঙ্গোয় যা বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিয়োপোডবিলের (১৮৬৫-১৯০৯)। তার আমলে আফ্রিকার কঙ্গোয় এক হতে দেড় কোটি কালো মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল শ্রেফ সেই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আর হীরক সম্পদ লুঠপাটের জন্য । ১৯৪৩ সনে বাংলার দূর্ভিক্ষে কম পক্ষে ত্রিশ লক্ষ মানুষ খাদ্যাভাবে মারা যায় । এর জন্য ইতিহাসবিদরা বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে দায়ী করেন । জাতি সংঘ ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে । বাংলাদেশ চেষ্টা করছে ৯ ডিসেম্বরের পরিবর্তে তা ২৫ মার্চ করার জন্য । বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে অনেক অসাধ্য সাধন হয়েছে । আশা আছে তার আমলে এই সফলতাটুকুও তিনি ঘরে তুলতে পারবেন ।


লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক । মার্চ ২৪, ২০১৭

@

@

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

@

[প্রথমপাতা]

@

@

@

লেখকের আগের লেখাঃ

@

@

 [......লেখক আর্কাইভ]


@

@