প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

 এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 



বিচ্ছিন্ন মন অবিচ্ছিন্ন জীবন
মেহেরুন নেছা রুমা


গল্পতো কেবল শুরু। শুভদৃষ্টি কালে আশফাকের মুখখানি দেখামাত্রই ঘোমটা ফেলে উঠে লায়লা জোর গলায় তার দুলাভাইকে ডাকে। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে দুলাভাইকে সে পাবে কোথায়? রাগে দু:খে ক্ষোভে গড়গড় করে এতগুলো মানুষের মাঝে স্পষ্টকণ্ঠে বলে উঠল, আমার জীবনটা এভাবে পোড়ানোর কোন অধিকার কারো নেই। দুলাভাইকে আমি ছাড়ছি না। আমার বাপের বয়সী বয়স, এই লোকটা আমার স্বামী হয় কি করে? বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে ফেলল লায়লা। বাপের বাড়ি থেকে বিদায়ের মুহূর্তেও এমন করে কাঁদেনি সে।
লায়লার বড় বোন শায়লার যখন বিয়ে হয় লায়লা তখন ন-দশ বছরের বালিকা। ভীষণ জেদি আর সুদর্শনা লায়লা, নিজের মনের বিরুদ্ধে কিছু দেখলেই প্রতিবাদ করতে থামেনি কখনো। নিজেকে কিংবা স্কুল পথে অন্য কোন মেয়েকে কোন বখাটে উত্তক্ত করলে জুতোপেটা করে শিক্ষা দিতেও ছাড়ত না। তাকে কোন মন্তব্য করে কেউ কখনো পার পেয়ে যেতে পারেনি। সেই লায়লা অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতেই শায়লার স্বামী আনোয়ার তার বন্ধু সৈয়দ আশফাক এর সাথে লায়লার বিয়ে ঠিক করে ফেলে। ভাল বংশ ভাল চাকরি আর স্বভাবে একেবারে হীরের টুকরো। এসব বুঝিয়ে শ্বশুরকে বিয়েতে রাজি করিয়ে নেয় আনোয়ার। ঘটনাক্রমে লায়লাও সৈয়দ বংশের মেয়ে। আনোয়ার বলেছিল, বংশের সাথে বংশ মিলিয়ে সম্বন্ধ হলে সংসার সুখের হবে। কিন্তু হয়েছিল তার উলটোটা। এই বংশের ঝাঁজটাই তাদের সংসারে বেজেছিল বেশি। দুজনই বলতো, আমি কম কীসে? আমিও সৈয়দ বংশের সন্তান। এই ডবল সৈয়দ কখনো সমান্তরালে চলতে পারেনি।
আশফাক সাহেবের মনটা সরল। কখনো আবার তা হয়ে ওঠে অতি মাত্রায় গরল। একই সময়ে দু ধরনের আচরণ করতে পারেন তিনি। নিজের মনের বিরুদ্ধে কোন কিছু হলে, বা কারো উপর রাগ হলে সেই রাগ তিনি সর্বদাই বউয়ের উপর ঝাড়েন। বউয়ের কাছে তার ব্যবহার যতটাই অপ্রিয়, ঠিক ততটাই বাইরের মানুষের কাছে প্রিয়। এলাকার চায়ের দোকান, অফিস, শ্বশুর বাড়ি, খেলার মাঠ কিংবা মসজিদ, সব খানেই তার সদ্ব্যবহারের খ্যাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অথচ পাশের বাড়ির বিলকিছ, হারুনের মা, রমিজের খালা সৈয়দ বাড়ির দিকে মনোনিবেশ না করলেও বুঝতে পারে আশফাক সাহেব কখন ঘরে আছেন, কখন নাই। কারণ তখন সেই বাড়ির আবহাওয়া প্রচণ্ড থেকে প্রচণ্ডতর হয়ে গরম বাতাস আর বাতাসের তাণ্ডবতা চারিদিকে এত উচ্চমাত্রায় ছড়াতে থাকে যে আশেপাশের সকল প্রাণীকুল একেবারে ঠান্ডায় চুপসে যায়। সে চুপসে যাওয়ার দু-রকম অর্থ হতে পারে। হয় তারা আশফাক সাহেব এবং তার বউয়ের গলাবাজিতে ভয় পান, নয় তারা চুপ করে তাদের ঝগড়া উপভোগ করেন। এই ঝগড়া একটা ভীষণ উপভোগ্য বিষয়। অবসর সময়ে প্রতিবেশী নারীগন শীতের সকালের মিষ্টি রোদে পা ছড়িয়ে বসে পরস্পরের মাথার উকুন বাছার ছলে এসব গল্পকে বেশ মুখরোচক করে তুলতে পারেন । সাথে যদি কেউ তখন দয়াবশত কাপভর্তি গরম ধোয়া ওঠা চা এনে পরিবেশন করে তো সোনায় সোহাগা।
স্ত্রীর সাথে যতটাই উচ্চকণ্ঠে বাক্যবিনিময় করেন, একই সময়ে ততটাই মধুর নম্র সুরে øেহ মমতার প্রলেপ দিয়ে নিজের মেয়েদের সাথে কথা বলেন আশফাক। সেই মুহূর্তে বাইরের কোন দর্শনার্থী যদি বাড়িতে আসেন তো হয়ে ওঠেন আরো বেশি বিনয়ী আর হাস্যোজ্জল এক ব্যক্তিত্ব।
কন্যা দ্বয় তার খুবই প্রিয়। আর এই সুযোগটা স্ত্রী লায়লাও উশুল করে নিতে জানেন। প্রায় সময়ই সে মেয়েদের মাধ্যমে স্বামীর কাছ থেকে কোন বড় রকমের বিল পাশ করিয়ে নেন। সেটা জেনে বুঝেও আশফাক সাহেব মনে মনে এই ভেবে সন্তুষ্ট থাকেন যে, এই জায়গাটায় এসে তার দাম্ভিক স্ত্রী ঠিকই তার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। রূপের আগুনের হলকা ছড়িয়ে লায়লা যখন কোমরে আঁচল গুঁজে স্বামীর সাথে তর্ক করে, আশফাক সেই তেজদীপ্ত রূপ দেখে বিস্মিত হন। মনে মনে বলেন, তোমার এই ঝাঁজালো রূপের সাথে কণ্ঠের ঝাঁজালো আওয়াজ না বেরোলে ঠিক বেমানান হত। এর টানেইতো আমি গৃহে ফিরে আসি।
বিয়েতে লায়লার মত ছিল না। অবশ্য কেউ তার মতামত জানতেও চায়নি। ঘরের পাশে আড়ি পেতে তার দুলাভাই আনোয়ারকে বলতে শুনেছিল,“ছেলে একটু দেখতে কালো, আর বয়স খানিকটা বেশি। কিন্তু স্বভাবে, আভিজাত্যে, শিক্ষা-দীক্ষায় একেবারে অদ্বিতীয় । পুরুষের বয়স আর কালো রং কোন ব্যাপারই না।”
সমস্ত বাড়ি মাথায় করেছিল লায়লা এই বলে যে, কালো বুইড়া ব্যাটাকে আমি বিয়া করব না। কিন্তু বাপের কড়া শাসনের কাছে লায়লার উচ্চকণ্ঠ সেদিন মার খেয়েছিল। যথা সময়ে বিয়ের সানাই বাজল, বর এলো, খাওয়া দাওয়া হল, লাল বেনারসিতে সেজেগুজে লায়লা শ্বশুর বাড়িতে চলে গেল।
কোন রকম রাতটা পার করে ভোর হতেই বাপের বাড়িতে ছোটে লায়লা। বলে, ওই জামাইকে আমি কিছুতেই মানি না। সকলে মিলে বোঝায়, কিন্তু লায়লা দমে না। অত:পর লায়লার বৃদ্ধ বাবা এসে বলেন, এক্ষুনি যদি ওই বাড়িতে ফিরে না যাস তো তুই আমার মেয়ে না। যেন জ্বলন্ত আগুনে বরফ পরে। মাথা নিচু করে ফিরে যায় আশফাকের ঘরে। কিন্তু মন থেকে আশফাক সাহেবকে দেখতে পারে না লায়লা। হাতির মত দড়াম দড়াম করে চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। কোন কথার পরোয়া করে না। বাপের বাড়িতেও যায় না। রোজ দুইবেলা আনোয়ারকে অভিশাপ দেয়। সামনে পেলেই আনোয়ারের উপর অভিযোগের বাণ ছুঁড়ে মারে। লায়লার ভয়ে আনোয়ারও এখন তেমনটা বন্ধুর বাড়ি যায় না।
এমনি করে দিন মাস বছর গড়িয়ে জীবনের ক্রান্তি লগ্নে এসেও উভয়ের মনের মিল আর কোনকালে হয় না। দুটি মেয়ে বড় হয়। মেয়েদের বিয়ে হয়। লায়লার পাকা চুলে মেহেদির রং টক টক করে। এখনও শাড়ির কুচিটা এলোমেলো হয় না। গহনাগুলো সব সময়ই অঙ্গে শোভা বর্ধন করতে থাকে। অপরদিকে আশফাক সাহেব দিনে দিনে আরো বুড়ো হয়ে যায়, শীর্ণ শরীর, কথাবার্তা এলোমেলো, সংসারে বেখেয়াল, টাকা পয়সার বেহিসেব, ময়লা কাপড়, অপরিচ্ছন্ন দাড়ি গোঁফ, ছেঁড়া জুতো, পানের পিক। কিন্তু এখনও আগের মতই ঘরে আসলেই আবহাওয়া গরম, আসবাবপত্রের ছোঁড়া ছুঁড়ি, ভাঙচুর, দুজনের জীবন নষ্ট করার পারস্পরিক অভিযোগ। বাবা-মায়ের এমন কোন্দল মেয়েরা তাদের স্বামীদের দেখাতে চায় না। পাছে তাদের সম্মানহানি হয়। তাই তারাও তেমন বেড়াতে আসে না। কখনো অল্প সময়ের জন্য এসে বাবা মাকে দেখে যায়। সেই অল্প সময়টুকুর মধ্যেই মেয়েদের কাছে আলাদা আলাদা করে পরস্পরের প্রতি অভিযোগ তুলে ধরেন দুজন।
দিন চিরকাল একরকম যায় না। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে ভুগতে ভুগতে একদিন আশফাক সাহেবের গলার আওয়াজ থেমে যায় চিরতরে। কালো কুচকুচে দীর্ঘ দেহটা খাটিয়ার উপর নি:শব্দে পরে থাকে। নাকের ছিদ্রে গুঁজে দেয়া সাদা তুলো। কালো মুখমণ্ডলে সাদা ধবধবে তুলোর গোলাদুটির দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে লায়লা। কতক্ষণ তার সঠিক হিসেব নেই। ওই তুলোর গোলাটা তাকে কোন এক জীবনের বার্তা প্রেরণ করে। তাকে নিয়ে যায় দূর কোন অজানায়। আত্মীয় স্বজনরা এসে লায়লার পরনের রঙিন শাড়ি পালটে সাদা শাড়ি পরিয়ে দেয়। খুলে নেয় জড়োয়া গহনা।
দৃষ্টি ফেরাতে পারে না লায়লা। এতটা বছরে এমন করে কোনদিন আশফাক সাহেবের মুখের দিকে তাকানো হয়নি তার। এ মুখ আজ সে দেখেই যায়। দেখার যেন শেষ নেই। সেই তাকিয়ে থাকার উপরই খাটিয়া সরে যায় চোখের সামনে থেকে। লায়লা তখনও চেয়ে থাকে শূন্য মেঝেতে। সেখানে তখনও সে তুলোর গোলা দুটি দেখতে থাকে।
চারদিন পর আস্তে আস্তে বাড়িটা ফাঁকা হতে থাকে। আত্মীয়রা ফিরে যায় যার যার বাড়ি, মেয়েরাও একসময় তাদের স্বামীদের ঘরে ফিরে যায়। একলা ঘরে লায়লার দম বন্ধ হয়ে আসে। আশফাক বিহীন বেঁচে থাকা মৃত্যুর সমান। এই জীবন সে চায় না। সেও যেতে চায় সেখানে, যেখানে আশফাক গিয়েছে। কাজের মেয়েটি যখন তাকে খেতে ডাকে বিড়বিড় করে বলে, এই তুই দেখেছিস ওনাকে? কতদিন বাড়ি আসে না! বলতো কোথায় গেল? আবার একটু চুপ থেকেই বলে, এই চল না আমাকে নিয়ে। তুই চিনিস সেই জায়গা যেখানে উনি গিয়েছে? আমাকে নিয়ে চল না। বলতে বলতে শিশুর মত কেঁদে ওঠে লায়লা। সারারাত আলো জ্বেলে বসে থাকে, নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে মেঝের দিকে। চোখের সামনে উড়তে থাকে সাদা সাদা তুলো।
!

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ