[প্রথমপাতা]

 

 

 

ওইখানে যেওনাকো তুমি(পঞ্চম পর্ব)
 
 

- মেহেরুন নেছা রুমা -

 

 
অষ্টম শ্রেনীতে উঠে রূপা স্কুলেরই একজন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়া শুরু করল। অংকটা বাড়িতে এসে দেখিয়ে দিয়ে যাবে। স্কুলে একজন সিনিয়র অংকের শিক্ষক তিনি। একজন ভাল শিক্ষক হিসেবে তার নাম ডাক এলাকায় কিছু কম নয়। অনেক ছাত্রছাত্রীকে ব্যাচ এ প্রাইভেট পড়ায় সে। অনেক ছেলে মেয়েকে একত্রে পড়ায় বলে রূপাকে তার মা ব্যাচ এ পড়তে যেতে রাজি হয়নি। তাই সে বাড়িতে এসে পড়ান। মেয়েকে বিশেষ যতœ করে পড়াবেন বলে।
রূপার মা জানে শিক্ষকরাও সুযোগ পেলে ছাত্রীর সাথে অশোভন কিছু করে বসতে পারে। যদিও আমাদের সমাজে শিক্ষকদের পিতার আসনে স্থ—ান দেয়া হয়। কিন্তু সে স্থানে তারা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে নারাজ। তারা ছোবল মারতে চান মেয়ে সমতুল্য ছাত্রীদেরকে। রূপার মা তাই মেয়েকে পড়ানোর সময়ে আশে আশেই থাকেন। কিন্তু তারও তো সংসারে কাজ কর্ম আছে । কতক্ষণই বা বসে থাকতে পারেন সে। মাঝে মাঝে উঠে যেতেই হয়। তারপরেও মায়ের পাহারাদার চোখ দুটি মেয়ের উপর থেকে সরে না। মা চায় মেয়েটাকে সকল রকম অনাচার থেকে দূরে রাখতে। নিরাপদে রাখতে। সব মায়েরাই চান। তারপরেও মাকে বেঁধে রেখে চোখের সামনে মেয়েকে আক্রমন এ সমাজে কি হয়নি কখনো ? খুব হয়েছে। পুরুষের পেশি শক্তির কাছে যুগে যুগে মায়েরা পরাজিত হয়েছেন। তাদের সামনেই মেয়েদের ইজ্জত লুটে নিয়েছে নরপশুরা।
ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে স্কুল মাঠে মারামারি করতে যেয়ে রূপার ছোট ভাইয়া রাসেল একদিন হাত পা ভেঙে বাড়ি আসে। মেয়েকে নিয়ে যতটা চিšায়— থাকেন মা,যতটা সাবধানে রাখেন,যত বিধি নিষেধ আরোপ করেন,মেয়ে ঠিক তা পালন করে। এখন পর্যন্ত রূপাকে নিয়ে কোন বড় রকমের বিপদের সম্মুখিন হননি তিনি। কারন রূপা বুঝতে পারে মা কি বুঝাতে চান,কেন এত নিষেধ আসে তার উপর। ভাল না লাগলেও মনে করে বাবা মা যা বলেন সন্তানের ভালর জন্যই বলেন। তাই রূপা সেসব মেনে চলে । কিন্তু ভাই দুটো যেন ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ওদের বিরূদ্ধে অন্য বাড়ির মেয়ের মায়ের নালিশও আসতে শুরু করেছে। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায় বাবা মার। রূপক নাকি কোন মেয়ের স্কুলে যাবার পথ আগলে রাখে প্রতিদিন। মেয়েদের পিছন পিছন হাঁটে, শিস দেয়,গান গায়। এসব কি সহ্য করা যায় ? ইদানীং রূপক কে কিছুই বলা যায় না। ফোঁস করে ওঠে। কিছু বলতে গেলেই বলে,আমি আর ছোট খোকা নই মা। সব সময় বকাঝকা ভাল লাগে না। হন হন করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে ।
রাসেলের হাত পা কারা ভেঙে দিয়েছে সেটা জানতে চায় না বাবা মা। নিশ্চয়ই রাসেলও গিয়েছিল মারামারি করতে। পেরে ওঠেনি তাই মার খেয়ে এসেছে। দ’ুটো ছেলে নিয়েই বাপ মায়ের দু:খ শুরু হল। এত শিক্ষা দেয়ার পরেও ছেলে দুটি কেন তাদের অবাধ্য হয়ে উঠছে দিনে দিনে। তার উপর তিন চারটা প্রাইভেট শিক্ষক দিয়েও ওদের কাছ থেকে পরীক্ষায় ভাল ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।
রাসেলের চিকিংসার জন্য একদিন সদর হাসপাতাল যেতে হল। সঙ্গে বাবা মা দু’জনেই গেলেন। কাজের মেয়ে মজিলাকে রূপার কাছে রেখে গেলেন মা। সারাক্ষণ রূপাকে দেখে রাখতে নির্দেশ দিলেন। বিশেষ করে যতক্ষণ স্যার পড়াবেন মজিলা যেন সেখানেই বসে থাকে।
মজিলা বসে তো ঠিকই ছিল। কিন্তু কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ল সেদিকে খেয়াল ছিল না তার। রূপা মনোযোগ দিয়ে অংক কষছে। স্যার জিজ্ঞাসা করেন,তোমার মা কোথায় গেছেন রুপা ?
ছোট ভাইয়াকে নিয়ে হাসপাতাল গেছে ।
ওহ আচ্ছা।
আমার জন্য এক গ্লাস পানি আনতে পার রূপা ?
জ্বি স্যার ,আনছি।
পানি হাতে রূপা স্যারের দিকে গ্লাসটি ধরতেই স্যার রূপার হাত সহ গ্লাসটি ধরলেন। নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে রূপা চেয়ারে এসে বসল। মনে মনে ভাবল,স্যার কি ইচ্ছা করে হাত ধরলেন ,নাকি অন্যমনস্ক ছিলেন। তবে যেভাবেই স্পর্শ করুন না কেন,রূপার তখন কেমন অসহ্য লাগছিল স্যারকে।
স্যার দরজার কাছে বসা মজিনাকে একটু পর পর দেখছিলেন । নিজের চেয়ারটা অংক দেখার নাম করে টেনে রূপার কাছাকাছি নিয়ে আসলেন। পাশের চেয়ারে বসে স্যার রূপার পিঠের উপর একটা হাত রেখে বলেন, না বুঝলে বলো কেমন ? স্যারের স্পর্শে রূপা চমকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল।
-আরে কর কি রূপা ? বসো বসো। বলেই স্যার রূপাকে তার কোলের উপর টান মেরে বসিয়ে দিল। তারপর দু’হাতে সজোরে চেপে ধরল। বিড়বিড় করে বলতে থাকল-এই মেয়ে এত তেজ দেখাও কেন ? চুপ করে বসে থাক না । দেখ মজা পাবে। অনেক মজা দিব তোমাকে । অনেক আদর করব। প্রতিদিন করব। আমার কথার অবাধ্য হইও না।
কথার সাথে সাথে হাত চলে যাচ্ছে সবখানে। উপরে নিচে ,জামার নিচে,ওড়নার নিচে।
স্যারের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য রূপা জোর জবরদস্তি করতে থাকল। কিন্তু ওরকম একজন পুরুষের শক্তির সাথে এতটুকু রূপার পেরে উঠা যখন সম্ভব হচ্ছিল না, তখন রূপা বলল,
আমাকে ছেড়ে দিন। আমি চিৎকার করে লোক ডাকব। স্যার ছেড়ে দেন আমাকে।
-এই মেয়ে তোমার তো দেখছি অনেক সাহস। আমাকে হুকুম করছ ? স্যার কে হুকুম ? জানো আমি তোমাকে পরীক্ষায় ফেল করাতে পারি ? বলেই রূপার মুখ চেপে ধরল এক হাতে ,আর এক হাত রূপার বুক ,পিঠ,কোমর সবখানে হাতিয়ে বেড়াচ্ছে। রূপা হাত পা ছুড়ে স্যারের সাথে ধস্তাধস্তি করে বন্ধ মুখে গোঙাতে লাগল। কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না। তখন পা দিয়ে ঠেলা দিয়ে পাশের চেয়ারটা ফেলে দিল রূপা । চেয়ার পড়ার শব্দে জেগে উঠে মজিলা। রূপাকে ছেড়ে দিয়ে হাঁপাতে থাকে স্যার এবং রূপা দু’জনেই। রূপা ঘরের মধ্যে চলে যায় । আর স্যার বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
জগতের কোন কিছুই আনন্দদায়ক মনে হয় না নীরার কাছে। সবই যেন মেকি,সবই যেন ফাঁকি। নিজের ঘর থেকে খুব একটা বের হয় না। বোনদের সাথেও কথা বলে না। কলেজে যায় না,খায় না ,ঘুমায় না,পড়ে না। মনে করতে না চাওয়া ভালবাসার এক একটা মুহুর্ত স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে। কখনো নিরবে কখনো বা স্বশব্দে ডুকরে কেঁদে ওঠে নীরা। এক সময় মনের কষ্ট ভুলতে বইয়ের মাঝে ডুব দিল। দিন-রাত বই পড়ে । সময় তার এমনি কেটে যায়।
তপুর কথা মনে পড়লে আপ্রাণ ভুলে থাকতে চেষ্টা করে। মনে সে করতে চায় না সেই পুরুষকে । যার পরিচয় নীরার কাছে কেবলি একজন লোভী আর প্রতারক ছাড়া কিছু নয় ।
‘যে পুরুষের মাঝে পৌরুষদীপ্ত ভাব বেশি ফুটে ওঠে ,সেই পুরুষই নারীর বিশ্বাস ভাঙে সবচেয়ে বেশি’। নারীর সাথে প্রতারনা করেই তারা নিজেদেরকে বীর পুরুষ প্রমানতি করে। আসলে তারা হল কাপুরুষ।
কত সহজে একজন পুরুষ একজন নারীর মনের ভেতর ঢুকে সবকিছু ঝেড়ে পুছে নিয়ে গিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে সন্তোর্পনে ! তপুর বলা কথাগুলো ভাবলে নীরা অবাক হয়। যে ছেলে ‘ জীবন দিয়ে ভালোবাসে’ নীরা কে। সে কি আসলে জানে ভালোবাসা কাকে বলে ? আর জীবন দেয়াটাই কি রকম ? যাকে কথায় কথায় জীবন দিয়ে দিত, সে পুরুষ অর্থের ভাগ কম পড়বে বলে ভালোবাসার মানুষ কে অসীম দু:খ দিয়ে অন্য কোন ঘাটে তার নৌকা ভিড়াতে দ্বিধা করেনি,সেই পুরুষের কথা নীরা ভাবতে চায় না। যেখানে মানুষ হিসেবে নিজের ভাবনার মূল্যায়ণ পেল না, সেখানে তাকে মূল্যায়ণ করার কোন মানে হয় না।
মন ও মস্তিস্ক দুটি আলাদা সত্ত্বা। মস্তিস্ক এসব যুক্তি বুঝে,কিন্তু মন ? সে যুক্তি মানতে নারাজ। নীরা যতই মনটাকে মস্তিস্ক দ্বারা বুঝাতে চায় ,মন কিছুতেই আবেগকে সংবরণ করতে পারে না। বারবার মনটা ওই তপুর কাছেই ছুটে যায়।
আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা নিজেদেরকে সকল নারীর প্রভু মনে করে। মনে করে তাদের ছাড়া নারী চিরকালই অসহায়। তারা নারীর ভালোবাসাকে দুর্বলতা ভেবে তার সাথে ‘মিষ্টি কথা’ বিনিয়োগ করে উদ্দেশ্য হাসিল পর্যন্ত টিকে থাকে। লাভের অংশ পুরোটাই তাদের চাই। একটু কম হলেও চলবে না। বিয়ের বেলায় বৌটা যেমন হতে হবে একশ তে একশ, তার পায়ের গোড়ালি থেকে মাথার চুল পর্যন্ত প্রতিটি জিনিস যাতে নিঁখুত হয় । তেমনি আবার তার সাথে যেতে হবে গৃহসামগ্রী,সোনা দানা, ঘটি বাটি,নগদ অর্থকড়ি। না হলে পুরুষের মান থাকে না।
‘ভাগ্যবানের বৌ মরে ,অভাগার গরু’-যেন এ প্রবাদটি তারা টিকিয়ে রাখতে চায় আপাদমস্তক। কারো গরু মরলে গরুওয়ালার অনেক লোকসান হল। কিন্তু কোন পুরুষের যদি বৌ মরে যায় তো আর একটা বৌ ঘরে আনলে তার কোন লোকসান নেই। বৌ আসবে আবার বৌ এর সাথে অর্থকড়িও আসবে। তাহলে গরুর মরার চেয়ে বৌ মরাটাকেই তারা শ্রেয় মনে করে।

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ