[প্রথমপাতা]

 

 

 

ওইখানে যেওনাকো তুমি(৮ম পর্ব)
 
 

- মেহেরুন নেছা রুমা -

 

 
কিন্তু কোথায় রূপক? সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল,সন্ধ্যা ,রাত । রূপকের দেখা নাই। ততক্ষণে মায়ের মনে দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেছে। কেন জানি মনে হল রূপক বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। ব্যাপারটা মনে হতেই নিজের এবং রূপকের বাবার টাকা পয়সার খোঁজ নিল। যা আশংকা করেছিলেন তাই হয়েছে। রূপক তার বাবার ড্রয়ার ভেঙ্গে ঘরে যা টাকা ছিল সবই নিয়ে গেছে। সাথে তার মায়ের এবং রূপার বিয়ে দেয়ার জন্য কিছু গহনা রেখেছিল তাও নেই। শেষ পর্যন্ত এমন কাজ করতে পারল ছেলেটা ?
মাথা ঘুরে বেহুশ হয়ে পড়ে আছেন মা। রূপা মায়ের মাথায় পানি ঢালছে। রূপার বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন ঘরে। ছোট ছেলেটার এসবে কোন ভ্রুক্ষেপ নাই বললেই চলে। আশে পাশের মানুষজন কেউ কেউ বিষয়টা টের পেল। টের পেয়ে তারা পিপড়ার মত এসে হাজির হয়েছে রহস্য উদ্ঘাটনে। বাড়ির বড় ছেলে কেন রাতের অন্ধকারে বাড়ি ছাড়ল ? সবার মনের অদম্য কৌতুহল মেটানোর আগ্রহ বা ইচ্ছা এই মুহুর্তে রূপা , রূপার বাবা বা মায়ের কারোই নেই।
বাইরের ঘরে আফজাল চাচার গলার আওয়াজ শুনা গেল। কাশি দিয়ে ঘরে ঢুকে বাবাকে বলছেন ,কি হয়েছে ভাইজান ,শুনলাম রূপক বাবা নাকি রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গেছে ?
সবই আমার কপাল ভাই। কষ্ট করে ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে চেয়েছি। সারা জীবন ন্যায়ের সাথে চলেছি। ওরা মানুষ হলে তো ওদেরই লাভ। আমরা আর ক’দিন আছি। এখন নিজের ভাল যদি নিজেরা না বুঝে তো আমাদের আর কি করার আছে বলেন ।
ঠিকই বলছেন ভাইজান। আসলে ছেলে মেয়েরা বড় হলে বাবা মার কথা শুনতে চায় না। তারা নিজেরাই নিজেদেরকেই বড় ভাবে। যাক না ভাই,দেখবেন পেটে যখন খিদে লাগবে ঠিক বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরে আসবে।
একটু থেমে আফজাল চাচা আবার বলেন,ছেলের জন্য ভাবীসাব তো অসুস্থ্য হয়ে গেলেন। আপনার রূপা দেখবেন একদিন অনেক বড় হবে ভাইজান। সে অনেক বুদ্ধিমতি মেয়ে ।
রূপার বাবা রূপাকে ডেকে আফজাল চাচাকে পান দিতে বললেন । রূপা তার সামনে আসতে চায় না। তারপরেও বাবা ডাকছেন বলে আসতে হল। পিরিচে করে পান সাজিয়ে রূপা যখন সামনে এল শকুনের মত চোখ করে আফজাল রূপাকে দেখছিল। শৈশবের গন্ডি পেরিয়ে রূপা এখন উঠতি তরুনী । গড়ণে বরণে রূপা এখন মুগ্ধকর এক মুর্তি। এমনিতেই সবার নজরে পড়ার মত রূপ তার। আফজাল চাচার চোখের দিকে একবার চোখ পড়তেই রূপার ভেতরটা ঘৃনায় ছেয়ে গেল। দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করল। ঘরের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে আফজাল কিছু সুবিধা করতে না পেরে উঠে চলে গেল।
এখন নীরা দিন রাত ব্যস্ত থাকছে তার সংগঠন নিয়ে। স্কুল এবং কলেজের অনেক মেয়ে তার কাজের সাথে যুক্ত হয়েছে। ওদেরকে এখন আর পথে ঘাটে কোন ছেলেরা বিরক্ত করে না। পারলে রাস্তা ছেড়ে মাঠে গিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েদের যেতে দেয়।
এখানে নতুন একজন ম্যাজিস্ট্রেট এসেছেন। নাম তার সাকিরা সুলতানা। এর আগে কখনোই এ অঞ্চলে নারী ম্যাজিস্ট্রেট ছিল না। সাকিরা কোন মাধ্যমে নীরার ব্যাপারে শুনে নীরাকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করল। নীরা তার সঙ্গীদের নিয়ে একদিন তার কাছে গেল।
সেই মহিলা একাকী জীবন যাপন করেন। বিয়ে শাদি করেননি এখনো। কোনদিন যে করবেন তারও সম্ভাবনা নাই। একা আছেন বলে তার কোন দু:খও নাই। বরং অনেক ভাল আছেন সে কথাই বললেন। সাকিরা নীরার সাথে অনেক আলাপ আলোচনা করল। নারীদের নিয়ে আসলে নারীকেই ভাবতেই হবে। তাদের সমস্যাগুলো তারা ছাড়া অন্য কারো বুঝার ক্ষমতা নাই। নারীদের অধিকার সম্পর্কে তারা নিজেরাই যদি সচেতন না হয় তো সাধ্য নাই তাদেরকে কেউ তাদের ন্যায্য পাওনাগুলো হাতে তুলে দেয়।
এরই মধ্যে দুটি বাল্য বিবাহ রোধ করেছে তারা। নীরার দল খবর পেয়ে জায়গা মত যেত ,আর কেউ গিয়ে সাকিরাকে খবর দিত। অত:পর তাদের সাথে গ্রামের আরো গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ যুক্ত হয়ে বিবাহের আয়োজন বন্ধ করে দিত। সকলে এক বাক্যে বাল্য বিবাহ যে সমাজে কুফল বয়ে আনে তা স্বীকার করতে বাধ্য হত। এসব কাজ যেদিন করে সেদিন নীরা এবং তার দল নিজেদেরকে স্বার্থক বলে মনে করে।
ইতিমধ্যে নীরার অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসলেও নীরা তা আমল করেনি। তার এখন অনেক কাজ। মাস্টার্স শেষ হয়েছে । এখন একটা ভাল চাকরী নিতে হবে। তারপর অন্যকিছু। যেসব কাজ মেয়েরা সাধারনত করতে চায় না,বা এই সমাজ যেসব কাজকে মেয়েদের কাজ নয় বলে গণ্য করে ,নীরা চায় সেরকম কিছু একটা করতে। কাজ কাজই। নারী পুরুষের আলাদা বলে কোন কাজ নেই।
সাকিরার সাথে নীরার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সাকিরা নীরাকে সব ব্যাপারেই সহযোগিতা করে। নীরা যখন একের পর বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিচ্ছিল তখন নীরার ছোট বোন শিলার কথা একদিন বাবা মা বলেন। তোমার বিয়ে না হলে তো শিলার বিয়ে দিতে পারছি না । তারপর তুলি রয়েছে। তখন নীরা বলেছিল,শিলার যদি উপযুক্ত বর মিলে তো ওকে তোমরা বিয়ে দিয়ে দেও। আমার জন্য ওর বিয়ে দেয়া যাবে না এটা কেমন কথা। যার যখন বিয়ে করার সময় এবং সামর্থ হবে ,সে তখন বিয়ে করবে। এখন আমার বিয়ে ছাড়া অন্যকিছু করার আছে। তো আমি বিয়ে করব না বলে কি শিলার বিয়ে হবে না ?
কিছুদিন আগে শিলার বিয়ে হয় এক সরকারী চাকুরে পাত্রের সাথে। কোন যৌতুক এবং দরদাম ছাড়াই শুধুমাত্র কনে দেখেই তারা শিলাকে বৌ করে নিয়ে যায়।
একজন সিভিল সার্ভিস অফিসার হওয়ার জন্য নীরা উঠে পড়ে লেগেছে । দিনরাত পড়াশুনা করছে,মাঝে মাঝে সাকিরার বাসায় যেয়ে তার কাছে থেকে পরামর্শ নিচ্ছে।
লক্ষ্য যদি অটুট থাকে আর সেই সাথে যদি থাকে প্রচেষ্টা ,তো লক্ষ্যে পৌঁছা অসম্ভব কিছু নয়। নীরার পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকরী হয়ে গেল । প্রথম ট্রেনিং এ যেয়ে একবার ভাবল চাকরী বাকরী তার হবে না। জীবনে এত কষ্ট আর কোনদিন পায়নি সে। তারপর সাকিরাকে একদিন ফোন করে বলতেই সাকিরা তার মনোবল বাড়িয়ে দিল। কষ্ট সহ্য করতে না পারলে মানুষের জীবনের স্বার্থকতা কোথায় ? আর, বড় হতে হলে কষ্ট তো করতেই হবে।
রূপক বাড়ি থেকে সেই যে গেল আর ফিরে আসেনি । কোথায় আছে তাও কেউ বলতে পারে না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মা এখন স্তব্ধ হয়ে গেছেন।
রুপার সামনে এস এস সি পরীক্ষা। পড়াশুনা নিয়ে দারুণ ব্যস্ত সে। পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে পারলে ঢাকা যেয়ে পড়ার ইচ্ছা আছে তার। নীরা চাকরী পেয়ে চলে যাবার পর নীরার অনেক কাজের দায় দায়িত্ব এখন রূপা আর তুলির উপর।
নীরা বলেছে , এসএসসি এবং এইচএসসি তে যদি ভাল করে পাস করে বেরোতে পার তো, তোমাদেরকে আমি ঢাকাতে পড়াশুনা করার ব্যবস্থা করে দিব। সেই আশ্বাসে দুজন মরিয়া হয়ে পড়ছে।
সাকিরা ঘরে ঢুকেই দেখতে পায় রূপা আর তুলি বসে আসে ড্রইংরুমে।
কি খবর তোমাদের ? কেমন আছ ? কাজকর্ম,পড়াশুনা ঠিকঠাক চলছে তো ?
জ্বি আপা । সব ঠিক আছে । কিন্তু এখন আমরা এসেছি একটা খবর নিয়ে।
কি খবর ?
নীরা আপুর এক বান্ধবী, নাম পান্না । পান্না আপু নীরা আপুর সাথে প্রাইমারী থেকে একত্রে পড়াশুনা করত। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ক’দিন আগে পান্না আপু তারই এক সহপাঠীর সাথে বিয়ে করে পালিয়েছিল। পরে উভয় পরিবার বিয়েটা মেনে নেয় । পান্না আপুর আর পড়াশুনা হয় না। বিয়ের দেড় বছরের মধ্যে তাদের একটা মেয়ে হয় । তার দু’বছর পর আরও একটা মেয়ে হয়। মেয়েদের নিয়ে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু সমস্যা হল পরের মেয়েটা জন্মের সময় গ্রাম্য ধাত্রির অপরিপক্কতার কারনে আপুর শরীরে কিছু সমস্যা হয়। যার কারনে বাচ্চার জন্মের পরে অনেকদিন তাকে ভুগতে হয়েছিল। ডাক্তার বলেছে আপু আর সন্তান নিতে পারবে না। তাহলে তার জীবন হুমকির সম্মুখিন হবে। কিন্তু এখন পান্না আপুর শ্বশুর বাড়ির লোকজন একটা পুত্র সন্তানের জন্য পাগল হয়ে উঠেছে।

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ