প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

 এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

অপরাহ্ণ প্রেম
 
 

- মেহেরুন নেছা রুমা -

 
চোদ্দ বছরের বিশাল অ-দেখার পরে হঠাৎ করেই সেদিন সোহেলীর সাথে কাকতলীয়ভাবে আমার দেখা হয়ে গেল। মনের পুরনো স্মৃতিপটের ধ্বংসস্তুপ ঠেলে এক ধাক্কায় খোলসহীন ভাবে বেরিয়ে এলো আমার আঠারো-উনিশ বছর বয়সের সেই ভালো-মন্দ’য় গোল পাকানো সু:খ কিংবা দু:খময় স্মৃতিগুলো। যে স্মৃতিগুলোর সাথে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে সোহেলী। যেন খুবই কাছাকাছি কোন সময়ের ফ্রেমে বাঁধানো দুজনের একটি যুগল ছবি। যে ছবিটি আজ আমি বড় যতœ করে মেলে ধরেছি আমার মনের দুয়ারে।
দু’চাকা, তিন চাকা, চার চাকা, সব চাকাই স্থবির হয়ে আছে । পিঁপড়ের মত সারি সারি রাশি রাশি পা। পিঁপড়া তো তবু পিলপিল করে চলে; কিন্তু এই বাহনগুলো আটকে আছে তো আছেই। জট খোলার সকল সম্ভাবনাই যেন আজ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সামনে-পেছনে, ডানে-বায়ে যতদূর চোখ যায় স্থবির হয়ে থাকা বাহনগুলোকে অসহায়ের মত পড়ে থাকতে দেখা যায়। গরমে ঘামে নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে চালক এবং যাত্রীদের প্রাণ। কাঠ ফাটা রোদ। গগণবিদারী আর্তচিৎকারে প্রকৃতি গলা ফাটিয়ে মরলেও বিধাতার আকাশের কোন এক কোণে বিন্দুমাত্র মেঘের ছায়াও দৃষ্টিগোচর হয় না। শেষ কবে যে ধরণী মাতা বরষার জলে সিক্ত হয়েছিল তাও ভুলে যেতে বসেছি। একেতো আকাশ থেকে বর্ষিত হচ্ছে গণগণে আগুনের তাপদাহ, অন্যদিকে যানবাহনের ইঞ্জিনের উত্তাপে চারদিক থেকে আগুনের হুলকা ছড়িয়ে পড়ছে। দু’দিন ধরে গাড়ির শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটাও বিকল হয়ে আছে। সরকারী গাড়ি, উপরওয়ালার কখন মর্জি হয় উপরওয়ালাই জানেন। তাই যাত্রাপথে আমাকেও অসহনীয় তাপদাহ ভোগ করতে হচ্ছে।
প্রশাসনিক কর্মকর্তার ব্যবহ্র্ত গাড়ি, দেখলেই মানুষ সমীহ করে। কেউ সালাম জানায়, কারো চোখের ইশারাতেই ফুটে ওঠে বিনয়ের ভাব। কেউ বা আবার মনে মনে গালি দিয়ে রাস্তাটা ছেড়ে দেয়। এই ছেড়ে দেয়ার মাঝে কোন্টা যে সম্মান আর ক্টোা অসম্মান আজকাল সেটা আর বুঝে উঠতে পারি না। অথবা এসব নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাই না আমি।
নতুন নতুন সবকিছুতেই মানুষের কৌতুহল থাকে। আমারো ছিল একসময়। বিসিএস দিয়ে যখন এই পদটি অর্জন করেছিলাম মনে মনে ভাবতাম আমিই সবার সেরা। সবাই আমার সম্পর্কে কি ভাবছে সেটা বোঝার চেষ্টা করতাম। যখন গাড়িটিতে চড়ে রাস্তায় বের হতাম মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে মনের ভাব বুঝতে চাইতাম। এখন হাসি পায়। ভাবি, কতটা ছেলেমানুষি ভাবনা ছিল আমার। আমার মত বিসিএস ক্যাডার এখন পায়ে পায়ে ধাক্কা খায়। আর আমার চেয়েও কত যোগ্য ছেলে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে সংসার এবং সমাজে সকলের নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। ব্যথিত হই তখনি, যখন দেখি তাদের এই র্দ্বূলতার সুযোগ নিয়ে কত রাঘব বোয়াল এই অসহায় শিক্ষিত জাতিকে অন্ধকার দুনিয়ায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পরিবারের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত স্বপ্নটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে নি:শ্বেষ হয়ে যাচ্ছে।
*
বস্ কে ধরে আছি ডান কানে। সরকারী সেলফোনটাকে আমি বস্ বলি। কথা হচ্ছিল আমার উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে। সারা শরীর ঘামে ছপছপ। তৃষ্ণায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। দেহরক্ষী বুলবুলকে হাতের ইশারায় একটি ঠান্ডা পানি নিয়ে আসতে বললাম। গাড়ি থেকে নেমে সে দৌঁড়ে গেল পাশের দোকানটিতে। এদিকে যানজটের নিরসন কখন হবে সেই আশায় বসে থাকলে আমার যে সময় নষ্ট হচ্ছে সেটা চালক কে বুিঝয়ে দিচ্ছি হাতের ইশারায় । কোনকিছু বিস্তারিত বুঝিয়ে না বললে সে আবার কিছু বুঝে না। তাই সেলফোনটা নামিয়ে রেখে ধমকের সুরে বললাম, ‘সহজ কথা বোঝো না? বলছি না গাড়ি ঘোরাও?
নির্দেশনা দিচ্ছি কিভাবে উল্টো পথ দিয়ে বে-আইনি ভাবে চলে যাওয়া যায়।
আইনের লোক বে-আইনি কাজ করলে তেমন কিছু যায় আসে না। এ ধরনের কিছু মন্ত্র এ পেশায় আসার পরে আমি রপ্ত করেছি। মন সায় না দিলেও কখনো কখনো এমন ছোট খাটো বে-আইনি কাজ আমাকে করতে হয় । এখন আর কাজগুলোকে তেমন বে-আইনি বলে মনে হয় না। মনে হয় আমার প্রয়োজনেই আমি সবকিছু করছি। অনিয়মটাই হয়ে গেছে এখন নিয়ম।
‘‘সময়ের সাথে সাথে মানুষের প্রয়োজনও বদলায়’’। আমারও বদলেছে অনেক কিছু। সময় আমাকে নিয়ে যাচ্ছে বহুদূর। সময়ের স্রোতে আরো বহুদূরে আমার যাওয়ার ইচ্ছা!
ধমকটাকে হজম করে চালক কৌশলে গাড়ি ঘুরিয়ে ভুল পাশ ধরেই এগিয়ে চলল আমাকে নিয়ে। পানির বোতল হাতে নিয়ে বুলবুল দৌঁড়ে এসে গাড়িতে উঠলো। বস্ আবারো বেজে উঠলে ঠান্ডা পানিতে গলা ভিজিয়ে ফোনটা রিসিভ করলাম। কথা চলছে, গাড়ি চলছে।
সরকারী ফোনটি আমার হাতেই থাকে। আর ডার্লিং থাকে বুক পকেটে। ব্যক্তিগত ফোনটিকে আমি ডার্লিং বলি। এই বস্ এবং ডার্লিংয়ের যন্ত্রনায় মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে সব ছেড়ে ছুড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাই। কেন যে দুনিয়াতে মোবাইল ফোন আবিস্কার হলো! অতীষ্ট হয়ে কিছুক্ষণ আগে ডার্লিংকে নিরব করে রেখেছিলাম । অনেক জরুরী কাজের মাঝে যখন রূপা ফোন দেয় ফোনের লাল বাটনে জোরে চেপে ধরি। ব্যাপারটাকে মনে হয় যেন কারো আচরণে বিরক্ত হয়ে গলা টিপে ধরেছি। উপায় নেই। সেটাতেও আজ বারবার কল আসবে। আজ নয়, প্রতিদিনই আসে। আজকের উল্লেখযোগ্য সমস্যা হল মেয়েটার প্রচন্ড জ্বর। সকালে তাপমাত্রা ছিল একশ তিন। এরই মধ্যে রূপা অন্তত পনের বার ফোন করেছে । মৌটুসীর জ্বর কিছুতেই নামছে না । কাশিটাও বেড়েছে। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হল অসুখে পড়লেই মেয়েটা সারাদিন ঘ্যানর ঘ্যানর করে বাবা বাবা ডাকতে থাকে। আগে যখন কথা বলতে পারতো না তখন শুধু বা বা বা বলতো। এখন ওর মায়ের মাথাটা খারাপ করে দেয়। বলতে থাকে বাবাকে আসতে বলো, বাবা কখন আসবে, বাবার কাছে যাবো।
আমার ব্যস্ততা সম্পর্কে রূপা জানে এবং বুঝেও । কিন্তু মেয়েটাকে শতবার বোঝালেও তার গান সে গাইতেই থাকে- বাবাকে আসতে বলো। পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ে, সে কেমন করে বুঝবে তার বাবার উপর রাষ্ট্রের কত দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে। তবুও রূপার জেদ-কেন সে বুঝে না। শেষে মেজাজ চড়ে গেলে অসুস্থ্য মেয়ের গালে কষে একটা চড় এঁকে দিয়ে রূপার জেদে কুয়াশা পড়ে। সেই জেদের কিছুটা অংশ তখন আমার উপরও এসে পড়ে; মহান এই মোবাইল ফোনের কল্যাণে।
রূপার সমস্যার কথা কয়েকবারই শুনতে হয়েছিল । এরপর কল আসার সাথে সাথেই দিলাম ঝাড়ি-কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করোনাতো রূপা । অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারো না? কচি খুকি তো নও। বাচ্চার মা হয়েছো তো বাচ্চাকেও সামলাতে জানতে হবে। দেখছো না আমার অতো সময় নাই? বলো তো চাকরী বাকরী ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে সংসার আর বাচ্চা সামলাই, আর তুমি রোজগার করে সংসার চালাও।
আমার অমন ব্যবহারে রূপা ফোন কেটে দেয়। ঠিক শুনতে পাচ্ছিলাম তখন সে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে ছিল, আর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ভেজা চোখের পাতা শুকাতে চেষ্টা করছিল। তখন একটু খারাপ লাগছিল রূপার জন্য। পরক্ষণেই কাজের চাপে কখন যে সেই খারাপ লাগাটা হারিয়ে গেল বুঝতে পারিনি।
মৌটুসীর জন্য বড় চিন্তা হয়। জন্মের সাথে সাথেই মেয়েটি একটি সমস্যা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তার রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমান কম। আর তাই রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও কম। মাসের বিশ দিনই ধরতে গেলে সে অসু¯্য’ থাকে। তার উপর মেয়েটির চোখেরও সমস্যা।
কোন কিছুর সিদ্ধান্ত রূপা একা নিতে পারে না। তারই বা দোষ দিয়ে লাভ কি । এমন অনেক বিষয় আছে যা শুধু তার একার সিদ্ধান্তে করতে গেলে কাজটি প্রায়শ:ই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বেশ কয়েকবারই এমনটি হয়েছে । কোন কিছু উল্টা পাল্টা করে ফেললে আমার রাগের মাত্রা আরো বেড়ে যায় । তখন বলি, একটা কাজ ঠিকমত করতে পারো না? কাজটি করার আগে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারলে না? মাথায় কি মোটেও ঘিলু টিলু নাই নাকি ? আমার এমন আচরণ রূপার মনোবলকে আরো বিধ্বস্ত করে দেয়। আমিও নিজের ভুল বুঝতে পারি। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে কিছুতেই মন মেজাজ স্বাভাবিক রাখতে পারি না। এরকম ব্যবহারে রূপা অন্তত তিনদিন গাল ফুলিয়ে থাকে। সবই বুঝতে পারি। কিন্তু করার কিছুই নাই । চাকরিটাই এমন বেরসিক, প্রিয়জনদের মোটেই সময় দিতে পারি না। প্রিয়জনদের মনের সাথে মন মিলিয়েও চলতে পারি না।
*
রূপা একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে । চাকরীর পাশাপাশি সংসার নামক প্রতিষ্ঠানটিরও একক কর্ণধার সে। রূপার বৃদ্ধ মায়ের দায়িত্বও তার উপর। তার একমাত্র ভাই বিয়ে করে আলাদা জগৎ সংসার সাজিয়েছে। সেই জগতে রূপার মায়ের জায়গার সংকুলান হয়নি। তাই ঠাঁই হয়েছে আমার ঘরে। যদিও আমার ঘরে আমার মায়েরও সংকুলান হয়নি এক সময়। এখন তো এই পৃথিবীতেই আমার মায়ের জায়গার সংকুলান হয়নি। সেই কবে আমাকে মাতৃহীন করে দিয়ে ওপাড়ে চলে গেছেন!
এতকিছু সামলে কখনো কিছু ভুল ভ্রান্তি তো রূপার হতেই পারে। তবুও আমার মেজাজ বিগড়ে যায় যখন ঘরের সমস্যাগুলি আমার কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর বাজে। তাদের জন্যতো অনেক কিছুই করতে ইচ্ছা করে আমার; কিন্তু পারি না বলেই হয়তোবা আমার মেজাজটা চড়ে যায়। কষ্টটা চেপে রাখি নিজের ভেতরে। শুধু ধোঁয়াটা দেখে তারা। তাদের কাছ থেকে আমি শুধু স্বার্থপরের মত ভাল খবরটাই শুনতে চাই। অথচ ‘‘দুনিয়াটা হল সেই জায়গা, যেখানে ভালোর পাশাপাশি মন্দেরও সহাবস্থান। ঠিক গোলাপের সাথে যেমন কাটা’’।
পরে যখন মাথা ঠান্ডা হয় রূপাকে ফোন করে দু:খ প্রকাশ করি। সে তখন খুশি হয়ে যায় । খুশি হয়ে আবার রাজ্যের সমস্যা পেশ করতে থাকে। “সংসারটাই হল তার রাজ্য । আর এটি এমন একটি রাজ্য, যার সমস্যার শুরু আছে; কিন্তু কখনো শেষ নাই ।”
আট বছর বিবাহিত জীবনে এক নাগারে একটা বছর বউয়ের সাথে থাকা হয়নি আমার। নিজের ঘরে সর্বদাই আমার অবস্থান একজন মেহমানের মতো। কিছুদিন পর পর বদলি। আজ রাজশাহী তো কাল সিলেট । আমার জন্য ওদের টানা হেচড়া হোক সেটা আমি কখনো চাইনি। আর চায়নি রূপাও। রূপার চাওয়াটাকে প্রাধান্য দিতে যেয়েই আমি আজীবন এক ‘বিবাহিত ব্যাচেলর’। রূপার পোষ্টিং আর বাচ্চাদের পড়াশুনা ঢাকাতেই। আমি আজ এখানে তো কাল ওখানে। এভাবে বছরগুলো পার করছি। মাঝে মাঝে মন চায় সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাই । কিন্তু পারি না । সে রকম ভাবনারও সময় কোথায়।
আমি ছিলাম নিতান্তই শান্ত প্রকৃতির ছেলে । অভাবের সংসারে বড় হওয়া, খেয়ে না খেয়ে থাকা একজন মানুষ; যার স্বপ্ন ছিল শুধু প্রতিষ্ঠিত হয়ে জীবনের দৈন্যদশা থেকে মুক্তিলাভ। আর এর একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে আমি ‘লোখাপড়া’কেই গ্রহন করেছিলাম। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম- ‘ঘুম থেকে উঠেই পড়তে বসা, আর পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়া’। আড্ডা, ঘুরাফেরা এসবও করিনি। মদ, গাঁজা, সিগারেট পর্যন্ত ছুয়ে দেখিনি। হলে থেকেছি, কত মিছিল মিটিং আন্দোলন বিক্ষোভ চোখের সামনে দেখেছি, কখনো একটা শ্লোগান ভুলেও উচ্চারণ করিনি। রুমের অন্যরা যখন রাত জেগে মোনাজাতের ভঙ্গিতে তাসে ডুবে থাকতো, আমি তখনো বইয়ের পাতায় নিমগ্ন থেকেছি। কখনো কোন সভা-সেমিনারে উঁকিও মারিনি। কোন নারীকে দু’ লাইন চিরকুট লিখে কিংবা একদিন কফিশপে পাশাপাশি বসে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুকও দিয়ে সময় নষ্ট করিনি। সিনেমা হলের সামনে দিয়ে যতবার আসা যাওয়া করেছি বাইরের লাগোয়া পোষ্টার দেখেই সিনেমা দেখার স্বাদ মিটিয়েছি। কোন নারী সঙ্গ পাইনি বা পাওয়ার চেষ্টাও করিনি। প্রেম ভালোবাসাকে মনে হয়েছে জীবনের বিলাসিতা । নারীই বা পাবো কোথায়? আমারতো সেই কপালই ছিল না। হয়তো আমাকে দেখে কোনকালে কোন নারীর নষ্ট করার মতো সময়ই হয়নি। আর যে ছেলে শুধুমাত্র বইয়ের ভাজে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে, তাকে কোন মেয়ে পছন্দ করতে যাবে কোন্ দু:খে? স্বপ্ন ছিল একটাই- আমাকে কিছু একটা হতেই হবে। লেখাপড়া দিয়েই জীবনে যা কিছু সম্ভব অর্জন করতে হবে। এটাই ছিল আমার একমাত্র যোগ্যতা আমার অবলম্বন আমার সম্বল আর আমার সম্পদ। আর আমি তাকেই বাঁচিয়ে রেখেছি অন্য সবকিছুকে বিসর্জন দিয়ে।
মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েই প্রথম বার বিসিএস দিলাম। দয়াময়ের কৃপায় রাস্তাটা আমার কাছে মসৃণভাবেই ধরা দিয়েছিল। একবারেই হয়ে গেলাম প্রথম শেণির একজন সরকারি কর্মকর্তা। যা হবার স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই ছাত্রাবস্থায়। আমার প্রথম পছন্দ ছিল ‘প্রশাসন’। হয়েও গেল তাই। উপরে ওঠার সিঁড়ি পেয়ে গিয়েছিলাম। তাকে আকড়ে ধরেছি খুব শক্ত করে। এই সিঁড়ি দিয়েই আমাকে আরো উঠে যেতে হবে। এর শেষ পর্যন্ত যেতে হবে আমাকে ।
“জীবনের লক্ষ্য যদি স্থির থাকে, আর সেই লক্ষ্য পূরণে যদি স্বপ্ন এবং সাধনা থাকে, তাহলে একদিন না একদিন লক্ষ্য পূরণ হবেই।”
নিজেকে শিখরে দেখার স্বপ্ন নিয়ে চলতে গিয়ে ক্রমশই আমি আমার প্রিয়জনদের থেকে বিচ্যূত হয়ে যাচ্ছিলাম। তবুও ভেবেছিলাম দুনিয়াটাই বুঝি এরকম। আমার যা পাওয়ার তাতো আমি এমন করেই পাবো। তবুও মাঝে মাঝে বড় একা লাগতো। যখন একলা ঘরে বিছানায় এপাশ ওপাশ করেও হাতের নাগালে কোন একটি প্রাণীর স্পর্শ পাইনি আমি। যখন আমার একাকিত্বের সুযোগে মধ্যরাতের দেয়ালে একজোড়া টিকটিকি যুগলপ্রেমে মত্ত হয়ে আমাকে লেজ নেড়ে প্রহসন করত। যখন বাইরের সুপাড়ি বাগানে একজোড়া বাদুড়ের পাখা ঝাপটানির শব্দ শুনতাম, তখন ওদের কাছেও আমি বড় অযোগ্য আর হতভাগা বলে প্রমাণিত হতাম। মনে হতো পৃথিবীতে আমার মতো একা আর কেউ নেই। সবই আছে; তবু কোথাও কেউ নেই।
দায়িত্বে অবহেলা করি না বলে আমার পদোন্নতিও হয়ে যাচ্ছে ঠিকঠাকমত। জীবনের এই পর্যায়ে এসেই নিজেকে নিয়ে আমার গর্ব করতে ইচ্ছা করে। খুব ছোট ঘর থেকে এসেছিলাম বলেই হয়তো সবকিছুতে আমি একটু বেশিই খুশি হই। নিজের ভেতরের অহংকারটাও তাই অন্য সবার থেকে একটু বেশিই অনুভব করি।
যখন গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাই দূর দূরান্ত থেকে কত লোকজন আমাকে এক নজর দেখতে এসে ভীড় করে। কত জনের কত সমস্যা আমাকে শোনানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। যেন সবার সকল সমস্যার সমাধান শুধু আমার কাছে। আমিও যথাসাধ্য মানুষের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করি।
কত জনবল আমার নির্দেশনায় কাজ করে। সামনে দিয়ে কেউ গেলে সম্মান করে সালামটা দিতে ভুল করে না। আসলে এটা কি আমাকে সম্মান জানানো? নাকি আমার পদ মর্যাদাকে ? এটাকি সম্মান, নকি ভয়, নাকি তোষামোদি? মাঝে মাঝে ঠিক বুঝি না। মাঝে মাঝে নিজেকে খুবই একা লাগে। এত সম্মান এত তোষামোদী বড় বেশি বাড়াবাড়ি মনে হয়।
*
গাড়ির জট ছাড়ল। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে গন্তব্যে। কেন যে এত অঘটন ঘটে প্রতিদিন। একই দেশ মাতৃকার সন্তান এই মানুষ আমরা, অথচ মানুষে মানুষে কত শত্র“তা!
সরকারী ফোনটা বেজে উঠলো। কথা হচ্ছিল আমার উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে। স্যারের সাথে কথা শেষ হতেই পকেটের সাইল্যান্ট করা ফোনের নীল আলো চোখে পড়ল। ডার্লিং ডেকে ডেকে ক্লান্ত বিরক্ত। বের করে দেখি রূপার নয়টি কল। এখনি কথা না বললে রেগে মেগে আগুন হয়ে যাবে । ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করতে যাব এরই মধ্যে ঘটল বিপত্তিটা।
এত বছর পরে এত পথ ঘুরে সৃষ্টিকর্তা কোন্ রহস্যের বেড়াজাল ভেদ করতে আজ এই মধ্য দুপুরে এই অচেনা শহরে পুরাতন দুজন মানুষকে মুখোমুখি করে নতুন একটি অধ্যায়ের জন্ম দিতে পারলেন!
পাশের কালো রঙের একটি গাড়ির চালকের আসন থেকে মাথা বের করে একটি মেয়ে আমাকে হাতের ইশারায় কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। বিষয়টা দেখতে যেয়ে হাতের মোবাইলটি আনমনে হাতেই রইল। রূপাকে আর ফোন করা হল না।
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করলাম। আমাকে গাড়ি থামানোর জন্য বলছে সে । রাস্তার মাঝখানে এমন করে কে ডাকছে আমাকে! তাও এই অচেনা শহরে । এখানে বদলি হয়ে এসেছি খুব বেশিদিন তো হয়নি । চেনা জানা মানুষ তো কেউ নেই আমার।
মনে মনে ভাবছি মেয়েটি কি কোন বিপদে পড়েছে? সরকারী গাড়ি দেখে সাহায্য চাইছে?
কালো গাড়িটি একটু এগিয়ে গিয়ে আমার গাড়ির সামনে গতিরোধ করলো। রহস্য আরো ঘনীভূত হয়ে উঠলো। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল, স্যার গাড়ি কি থামাবো?
আমি বললাম, হ্যা, রাখো তো একটু। দেখি ব্যাপারটা কি।
আমার গাড়ি থামাতে থামাতে সামনের গাড়িটি থেকে নেমে এলো মেয়েটি। এ যেন শুধু নেমে আসা নয়, যেন লক্ষ কোটি যোজন মাইল দূরত্বের কোন ভিনগ্রহ থেকে আবির্ভূত হলো এক মহাজাগতিক রশ্মি । যে রশ্মিতে আমি মুহূর্তেই আলোকিত হয়ে উঠলাম।
মেয়েটি এগিয়ে আসলো আমার দিকে। এবার সে একেবারে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। বিষ্ময় প্রকাশের সমস্ত অভিব্যক্তি আমার দুনিয়া থেকে উধাও হয়ে গেল। অবাক করা দৃষ্টি আমার আটকে গেল সামনের মানুষটির উপর। নিজের চোখকেও অবিশ্বাস করতে মন চাইলো।
স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন?
কে যেন,(মনে মনে)। একটু হেসে নিজের মাথার চুলের মধ্যে ডান হাতের আঙুলগুলো চালান করে দিয়ে বললাম, ঠিক মনে পড়ছে না। তবে কোথায় যেন দেখেছি আপনাকে। বলুন তো কে আপনি? আমিকি আপনাকে চিনি?
স্যার, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? মেয়েটার চোখে দুনিয়ার বিষ্ময় ।
সরি, আসলে আমি...
প্রথমে আমি ঠিকই চিনতে পারিনি। পারবোই বা কিভাবে? এত বছর পর দেখা। এখন ঠিকই মনে পড়েছে । তারপরেও বললাম, আপনি কি আমাদের ডিপার্টমেণ্টর কেউ? কোথায় যেন দেখেছি বলুন তো?
আমার কথা শুনে সে একেবারে বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। আমি তাকে এমন করে ভুলে যাব এটা সে ভাবতেই পারেনি । আমার এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তারপরেও আমি তাকে চিনতে পারছি না। তার চোখ দেখে মনে হল আমি চিনতে পারিনি বলে সে একটু অভিমানও করেছে।
স্যার, আমি সোহেলী । আমাকে সত্যি চিনতে পারছেন না? আপনার ছাত্রী ছিলাম। আপনি তখন বিএম কলেজে পড়তেন। বিএম কলেজ মনে আছে তো স্যার? নাকি সেটাও ভুলে গেছেন?
আরে না। কি যে বলো না তুমি ? এবার আমি ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে এলাম। তারপর বললাম, ওটা আমার সবচেয়ে স্মৃতিময় বিদ্যাপীঠ । তাকে কি সহজে ভুেল যাওয়া যায় বলো?
স্যার, সত্যি আমাকে আপনার একটুওু মনে নেই? তিন তিনটি বছর আপনার কাছে পড়েছি। সবকিছু কি এত সহজে ভুলে যাওয়া সম্ভব?
ওহ্ হ্যাঁ । মনে পড়েছে । দেখ কি কান্ড। প্রথমেই না চেনার জন্য আমি দু:খিত সোহেলী। কেন যে চিনতে পারলাম না। আর চিনবো ই বা কি করে। তখন তুমি ছিলে এই একটুসখানি। এখন তো মাশ্আল্লাহ্ । তুমি তো অনেক বদলে গেছ।
বদলে গেছি স্যার? কেন আমি কি আগের মত সুন্দর নেই?
ওর কথায় আমি হতচকিত হয়ে গেলাম। আমি কি বলছি আর মেয়েটা কিভাবে ভাবছে।
আরে সেটাতো বলিনি। অবশ্যই সুন্দর আছো তুমি। আগেরও চেয়েও বেশি। আর তাই তো চিনতে কষ্ট হল।
এবার সোহেলীর মুখে হাসি। (জগতের সব মেয়েদেরই মনে হয় সুন্দরের প্রশংসা শুনলে মুখে হাসি ফুটে)
স্যার অনেক খুঁজেছি আপনাকে। সেই যে চলে গেলেন আর কোন দিন যাননি আমাদের ওখানে। কতজনের কাছে খোঁজ নিয়েছি । কেউ বলতে পারল না আপনি কোথায় আছেন। আমি যতবারই বরিশাল গিয়েছি আপনার একটু খোঁজ নেয়ার জন্য অনেকের কাছে ছুটে গিয়েছি। সাত আট বছর আগে আপনার এক বন্ধুর সাথে দেখা হলে সে বলেছিল আপনি বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন। আপনি দেশের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়েছেন শুনে খুব আনন্দিত হয়েছিলাম । তখন আপনাকে আরো দেখতে ইচ্ছা করছিল স্যার। কিন্তু যোগাযোগ করার মত কোনকিছুই পাইনি। বছর দুয়েক আগে আমি একবার কুয়াকাটা বেড়াতে যাই। তখন পটুয়াখালী জেলার উপর দিয়ে যেতেই আমার মনের ভেতর এক ধরনের কম্পন অনুভব করি এই ভেবে যে, এই তো আমার স্যারের জন্মস্থান। যতক্ষণ ওই শহরটা পাড়ি দিচ্ছিলাম আমার দুচোখ শুধু আপনাকে খুঁজতেছিল। তারপর দেশের যে প্রান্তে যখনি গিয়েছি মনে মনে আপনাকে কত খুঁজেছি। এই ভেবে যে সরকারী কর্মকর্তা আপনি, কত জায়গায়ই তো পোস্টিং হতে পারে। সৃষ্টিকর্তা এতদিন পর আজ আমার মনের ভাবনার অবসান ঘটালেন। আপনার সাথে সাক্ষাৎটা ঠিকই ঘটিয়ে দিলেন।
আমি অভিভূত হয়ে শুনছিলাম সোহেলীর কথাগুলো । আমাকে নিয়ে তার এমনতর ভাবনা! তাও এতদিন ধরে, যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু অবিশ্বাসেরও কোন সুযোগ ছিল না। কেননা ওর চোখে মুখের উচ্ছাসই জানিয়ে দিচ্ছিল আমাকে পেয়ে তার মনের অবস্থা কিরকম। আমাকে পেয়ে এমনভাবে আনন্দে টগবগ করতে থাকলো যেন দুনিয়াটা উদ্ধার করে ফেলেছে। ওর অমন আবেগী মনের আকুলতা আমাকেও আক্রমণ করছিল। কেননা কেউ এমন করে আমাকে মনে করে এটা আমি ভাবতেই পারিনি কখনো। তাহলে আমিও কারো মনের মাঝে বসবাস করি। কারো কাছে আমারো মূল্য আছে। তাও এতকাল ধরে একই রকম! কেননা আমি সোহেলীর চোখে সেই চোদ্দ বছর আগের রংটাই সেদিন অবিকল দেখতে পাচ্ছিলাম। যে চোখের বাঁধনে ধরা পড়েও একদিন আমি পালিয়ে এসেছিলাম জীবন আর বাস্তবতার কাছে হার মেনে।
আমি বললাম, হ্যাঁ তোমাদের বাড়িতে যেয়ে একবার দেখা করাটা আমার উচিৎ ছিল । কিন্তু সেই যে ঢাকা চলে আসি তারপর জীবনটা এত যান্ত্রিক হয়ে ওঠে যে খুব স্বাভাবিক কাজগুলোও আমার আর করা হয়ে ওঠেনি। লেখাপড়া শেষ হতেই চাকরীটা পেয়ে গেলাম। তারপরতো এটা ধরেই দেশের নানা জায়গায় বসবাস করছি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে কখনো কখনো নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি। এত জেলায় ঘুরেছি তবু বরিশাল আমার আর যাওয়া হয়নি। মা মারা যাওয়ার পরে পটুয়াখালীও তেমন একটা যাই না।
আমার কথা রাখো, এখন বলো তোমার খবর কি? কোথায় আছো কি করছো কেমন আছো?
গাড়ির হর্ণ এবং পায়েচলা মানুষের ভীড়ে আমাদের কথাবার্তা বারবারই পথচ্যূত হয়ে যাচ্ছিল। সোহেলী বলল, আমি ভালো আছি। তারচেয়ে বেশি জানাটা জরুরী হলো আপনি কেমন আছেন?
আমি একটু হাসলাম। মুখে কিছুই বললাম না। সেই না বলার মাঝেই সে বুঝে নিল আমার ভালো থাকা। তারপর বললাম, কিছু মনে করোনা সোহেলী আজ আমার অনেক ব্যস্ততা। তোমার সাথে পরে কথা হবে। এরই মধ্যে আমার সরকারী ফোন বেজে উঠলে বললাম, আসলে এই চাকরীতে নিজের জন্য কোন সময় নেই বুঝলে? আমি হচ্ছি রাষ্ট্রের একজন গোলাম মাত্র।
কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সোহেলী মাথাটা একটু নিচের দিকে নামিয়ে বলল, স্যার আপনি ঠিক হাদারামই রয়ে গেলেন।
আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলাম কথাটি কেউ শুনল কিনা। ভেতরটা কেঁপে উঠল । একটু লজ্জাও পেলাম।
এ শব্দটি জীবনে অনেক বছর আগে সোহেলীই বলেছিল আর একবার। আজ সে আবারো সেই কথাটিই বলল। আমি কিছু বলতে পারলাম না। ওর কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। বুঝতে পারলাম, সোহেলী ততক্ষন তাকিয়ে ছিল যতক্ষন আমাকে দেখা যায়।
কিছুদূর আসার পর মনে হল সোহেলী কোথায় থাকে কি করে তাও জানা হল না। আমার ভিজিটিং কার্ডটাও দিতে পারতাম। সেটাও দিলাম না। তাকে দেখার পর সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। ওর ফোন নম্বরটিও নেয়া হলো না। আর কি আমাদের দেখা হবে?
হঠাৎ করে আমার মনে এমন একটা ভাবনা কেন যে উদয় হলো বুঝলাম না। ওর সাথে আবার দেখা হোক সেটাকি আমি চেয়েছিলাম? যদি চেয়েই থাকি তবে কেন চেয়েছি? দেখা হওয়াটা যদি এতটাই জরুরী ছিল তবে এতকাল কেন দেখা হলো না?
শহরের কোলাহলপূর্ণ রাস্তা ছেড়ে গ্রামের দিকে যেতে যেতে মনে পড়ে গেল সেসব দিনগুলোর কথা।
*
এসএসসি তে ঝমকালো রেজাল্টের পর আমি বরিশাল বিএম কলেজে ভর্তি হই। তখন বিএম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ছিল । এখন নাই। এখন সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। আমার মত দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি স্টুডেণ্টেরই বিএম কলেজে পড়ার একটি স্বপ্ন থাকতো।
সংসারের অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল ছিল না বলে আমি পড়াশুনার পাশাপাশি টিউশনি করতাম। এটা আমার পেটের ক্ষুধা আর মনের ক্ষুধা নিবারণ করত। পড়াটাই ছিল আমার মনের ক্ষুধা। এর জন্য আমি সবকিছু করতে পারতাম।
নিজের পড়া এবং অন্যকে পড়ানোর ব্যাপারে আমি কখনো অমনোযাগী ছিলাম না বলেই রাতারাতি আমার অনেক টিউশন জুটে যেত। একবার কাউকে পড়ানো শুরু করলে সেই স্টুডেণ্ট আর ছাড়ানো যেত না সহজে। এভাবে বেশ ভালোই চলছিল আমার জীবন যাপন। বাড়ি থেকে আমার জন্য টাকা পাঠানোর প্রয়োজন হত না, বরং মাস শেষে আমার সঞ্চিত অর্থ থেকে মায়ের জন্য এটা ওটা কিনে নিয়ে যেতাম। সামান্য কিছু হলেও সেসব দেখে মা যে কী খুশিই না হতেন ।
সোহেলী তখন ক্লাস নাইন এর ছাত্রী। ব্যাবসায়ী বাবার একমাত্র মেয়ে ছিল সে। আর ছিল তার ছোট একটি ভাই। ক্লাস নাইন থেকে এসএসসি পর্যন্ত তিন বছর ওকে আমি পড়াই। এসএসসিতে বেশ ভাল ফলাফল করেছিল সোহেলী। আমাকে বরাবর বলত, স্যার আপনার জন্যেই আমার এই রেজাল্ট। আগে তো আমার মাথায় কিচ্ছু ছিল না। আপনি কত কি শিখালেন । আমি হাসতাম । বলতাম, কথা কম বলে পড়ায় মন দাও। কাজে লাগবে। আমাকে কেউ সামনা সামনি প্রশংসা করুক কেন জানি সেটা শুনলে আমি অস্বস্তিতে পড়ে যেতাম। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইতাম।
আমি প্রায়ই খেয়াল করতাম সে মাঝে মাঝে কি রকম অন্যমনস্ক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর সেই তাকানো দেখে আমার হ্্রদয়টা প্রবল বেগে আলোড়িত হয়ে উঠতো। আমি ভয় পেতাম। ইচ্ছা করতো প্রহরের পর প্রহর ওই চোখের গভীরে ডুব দিয়ে হারিয়ে যাই, আবার নিজে থেকেই নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতাম। যাতে সোহেলী আমার মনের অবস্থা পড়ে না ফেলে। কেননা আমি কখনো তার কাছে ধরা দিতে চাইনি।
আমাকে নিয়ে সোহেলীর আগ্রহের কমতি ছিল না। ঘরে কোন ভাল খাবার থাকলে এনে আমাকে দিত। আমি খেতে চাইতাম না। না খেলে খুব রাগ করত। আমি যেন তার কথা শুনতে বাধ্য।
একবার আমার জন্মাদিনে দেখি সে বিরাট আয়োজন করে বসে আছে। আমার জন্য নতুন শার্ট, প্যাণ্ট, কলম, ডায়েরী, ফুল আরো কত উপহার এনে টেবিলে জড়ো করল। দেখে তো আমার মন ভরে গেল। অভাবের সংসারে বড় হয়েছি। জন্মদিন নিয়ে কেউ কখনো মাথা ঘামায়নি । আর সোহেলী, যে কিনা আমার সম্পর্কে কিছুই হয় না, সে আমার জন্মদিনটিকে একটি উৎসবের দিন হিসেবে পালন করছে! অভিভূত হলেও ভাবলাম তার এসব কাজকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। আমি যে তার শুধু একজন শিক্ষক, এই ধারনা তার মাথা থেকে সরতে দেয়া যাবে না। তাতেই উভয়ের জন্য মঙ্গল। এরপর সোহেলীর মা যখন খাবার টেবিলে ডাকলেন আমি তো অবাক । দুনিয়ার আয়োজন করে বসে আছেন আন্টি। বললাম, এত কিছু কেন আণ্টি ?
আন্টি বললেন, আজ তোমার জন্মদিন, তোমার জন্য আমরা কি এটুকু করতে পারি না? তোমার মা কাছে থাকলে সে কি করতো না? বাবা-মার কাছ থেকে দুরে থাকো তুমি । তোমাকে তো আমি আমার ছেলের মতই দেখি বাবা। আর এসব আয়োজন এই সোহেলীর জন্যই করা। সেতো কতদিন থেকে আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল, স্যারের জন্মদিনে এটা করবে ওটা করবে।
আমি একবার সোহেলীর দিকে তাকালাম। কেন জানি ওর উপর আমার খুব রাগ হচ্ছিল তখন। মনে হলো মেয়েটা আমাকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি না করলেও পারত? কি দরকার ছিল তার মাকে এতকিছু বলা এবং তাকে কষ্ট দেয়ার? মন চাইল তখনি সব ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি । কিন্তু তার মায়ের কথা ভেবে তা করতে পারলাম না। সে কত আন্তরিকতার সাথে কতকিছু করেছেন। আণ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের মায়ের মুখটি মনে পড়ে গেলো।
চুপচাপ একটু খেয়ে নিলাম। তারপর পড়ার টেবিলে আর ফিরে না গিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন সোহেলীর সাথে আর একটি কথাও বললাম না। কেন যে এতটা করেছি তা আমি নিজেও বুঝতে পারিনি । আমার ভেতরটা খুব অস্থির লাগছিল । কি করতে হবে তাও বুঝতে পারছিলাম না। ভাল লাগা নাকি মন্দ লাগা। তাকে প্রশংসা করা নাকি শাসন করা। অত:পর কোনকিছু না করেই বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক সেদিক হাঁটতে থাকলাম।
পরদিন পড়াতে যেয়ে দেখি চোখ মুখ লাল করে বসে আছে সোহেলী। আমি তেমন পাত্তা দিলাম না । খাতা খুলে অংক নিয়ে বসলাম। সোহেলী রাগে অভিমানে ফোঁস ফোঁস করছিল। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম তার মনের তোলপাড় কিসের জন্য । কিন্তু প্রকাশ করলাম না। বললাম, তোমার সামনে পরীক্ষা, পড়ায় মন দাও। সময় নষ্ট করছ কেন সোহেলী ?
সে চুপচাপ খাতা খুলে অংক নিয়ে বসল। কিছুক্ষন পর দেখি টপ টপ করে পানি পড়ছে খাতার উপর। দেখলাম সে কাঁদছে।
কি হয়েছে সোহেলী, কাঁদছো কেন ? অংক বুঝতে পারছ না ?
মাথা নেড়ে জবাব দিল, পারছি।
তাহলে কাঁদছ কেন?
চোখ মুছে বলল, মন চায় । তাতে আপনার কি ?
কিছুটা রাগান্বিত, কিছুটা অহংকারী, কিছুটা অভিমানী সুরে আমার দিকে কথাটা ছুড়ে মারল সে। বুঝতে পারলাম, গতকালের ব্যবহারে সে কষ্ট পেয়েছে। তার উপর তার দেয়া উপহার গুলো আমি না নিয়েই চলে গিয়েছিলাম। তখন তার জন্য আমার একটু খারাপ লাগছিল। কিন্তু নিজেকে সংযত করলাম। আমার ভেতরের অভিব্যক্তি আমি কোনদিনই তাকে বুঝতে দেইনি। সেটা আমার দোষ নাকি গুন তা আমি আজও বলতে পারি না।
সোহেলী একটু পর লেখা বন্ধ রেখে হতের নখ খুটতেছিল। জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার লিখছ না যে।
কোন কথা বলে না। কি বিপদ রে বাবা! ছাত্রী পড়াবো, টাকা নেব। তা কিনা কি সব ঝামেলার মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছি। এসব করলে তো আমার টিউশনিটা যাবে দেখছি। তখন প্রায়ই সোহেলীর উদ্ভট কিছু আচরণ আমার চোখে পড়তো। যেমন অল্পতেই খুশি হয়ে যাওয়া, আবার অল্পতেই রেগে যাওয়া, কান্না করা। কখনো দেখতাম কোন উপলক্ষ্য ছাড়াই অতিরিক্ত সাজগোজ করে বসে আছে। কখনো আমাকে দেখলেই বলতো আজ আমি পড়বো না স্যার, আপনার সাথে গল্প করবো। আবার মাঝে মাঝে খুবই এলোমেলো থাকতো। যেন মহাকালের কোন দুর্যোগ এসে ওদের ঘর থেকে চিরুণী নামক পদার্থটিকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে এমন।
এমনি করে সোহেলীর এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। প্রায়ই সে নানা ধরনের কথা আমাকে বলতো। যতই বোকা হই না কেন সেসব কথার মর্মার্থ আমি যে একেবারেই কিছু বুঝতাম না তা নয়। কিন্তু ভয় পেতাম আমি। আর তাই বুঝেও না বোঝার ভান করতাম। ওর পাগলামীগুলো মনে মনে ঠিকই উপভোগ করতাম। ভাবতাম এর চেয়ে বেশি কিছু হলে যদি এটুকুও হারিয়ে যায়!
তার আবেগী মনের অভিব্যক্তিগুলো বুঝেও কাঠিণ্য বজায় রেখে শুধু লেখাপড়ার কথাই বলতাম। তখন সে খুব মন খারাপ করত। একদিন দেখলাম খাতার মধ্যে লিখে রাখছে, ‘আমার স্যার একটা অন্ধ’। লেখাটার পাশে আমার মত একজন মানুষের মুখের আদল এঁকে চোখের উপর কালো চশমা এঁকে দিয়েছে। দেখে আমার হাসি আসছিল। কিন্তু ভাবটা এমন করেছিলাম যেন ওটা আমি দেখিই নি। কিন্তু মনের ভেতর অন্য একটা অনুভূতি টের পেলাম। কিছুটা সুখের কিছুটা কষ্টের মিশ্রণ। মনে হল একটা মায়ায় পড়ে যাচ্ছি আমি। কেন এমন মায়া হল ওর জন্য! ‘আমি যে কেন অন্ধ তা তো সে বুঝে না’। কেন সে বুঝে না!
অনেক সুন্দরী ছিল বলে ক্লাস নাইন-টেন এ পড়া অবস্থায়ই তার অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসত। তার মা প্রায়ই আমার সাথে সেসব বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতেন। বুকের মধ্যে কষ্টের চিনচিনানি নিয়ে আমি তার সাথে আলাচনায় অংশ নিতাম। বলতাম, সোহেলীকে অন্তত ইন্টারটা পাশ করতে দিন আন্টি। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া কি ঠিক? আন্টি বলতেন, কি করব, ওর বাবার হার্টের সমস্যা। কোন্দিন কি হয়। সেই ভেবে মেয়েটাকে বিয়ে দিতে চাই। কিন্তু বিয়ের কথা বললেই মেয়েটা রেগে ওঠে। তুমি একটু বুঝাবে বাবা? তোমার কথা সে শুনবে।
শুনে আমার কষ্টটা বেড়ে যেত। ভাবতাম এসব কথা আমাকেই কেন বলা হচ্ছে?
*
আমার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলে ঢাকায় যাবো কোচিং করতে; এরকমই পরিকল্পনা ছিল মনে। যে করেই হোক ঢাবিতে নিজেকে দেখতে চাই-এই ছিল আমার স্বপ্ন। আর মনে আমার বিশ্বাস আমি পারবোই। এরই মধ্যে সোহেলীরও এসএসসির রেজাল্ট বের হলো। খবরটা সেদিন সে নিজেই দিতে এসেছিল আমাকে।
দুপুর বেলা আমি আমার রুমে বসে পড়ছিলাম। রূমে তখন আমি একাই ছিলাম। পরীক্ষার পর পরই আমার হলের সিট বাতিল হয়ে গেলে প্রথম বর্ষের যে ছেলেটি আমার রুমে উঠল তাকেও আমি প্রাইভেট পড়াতাম। তার অনুগ্রহেই আরো কিছুদিন রুমে থাকতে পেরেছিলাম আমি। আমাকে ওর বিছানাটি ছেড়ে দিয়ে সে তার আর এক বন্ধুর সাথে ভাগাভাগি করে থাকতো। বাড়ি চলে গেলে আমার পড়াশুনাটা ঠিকমতো হতো না তাই হলটা ছাড়িনি তখন, আর মাস শেষে টিউশনির টাকাটা হাতে পেলেই ঢাকা চলে যাব সেই প্রতীক্ষায় ছিলাম।
নির্জন দুপুরে একা আমি বইয়ের পাতায় ডুবে আছি । সেই নির্জনতা ভেদ করে সোহেলী তার বান্ধবী নীলাকে নিয়ে আমার রুমে আসল।
আমার গায়ে জামা ছিল না। ওদেরকে দেখে চট করে উঠে গেঞ্জিটা গায়ে দিলাম।
এর আগেও সোহেলী একবার আমার রুমে এসেছিল। সেবার হোস্টেলের অনেকেরই জ্বর হয়েছিল । আমারো হলো। জ্বরের কারনে চারদিন আমি পড়াতে যাইনি। শেষে অপেক্ষা করে করে সোহেলী সব দ্বিধা তুচ্ছ করে, লোক লজ্জা ভুলে আমার রুমে আসে। আমাদের ছেলেদের রুমে মেয়েদের আসাটা এক রকম ঈদের চাঁদের মতই ছিল। কোনদিন কোন কারনে কারো রুমে কোন মেয়ে আসলে সেদিন সারা হোস্টেল সেটা নিয়ে রৈ রৈ ব্যাপার হয়ে যেত। যার কাছে মেয়েরা আসত সে ছেলে যেন ভীমরুলের বাসায় ঢিল ছুড়েছে এমন অবস্থা। রেহাই নাই তার। সেই ছেলের প্রেমিকা হোক বা না হোক সবাইকে খাওয়ানোর মত জরিমানা তাকে দিতেই হতো।
আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সোহেলী বলল, স্যার আমি জিপিএ ফাইভ পেয়েছি। আপনিতো আর ওদিকে যাবেন না তাই আমিই আপনাকে খবরটা দিতে আসলাম ।
কেন যাবো না? আমি বিকেলেই তোমার খবর নিতে যেতাম ।
মিষ্টির প্যাকেটটা টেবিলে রাখতে রাখতে সোহেলী বলল, স্যার মা আপনার জন্য পাঠিয়েছেন, আর একবার যেতে বলেছেন বাসায়।
আমি বললাম, আচ্ছা যাব।
ওদেরকে কোন আপ্যায়ন করতে পরলাম না। আমার ভেতরে খুব টেনশন হচ্ছিল, দুটি মেয়ে আমার রুমে আসছে, এটা কেউ দেখলে ক্যাম্পাসে খবর হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি ওদেরকে বিদায় করতে পারলে বাঁচি।
সোহেলী আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারল। ওর বান্ধবীকে বলল, নীলা চল আমরা যাই। বলেই হাঁটা শুরু করলো। নীলা আগে সোহেলী পিছনে। আমি একবারও বললাম না আর একটু বসো। খাম্বার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। সোহেলী দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার দু’কদম পিছনে আসলো। আমার দিকে তাকালো। তার চোখে সমুদ্রের গভীরতা আর অথৈ নীল পানির ঢেউ আছড়ে পড়ছিল তখন। টলমলে চোখের দিকে তাকাতেই আমার গলা শুকিয়ে গেল। ইচ্ছা করছিল ঐ অশ্র“ পান করে আমার পিপাসা মেটাই। সোহেলীর চোখের অশ্র“ আমার ভেতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এখনি আমার উপর আঘাত হানবে প্রচন্ড এক ঢেউ ।
আমার মুখোমুখি এসে বলল, স্যার একটা কথা বলবো।
হ্যাঁ, বলো ।
স্যার আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ।
খবরটা শুনে আমার বুকের ভেতর প্রবল এক ধাক্কা লাগল। কয়েকটা মুহুর্ত আমি মনে হয় কিছু শুনছিলাম না।
তারপর একটু স্বাভাবিক হয়ে অনেক কষ্টে ঠোঁটে হাসি এনে বললাম, তাই নাকি? বাহ্ ভাল খবর তো। এক দিনে দু’টি সু-সংবাদ।
সোহেলীর দ’ুচোখ বেয়ে এবার জলধারা নেমে এল। সেই জলধারায় আমার ভেতরের ‘আমি’ ভেসে যেতে থাকলাম। আমার দিকে তাকিয়ে রইল সেই ভেজা চক্ষু নিয়ে। কণ্ঠটা ভারী হয়ে এলো তার। বলল, স্যার আপনি একটা নিষ্টুর, পাথর, অন্ধ, বধির আর ..আর আপনি একটা হাদারাম। আপনি আসলেই একটা..। কথাটি বলে শেষ করলো না। মনে হয় আমাকে বলার মতো ওর ঝুড়িতে তখন আর কোন শব্দ ছিলো না। শুধু চোখদুটি টলটল করছিল।
কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালো না। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পিছন থেকেই অনুমান করতে পারলাম ওড়নার আঁচলে সোহেলী চোখের পানি মুছে নিচ্ছে। তার ভেতরটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম তখন । তার চোখের পানিতে আমিও যে কাদা কাদা হয়ে যাচিছলাম সেই খবর আর নাই বা দিলাম তাকে।
আমার ভেতরের আমি’টা তাকে বেশিদূর যেতে দেয়নি। পিছন থেকে ডাক দিলাম সোহেলী বলে। আমার ডাকে সাড়া দিয়ে সোহেলী দাঁড়িয়ে গেল ; যেখানে সবুজ ঘাসের উপর শুকিয়ে যাওয়া শেষ রাতের কুয়াশার দাগ তখনো মলিন হয়ে যায়নি। আমি হলের বড় বারান্দা পেরিয়ে মাঠে নেমে এলাম। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকলাম সজল দুটি আঁখির দিকে। আমার চাহনি আর উপস্থিতিতে সোহেলীর অধর বেয়ে ছলছল করা চোখের এক ফো^টা পানি গড়িয়ে পড়ল। তাকে আমি ভূমিতে পড়তে দিলাম না। মুক্তদানার মত পানির ফোঁ^টাটা হাত পেতে নিয়ে অন্য হাতে ওর একটা হাত ধরলাম। সোহেলীর তখন আশ্চর্যের সীমা নেই। আমার দিকে বিষ্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দূর থেকে কলেজের কিছু ছাত্র আমাদেরকে দেখছিল। তাতেও আমি ভ্রুক্ষেপ করলাম না। ওর বান্ধবী নীলা এতটাই অবাক হল যে জায়গায় দাঁড়িয়েই জলজ্যান্ত মানুষটি যেন স্ট্যাচু হয়ে গেল। আমি কোনকিছু পরোয়া না করেই বললাম, লক্ষèী মেয়ে এমন করে কাঁদতে নেই। তোমার একফোঁটা চোখের পানি আমার শরীরের সমস্ত রক্তের চেয়েও দামী। কেন তাকে অহেতুক বিসর্জন দিচ্ছ?
একথা শুনে সে লোকলজ্জা ভুলে মাঠের সবুজ ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে মুক্ত আকাশের নিচে সকলের সামনেই আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। যখন আমিও সোহেলীকে বুকে জড়িয়ে নিতে চাইলাম তখন দেখি ওরা দ’ুজন মাঠ পেরিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। আর আমি সেই বারান্দাতেই পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
বুঝতে পারলাম এ ছিল আমার কল্পনা। কল্পনাতেই আমি বড়ে বেশি দু:সাহসী হয়ে উঠি।
তারপর অনেকক্ষন ধরে তার কথাগুলো কানে রিনরিন করে বাজতে থাকল।
*
তার কিছুদিন পর শেষবারের মত তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম একবার। আমি ঢাকা চলে যাব তাই সৌজন্যমূলক শেষ সাক্ষাৎটা করার উদ্দেশ্যেই যাওয়া। সেদিন সোহেলী বাড়ি ছিল না। তাই আমার সাথে তার আর দেখা হয়নি। তার অনুপস্থিতি তখন আমার বুকের ভেতর কষ্টের কুন্ডুলি পাকিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আর বুঝি কোনদিনই তার সাথে আমার দেখা হবে না। সেই পড়ার টেবিল, চেয়ার, দরজার পাশের ওই ছোট্ট অন্ধকার জায়গাটিতে আমার কেবলি মনে হচ্ছিল এই বুঝি সোহেলী উঁকি দিয়ে আমাকে দেখছে আর দুষ্টুমি ভরা হাসি লুকিয়ে রাখছে। আণ্টির সাথে কথার ফাঁকে আমার দুচোখ এদিক সেদিক সোহেলীকেই খুঁজতেছিল। তার সাথে দেখা হওয়ার সকল সম্ভাবনা যখন ক্ষীণ হতে দেখলাম, তখনি এক বুক হতাশা নিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম।
আজও সে এতদিন পরে সেই কথাটি বলে গেল। সেই হাদারাম শব্দটি। ওই শব্দের মানে কি? আমিকি খুব বোকা? নাকি বেকুব? সেটা কেন বলল? ওকে চিনতে পারিনি বলে? ওকে এতদিন পরে দেখেও তেমন উচ্ছাস প্রকাশ করলাম না বলে? আজও সে আমার উপর অভিমান করতে পারে? এখনো আমার সাথে অভিমান করে সোহেলী! এখনো অভিমানে কণ্ঠ ভিজে ঠোঁট কেঁপে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে সে! অথচ আমার ভেতরটা সে কোনদিনই দেখতে পেল না। নাকি সে দেখত বলেই এমন করত। আমি নিজের ভাবনাকে পাত্তা দিতাম না বলে আমার উপর তার যত অভিমান?
সোহেলীতে পড়াতে যেয়ে কখনো কখনো আমিও কোথায় যেন হারিয়ে যেতাম। সপ্তাহে তিন দিন পড়ানোর কথা থাকলেও আমি অন্তত পাঁচদিন যেতাম ওই বাড়িতে। ওকে না দেখলে ভাল লাগতো না। আমার দিকে যখন তাকিয়ে থাকতো নিজেকে সেই চোখের গভীরে হারিয়ে ফেলতাম। ওর দুষ্টুমিগুলো উপভোগ করতাম মনে মনে। কিন্তু কখনো নিজেকে প্রকাশ করিনি। আমার অনুনয়টুকু কাঠিণ্যের আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখতে আমার প্রচেষ্টার কমতি ছিল না। প্রথম জীবনের প্রথম প্রনয়টুকু সোহেলীর প্রতিই যে হ্্রদয়ের কোণে একটু একটু করে জমতেছিল, তা আমি কোনদিনই তাকে বুঝতে দেইনি। অনেক কষ্ট পেতাম। কষ্টটা বেশি বোধ করতাম যখন বুঝতে পেরেছিলাম আমার হ্দ্রয়ে সোহেলী একটা জায়গা করে নিয়েছে অতি সন্তর্পনে। ওর প্রতি এক বিচিত্র ধরনের মায়া অনুভব করতাম। মনের এমন একটা টান যার সাথে আর কোনকিছুরই তুলনা করা যেত না। অনুভব করতাম কষ্ট এবং সুখের মিশ্রিত এক ধরনের চিনচিন ব্যথা। কিন্তু নিজের অবস্থান সম্পর্কে আমার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। মনে করেছিলাম আমি সোহেলীর যোগ্য কোনদিন ছিলাম না, হবো ও না। সোহেলীর প্রতি হাত বাড়ানোটা আমার লোভী মনের পরিচায়ক হতো।
অভাব অনটনের সংসারে উপার্জনের কেউ ছিল না অমার। বড় ভাইয়েরা বিয়ে শাদি করে যার যার সংসার আলাদা করে নিয়েছিল। অভাবের কারনে তারা বেশি পড়াশুনাও করতে পারেনি। তখন তাদের উপর বাবু সেজে আমি লেখাপড়া করব সেটাও তারা মেনে নিতে পারতো না। আমি ক্লাস সেভেনে থাকা কালে বাবা মারা গেলেন । তারপর থেকে মা ই আমার সব। বড় ভাইয়েরা কখনোই আমার প্রতি দায়িত্ববান ছিলেন না। হবেনই বা কেন? আমিতো ছিলাম তাদের সৎ ভাই। আমার বড় মা মারা যাবার পর তার ছোট ছোট সন্তানদের কথা ভেবেই বাবা আমার মাকে বিয়ে করেছিলেন। মা তাদেরকে আপন সন্তানের মত পেলে পুষে বড় করলেও তারা আমাকে আপন ভাই মনে করেনি কখনো। আর আমার মাকেও সারাটি জীবন সৎ মা হিসেবেই দেখেছে।
লেখাপড়া করে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। পঞ্চম আর অষ্টম শ্রেনীতে বৃত্তি পেয়ে আমার অনেক সুিবধাই হয়েছিল। বৃত্তির টাকা দিয়েই পড়াশুনার খরচের অনেকটা চালিয়ে যেতে পারতাম। আর ক্লাস এইট থেকেই আমি টিউশনি করি। অংকে ভাল ছিলাম বলে আমার অনেক স্টুডেণ্ট জুটে যেত। আমার ক্লাসেরও অনেককে আমি অংক শেখাতাম।
আমার জীবনে প্রেম ভালবাসা এসব বিলাসিতার কোন স্থান রাখিনি। রাত দিন একাকার করে পড়াশুনা করছি, টিউশনি করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাব। খুব বেশি কিছু নয়, একটা সরকারী ভাল চাকরী হলেই আমার হয়ে যাবে। অন্তত মায়ের দু:খটা যেন ঘুচাতে পারি এই ছিল আমার স্বপ্ন। কখনো স্বপ্ন দেখতাম একজন বড় অফিসার হয়ে সরকারী কোন কোয়ার্টার্সে থাকবো। ঘরের সামনে আমার নেমপ্লেট থাকবে । সেই ঘরে আমার সাথে থাকবে আমার মা। মায়ের সেই খুশিভরা মুখটি কল্পনা করে মন ভরে যেত আমার।
আমার অবস্থা ঠিকই পরিবর্তন হলো, চাকরীও হলো, আমি বড় অফিসার হলাম, ঘরের সামনে আমার নেমপ্লেট হলো, কিন্তু মা আমার কিছুই দেখতে পেলেন না। এসবের আগেই যে মা মারা গেছেন তা নয়। “কিন্তু কখনো কখনো প্রকৃতি এবং পরিস্থিতির কাছে আমরা এমনভাবে আটকা পড়ে যাই যে, একান্ত বাধ্য কাজটাও তখন অবাধ্য হয়ে যায় অন্যের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে যেয়ে”।
সোহেলীর মনের ভাব খুব ভালোই বুঝতে পারতাম। বুঝতে পারতাম আমার নিজেরটাও । কিন্তু সেটা অপ্রকাশিতই রেখেছি। জানতাম, আমার পক্ষে তখন এছাড়া করার কিছুই ছিল না।
মেয়ের শিক্ষক হিসেবে সোহেলীর বাবা মা আমাকে øেহ করতেন। কিন্তু জামাতা হিসেবে কখনো মেনে নিতেন না। কোন বাবা-মাই তা করেন না। আমি ছিলাম সবে একজন ছাত্র। সোহেলীর বাবার মত আমার বাবার বিত্ত বৈভব ছিল না। কবে যে কিছু করতে পারবো তারও কি নিশ্চয়তা ছিল? শুধুমাত্র মেধাকে সম্বল করে এদেশে কবেই বা কেউ কিছু হতে পেরেছে? এরকম একটা অনিশ্চয়তার সাথে আমার দিনরাত বসবাস ছিল।
*
সুখ স্বাচ্ছল্যে ভরপুর একটি পরিবার ছিল সোহেলীর। সুশ্রী, মেধাবী, বিনয়ী, আপন আভিজাত্যে সমুজ্জ্বল একটি মেয়ে ছিল সে। যেন দীঘির জলে ফুটে থাকা এক পদ্ম । সোহেলীর জন্য প্রতিদিন কত কত সুপাত্র বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতো। তাদের সাথে তুলনা করলে আমারতো তখন পায়ের নিচে মাটিই ছিল না। ওই অবস্থায় তাকে মনের কথা বললে আমার টিউশনিটা হারাতাম। আর টিউশনি হারানো মানে সোহেলীকে যতটুকু পাচ্ছি তাও হারিয়ে ফেলা। আর মনে হতো আমার মনের কথা প্রকাশ করলে তার বাবা অনেক কষ্ট পাবেন। আমার উপর তাদের বিশ্বাস হারাতেন এবং তাদের মেয়ের উপরও। এছাড়া আমিতো তখন সোহেলীকে বিয়েও করতে পারতাম না। সেটা ভাবাও ছিল আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু সোহেলীকে বিয়ে দেয়া ওর পরিবারের তখন কর্তব্য ছিল।
যদিও গভীর রাতে যখন চোখের পাতায় ঘুম আসতো না, তখন কত রাত সোহেলীকে নিয়ে জোছনা রাতে হলের সামনের খোলা মাঠের সবুজ ঘাসের বিছানায় বসে চাঁদের আলোয় অবগাহন করেছি। ঝিরিঝিরি বাতাস এসে শীতল পরশ বুলায়ে দিয়ে গেছে দুজনকে। যখন পুকুরধারে নারকেল গাছের নিচে বসে গল্প করছিলাম বাতাস এসে ওর চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছিল আর আমি সেই এলোচুলের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। আমার কল্পিত সেই সুখগুলো একান্তই আমার হয়ে আমার মনেই রইল।
আমি যদি সোহেলীর মনের ভাবনার উপর একটুখানি সুখের বাতাস দিতাম, সে দ্বিগুন প্রবাহে প্রবাহিত হয়ে আমাকে নিয়ে ভেসে যেতে চাইত। কিšতু আমি কি তা করতে পারতাম? আমাকে পেতে হলে তার আরো অন্তত দশটি বছর অপেক্ষা করতে হত। আর তা সে কোনদিনই পারত না। সে পারলেও অসুস্থ্য বাবা-মায়ের কথা ভেবে তাকে প্রতিটি মুহুর্তই মানসিক টানা পোড়েনের মধ্যে থাকতে হত।
“সংসারে ছেলেদের সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত করা যত সহজ মেয়েদের সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত করা ততই কঠিন”। আর আমার ভবিষ্যৎ যে কী হবে তাতো আমি নিজেই জানতাম না। মনে তো লালন করতাম বড় হওয়ার প্রত্যাশা। কিন্তু হতে যদি না পারি? আর কিছু হতে না পারলে আমার জীবনের সাথে সোহেলীকে জড়িয়ে তাকে শুধু কষ্টই দেয়া হত।
যাকে ভালোবাসি তাকে কষ্ট দেয়াটা আমার স্বভাবে ছিল না। তাইতো সাময়িক কষ্ট হলেও বৃহত্তর এবং দীর্ঘতর কষ্ট যাতে পোহাতে না হয় তার জন্যই সোহেলীর মনের ভাবনাটাকে গ্রাহ্য করলাম না। জানি তাতে ওর কষ্ট হত। তারপরেও বড় কষ্টের তুলনায় এই কষ্টটা সহনীয়ই ছিল । আর আমি যে নিজেকে প্রতিষ্টিত করে সোহেলীর উপযুক্ত হতে পারবো সেই আশায়ই বা সোহেলীর মত মেয়েকে আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলি কি করে? তাইতো চাল-চুলাহীন আমি সোহেলীর কাছে নিজেকে অযোগ্য ধরে নিয়ে মনের কথা মনেই রেখে দিলাম।
তারপর আর ওদের কোন খবর জানি না। এদিকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলাম। জীবনে উপড়ে ওঠার সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিয়েই নিজের প্রতি এক ধরনের আস্থা অর্জন করলাম। কখনো কখনো কার্জন হলের পুকুর পাড়ের খোলা হাওয়ায় সোহেলীর স্মৃতিগুলো আমার মানস পটে ভেসে উঠত। কোথায় আছে, কেমন আছে, কার সাথে বিয়ে হল, সে কি সুখে আছে? আমাকে কি তার মনে আছে! এসব ভাবতাম। আবার ইচ্ছে করেই ভাবনাগুলো দমিয়ে রাখতাম।
*
মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস দিয়েই চাকরীটা হয়ে গেল। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে সুযোগ পাইনি। ওই সময়ে রূপা এল আমার জীবনে। পরের এক বছরের মধ্যেই আমরা বিয়ে করলাম।
চাকরী রক্ষা করতে যেয়ে যখনি আমার মনের বিরুদ্ধে কোন কাজ করতে হয়, ভাবি-আর নয়। সব ছেড়ে ছুড়ে গ্রামে চলে যাই। সেখানে যেয়ে চাষাবাদ করি। তাও স্বাধীন মত বেঁচে থাকা হবে। পরের গোলামী করতে আর মন চায় না। পরিবার থেকে দূরে থাকাও আমাকে প্রতিটি মুহূর্তেই কষ্ট দিত।
কিন্তু যেতে আমি পারি না। অনেক সাধনার পরে যা অর্জন করেছি এত সহজে কি তাকে ছাড়া যায়? অব্যবস্থা আর অনিয়মই এখন নিয়ম হয়ে গেছে। মনের বিরুদ্ধ হলেও সেসবের সাথে তাল মিলিয়েই আমাকে চলতে হবে। এ দ্বায় আমার নয়; আমার সমাজের।
আমার ঘরের সামনে নেমপ্লেট। সারাক্ষণ সাথে বডি গার্ড থাকে। আমার জন্য সরকারের ছয়জন কর্মচারী নিযুক্ত। সরকারী গাড়ি ব্যবহার করি। আমার স্ত্রী-কন্যাদেরও কত সুবিধা । সবাই দেখলে কেমন সমীহ করে কথা বলে । ক্ষমতা যে কি জিনিস তা আমি হারে হারে টের পাই। এসবও তো এক প্রকার সুখ। যা যা আমার অভ্যাস ছিলনা ধীরে ধীরে তার অনেক কিছুই রপ্ত করে নিয়েছি। সবাই বলে ‘এ্যাডজাস্ট করো’। আমি সেই এ্যাডজাস্ট করতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু আমার মন ও শরীর থেকে আমার মাটির গন্ধ, আমার মায়ের আচলে মুখ মোছা ঘামের গন্ধ, সেসব আমি কেমন করে মুছে দিয়ে রঙিন জগতের সাথে নিজেকে এ্যাডজাস্ট করবো?
কত কত সুনাম আমার। অনেক ভাল লাগে যখন কোন অপারেশনে যাই, সফল হই, মিডিয়ায় আমার খবর প্রকাশিত হয়, সাক্ষাৎকার দেই। পুরস্কার পাই। মনে হয়, এইতো আমি পেরেছি। এটাই তো হতে চেয়েছিলাম। বড় হওয়া। আমিতো অনেক বড় হব। শিকড় ছেড়ে এসেছি অনেক দিন আগে, এখন আমার শিখড়ে ওঠার পালা।
তবুও মাঝে মাঝে এখনো মন ছুঁয়ে যায় সোহেলী । কেন ছুঁয়ে যায় সে? কেন তাকে ভুলতে পারিনি কোনদিন?
আমার চোখে সোহেলীর তখনকার রূপটাই ভেসে উঠত। কিন্তু এতদিন পরে তাকে অন্য রূপে দেখে আমার ভাবনায় আবার নতুন করে নতুন প্রবাহ বইতে লাগল। তুমি কোনদিনও জানবে না আমার মনে কি ছিল। তুমি রবে নিরবে, বইবে নিরবধি ।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ:
দুপুরের পর থেকেই সোহেলীর øায়ুচাপ বেড়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। ভিন্ন এক উত্তেজনার ঢেউ উথাল-পাথাল আছড়ে পড়ছিল মনের সৈকতে। তাড়াতাড়ি করতে যাওয়া কাজগুলো কেবলিই দেরী হয়ে যাচ্ছিল। ভুল করার মত না হলেও অনেক কিছুই সেদিন তার ভুল হয়ে যাচ্ছিল । হাতে পর্যাপ্ত সময়ও ছিল। তবুও মনে হচ্ছিল তার, ‘না জানি আমার দেরি হয়ে যায়’। দুপুরের পর লম্বা একটা ঘুম দিয়ে বিকেলে চায়ের পর্বটা শেষ করে ধীরে সুস্থ্যে বের হলেও সময়ের আগেই পৌঁছে যেতে পারতো সে। কিন্তু সোহেলী এসব কিছুই করল না। মনের উত্তেজনায় দুপুরের খাবারটাও খেতে পারল না ঠিকমত । কোন্ পোশাকটা পরবে সেটা নিয়ে নিজের মনের সাথে তখনো মিমাংসা করে পেরে উঠেনি। প্রথমে ভেবেছিল নীল শাড়ি পরেই যাবে। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পাল্টে বেছে নেয় কালো শাড়ি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কালো শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে মনপুত না হওয়ায় আবার জড়িয়ে নেয় বাসন্তী রং। এক সময় শাড়ি রেখে থ্রিপিচ পরার সিদ্ধান্ত নেয়। ধবধবে সাদা থ্রিপিচ পড়েই যাবে তার প্রিয় মানুষটির সাথে দেখা করতে। এতটা বছর পরেও যাকে হ্্রদয়ের এধার থেকে ওধারে সরাতে পারেনি। যে ছিল সর্বদাই একেবারে অন্তরের মধ্যখানটিতে।
বিকেল থেকেই সাজগুজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সোহেলী। যদিও সে কখনোই বেশি সাজে না। চোখে কাজল আর শাড়ির সাথে মিলিয়ে কপালে একটি ছোট্ট টিপ, রেশমি কালো চুলগুলো থাকে পিঠের উপর ছড়ানো। এই তার সাজ। সেদিনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু মনের সাজ সাজতে সাজতেই মহারানী সারাদিন ব্যস্ত।
রওয়ানা দেয়ার আগ মুহূর্তে সোহেলী একবার ফোন করার কথা ভাবল। তারপর ভাবনাটাকে দমিয়ে রেখে কিছুক্ষণ বসে রইল নিরবে। আয়নায় আর একবার দেখে নিল সব ঠিক আছে কিনা। সাদা থ্রিপিচটাও শেষ মুহুর্তে তার পরা হয়নি। সব রেখে লাল টুকটুকে একটি শাড়ি বেছে নিল। কেন জানি মনে হল ওটাতেই আজ তাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগবে। নিয়মমাফিক চোখে কাজল আর কপালের টিপটা এঁকে নিল। এতেই অপরূপা হয়ে উঠল সোহেলী।
অনেকবারই ফোন করার ইচ্ছাটা মনের মধ্যে তোলপাড় করছিল। জানতে ইচ্ছা করছিল অপর পক্ষের অবস্থান, সে কী ভাবছে কী করছে কতদূর আসছে এসব । তবুও সোহেলী আশা করছিল ফোনটা যেন ওপাশ থেকেই আসে। কিন্তু সেরকম সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হতে দেখে মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল তার ।
সময় বয়ে যাচ্ছিল স্রোতের মত! সাড়ে সাতটায় থাকার কথা। এখনি বের হয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু তার তো কোন খবরই নাই-ভাবতে ভাবতে ঘামতে ছিল সোহেলী ।
মনের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঘূির্ণপাক খাওয়া কিছুটা সময় পার করে সেলফোনটা হাতে নিল। সংখ্যাগুলো তার মুখস্তই ছিল। যেদিন নম্বরটা সংগ্রহ করল সেদিনই মোবাইলে সংরক্ষণ না করে মনের ডায়রীতে সংরক্ষণ করল তার প্রিয় স্যারের নম্বরটি। (এখনো সোহেলী তাকে ‘স্যার’ বলেই স¤েম্বাধন করে। )তারপরেও নম্বর টিপে আর একবার খবরের কাগজের বিল এর উল্টোপাশে লেখা নম্বরটার সাথে মিলিয়ে নিল, যাতে কোনক্রমে ভুল না হয়ে যায়। নম্বরটা পাওয়ার পর এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সে তাকে ফোন করে। এখন পর্যন্ত যদিও দুই নম্বর কলটি করা হয়ে ওঠেনি। ডায়াল করার সাথে সাথে নিজেই আবার লাইন কেটে দিল। মনটা কেমন দুরু দুরু কাঁপছিল। স্যার কি ভাববেন সেকথা ভেবে যখন নিজেই লাইনটা কেটে দিল তখন সোহেলীর ফোনে একটা কল আসে। হ্্রদয় কেঁপে ওঠে। নিশ্চিৎ ভেবে নেয় কলটা স্যারেরই হবে। যদিও মনের সংরক্ষিত সংখ্যা আর কাগজের টুকরায় অংকিত সংখ্যাগুলির সাথে ইনকামিং কল এর সংখ্যার কোন মিল নাই। কম্পিত বুকে যখন ঘনঘন নি:শ্বাস অনুভব করছিল তখন ফোনের ইয়েস বাটনে চাপ দিয়ে ঈষৎ কাঁপা কণ্ঠে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে সাদি’র কণ্ঠ ভেসে আসে।
‘সোহেলী আমি সাতটার ফ্লাইটে রাজশাহী আসতেছি। আমার মোবাইলের চার্জ নেই তাই বন্ধ হয়ে গেছে। সারাদিন মিটিংএ ব্যস্ত ছিলাম বলে বুঝতেও পারিনি। এখন বাইরে থেকে কল করলাম।’
কথাগুলো একদমে বলে সাদি একটু নি:শ্বাস নিল। সেই নি:শ্বাস নেয়ার ফাঁকের সময়টাতে ঘোর এক অনিশ্চয়তার মধ্যে সোহেলীর নি:শ্বাস প্রায় আটকে যাওয়ার উপক্রম। কি বলবে না বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না।
সাদি’র সাথে কথা বলার মুহুর্তেই অন্য আর একটা কল আসে । সোহেলী এবার শতভাগ নিশ্চিৎ যে এই কলটা অবশ্যই স্যার করেছে। কিন্তু সাদি’কে রেখে সেই কলটা তখন রিসিভ করতে সে অপারগ। বিভ্রান্ত বিব্রত আশাহত আর দ্বিধাগ্রস্ত মনে সোহেলী সাদিকে বলল-
তুমি ঢাকা আসছ কখন? আমাকে তো একবারও বললে না। এখন কোথায় তুমি? আসতে কতক্ষণ লাগবে?
বারবার মুখে জড়িয়ে যাচ্ছিল কথাগুলো। হ্্রদয়টা কম্পিত হচ্ছিল দুরুদুরু।
আরে একসাথে এত প্রশ্ন করলে উত্তর দিব কি করে? একটা একটা করে শোন- আজ সকাল এগারোটায় আমি ঢাকা ল্যান্ড করি । তারপর বারোটা থেকে মিটিং চলে একটানা পাঁচটা পর্যন্ত। এর মধ্যে শুধু লাঞ্চ ব্রেক ছিল এক ঘণ্টার । সেই এক ঘণ্টাও আমি ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম। ভাবলাম সব কাজগুলো শেষ করতে পারলে আজই রাজশাহী চলে যেতে পারব । এক ফাঁকে জগলুল কে দিয়ে টিকিট কনফার্ম করলাম । এখন তোমার সাথে কথা শেষ করেই এয়ারপোর্ট দৌঁড়াতে হবে। সময় বেশি নেই। সারাদিন এত ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম যে তোমাকে ইনফর্ম করতে পারিনি। তার উপর ফোনের ব্যাটারি লো। একবার ভেবেছিলাম কিছু না বলেই এসে পড়ব। তোমাকে একটা বড় রকমের সারপ্রাইজ দিব। কিন্তু পরে ভাবলাম তোমাকে একেবারে না জানিয়ে চলে আসাটা ঠিক হবে না। তাই এখন জানালাম যাতে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করার সুযোগটা পাও । হাজব্যান্ড বাইরে থেকে আসবে আর ওয়াইফ তার জন্য অপেক্ষা করবে, এই সুখময় মুহুর্তটি আমিতো মিস করতে চাইই না। আর তোমাকেও মিস করতে দিব না। তাইতো জানিয়ে রাখা ম্যাডাম। এখন আমার জন্য রেডি হও।
সাদি আর কিভাবে সারপ্রাইজ দিবে সোহেলীকে। এরই মধ্যে সোহেলী নিজেই সারপ্রাইজের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে কাঁপা কণ্ঠে সাদি’কে বলল-আচ্ছা তাহলে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।
অন্য যে কলটি ওয়েটিং পাচ্ছিল এখন তাকে সোহেলী রিসিভ করল । নম্বরটা তার চেনা। বহু আকাঙ্খিত সেই নম্বর।
ফোনটা রিসিভ করতেই লাইন কেটে গেল। দ্বিতীয়বার কল আসবে সেই অপেক্ষা না করেই সোহেলী রিসিভ কল থেকেই পুনরায় ডায়াল করল। একবার দুইবার করে অনেকবার। যতবারই ডায়াল করে শুধু একই সংলাপ-দু:খিত এই মুহুর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব নয়, একটু পরে আবার ডায়াল করুন। দুশ্চিন্তায় রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। স্যারের ফোন বন্ধ, ওদিকে সাদি রওয়ানা দিয়েছে, এক ঘণ্টার মধ্যেই রাজশাহী পৌঁছে যাবে । বিমানে আসতে লাগবে বড়জোর ত্রিশ মিনিট। তারপর বাসায় আসতে যতক্ষণ লাগে। স্যারের সাথে এখনি কথা না বলতে পারলে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। সেও হয়তো রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে। আমাকে না পেলে বাসায়ও চলে আসতে পারে। হয়তো স্যারও ভাবছে আমাকে আগে থেকে কিছু না বলে বাসায় এসে চমকে দিবে। তখন হয়তো সাদিও এসে পড়বে।
হায় আল্লাহ্ একদিনেই এত চমক আমি কী করে সামাল দেব!
মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছে আর একই নম্বরে বারবার ডায়াল করে যাচ্ছে। বারবার একই কথা-সংযোগ দেয়া সম্ভব না।
*
রাস্তার সেই অকষ্মাৎ সাক্ষাতের পর থেকে আমার মনের উপর নিরবধি কি যে এক ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল তা বুঝানোর সাধ্য আমার নাই। দৈনন্দিন সকল কাজের মাঝেই সোহেলীর অবয়ব মানসপটে ভেসে উঠতে লাগল যখন তখন। খেতে ঘুমাতে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোন মিটিংএ বসেও হঠাৎ করে সোহেলীর দুষ্টু আর মিষ্টি হাসিটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত। সকল কাজের মাঝখান থেকে সোহেলী আমাকে অন্য ভূবনে নিয়ে যেত। আমিও হারিয়ে যেতাম সেই ভূবনে। এই হারানোতেই যেন দুনিয়ার সমস্ত সুখ নিহিত ছিল। হয়তো বিরক্তিকর মনোভাবে যানজটে বসে আছি, হঠাৎ করে কল্পনায় দেখছি সমুদ্রের মাঝখানে কোন এক নির্জন দ্বীপে সারি সারি নারকেল গাছের ছায়ায় জ্যান্ত শৈবাল পাথরের উপর বসে আমি আর সোহেলী সমুদ্রের গর্জন শুনছি, আর ঢেউ এসে সোহেলীর আলতা রাঙা পা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শৈবালে আছড়ে পড়া ঢেউ থেকে ছিটকে পড়া পানি সোহেলীর চোখে মুখে পড়ছে, চুলগুলো বাতাসে উড়ছে এলোমেলোভাবে আর আমি তাকিয়ে আছি অপলক চোখে।
জগতে বুঝি এমন সৌন্দর্য আর কোথাও নেই। ভালোলাগার এর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কোন মুহূর্ত আর হতে পারে না। মনে মনে ভাবি আমি, যদি ওই ঝিরিঝিরি বাতাস হতাম কিংবা সমুদ্রের ঢেউ, আমিওতো ওমন করে ছুঁয়ে যেতে পারতাম আমার কল্পনার রাণী সোহেলীকে।
এমন সব কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসতে আমার মন সায় দেয় না। তবুও ফিরে আসতে হয়। কেননা আমার কল্পনা আর আমার বাস্তবের মাঝে অসীম ব্যবধান।
আমার হঠাৎ করে চনমনে হয়ে ওঠা মনটা চেয়েছিল মনের ওই অভিব্যক্তিটা যদি কারো কাছে প্রকাশ করতে পারতাম! কিন্তু তার কোন উপায় ছিল না। কেননা সেরকম কোন বন্ধুই এখন আমার নেই। সময়ের স্রোতে সবাই কেমন ভেসে গিয়েছে শ্যাওলার মত। যার যার জীবন নিয়ে সে সে ব্যস্ত। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পরে ক্লান্ত অবসন্ন দেহমন নিয়ে এক রাশ ঘুমের ঘোরে রাতটা আমার পার হয়ে যায় অন্যসব রাতের মতই। জীবনটা বুঝি এমনি যাবে, এক বৈচিত্রহীন ধুষর পান্ডুলিপি।
রাতের খাবার শেষে ঘরের সামনের খোলা মাঠে কিছুক্ষণ পায়চারি করা আমার নিত্য অভ্যাস। এরপর কোন রকম আয়োজন ছাড়াই আমি বিছানায় যেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমানোর আগের ঠিক ওই সময়টাতেই রূপার সাথে আমার প্রতিদিন ফোনে কথা হয় । সারাদিনের ফিরিস্তি তাকে দেয়া লাগে। বাচ্চার খোঁজ খবর নেই, কথা বলি। কোনদিন আমি ফোন দেই, কোনদিন রূপা। তবে বেশিরভাগ সময়ই আমি নানান রকম ঝামেলার মধ্যে থাকি বলে সময়মত ফোনটা করা হয়ে ওঠে না। তখন রূপাই আমাকে ফোন করে ।
কিন্তু সেদিন রূপার অতগুলো কলের পরেও যখন আমি তার সাথে আর যোগাযোগ করলাম না, তখন সে রাগে অভিমানে গাল ফুলিয়ে চোখ ফুলিয়ে মেয়েটির সাথে অযথা বকাঝকা করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে একাকী অন্ধকারে বারান্দায় বসে ছিল।
এ সবই আমি অন্তর্চক্ষু দিয়ে দেখতে পাই। আমার এ দেখা কখনোই ভুল হয় না।
রূপা নিশ্চিৎ ছিল অন্তত ঘুমানোর আগে আমি অবশ্যই তাকে ফোন করব। কিন্তু না জানি কোন্ মগ্নতায় সেই রাতে আমার আর রূপাকে ফোন করা হয়নি। কোথা থেকে সকল ভাবনাকে ছাপিয়ে এক সোহেলী আমার ভাবনার জগৎটাকে অধিকার করে বসল। আর তার কথা ভাবতে ভাবতেই আমি ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। ওদিকে রূপা আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন আমার পক্ষ থেকে কোন সাড়া শব্দ পেল না, তখন তার মনে জন্ম নিল আমাকে নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। এমনিতে ওদের কাছ থেকে দূরে থাকি বলে সব সময় একটা দুশ্চিন্তা আমাদের দুজনের মনেই বিরাজ করে।
সেই উৎকন্ঠা থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য রূপা রাত একটা বাজার একটু পরে আমাকে ফোন করে। গভীর ঘুমে আমি তখন নিমগ্ন। ফোনের আওয়াজই আমার চেতনাকে স্পর্শ করতে পারেনি। পারবে কিভাবে? সেই যে দুপুরবেলা ডার্লিংকে সাইল্যন্ট করে রেখেছিলাম, ওটা আর জেনারেল করা হয়নি। ব্যপারটা আমার মাথায়ই আসেনি একবারও । এমন ঘটনা যে এই প্রথম তা নয়। বহুবারই এমন হয়েছে আর রূপার সাথে এই নিয়ে কম তর্কযুদ্ধ হয়নি। দূরে থাকে বলে আমার অবস্থাটাও সে বুঝবে না এমনটাতো ঠিক না।
‘মাঝে মাঝে মনে হয় আমাকে কেউ বুঝে না। সবাই শুধু না বুঝেই রাগ করে। কখনো ভাবি আমিই কি পারিপার্শিক অবস্থার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছি না, নাকি অন্য সবারও আমারি মত অবস্থা?’
*
ঘরের দুয়ারে সোনালী চিকন সূর্যরশ্মির উপস্থিতির আগেই আমার ঘুম ভাঙে। তখন নিজেকে বেশ ঝরঝরা মনে হয়। শান্তির ঘুম শেষে ভোর হতেই আচমকা রূপার কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল মেয়েটার জ্বর। ফোনটা হাতে নিয়ে ছাদে উঠে কবুতরের ঘরের দরজা খুলে দিয়ে একহাতে খাবার ছিটিয়ে দিতে দিতে অন্য হাতে মোবাইলটা নিতেই রূপার মিসড কলগুলো চোখে পড়ল। এতগুলো কল দেখে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হল তখন । কেমন করে গত রাতে কথা না বলেই ঘুমিয়ে পড়লাম! ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলেও রূপা কখনোই তাকে স্বাভাবিক ভাবে নিবে না।
ফোন দিতেই রূপার অভিমান ভরা নির্ঘুম রাত জাগা কন্ঠস্বর আমাকে ব্যথিত করে। আমি সরি বললাম, মৌটুসীর খোঁজ নিলাম। রোবটের মত রূপা সব শুনলো আর হুম হুম জবাব দিল। ওর এই অভিব্যক্তি যে মারাত্মক অভিমানের সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম। একবারও জিজ্ঞাসা করেনি কেন রাতে তাকে ফোন করলাম না। কেনই বা তার ফোন রিসিভ করলাম না। তখন নিজে থেকেই আমি কৈফিয়ত দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চেষ্টা করলাম। তাতে রূপা খুব একটা গায়ে মাখল না আমার কথাগুলো।
অভিমান যখন চরম আকার ধারণ করে তখনি রূপা এমন আচরণ করে। আট বছর সময় তো খুব কম নয়। “সম্পর্ক যদি খুব মধুর হয় তাহলে সময়টাকে তখন খুব অল্প বলে মনে হয়”। কিন্তু আমি জানিনা কেন জানি আমার প্রতিনিয়ত মনে হয় আমার সংসার অনেক পুরনো। কত কত যুগ না জানি পার হয়ে গেছে এর মধ্যে। অথচ আমি কিছুই পেলাম না । তাহলে কি বলবো রূপার সাথে আমার সম্পর্কটা মধুর নয়?
জানি, এমনি হয়। এই আমাদের সংসার। এই পরিস্থিতির সাথে আমার বহুদিনের পরিচয়।
তার দু’দিন পর,
দিনের শুরুটা মোটামুটি ঝামেলামুক্তই ছিল। সকাল এগারোটার দিকে অফিসে বসে টুকিটাকি কিছু কাগজপত্র দেখছিলাম। দেখা মানে সই করা। মনটা একটু ভাল। কারন মেয়েটার শারীরিক অবস্থার অনেকখানি উন্নত হয়েছে। অফিসে ছুটির আবেদন করেছি। দু’একদিনের মধ্যেই গিয়ে ওদেরকে দেখে আসব।
কাজের ফাঁকে ফাকে ফোন রিসিভ করতে হয়ে । এরই ধারাবাহিকতায় সরকারী ফোনে একটা কল আসে। রিসিভ করতেই ওপাশে সুললিত নারী কন্ঠ আমাকে সালাম জানিয়ে বলে, স্যার আমি সোহেলী। নামটা শুনেই যেন হ্্রদয়ের পালে হাওয়া বয়ে গেল এক ঝলক। যদিও ওর তখন নামটা বলার প্রায়োজন ছিল না। কেননা সালামটা শুনেই আমি তাকে চিনেছিলাম । ওই কন্ঠস্বর আর ভুলে যাওয়ার মত নয়। আমি হয়তো কোনদিনই ভুলে যেতে পারবো না সোহেলীর কণ্ঠস্বর বা সোহেলীকে।
আমার ভেতরে একটা সুখের চনমনে বাতাস শুড়শুড়ি দিয়ে গেল। কিন্তু অফিসে ছিলাম তাই কথা হল খুবই পরিমিত। জানতে চাইলাম, আমার নম্বরটা কোথায় পেলে ?
সে বলল, ইন্টারনেটে সার্চ করে পেয়েছি।
আমি বললাম, আমার নম্বর ইন্টারনেটে আছে নাকি?
বলল, জ্বি স্যার, ইন্টারনেটে বাংলাদেশের সকল জেলার জেলা প্রশাসকের ফোন নম্বর পাওয়া যায়। সেখান থেকে রাজশাহীরটা খুঁজে আপনারটা নিলাম। তারপর খুব ভয়ে ভয়ে কল করলাম। কিন্তু প্রথমে ফোনটা রিসিভ করলো এক নারী কণ্ঠ। তাকে আপনার কথা বলার পর সে আমাকে বলল ওই ন¤বরেরই শেষ ডিজিট ৭ এর পরিবর্তে ৮ দিলেই আপনাকে পাওয়া যাবে। তারপর সেই নারী কণ্ঠ আমার পরিচয় জানতে চাইল। আমি কে, আপনার কি হই, কোথা থেকে বলছি এসব।
তাই নাকি? এত প্রশ্নতো করার কথা না। তারপরেও করেছে ওটা হয়তো তার ব্যক্তিগত কৌতুহলেরই কারন। যে ফোন ধরেছে সে এখানেরই এক অফিসার। তুমি মেয়ে বলেই তার কৌতুহলের কারন। যাক তাতে সমস্যা নেই । তুমিতো অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে। কেমন করে আমাকে বের করে ফেললে। আমিতো সৃষ্টিকর্তার উপরই হাল ছেড়ে বসেছিলাম। তিনি যদি ফের তোমার সাথে সাক্ষাৎ ঘটাতেন তাহলে হতো, নইলে ভাগ্যের পরিহাস মনে করে চুপ করে থাকতাম।
তারপর বললাম, তোমার সাথে তো সেদিন ভাল করে কথাও বলতে পারলাম না। কিছু মনে কর না প্লিজ। আমার চাকরীটাই এমন যে ইচ্ছা থাকলেও কোনকিছু করতে পারি না। তোমার যদি সময় হয় আসো একদিন কোথাও বসে গল্প করা যাবে।
আমার কথাটি শুনে সোহেলীর মনেও ভালোলাগার সুখানুভূতি দোলা দিয়ে গেল । বলল, স্যার সত্যি বলছেন? তাহলে আগামী কালই আমি আসি
আমিও সঙ্গে সঙ্গে আগামী কালকের কর্মদিবসের উপর মনে মনে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললাম, ঠিক আছে তাহলে সন্ধ্যা সাতটায় চলে এসো। কোথায় আসতে হবে তাও বলে দিলাম। তারপর আমিও অপেক্ষা করতে থাকলাম পরের দিনটির জন্য। তার আগে সোহেলীকে বললাম, আমি কি এখনো তোমার স্যার? ওই সম্বোধনটা এখনো নাকের ডগায় ঝুলিয়ে রেখেছ কেন?
আমার কথাটি শুনে তার আপ্লুত খুশির ঝিলিক মাখা মুখখানা আমি মনে মনে দেখতে পাচ্ছিলাম।
সোহেলী বলল, তাহলে কি বলব স্যার?
যা খুশি বলো। কিন্তু ‘স্যার’ নয়। এমনিতেই এই ডিপর্টমেন্টে চাকরী করছি বলে ‘স্যার’ শব্দটা এত বেশি শুনতে হয় যে ওটাকে এখন বেশ সস্তা মনে হয়। তোমার কাছ থেকে ওই সম্বোধন শুনে শব্দটার সস্তা ব্যবহার আর করতে দিতে চাচ্ছি না। স্যার ছাড়া তুমি আর যাই বলবে তাই আমার কাছে দামী মনে হবে।
এরপর সোহেলী খুব মিষ্টি করে বলল, আচ্ছা সেটা আগামী কাল দেখা হলেই ঠিক করে নিব আপনাকে কি বলে ডাকবো।
কথাটি এমন মিষ্টি করে বলল যেন মনে হলো আমার কানে-মনে-প্রানে লেগে রইল বহুক্ষণ।
*
রবীন্দ্রনাথ একটি কথা বলেছিলেন, “তুমি যদি কাউকে ভালোবাসো তবে তাকে ছেড়ে দাও। যদি সে তোমার কাছে ফিরে আসে, তবে সে তোমারি ছিল। আর যদি সে ফিরে না আসে তবে সে কোনদিনই তোমার ছিল না”। সোহেলীকে আমি মনপ্রাণ উজাড় করেই ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু কখনো তাকে অধিকার করতে চাইনি। তাকে বেঁধে রাখতে চাইনি। রবিঠাকুরের কথাই আজ সত্যি মনে হচ্ছে । সোহেলী আমারি ছিল। আর তাইতো এতকাল পর সে আমার কাছে আবার ফিরে এসেছে।
“ভালোবাসার মানুষটি যেখানে যতদূরেই থাকুক না কেন, তাকে একইভাবে হ্্রদয়ের মাঝে রেখে ভালোবেসে যাওয়া যায় অনন্তকাল”।
সারাদিনের কাজগুলো দ্রুত শেষ করে নিলাম যাতে সন্ধ্যায় রিলাক্স মুড এ সোহেলীর সাথে দেখা করতে যেতে পারি। সকাল থেকেই দিনটা যেমন ঝামেলাহীন পার হচ্ছিল। মনে মনে আশংকায় ছিলাম, না জানি সন্ধ্যায় কোন্ ঝামেলার মধ্যে পড়ি। এমনটা প্রায়ই ঘটে। যেদিন একটু শান্তিতে থাকতে চাই সেদিনই অশান্তি হয় সবচেয়ে বেশি।
হলোও তাই।
বিকেল পাঁচটায়ই ঘটল দুর্ঘটনাটি। আমার জন্য এসব আর এখন দুর্ঘটনা না। নিত্য নৈমিত্যিক ঘটনা। এদেশে এখন আর কোন দুর্ঘটনা নেই। সবই হল সাধারণ ঘটনা। সেরকমই এক সাধারণ ঘটনায় আমাকে সবকিছু ফেলে তুরণ ছুটে যেতে হল।
কেমন করে যেন ঠিক সেই সময়টাতে আমি অন্য সবকিছু ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম সোহেলীর কথাও। সোহেলীর সাথে দেখা করার কথাটিও।
ফেরী বা লঞ্চযোগে পদ্মা নদী পাড়ি দেয়ার সময় যখন নদীর মাঝ বরাবর থাকি, তখন হঠাৎ করেই গভীর জলরাশির ভেতর থেকে ঝপাৎ করে এক পলকের জন্য মাথা তুলেই আবার হারিয়ে যাওয়া শুশুকের মত আমার মনের প্রবাহে সোহেলী ভেসে উঠল অকস্মাৎ। সাথে সাথে মনে পড়ল ওর সাথে সন্ধ্যা সাতটায় আমার দেখা করার কথা । কিন্তু আমিকি এখন যেতে পারব? সোহেলীতো এসে বসে থাকবে আমার জন্য। এখনি ফোন করে জানিয়ে দেই যে আজ সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, যদি ঝামেলাটা শেষ করে যেতে পারি তাহলে আর শুধু শুধু তাকে আগে থেকেই না করা কেন? অনেক সাধনা করেও এমন একটা সময় বের করা যায় না। কেন তাকে জলাঞ্জলি দেব?
দুর্ঘটনার কাজটি কোনরকম গোজামিল দিয়ে চলে আসার জন্য আমি আদা জল খেয়ে নামলাম । কাজের ক্ষেত্রে সামান্যতম অবহেলা কখনো আমার দ্বারা হয়নি। কিন্তু কেন জানি সেদিন কোন কাজেই আমার মন বসছিল না। সোহেলীর কথা মনে পড়তেই ইচ্ছা করছিল সকল কিছু রেখে আমি দৌঁড়ে ছুটে যাই সোহেলীর কাছে। সোহেলীকে একটি মিনিটের জন্য অপেক্ষা করাতে আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। কেন জানি তখন সোহেলীই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। আর আমি তাই করলাম। কিন্তু আমি যে সময়ের আগেই যেতে পারব তা বুঝিনি। আর একজনের হাতে কাজটি ন্যস্ত করে আমি ফিরে আসলাম। ওজুহাত দিলাম শারীরিক ভাবে আমি অসুস্থ্যবোধ করছি। এমনটা আমি খুব একটা করি না। অথচ তখন করলাম। সোহেলীর জন্য আমাকে আমার ভেতরের ‘আমি’টি এমনটা করতে বাধ্য করলো।
আমার ভেতরে এক অজানা উত্তেজনা আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছিল কোথাও। এমন অনুভূতি এর আগে কখনো অনুভব করিনি। এ সবই ভালোবাসা বলে প্রতীয়মান হতে লাগলো। ঘরে ফিরে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। সাদামাটা আমি, বরাবর যেরকম থাকি সেরকমই । কিন্তু মনের গহীনে কোথায় যেন একটু খচখচানি। আয়নায় নিজেকে যতœ করে একবার দেখে নিলাম। একবার না, মনের অজান্তেই দেখে নিচ্ছিলাম বারবার। বহুদিন আয়নায় এমন করে নিজেকে দেখা হয়নি আমার।
বাসা থেকে বের হওয়ার আগ মুহুর্তে সোহেলীকে ফোন করলাম। মনে মনে ভাবছি মেয়েটা হয়তো আমাকে একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন পুরুষ ভাবছে। উচিৎ থাকা সত্ত্বেও সারাদিন একবারও খবর নিলাম না তার। সারাদিন আমার উপর দিয়ে কী ঝড়টাই বয়ে গিয়েছিল সেটা আর তাকে বলার প্রয়োজন মনে করলাম না।
*
সোহেলীর ফোনটা অপেক্ষমাণ পেয়ে আমার ভেতরের অস্থিরতা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল । বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল কপালে। অপেক্ষমাণ এর পর যখন আবার ডায়াল করলাম তখন আবারো ফোনটি বন্ধ পেলাম। টের পাচ্ছি আমার রক্তচাপ তখন দ্রুত গতিতে দৌঁড়াচ্ছে আর হ্্রদয়ের কম্পনও বেড়ে যাচ্ছিল।
অনেকবার ডায়াল করার পরে যখন ফোনটা রিসিভ হল একটু স্বস্তির নি:শ্বাস নিলাম । কিন্তু আমার সেই স্বস্তিটুকু নিমিষেই উবে গেল । হাত থেকে আচমকা ফোনটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে সাথে সাথে কয়েক টুকরা হয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে তুলে নিলাম ফোনটা। এমন করে ভেঙ্গেছে যে ওটা দিয়ে আপাতত আর কিচ্ছু হচ্ছে না। ভাঙা ফোনটা কোনরকম টেবিলের উপর রেখে সরকারী ফোনটা হাতে নিলাম । আশ্চযর্! কোথাও সোহেলীর নম্বরটি নেই। তখনি মনে হল তার সাথে আমি ব্যাক্তিগত ফোন দিয়েই কথা বলতাম এবং সেই ফোনেই ওর নম্বরটি সেভ করেছিলাম। সোহেলীকেও একদিন বলেছিলাম আমাকে ফোন করলে যেন ওটাতেই করে । সরকারী ফোনের কথাবার্তা সব রেকর্ড হয়, তাই আমি ব্যক্তিগত কাজে সেটা কখনোই ব্যবহার করি না।
ভাঙা ফোনের সিমকার্ড খুলে অন্যটার মধ্যে দিয়ে সোহেলীর নম্বর খুঁজলাম।
‘‘ভাগ্য যখন খেলা করে তখন চারিদিক দিয়েই সে খেলায় মেতে ওঠে’’। তখন আমার ভাগ্য আমাকে নিয়ে খেলায় মেতেছিল। তার নম্বরটা আমি সিম কার্ড এ সেভ না করে মোবাইলে করেছিলাম। তখন তাই অন্য ফোনে সিমকার্ড দিয়েও নম্বরটা পেলাম না। উদ্বিগ্নতা আমাকে চেপে ধরলো। সোহেলী নিশ্চয়ই এতক্ষণে বেরিয়ে গেছে। সরকারী ফোনটা বন্ধ রাখার নিয়ম নাই। তাই ব্যক্তিগত সিমকার্ডটা খুলে সরকারী ফোনটা একটিভ রাখলাম। মনে মনে জপ করতে লাগলাম সোহেলী যেন একবার অন্তত সরকারী ফোনে একটা কল করে।
উহ্ কী যন্ত্রনা। এমন কেন হলো!
সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল, সোহেলীর ফোন আর আসে না। এখন কি করা উচিৎ, কিভাবে সোহেলীর সাথে কথা বলা যায় সেই চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। ভাবলাম যেখানে দেখা করার কথা সেখানেই সরাসরি চলে যাই। আবার ভাবলাম আমাকে না পেলে তো সোহেলী একা ওখানে যাবে না। অনেক ভেবে চিন্তে শেষে ঠিক করলাম তার বাসায়ই যাব। এছাড়া আর কোন উপায় দেখছিলাম না তখন।
কিন্তু সোহেলীর বাসার ঠিকানাই তো জানা ছিল না আমার। একদিন শুধু লোকেশনটা একটু জেনেছিলাম। চাকরীর সুবাদে এই শহরটা আমার নখদর্পনে। লোকেশন জানা থাকলে কোন বাসা খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট হবে না । ঠিকই বের করতে পারবো সোহেলীকে।
মনের ভেতর ভিন্নরকম এক উত্তেজনা নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। শহরের সীমানা পেরিয়ে একটা জায়গায় এসে ড্রাইভারকে বললাম আমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে। গাড়ি বিদায় দিয়ে ছোট রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম।
দিনটা ছিল শুক্রবার। তাই শুধুমাত্র কিছু খাবার দোকান ছাড়া প্রায় সব দোকানপাটই ছিল বন্ধ। ফোনটা ভেঙে যাওয়ার সাথে সাথেই ভেবেছিলাম আগে আর একটা মোবাইল সেট নিয়ে নেই। পরক্ষণেই মনে পড়ল আজ শুক্রবার। সব মার্কেট বন্ধ।
এখন রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আর সরকারী ফোনটার দিকে বারবার তাকাচ্ছি। একটি বারও কি সোহেলী এটাতে কল করতে পারে না? সে কী করছে এখন! আমাকে কী খুঁজছে না? কী ভাবছে আমাকে নিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে আনমনা আমি হঠাৎই একটা রিক্সার সাথে ধাক্কা খেলাম। রিক্সাটি প্রায় আমার পায়ের উপর উঠে যাচ্ছিল।
রিক্সার আরোহী ভদ্রলোক ভদ্রতা দেখিয়েই বললেন, সরি । আমি বললাম ভুল তো আমারি ছিল, বেখেয়াল হয়ে চলতেছিলাম তাই আই এম সরি। সে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল ইট্স ওকে ব্রাদার।
রিক্সাটা সামনের দিকে দু’চাকা যেতেই ভাবলাম এই লোকটা যেহেতু এ পাড়ায় যাচ্ছে তো সোহেলীর বাসাটা চিনলেও চিনতে পারে। তাকে কি ডেকে জিজ্ঞাসা করবো? কিন্তু সোহেলীর কথা বললে কি চিনবে? ওর হাজব্যান্ডের নাম বললে হয়তো চিনতে পারে।
সোহেলীর হাজব্যন্ডের নাম বলে বাসার ঠিকানাটা নেব ঠিক সে সময়ে মনে হল আমিতো সোহেলীর হাজব্যন্ডের নামই জানি না। তাহলে কিভাবে খুঁজে বের করবো সোহেলীকে। ওই মুহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর প্রথম কাতারের গর্দভ বলে মনে হলো। সোহেলীর ভাষায় “হাদারাম”।
ব্যক্তিগত ফোনটি ভেঙে যাওয়ার পর আমি যখন অফিসের ফোনে ব্যক্তিগত সিমকার্ডটি ব্যবহার করে সোহেলীর নম্বরটি খুঁজতেছিলাম ঠিক সেই সময়ে সোহেলী আমার ব্যক্তিগত ফোনে না পেয়ে অফিসের ফোনে কল করে। যথারীতি সে ফোনটি বন্ধ পায়। আবার আমি যখন সরকারী ফোনটি একটিভ রাখি, সে তখন ব্যক্তিগত ফোনে হাজার বার কল করে এবং বন্ধ পায়। এমন করে করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে এবং সাতটা বাজার পঁিচশ মিনিট আগে দরজায় বেল বাজলে সোহেলীর হ্্রদয়ের সমস্ত শিরা উপশিারায় ঢং ঢং ঘন্টা বেজে ধরপাকড় করা মনে হাজার রকমের উদ্বিগ্নতা নিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।
দরজা খুলতেই প্রাণখোলা হাসি নিয়ে সামনে দাঁড়ায় সাদি। বিষ্ময় নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সোহেলীর মুখ ফসকে বের হয়েই যায়-তুমি?
কেন তুমিকি অন্য কাউকে আশা করেছিলে নাকি?
না তো, আর কাকে আশা করবো? এমনি বললাম। যাক ভালোই হয়েছে তুমি এসে পড়েছ।
কাঠের পুতুলের মত কথাগুলো বলে সাদির হাত থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে সোহেলী।
রাতের বেলা খাবার টেবিলে সোহেলীর আংশিক গোমড়া এবং ভারাক্রান্ত মুখটি অবলোকন করে সাদি বলল, তোমার কি মন খারাপ ?
না তো। কেন?
কেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে । কথাও কম বলছ। আমি একদিন আগে চলে আসলাম তাতে তুমি খুশি হওনি ?
কি যে বলো না তুমি । অবশ্যই খুশি হয়েছি।
আমিওতো তাই ভাবতাম। প্রতিবারই বাইরে যাওয়ার সময় তোমার মন খারাপ থাকে। তোমাকে একা একা রেখে যাই আমারো ভাল লাগে না। তারপরেও যেতে হয় বাধ্য হয়ে। তুমি বারবারই বলে দাও যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসি। তাই এবার যাওয়ার পরেই আমি আপ্রাণ চেষ্টা করলাম যেন কাজগুলো দ্রুত শেষ করে একদিন আগে হলেও ফিরে আসতে পারি। তাইতো চলে এলাম। আনোয়ারের বাসায় একটা দিন থাকার জন্য সে খুব ধরেছিল আমাকে। আমি বললাম, নারে বউ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। অন্য সময় তাকে সহকারে এসে দুদিন বেড়াবো। এটা শুনে আনোয়ার কি বলল শুনবে ?
কি বলে?
সে বলে, এই একটা কথা এ পর্যন্ত তো বহুবার শুনেছি। আজ পর্যন্ত তোর আসার সময় হয়নি। আর হবে বলেও আমার মনে হয় না।
সোহেলী বলল, সে তো ঠিকই বলেছে ।
কি করব বলো, ব্যবসার কাজে এত ব্যস্ত থাকি যে কোথাও কাউকে সময় দিতে পারি না। সকলেই অভিযোগ করে।
কথা ঠিকই বলছে শুনছে কিন্তু কোনটাতেই যেন সোহেলীর মনোযোগ নেই। ব্যাপারটা সাদির দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। কথাগুলো ঠিক মন দিয়ে শুনছে না সোহেলী। প্লেটের ভাতগুলো আঙ্গুল দিয়ে এদিক সেদিক নাড়াচড়া করছে আর কোথায় কোন ভাবনায় যেন ডুবে আছে। শুধু এক কথায় হু হা জবাব দিচ্ছে।
সাদি বলল, কি ব্যাপার বলোতো?
চমকে উঠে সোহেলী। নিজেই নিজের কাছে লজ্জা পায়। এমন কেন করছে সে। তারতো এটা করার কথা না। আসলেই তো সাদি একদিন আগে ফিরে আসাতে তার উচ্ছাস প্রকাশ করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা না করে স্যারের সাথে দেখা করতে না পারার বেদনাটা মনটাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। এ তো অন্যায়। ভারি অন্যায়।
সোহেলী তখন নিজেকে স্বাভাবিক ভাবে উপস্থাপনের যথাসাধ্য চেষ্টা করে । তারপর সাদির কাছে অন্য সব দিনের মতই দুবাইয়ের ট্যুর সম্পর্কে এটা ওটা জানতে চায়। সাদিও গল্প জুড়ে বসে। গল্প করতে করতে সবকিছু ঠিক হয়ে যায় এক সময়। তবু অতি সন্তর্পনে হ্্রদয়ের মাঝে রয়ে যায় কোন একজন। তা শুধু সেই জানে আর জানে তার মন।
এরই নাম সংসার।
বাইরে তখন ডানাকাটা পাখির মত ছটফট করে অন্য একজন। ঠিকানা খুঁজে না পেয়ে ফোনে না পেয়ে অবশেষে এক বুক হতাশা নিয়ে বাসায় ফিরে এসে খোলা সাদে গিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে শীতল পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। সেভাবেই পার হয় রাত। পুরো একটি রাত সে আকাশের সাথে মিতালী করে দুটি চোখ খোলা রেখে পার করে দেয়।
*
হাওড়ের পাড় বেয়ে নেমে যাওয়া ছোট ছোট মাচাগুলো দেখতে খুবই চমৎকার লাগে। এসব হাওড়ে বছরের বারো মাসই পানি থাকে। বর্ষাকালে ক’ল কিনারা ছাপিয়ে ওঠে মহা সমুদ্রের মত রূপ ধারণ করে। শুস্ক মৌসুমে পানি কিছুটা কমলেও একেবারে শুকিয়ে যায় না কখনো। বিশাল এই হাওড় অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হল নৌকা। ছোট ছোট এই মাচাগুলো মাছ ধরার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এখানে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরে স্থানীয় হাওড়বাসী। কখনো কখনো শহরাঞ্চল থেকেও সৌখিন কেউ কেউ বড়শি নিয়ে এসে বিশাল শান্ত জলরাশির তীর ঘেষে বসে মাছ ধরে।
আমি অনেকবার সেখানে গিয়েছিলাম । স্থানীয় একজন রাজনৈতিক নেতার সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকার কারনে তার সাথে প্রায়ই যাওয়া হতো। তাছাড়া জায়গাটা আমার বড়ই ভাল লাগে।
আজ সোহেলীকে নিয়ে সেই হাওড়ের একধারে বসে আছি, যেখানে মাথার উপর বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে কৃষ্ণচুড়া আর হিজলের ছায়া, তারই ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে আছে বৈশাখের শেষ বিকেলের একধারে পুঞ্জীভূত হওয়া মেঘময় আকাশ। ঝিরিঝিরি বাতাসে হাওড়ের পানিতে ছোটছোট ঢেউগুলো চিকচিক করছে। সূর্যটা হেলে পড়ছে দিগন্তের কাছাকাছি। চারিদিকে ঘন সবুজের মাঝে বিশাল শান্ত জলরাশির এই মোহনীয় পরিবেশটা যেন আজ আরো মোহনীয় রূপে সেজেছে।
জায়গাটা সোহেলীর দারুন পছন্দ হয়েছে । আমি যতবারই ওর দিকে তাকাই চমকে উঠে ভাবি একি সোহেলী, নাকি এই শান্ত নির্মল জলরাশিতে ফুটন্ত এক গোলাপী পদ্ম! মাঝে মাঝে পদ্মটি তার পাপড়িগুলো মেলে ধরে খিলখিল হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। একটুখানি প্রবাহ দিতেই সোহেলীর উচ্ছাস ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এই মুগ্ধতা আমার মন-প্রাণ ছুঁয়ে গিয়ে ভালোবাসার এক অনবদ্য কবিতা সৃষ্টি করতে থাকে।
এখনো সে আমাকে স্যার বলেই ডাকে। প্রতিবারই ‘স্যার’ শব্দটি বলার পর সোহেলী বলে এবারই শেষ, এর পরেরবার আর ‘স্যার’ বলবো না। অন্যকিছু বলবো। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে ‘স্যার’ ছাড়া সেই ‘অন্যকিছু’টা আর বলে উঠতে পারেনি। একবার আমি তার ডাকে সাড়া না দিয়ে চুপ করে ছিলাম। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, তাহলে আপনাকে আমি কি নামে ডাকবো সেটা আপনি ই বলে দেন। আমিও ভেবে পেলাম না সোহেলী আমাকে কী বলে ডাকলে আমার ভালো লাগবে।
সেদিন সোহেলীর বাসার ঠিকানা খুঁজে না পেয়ে পুরো রাত আমি ছাদে পার করি। রূপাকেও ফোন করা হয় না আমার। রূপা একবার কল করেছিল তাও রিসিভ করিনি। কেন জানি কোনকিছুই ভাল লাগছিল না।
তার পরদিন সকাল এগারোটায় নতুন সেট এ নতুন রিং টোনে বেজে উঠল পুরোনো পরিচিত নম্বরটি। অপেক্ষা করছিলাম অধীর হয়ে। সোহেলী তখন বিস্তারিত বলল।
আমার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে সেও ভীষণ উদ্বিগ্নতায় রাত পার করেছিল। আর আমি তখন এই ভেবে অস্থির যে আমার জন্য না জানি সোহেলী কত কষ্ট পেয়েছে। প্রথমবার দেখা করার কথা বলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কোন যোগাযোগ করতে পারিনি । আমার পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা চেয়ে নিলাম। সোহেলী বলল, খুব ভালো হয়েছে আপনার ফোনটি ভেঙে গিয়ে, আর আমার নম্বরটি না পেয়ে। কেননা আপনি তখন ফোন করলে আমি অপ্রস্তুত হয়ে যেতাম। সাদির সামনে কিছুতেই কথা বলতে পারতাম না। যদিও আমার মনের ভেতরে তখন কী যে এক উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আমাকে এলামেলো করে দিচ্ছিল সেটা কাউকে বুঝানোর ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল আপনার সাথে একবার কথা বলে সবকিছু বলতে পারলে মনটা শান্ত হত। যখন ভাবছিলাম আপনি হয়তো সেই জায়গায় গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন, তখন খুব কষ্ট অনুভব করেছি। নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়েছে। এদিকে আমার ভেতরের অস্থিরতার কারনে বারবারই আমি ধরা পড়ে যাচ্ছিলাম সাদির কাছে। তবুও নিজেকে সামাল দিয়েছি। তবে সাদি আসার আগে আপনাকে হাজারবার ফোন করেও যখন পাচ্ছিলাম না, মনে হচ্ছিল দুনিয়াতে এরচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ সময় বুঝি আর নেই। আমার সেরকম অস্থির করা মানসিক অবস্থার মধ্যে সাদি বাসায় আসে। আমার মুখের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করে আমি ঠিক আছি কিনা।
কথা বলতে বলতে কেটে গেল অনেকটা সময়। আমি বারবারই দেখা করার কথা বললাম। কেন জানি আমার ভেতরে এক প্রবল ইচ্ছা জাগতেছিল সোহেলীর সাথে একান্ত কিছু সময় কাটানোর জন্য। ওকে আরো নিবিড়ভাবে কাছ থেকে দেখার জন্য। তখনি ঠিক করে নিলাম ওইদিন বিকেলে আমরা দেখা করবো। পূর্বের নির্ধারিত সেই জায়গায়।
সেও এক কথায় রাজি হয়ে গেল।
যথারীতি দুজনে যার যার স্থানে থেকে মনটাকে সাজিয়ে নিচ্ছিলাম অতি যতœ করে। সময় যতই ঘনিয়ে আসছিল মনের মাঝে রঙিন প্রজাপতিগুলো ততই পাখনা মেলে ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে। সেদিন সকাল দুপুর বিকেল বেশ কয়েকবার কথা হলো আমাদের। আমরা দুজনেই সংকোচবোধের খানিকটা অংশ ঝেড়ে ফেলে অনেকটা সাবলীলভাবে কথা বলছিলাম। সেদিন অফিসেও আমার কাজের চাপ কিছুটা কম ছিল। তাই সোহেলীকে সময় দিতে পেরে মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছিল।
বাসা থেকে বের হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সোহেলীর কল পেয়ে হরষিত চিত্তে কানে চেপে ধরতেই কিছুটা নীরব সুরে সে বলল, স্যার একটা কথা বলতে চাই। আমি বললাম, কী কথা, আমাদের দেখা হচ্ছে না আজ? কেন জানি ওর কণ্ঠস্বরই আমাকে বলে দিচ্ছিল এমনই একটা কিছু বলবে সে।
সোহেলী তখন বলল, স্যার আমার মনে হয় এভাবে লুকোচুরি না করে ব্যাপারটাকে আমরা কিছুটা স্বাভাবিক ভাবে নিয়ে আসতে পারি।
সেটা কীরকম?
আমি না হয় সাদিকে আপনার কথা বলি। এখানেতো দোষের কিছু নাই। আপনি আমার শিক্ষক ছিলেন। এখন এখানে চাকরী করছেন, আপনার সাথে আমার দেখা হয়ে গিয়েছিল-এসবই সত্য সত্য বলবো। তারপর আমিই বলবো আপনাকে একদিন বাসায় নিয়ে আসার জন্য। সাদি এমনিতে খুব ভালো ছেলে। সামাজিকতাবোধ তার মধ্যে প্রবল। আমার মনে হয় সে কিছু মনে করবে না। সহজভাবেই সে বলবে, ঠিক আছে তাহলে তোমার স্যারকে আসতে বলো। আর এ উপলক্ষ্যে আপনার সাথে তার পরিচয়টাও হলো।
কথাটা মন্দ বলোনি তুমি। তোমার মাথায়তো বুদ্ধি আছে দেখছি। ঠিক আছে তাহলে তাই করো।
তাহলে স্যার আমরা সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করি। আগে সাদির সাথে আপনার সাক্ষাৎটা হোক। তারপর আপনাকে সহ অথবা আপনার সাথে আমি একা কোথাও গেলেও সে ততটা সন্দেহ করবে না। আপনিও সময় পেলে আমার বাসায় চলে আসতে পারবেন। ছুটির দিনে আমরা সবাই মিলে আড্ডা দিতে পারবো।
তুমি যেটা ভালো মনে করো তাই করো।
কথাটি শুনে কেন জানি আমার মনটা একটু উদাস হয়ে গেল। তাহলে কী সোহেলীর কথাটা আমার ভালো লাগেনি? পরপর দুদিন দেখা করার সমস্ত আয়োজন করেও দেখা করতে না পেরে আমার মধ্যে কি অন্যরকম ভাবনার উদয় হলো? সোহেলীর প্রতি কোন বিরাগ কিংবা অভিমান! কিন্তু ওর ভাবনাতো ঠিকই মনে হচ্ছে। ‘এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের চিন্তাভাবনাই বেশি প্রখর এবং যুক্তিযুক্ত হয়। ওরা ঠান্ডা মাথায় সবকিছু ভাবতে পারে। একসাথে অনেক বিষয় নিয়ে ভাবা এটা মেয়েদের দ্বারাই সম্ভব’। আর আমিতো শুধু একটা বিষয়ই ভাবছি, ওর সাথে দেখা করা ছাড়া অন্য কিছুই মনে আসছে না আমার। এটা কি আমার ভাবনার উন্নত রূপ নাকি অবনতি? আমি কেন তাকে ওমন করে পেতে চাইছি। আমাদের দুজনেরই আলাদা জগৎ সংসার আছে। এই সব কিছু ঠিক রেখেই আমাদের মাঝে সুন্দর একটা সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। যেখানে কোন কালিমা থাকবে না, থাকবে না কোন দেনা পাওনা আর অবিশ্বাসের অস্তিত্ব।
ওই মুহূর্তে আমার নিজের উপর এক ধরনের ধিক্কার এলো। মনে হলো আমার মনটা সোহেলীকে নিয়ে নোংরা কিছু ভাবতেছে। সোহেলী আমার প্রথম জীবনের অনুক্ত ভালোবাসা ছিল। কিন্তু ‘সেই সময়’ এখন আর আমাদের মাঝে বিরাজমান নেই। সময় আমাদেরকে বয়ে নিয়ে এসেছে অনেক অনেক দূর। এখন এতটা উতলা হওয়ার কোন মানে নেই।
পরদিন যথাসময়ে সোহেলীর ফোন আসে। সাদীর কাছে আমার কথা বলেছে সে। সেদিনই সন্ধ্যায় সোহেলী কথা বলার এক মুহূর্তে বলল, স্যার আমার হাজবেন্ডের সাথে কথা বলেন। সে আগে থেকেই আমাকে এটা বলে রেখেছিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তার সাথে আমার কথা হলো। তখনি সাদী আমাকে তাদের বাসায় নিমন্ত্রণ জানায়।
ওদের বাসায় যাওয়ার পরদিনই আমরা আমাদের কাঙ্খিত দিনটি অর্জন করি। সেদিনই সাদি আবার ব্যবসার কাজে রাজশাহীর বাইরে যায়।
*
জলের উপর ছোটছোট ঢেউ সৃষ্টি করে চলে সোহেলীর দুটি পা। আর গল্পের ছলে বারবারই পিছনে ফিরে যেতে চায় সে। সেই সময়গুলোর গল্প যেন কখনোই পুরনো হবার নয়। মনের পুরনো সব স্মৃতিস্তপের ভেতর থেকে আজও হীরকের মত দ্যূতি ছড়িয়ে যাচ্ছে সোহেলীর সাথে আমার কাটানো সেসব মুহুর্তগুলো। আমিও যে সেই দিনগুলোর কথা বলতে বা শুনতে বেশ আহ্লাদবোধ করছি না তাতো নয়। জীবনের ওই সময়টার মূল্য আমার কাছেও অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে একটু বেশিই। তবে সোহেলীর মতো আমার প্রকাশভঙ্গিটা ওরকম স্বচ্ছ আর অকৃত্রিম হতে পারে না। আমার ভেতরের অভিব্যক্তি আগেও আমি যেমন করে লুকিয়ে রাখতাম এখনো তেমনি রাখি।
আমার জীবনের গল্পগুলো ছেড়া ছেড়া তুলোর মত এখান ওখান থেকে একটু একটু করে সোহেলীকে শুনাচ্ছিলাম। আর শুনছিলাম তারটাও। তবে সে যেন তার টা শুনানোর চেয়ে আমারটাই শুনতে বেশি আগ্রহী ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে কেমন করে রূপা এলো আমার জীবনে, সেই শুধু আসা ই নয়; একেবারে যে আমার জীবনের সাথে অঙ্গীভূত হয়ে রয়ে গেল সেসব গল্পও বলছিলাম। সোহেলী রূপার ছবি দেখতে চাইলো পর আমার মোবাইল থেকে রূপা এবং মৌটুসীর ছবি দেখালাম।
আচমকা সোহেলীর চোখে বিষন্নতার মেঘ পুঞ্জীভূত হতে দেখে আমার কেমন জানি কষ্ট হয়। যেন গভীর কোন দু:খের অনল মনের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে সোহেলী। সেই অনলের বুদবুদ ধোঁয়া আড়াল করতে যেয়ে ব্যর্থ সোহেলীর চোখের তাড়ায় চোখ রাখতেই দৃষ্টি আড়াল করে নেয়। কৌতুহল দমনে ব্যর্থ হয়ে বলেই ফেললাম-
কী ভাবছো সোহেলী?
কই নাতো স্যার। কিছু তো ভাবছি না আমি।
তাহলে আমার দিকে তাকাও। মনে হচ্ছে তুমি যেন কি ভাবছো। আমার কাছে কিছু লুকাতে চাইছো নিশ্চয়ই। তোমার মনটা হঠাৎ কেন খারাপ হয়ে গেল? কোন সমস্যা থাকলে আমাকে বলতে পারো। রূপার ছবি দেখে কি তোমার মন খারাপ হয়েছে?
সে তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, না না, এসব কি বলছেন? তাকে দেখে কেন আমার মন খারাপ হবে? বরং তার ছবি দেখার পর সরাসরি তাকে দেখার বাসনা জেগেছে মনে। কতটা সৌভাগ্যবতী সে, সেটা দেখতে ইচ্ছা করে।
তাহলে কী লুকাচ্ছ আমার কাছে বলো? তোমার মনে গভীর কোন দু:খের ছায়া দেখতে পাচ্ছি আমি। আমার অন্তর্দৃষ্টি কতটা প্রখর আশা করি সেটা তুমি মনে রেখেছো।
আমার কথায় সোহেলীর আবেগ আরো ঘনীভূত হয়ে উঠল। কিন্তু সে যথাসাধ্য নিজেকে দমিয়ে রেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চেষ্টা করল। আমিও ভাবলাম হয়তো এমন কিছু কষ্ট আছে, যা সে আমাকে বলতে চাইছে না। অযথা কেন বিরক্ত করছি তাকে। সোহেলীকে অপ্রস্তুত করে দেয়ার জন্য মনে মনে নিজের উপরই রাগ হল।
ফেরার পথেও খুব একটা কথা বলল না সোহেলী । গাড়ির জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে ছিল। শুধু তাকিয়েই ছিল, কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম সে কিছুই দেখছিল না। ওর মনের এই আকস্মিক পরিবর্তন আমার মনটাকেও রেহাই দিল না। বারবারই জানতে ইচ্ছা করছিল কী এমন সমস্যা যা আমাকে বলা যায় না। বুঝতে পারলাম মনের মাঝে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এক কষ্টের কুন্ডুলি বয়ে বেড়াচ্ছে সে। তাই আর কিছুই জানতে চাইলাম না। শুধু ফিরে ফিরে ওর চোখের দিকে তাকাচ্ছিলাম।
*
এরপর প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন অজুহাতে আমাদের দেখা হতে থাকে। একদিন সোহেলী আমার অফিসেও চলে আসে। কিছু না বলেই এক বিকেলে ওর উপস্থিতি আমাকে অপ্রস্তুত করে দেয়। একই সাথে আনন্দিতও করে।
সেদিন অফিসের সবাই কেমন ঘুরে ঘুরে আমাদেরকে দেখছিল। সোহেলী চলে যাওয়ার পরে দু’একজন তার পরিচয়ও জানতে চেয়েছিল। সোহেলীকে আমি যখন একেবারে প্রধান ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছিলাম সমস্ত অফিস যেন আমার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। রোজ কত লোকের আনাগোনা এই অফিসে। কত মানুষইতো আসে যায়। কই এমনতো কখনো আমার প্রতি কারো কৌতুহল জাগেনি। তাহলে কী সোহেলীর সাথে আমার ব্যবহারই বলে দিচ্ছিল আমাদের মধ্যে কিছু একটা আছে? কিন্তু সেই কিছু’টা কী? আসলে কী আমাদের আচরণে সেরকম কিছু প্রকাশ পায়?
বেশ কয়েকবার ওদের বাসায়ও যাওয়া হল আমার । এখন আর আমার ছুটির দিনগুলোতে একাকিত্ব এসে ভর করে না। কথা বলার মানুষের অভাবে ছাদের উপর কবুতর নিয়ে খেলা করি না। বড়শী হাতে ওই রাজনৈতিক ব›ধুটির সাথে হাওড়ের পানিতে মাছও ধরি না। কাজের ব্যস্ততা ঠিক আগেরই মত আছে। কিন্তু কেন জানি কাজগুলোতে এখন আর আগের মত ক্লাšত হই না। অযথা কোথাও সময় নষ্ট করি না।
দিনে বেশ কয়েকবার সোহেলীর সাথে কথা হয়। রূপার সাথে ঠিক যেমনটি আগে হতো তেমনই রুটিম মাফিক। তবে ইদানীং রূপার মন মেজাজ ভালো যাচ্ছে। এর কারন হয়তো আমিই। কেননা আমার মন মেজাজ ভালো আছে বলে রূপার সাথেও ভালো ব্যবহার করছি। এখন আর রূপাকে ফোন করতে ভুলে যাই না। আর যদিও ভুলে যাই বা দেরি হয় সোহেলী আমাকে মনে করিয়ে দেয়।
কিছুদিন আগে আমাদের বিয়ের আট বছর পূর্ণ হল। ওইদিন রূপার জন্য আমি ডাকযোগে কিছু উপহার পাঠাই। বুদ্ধিটা সোহেলীরই ছিল। সোহেলীকে নিয়েই দু’দিন আগে রূপার জন্য একটা শাড়ি কিনলাম। সাথে একটি কবিতার বই এবং ধবধবে সাদা আটটি গোলাপ। সাদা গোলাপ রূপার অনেক পছন্দের। উপহারগুলো পেয়ে রূপার সে কী আনন্দ! এতটা বছরে এমন সারপ্রাইজ সে আর পায়নি। পাবে কিভাবে? আমিইতো দেইনি কখনো। কাজের ব্যস্ততায় আমিও দিনে দিনে কেমন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছিলাম। আর সংসারের এত ঝামেলার মধ্যে কখনো রূপার জন্য আলাদা করে আমার মনে কোন ভাবনার উদয় হয়নি। হয়তো আমিই সেরকম কোন ভাবনাকে মনে ঠাঁই দেইনি।
*
প্রতিবারই যখন ঢাকা আসি প্রথমবার গাড়ি থেকে নেমেই ঢাকাকে আমার কেমন জানি নতুন নতুন লাগে। প্রতিবারই বেশ কিছু পরিবর্তন দেখতে পাই। আবার দেখা যায় কোথাও তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি তবুও আমার চোখে সবকিছু পরিবর্তিত বলে মনে হয় ।
সঙ্গে একটি মাত্র ব্যাগ। গাড়ি থেকে নেমে ব্যাগটি কাঁধে নিয়ে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে হেঁটে যাচ্ছি। রাস্তার পাশে স্তুপ করা ময়লার ডাষ্টবিনগুলো থেকে ছুটে আসা ভোঁস ভোঁস গন্ধে নি:শ্বাস নেয়া দায়। এক ঝাঁক কাক বসে এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ময়লাগুলো থেকে তাদের আহারিত উপাদি খুঁজে খুঁজে খাচ্ছে। যেটুকু পথ তা আমি হেঁটেই চলে যাই। ভোর বেলার এই শান্ত স্নিগ্ধ আলোর হাত ধরে পায়ে চলার একটা অন্যরকম ভালোলাগা আছে।
হাঁটতে হাঁটতে কল্পনায় দেখছি দরজা খুললেই দেখতে পাবো আমার ছোট্ট রাজকন্যা আর তার মা পথের দিকে চেয়ে বসে আছে। ওদের মুখ দেখে আমার সারা রাতের ভ্রমনের ক্লান্তি নিমিষেই উবে যাবে। আমি অবশ্য রূপাকে বলে দিয়েছিলাম মৌটুসীকে যেন না বলে আমি এসময় আসবো। এজন্য বলেছিলাম যে আমার আসার খবরটা জানলে সারারাত আর ওর হবে না। ভোরের অপেক্ষায় থেকে থেকে প্রহর গুনবে সে। তার চেয়ে সেই ভালো আমি এসে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবো এবং চোখ খুলেই আমাকে দেখতে পেয়ে সে যে বিষ্ময়ে নির্বাক হয়ে যাবে সেই দৃশ্যটাই আমি বেশি উপভোগ করবো।
আমাকে হারিয়ে দিয়ে ওরাই জিতে গেল। দরজায় বেল বাজানোরও কোন প্রয়োজন পড়েনি। বাসার সামনে যেতেই দেখি দুজনই রাস্তায় পায়চারি করছে। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওরা বলল আমার জন্যই তারা অপেক্ষা করছিল।
রূপা আমার কথা শুনেছিল ঠিকই, কিন্তু সে নিজেই নিজের উত্তেজনার কাছে হেরে গিয়ে মেয়ের কাছে বলে দিয়েছিল যে আমি ভোরে আসবো। সেই থেকে অপেক্ষা।
“সংসারের মানুষগুলির এই ভালোবাসার সাথে জগতের আর কোনকিছুরই তুলনা হয় না”। অনেকদিন পর সবাইকে কাছে পেয়ে আমারও যেন সুখের সীমা রইলো না।
এই আনন্দ উল্লাসের মাঝে কখনো যে সোহেলীকে মনে পড়েনি তা নয়। সবকিছুর মাঝেই তার মৃদু পেলব ষ্পর্শ আমার হ্রদয়কে শিহরিত করে যাচ্ছিলো। কিন্তু এদিকের ব্যস্ততার কারনে ফোন কিংবা মেসেজ কোনটাই করিনি। আসার সময় সোহেলীকে বলে এসেছি আমি যতদিন ঢাকা থাকবো সে যেন আমাকে ফোন না করে। আমিই সুযোগ পেলে কথা বলবো। অন্যদিন হলে তো এরমধ্যে অন্তত দু’বার তার সাথে কথা হয়ে যেতো। আর মেসেজের আদান প্রদানের কোন নির্দিষ্ট হিসেব নেই।
তিনদিনের ছুটিতে কি কি কাজ সম্পন্ন করতে হবে তার একটা তালিকা আমি রাজশাহী থেকেই করে এসেছিলাম। তার সাথে যুক্ত হলো আরো কিছু বিষয়। রূপা যেগুলো সাজিয়ে রেখেছে আমার জন্য। দুজনে মিলে কোন্দিন কি করবো তার একটা পরিকল্পনা করে নিলাম। প্রথম দিন দুপুর একটা পর্যন্ত গেল শুধু ঘুমিয়ে। যাত্রাপথে আমার কখনো ঘুম হয় না বলে একরাতের ঘুমের কিছুটা পুশিয়ে নিচ্ছিলাম দুপুর পর্যন্ত। ততক্ষণ পর্যন্ত মৌটুসী হাজার বার আমার বিছানার পাশে এসে উঁকি দিয়ে গেছে। আমার ঘুমন্ত মুখের দিকেই হয়তো তাকিয়ে থেকেছে কিছুটা সময়।
ভোর পাঁচটায় বাসায় পৌঁছলে ছ’টার মধ্যে নাস্তা খেয়ে মেয়েকে নিয়ে দুষ্টুমি আর হাজার রকমের বায়না নালিশ শুনতে শুনতে আমার দুচোখে ঘুম জড়ো হচ্ছিল। মৌটুসী বলল, বাবা আমি তোমার গলা ধরে ঘুমাবো। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে দুজনই ঘুমিয়ে পড়লাম। ততক্ষণে রূপা ঘরের কিছু কাজকর্ম সেরে নিচ্ছিল। তারপর বিছানার পাশে বসে আমাদের ঘুমের দৃশ্যটা অনেক্ষণ ধরে উপভোগ করে সে। আস্তে করে আমার মাথায় হাত রাখে। ওর এই আদরটা আমার অনেক পরিচিত এবং আমি প্রাণভরে এটি উপভোগ করি। চোখ খুলে ওর মুখের দিকে তাকাতেই লাজুক একটা হাসি দেয়। মেয়েটি আমার গলা এমনভাবে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল যে নাড়া দিতেই জেগে যাবে এমন। রূপা আমাকে সাহায্য করলো। মেয়েকে অনেক যতœকরে পাশের বালিশে শুইয়ে দিল।
তারপর লম্বা এক ঘুমে দুপুর একটা। রুপা তখন পাশে এসে বলে, এবার উঠে ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো। ওর চোখে মুখে এক মায়াবী প্রচ্ছন্নতা ঝিকিমিক করছিল তখন। আমার মনেও ছিল প্রশান্তি। রূপার দিকে তাকিয়ে বললাম, কেমন আছো বউ?
আমার প্রশ্ন তাকে আরো আপ্লুত করে দিয়েছে বুঝতে পারছি। মিটি মিটি হেসেই উত্তর দিল, অনেক ভালো আছি। এমন ভালো যেন সারা জীবন থাকতে পারি। কিন্তু মনের মাঝে একটা সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
আমি বললাম, এর মাঝে আবার সন্দেহ আসে কোথা থেকে?
রূপা বলল, তুমিতো ঠিক এরকম ছিলে না, তাই তোমার পরিবর্তন দেখে সন্দেহ হচ্ছে কোথাও কিছু হলো কিনা, যার প্রভাবে তুমি এমন রোমান্টিক হয়ে উঠলে।
সোহেলী যেমন আমাকে হাদারাম বলে রূপাও তেমনি কিছু শব্দ বলে। আমি বরাবরই একটা নিরামিষ টাইপের মানুষ ছিলাম। রোমান্টিক কোন সংলাম আমার মন থেকে বের হলেও মুখ ফুটে কখনো বলতে পারিনি। বিয়ের পর রূপা অনেকবার আহলাদের সুরে আমার কাছে বলতো আমি যেন তাকে বউ বলে ডাকি, সময়ে অসময়ে যেন ভালোবাসার কথা বলি। কিন্তু আমি তো আমি ই। সেই আমার আজ মনের দিকটা আসলেই অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে “ভালোবাসার কথা প্রকাশ করার মাঝে এক ধরনের সুখ নিহিত আছে। তাতে ভালোবাসার মানুষটিকে আরো বেশি আপন মনে হয়। তার আস্থা এবং বিশ্বাস অর্জন করা যায়। ভালোবাসার কথা শুনতে এবং বলতে হ্্রদয়টা এক ধরনের সুখানুভূতি অনুভব করে, দুনিয়ার অন্যকিছুতে সেই অনুভূতি পাওয়া যায় না। যে ভালোবাসে সেই বুঝে এর শক্তি কতটা অপরিমিত এবং বিশুদ্ধ”।
এ সব অভিজ্ঞতাই আমার সোহেলীর কাছ থেকে পাওয়া।
আমার মধ্যে নাকি নতুন এক উম্মাদনা দেখতে পাচ্ছিল রুপা। যা নাকি এর আগে কখনো দেখেনি সে। বললাম, অনেকদিন পর তোমাকে কাছে পেয়েছিতো তাই । রূপা তখন বলে, আমিতো তোমাকে এমনটাই দেখতে চাই। কিন্তু তুমি বরাবরই একটু অন্য ধাচের মানুষ। তাই আমিও এখন আর বেশি কিছু প্রত্যাশা করি না। নিজের প্রত্যাশাগুলো একটা সীমানার মধ্যে বেঁধে নিয়েছি।
আমি নিজেও অবশ্য কিছু কিছু বিষয় টের পেতাম। যা সোহেলীর আগমনে আমার ভেতরে প্রবাহিত হচ্ছে নতুনভাবে। সোহেলীর বুদ্ধিতে রূপাকে বিবাহ বার্ষিকীতে যখন উপহার পাঠাই তখনো সে এমন প্রশ্ন করেছিল। এর আগে প্রতিবছরই রূপা তার মত করে দিনটি পালন করতো। হয়তো আমার কাছ থেকে কোন উৎসাহ পেত না বলেই।
এখনো মনে আছে, প্রথম বিয়ে বার্ষিকীতে রূপা ওর ভাই বোন বান্ধবীদের বাসায় দাওয়াত করেছিল, আমার জন্য চুপি চুপি উপহার এনে রেখে রাত বারোটা এক মিনিটে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেছিল চোখটা বন্ধ করোতো। আমি বলেছিলাম চোখ তো আমার বন্ধই ছিল, তাহলে কেন ডেকে তুললে? তখন সে উপহারটি হাতে দিয়ে বলেছিল বলোতো আজ কিসের দিন? আমি বলতে পারছিলাম না দেখে রূপা তখন রাগ করেছিল। তারপর নিজেই বলল আজ আমাদের বিয়ে বার্ষিকী। আমি তখন ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে বললাম এটা বলার জন্য এত রাতে ঘুম থেকে ডেকে তুললে? কাল ভোরে বললে কি হতো না?
আমার ওমন ব্যবহারে অনেক কষ্ট পেয়েছিল রূপা। তখন বুঝিনি, যখন বুঝতে পেরেছিলাম কোনকিছু বলে কিংবা করেও ওর মন থেকে সেই রাতের ব্যবহারটা আমি মুছে দিতে পারিনি। এটাই স্বাভাবিক। প্রতিটি স্ত্রীই হয়তো চায় এই দিনটি তার স্বামী মনে রাখুক, মনের মত করে পালন করুক। কিন্তু ঐ যে আমি একটু আলাদা। সোহেলীর ভাষায় হাদারাম!
এরপর রূপা আর কোনদিনই বিয়ে বার্ষিকীতে কোন আয়োজন করেনি। আর সত্যি কথা বলতে কি আমারো কেন জানি পরবর্তীতে অনেক প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও দিনটিকে মনে রাখতে পারতাম না।
এতটা বছরে এই প্রথমবার আমার কাছ থেকে এমন কিছু পেল যা সে বরাবরই আশা করতো। আমিতো জানি এবার কেন আমার মনে ছিল। আর কেনই বা রূপাকে উপহার পাঠাতে গেলাম। কিন্তু রূপাকে বললাম, তোমার কাছ থেকে দূরে থাকছি, তাই ভালোবাসাটা বেশি অনুভব করছি। রূপার খুশিভরা ঝিলমিলে চোখ দুটো আমি তখন মনের আয়নায় দেখতে পাচ্ছিলাম স্পষ্টকরে।
রূপা সেদিন এটাও বলেছিল, নাকি এমন কোন ঘটনা লুকাতে চাচ্ছ বা নিজের কোন অপরাধ ঢেকে রাখতে আমার প্রতি বেশি ভালোবাসা দেখাচ্ছো।
ওর কথাটি শুনে আমার মনের ভেতর প্রচন্ড এক ধাক্কা লাগে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, আরে নাহ্। আমার আবার কিসের অপরাধ। কিন্তু মনে মনে ভাবি আসলে কি আমার আচরণে তেমন কিছু প্রকাশিত হচ্ছে! সোহেলীর সাথে আমার সম্পর্কটা কি খারাপ কিছু? সেটাকি আমার অপরাধের মধ্যে পড়ে? আর নিজের মনের সেই অপরাধবোধ থেকেই কি রূপার প্রতি আমি বরাবরের চাইতে একটু বেশি যতœবান হয়ে উঠছি?
রূপা এটাও বলতে ছাড়েনি, “শুনেছি পুরুষরা যখন অন্য নারীতে আসক্ত হয়, তখন বউদের প্রতি হঠাৎ করে যতœবান হয়ে উঠে। এটা ওটা উপহার দেয়, বেড়াতে নিয়ে যায়, বেশি বেশি ভালোবাসা দেখায়।”
ওর এক একটি কথা শুনছিলাম আর আমি বারবারই কেঁপে উঠছিলাম। মনে হচ্ছিল রূপা কি সব বুঝতে পারছে? চোখ নাকি মনের কথা বলে। আমার চোখ কি আমার মনের কথা বলে দিচ্ছে? রূপা কি দেখতে পাচ্ছে আমার মনের কোথাও না কোথাও কখনো না কখনো সোহেলী এসে আনাগোনা দিচ্ছে?
এসব ভেবে আমি আরো সাবধান হয়ে যাই।
বিয়ের পর থেকেই রূপার সাথে আমার সম্পর্কটা সকাল-সন্ধ্যার মতো। এই ভালো তো এই মন্দ। ওর সবকিছুতেই বেশি অভিভাবকত্ব এবং সন্দেহ। ওর মনের মতো চলতে গিয়ে জীবনে আমি অনেক কিছু বর্জন করেছি। রূপা পছন্দ করতো না বলে বন্ধুবান্ধবের সাথে সময় কাটানো ছেড়ে দিয়েছি। কোথাও বেড়ানো, কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এসবও ভুলতে বসেছি। এমনকি আমার পরিবারের কেউ আমার বাড়িতে বেড়াতে আসলে রূপার কাছে সেটা ঝামেলার মনে হতো বলে নানাভাবে তাদেরকে এড়িয়ে চলেছি। বিনিময়ে সংসারে আমি যে খুব সুখি হয়েছি তার কোন প্রমাণ পাইনি।
*
সেদিন সকাল দুপুর পেরিয়ে বিকাল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা নামে তখন পর্যন্তও সোহেলীর সাথে আমার একটি কথাও হয়নি। সারাদিন কেটে গেল। ভেবেছিলাম সোহেলীকে একটি টেক্সট পাঠাবো। আমি যে ঠিকঠাক এসে পৌঁছেছি সেটা অন্তত তাকে জানানো দরকার। ভেবেছি ঠিকই কিন্তু মেসেজ আর পাঠানো হয়নি। আর কল করার তো কোন সুযোগই পাইনি। রূপা সারাক্ষণই আমার কাছাকাছি ছিল। তার উপর সংসারের নানা কাজকর্ম, অনেকদিন না থাকলে যা হয়। রূপা অবশ্য সবকিছুই ওর মত করে সামলে নিচ্ছিল। বাইরের সকল কাজতো এখন তাকেই সামলাতে হয়।
মৌটুসীকে সাথে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে একবার বের হলাম। মনে মনে ভাবছি এবার সোহেলীকে একটা ফোন দেয়ার সুযোগ হলো। আরো আগেই কথা বলা উচিৎ ছিল। সে নিশ্চয়ই সারাদিন আমার ফোনের অপেক্ষা করেছিল। এতক্ষণে নিশ্চয়ই অভিমান করে গাল ফুলিয়ে আছে। সোহেলী আমার জন্য অপেক্ষা করে এটা ভাবতে একপ্রকার ভালোই লাগে আমার।
কল করতেই সোহেলীর নম্বরটি বন্ধ পেলাম। দু’বার কল করার পরে ঘড়িতে সময় দেখে মনে পড়ল আমি ওর যে নম্বরটিতে কথা বলি সেটি এখন বন্ধ থাকারই সময়। কেননা ওই সময় সাদি বাসায় থাকে। নিজের উপরই রাগ হলো, আফসোসও হলো কেন আগে ফোন করলাম না। জানিনা সারাদিন সোহেলী কি ভেবেছে। নিশ্চয়ই আমার উপর অনেক রাগও করেছে। আমাকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তারও শেষ নেই। অবশ্য দুশ্চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
একটা টেক্সট লিখে পাঠিয়ে দিলাম- ‘আমি ঠিকমত এসে পৌঁছেছি।’
মেসেজটা পাঠানোর পর মনে হলো তাকে আর একবার বলে দেয়া দরকার আমাকে যেন মেসেজ বা কল না করে। যেহেতু রূপা সারাক্ষণই কাছে কাছে থাকছে তো ওর মেসেজ আসলে সন্দেহ করবে।
আমি ঢাকা এসেছি এজন্য রূপা স্কুল থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েছে। তিনদিন পরেই গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হলে তখন ওরাও আমার সাথে রাজশাহী যাবে বলে ঠিক করেছে। কথাটি আমাকে ওরা আগে বলেনি। যখন শুনলাম তখন রূপাকে বললাম, তোমরা যে যেতে চাচ্ছ আমাকে আগে বললে না কেন? এখন হুট করে গেলে তোমাদেরই সমস্যা হবে। আমি ওখানে আমার মত করে একা থাকি । পরিবার নিয়ে থাকার মত কোন ব্যবস্থাতো নেই সেখানে। তোমরা যাবে জানলে আমি আর এখন আসতাম না। তোমাদের জন্য ঘরে কিছু ব্যবস্থাদি করে রাখতে পারতাম।
রূপা বলে, তুমি এসব নিয়ে টেনশন করবে বলেই আগে বলিনি। তোমার কিচ্ছু করতে হবে না। যা যা দরকার হয় আমি গিয়েই ঠিক করে নিব। তার যুক্তির কাছে হেরে গিয়ে আমি রাজি হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, তারা যতদির রাজশাহী থাকবে সোহেলীর সাথে আমার যোগাযোগটা আরো কমে যাবে। এমনিতেই এখানে আসার পর থেকে একটা দিনও সোহেলীর সাথে ভালো করে কথা হয়নি। যখনি কথা বলার চেষ্টা করি কোন না কোন ঝামেলা এসে সামনে দাঁড়ায়।
রাজশাহীতে বদলী হওয়ার পর এখন পর্যন্ত আমার পরিবার আত্মীয় স্বজন কেউ যায়নি ওখানে। তাই রূপাকেও আর না করতে পারলাম না। আর এখন কোনকিছু বলতে গেলেই মনে হয় রূপা হয়তো আমাকে সন্দেহ করছে। নাকি সোহেলী নামের মেয়েটি যে আমার ভেতরে উকিঝুঁকি মারছে এটা রূপা টের পাচ্ছে! তাই রূপা যা বলে তাই শুনে যাই। আবার বেশি হুজুর হুজুর করতে গেলেও রূপা সন্দেহ করে কিনা সেটাও ভাবি। সব মিলিয়ে আমার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমি নিজেই খুব উদ্বিগ্ন।
পরের দিন সকালে রূপা একটু বাইরে গেলে আমি সোহেলীকে ফোন করলাম। যতারীতি ফোন বন্ধ। সময় দেখে মনে পড়লো এত ভোরে সোহেলীর ঘুম ভাঙেনা। তাছাড়া সাদিও ওই সময় বাসায় থাকে। কিন্তু এবার আমার মনটা সোহেলীর সাথে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো । এক ধরনের মায়া অনুভব করলাম মনে। গত দু’দিন ধরে ওর সাথে একটা কথাও হয়নি। তার কোন মেসেজও পেলাম না। পাবো ই বা কি করে ,আমিইতো তাকে বলে দিয়েছি আমাকে যেন ফোন বা মেসেজ না করে। কিন্তু আমি কি আমার কথা রাখতে পেরেছি? তাকেতো বলেছিলাম প্রতিদিন অন্তত তিনবার ফোন করে কথা বলবো, আর সুযোগ পেলেই বার্তা পাঠাবো। কিন্ত আমিতো একবারও কথা বলতে পারিনি। কেন পারলাম না আমি? গতকালতো ইচ্ছা করলেই অন্তত একবার কথা বলা যেত। কিন্তু কেন ফোন করলাম না? আমিকি তাহলে রূপাকে কাছে পেয়ে সোহেলীকে ভুলে গেছি? এমনটা সোহেলী বলেছিল আমাকে। বলেছিল আপনিতো ঢাকা যেয়ে আমাকে ভুলে যাবেন। আমি বলেছিলাম, ভূলবো না দেখো, আমি ঠিক মনে রাখবো এবং যোগাযোগও রাখবো। সে তখন বলেছিল, ঠিক আছে আমি অপেক্ষা করবো। তবে ততক্ষণই করবো যতক্ষণ আমার পক্ষে সম্ভব। এর বেশি হলে কিন্তু আপনার নিষেধাজ্ঞা মনে রাখবো না।
কথাটি মনে পড়ে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি আর ডায়াল করে যাচ্ছি। কিন্তু সময় যেন এখন আর এগোচ্ছে না। অন্যদিকে রূপার আসার সময় হয়ে গেল।
এভাবেই বেজে গেল দুপুর বারোটা। ভেতরে ভেতরে আমার অস্থিরতা বেড়েই যাচ্ছিল।
বারোটার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে সিঁড়ে দিয়ে নামতে নামতেই সোহেলীকে ফোন করি।
এক সাথে হাজারটা প্রশ্নের বান আমার উপর আছড়ে পড়লো। ওর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আমি কান্নার আভাস পচ্ছিলাম। বুঝাতে চেষ্টা করলাম কেন আমি ফোন করতে পারিনি । কিন্তু আমার যুক্তিগুলি ওর কাছে মার খেতে থাকলো। বলল, আমি জানতাম আপনি এমনি করবেন। আপনাকে কি আমি আজ থেকে চিনি? সেই ছোটবেলা থেকে জানি আপনাকে। আপনি কোনদিনই আমার মনের অবস্থা বুঝেননি, বুঝতেও চাননি। একটিবারও ভাবেননি আমার কথা । আমি যে আপনাকে নিয়ে চিন্তা করি, আপনার একটা খোঁজ খবর না পেয়ে আমারো যে মনে ভাবনার উদয় হতে পারে, আমি যে আপনাকে অনেক মিস করি একবারও মনে হয়নি আপনার। আপনিতো ভালোই আছেন। সুখেই আছেন। আমিও চাই আপনি সব সময় ভালো থাকেন সুখে থাকেন। কিন্তু তাই বলে এমনি করে আমাকে ভূলে থাকতে পারলেন?
বলতে বলতে রাগে উত্তেজিত হয়ে সোহেলী বলল, বউকে পেয়ে সোহেলীর কথা ভুলে গেছেন তাই না? আমাকে একবার ফোন করলে কি বউয়ের ভাগ কিছু কমে যেত? সে কি সারাক্ষণই আপনার গলা ধরে ঝুলে থাকে? নাকি হাত দুটো বেঁেধ রাখে যে একটা এসএমএসও করা যায় না?
তাকে সান্ত্বনা দেয়ার বৃথা চেষ্টা করে বললাম, আর এমনটি হবে না সোহেলী। এবারের মত মাফ করে দাও লক্ষèী মেয়ে। এখন বলো তুমি কেমন আছো?
সোহেলী তেমনি রাগান্বিত সুরে বলল, ইচ্ছা থাকলে সবকিছুই সম্ভব। আমিওতো এতকিছুর মাঝেও ঠিকই আপনার সাথে যোগাযোগ রাখছি। একটা ছোট্ট এসএমএস লিখতেও কি আপনার বউ আপনাকে ধরে রাখে?
বুঝতে পারছিলাম সে ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। আমি তখন শান্ত করার চেষ্টা করে আবরো বললাম, আর এমনটি হবে না সত্যি। যদি হয় তাহলে তুমি আমাকে ফোন করো।
হ্যা, আমি তাই করবো। তখন আবার বলবেন কেন ফোন করেছো আমার বউ দেখে ফেলেছে।
আমি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, বললাম আমিতো হারিয়ে যাইনি। হয়তো এখন কিছুদিন তোমার সাথে খুব বেশি যোগাযোগ করতে পারবো না। কিন্তু আবার যখন সময় আসবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সোহেলী তখন বলে, কিছুদিন মানে? আপনি আগামী কালই ফিরছেন না রাজশাহী?
আমি বললাম, হ্যাঁ ফিরছি। তবে আমার সাথে ওরাও আসবে রাজশাহী।
খবরটা সোহেলীর কাছে আনন্দেরতো ছিলই না। বরং অনেক বেশি কষ্টের ছিল। সেরকমই অনুভূতি নিয়ে সে বলল। ও তাহলে এই কথা? সবকিছু কি আগে থেকেই ঠিক করা ছিল?
আমি বললাম, না। এখানে আসার পর রূপা বলল, স্কুল ছুটি হলে তারা রাজশাহী যাবে বেড়াতে। আর তুমিই বলো ওদেরকে আমি না করি কিভাবে? আমার বউ আমার কাছে তো যেতেই পারে। এটাইতো স্বাভাবিক তাই না?
‘‘সত্য কথা কখনো কখনো শুনতে বড় খারাপ লাগে। আমাদের উচিৎ কখনো কখনো এমন সত্য সরাসরি কাউকে না বলা, যা শুনলে সে মনে কষ্ট পেতে পারে। যেভাবে বললে সে কষ্ট পাবে না, আবার মিথ্যাও বলা হবে না, সেভাবেই বলতে হবে। কেননা কারো মনে কষ্ট দেয়ার অধিকার আমাদের কারো নেই।’’
‘মানুষকে আনন্দ না দিতে পারি, অন্তত কষ্টটা যেন না দেই’।
আমার এই সত্য আর বাস্তব কথাটিও তখন সোহেলীর কাছে ততটাই খারাপ লেগেছিল যতটা আমার বোধের ধারে কাছেও ছিল না। যখন বুঝতে পারলাম তখন মনে হলো কথাটি ওমন করে না বললেও পারতাম। কিন্তু আমি বরাবরই একটু বিবেকবর্জিত কর্কশ প্রাণী। আমার বউ বলে একথা। আমার যখন যা বোধগম্য হয় আমি নাকি তাই বলি, তাই করি। কিন্তু তাতে অন্যজনের মনে কোন ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে কিনা সেটা নাকি আমি কখনোই ভাবি না। ওরা বলে এটা আমার দোষ। আর আমি বলি এটা আমার স্বভাব।
আমার কথার পরে সোহেলী একদমে যেন নিভে গেল। ওর সমস্ত রাগ শাসন অভিযোগ অনুযোগ মাটির সাথে মিশে গেল। শান্ত বিনম্র কণ্ঠে সে তখন বলল, জ্বি ঠিক বলেছেন। আমি আসলে অনেক বেশি বলে ফেলেছি স্যার। আপনার কাছে আমার প্রত্যাশাও হয়তো বেড়ে গিয়েছিল অনেকখানি। তাই ভুলেই গিয়েছিলাম আমি কে, আমার কতটুকু সীমানা। আমাকে মাফ করবেন প্লিজ।
সোহেলী আমাকে স্যার বলেই সম্বোধন করতো। ওর সাথে যখন ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করলাম অনেক বলে কয়ে ওর মুখ থেকে ‘স্যার’ শব্দটি বাদ দিতে চেষ্টা করেছিলাম। স্যার বলা থেকে বিরত থাকলেও তখন সে আমাকে কি বলে ডাকবে তাই নিয়ে নতুন বিড়ম্বনায় পড়ে যায়। একসময় কোন রকম সম্বোধন ছাড়াই স্রেফ ‘আপনি’ বলেই কথাবার্তা চালিয়ে যেত। আমারো অবশ্য ভালোই লাগতো। কেন জানি ওর এই ‘সম্বোধন বিহীন সম্পর্ক’টা আমি খুব উপভোগ করতাম। মনে মনে রূপার সাথে মিলাতাম। রূপা আমার বউ। সেও আমাকে কখনো নাম ধরে ডাকতে পারেনি। এখন সোহেলীকেও আমার বউ বলেই মনে হয়। আর সেভাবে ভাবলে আমার মনের মাঝে সুখের ঢেউ খেলে যায়। যে ঢেউ শুধু আমাকেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় গভীর থেকে আরো গভীরে।
আমার কথায় ওর প্রতিক্রিয়ার ধরণ দেখে মনে হলো কথাটি আমি এভাবে না বলেও পারতাম। কেননা একথা স্পষ্ট করে বলে বুঝানোর কিছু নয়। সোহেলী ভালো করেই জানে আমার ঘর-সংসার, স্ত্রী-কন্যা রয়েছে। আর আমিও জানি সোহেলী এবং রূপার মধ্যে কার অবস্থানটা কোথায়। “একজনকে আর একজনের সাথে তুলনা করলে অপরজন শুধু কষ্টই পাবে।’’
কেন জানি যখনকার কথা তখন না বুঝে বরাবরই আমি একটু দেরিতেই বুঝতে পারি। এজন্য খেসারতও কম দিতে হয়নি জীবনে।
*
সোহেলীর মনটা খারাপ করে দিয়েই আমার কথা শেষ করতে হলো। ভালো করার কোন অবকাশ পেলাম না। রূপা বারবার বাসা থেকে ফোন দিচ্ছিল । সোহেলীকে কথা দিলাম যত বাঁধাই আসুক না কেন দিনে অন্তত দু’বার তাকে ফোন করবো। আমার শেষের দিকের কথার সাথে সে তেমন সায় মিলাতে পারেনি। কেননা তখন তার মনের আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা বিরাজ করতেছিল। গম্ভীর কণ্ঠে শুধু জানতে চাইলো ভাবী রাজশাহী কতদিন থাকবেন?(এই প্রথম সে রূপাকে ভাবী বলে সম্বোধন করলো)। আমি বললাম পনেরো দিন। সে আর কোন কথা বলেনি।
পরের দিন সন্ধ্যা সাতটায় ট্রেনে টিকেট করা হয়েছে। আচমকা রাজশাহী যাবার বাসনার পেছনে রূপার মনে কোন উদ্দেশ্য থাক বা না থাক, মৌটুসীর আনন্দের সীমা রইলো না। এই প্রথমবার তারা রাজশাহী যাচ্ছে, প্রথমবার ট্রেনে চড়বে আরো কত কি। গুছানোর যেন শেষ নেই। পনেরো দিনের জন্য রূপা পারলে পুরো সংসারটাই ব্যাগে ভরে নিয়ে নেয়, এমন একটা ভাব। আমি বললাম, দেখো এতকিছুর দরকার নাই। ওখানে গিয়ে সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলবো। আর যেহেতু তোমরা মাঝে মাঝে এমন ছুটি কাটাতে যাবে তো কিছু কিছু ব্যবস্থা তো করতেই হবে আমার। এখন থেকে সবাই জানবে আমি আর ব্যাচেলর নই। আমারো একটি বউ একটি বাচ্চা আছে।
কথাটি আমি স্রেফ মজা করার জন্যই বলছিলাম। কিন্তু রূপা সেটাকে বাঁকাভাবে নিয়ে নিল। বলল, তার মানে তুমি সেখানে নিজেকে ব্যাচেলর হিসেবে উপস্থাপন করো? যাতে আশে-পাশের বাজারে তোমার দরদামে কোন নিম্নগতি না থাকে? আর মনের আনন্দে যা খুশি তাই করতে পারো?
ওর কথার পিঠে আর কথা বলার ইচ্ছা থাকলো না। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।
রাত এগারোটা পর্যন্ত নাটাইয়ের মত ঘুরে ঘুরে ঘরের সমস্ত কাজ গুলি শেষ করল রূপা। ওর এই ব্যস্ততার সুযোগে বিছানায় বসে টিভি দেখতে দেখতে সোহেলীকে তিনটি বার্তা পাঠালাম। সেও জবাব দিল। ওর মনের গম্ভীরতা কিছুটা কমেছে। আজ বিকেলে সাদি আবার রাজশাহীর বাইরে গিয়েছে। তাই সোহেলী আজ একা । সাদির অনুপস্থিতি সোহেলী এবং আমাকে আরো বেশি কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। তাই দিনটাকে আমিও খুব মিস করছি। তবে সত্যি কথা কি রূপার সাথে কাউকেই মিলাতে পারি না আমি।
আমার জীবনের দু:সময়ে রূপার আবির্ভাব হয়েছিল। তাকে আমি যথেষ্ট মূল্যায়ণ করি। কখনো ওর প্রতি অকৃতজ্ঞ হতে পারবো না। ওর কথা যখন ভাবি তখন মনে হয় রূপাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।
কিন্তু সোহেলীও কিছুতেই কম ছিল না। আমি যা ছিলাম যেমন ছিলাম তেমনভাবেই সোহেলী আমাকে পেতে চেয়েছিল। সেভাবেই ভালোবেসেছিল। ওর নিখাদ সরল ভালোবাসাকে আমি কখনোই অসম্মান করতে পারি না। জীবনের প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি আমি সোহেলীর কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। রূপা আমার জীবনের আলো। আমাকে ছাড়া অন্য কারো কথা একটি মুহূর্তের জন্যও রূপার মনে উদয় হয়নি কখনো। ওর প্রতি এতটাই বিশ্বাস আমার।
রূপা যদি আমার চাঁদ হয় সোহেলী আমার জোছনা। দুজনই আমার অস্তিত্বের অংশ। আমার জীবনের আধার। আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। দুজনকে যদি আলাদা করে ভাবি তখন মনে হয় কেউ যদি আমার জীবনে না থাকে তো আমার আর কিছুই থাকবে না। আমার সুখ স্বাচ্ছন্দের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে বিকশিত হচ্ছে এই দুটি নারী। মাঝে মাঝে মনে হয় কখনো যদি রূপা জানতে পারে সোহেলী নামের মেয়েটি আমার মনের একটা অংশ জুড়ে বসবাস করছে তখন তার প্রতিক্রিয়া কি হবে? সে কি সহ্য করতে পারবে? আমি কি অপরাধী হিসেবে প্রতিফলিত হবো তার কাছে? সে কি আমাকে আর বিশ্বাস করবে? আমি কি আমার রূপাকে হারিয়ে ফেলবো চিরদিনের জন্য?
মৌটুসী আমার সাথে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশের ঘরে তখনো টুং টাং আওয়াজ। বিছানা থেকে উঠে যেয়ে দেখলাম রূপার গুছানো তখনো চলছে। বললাম, তুমিকি পুরো রাতটা এভাবেই পার করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছ? সময় দেখেছো ক’টা বাজে?
রূপা বলল, তোমার যদি ঘুম আসে তো হাঁটাহাঁটি করছো কেন? শুয়ে পড়ো না। আমি কাজটা শেষ করে আসতেছি। আমি বললাম, তিন মাস পরে তিনদিনের জন্য বউয়ের কাছে আসছি কি একা একা ঘুমানোর জন্য?
কথাটির মধ্যে কিছুটা অভিমানের সুর মিশ্রিত ছিল বলেই রূপা হেসে দিল। বলল, বাপরে জনাবের দেখি মুখে খই ফুটেছে। এতকাল কোথায় ছিল এসব ভাষা। কে আমদানি করলো শুনি এমন এমন রোমান্টিক সংলাপ?
আমি বললাম, “নিজের মনের কথা বলতে কারো আমদানি হওয়ার দরকার হয় না”। সত্যি কথা বললেও সবটাতেই তোমার অবিশ্বাস। তাইতো অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করলেও বলি না। বুঝোনা তো আমি কি, যখন বুঝবে তখন দেখো আমাকে আর খুঁজে পাও কিনা। হারিয়ে গেলে বুঝবে তখন, আমি কি ছিলাম।
কথাটি বলার সাথে সাথে রূপা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। নিমিষেই ওর দুটি আঁখি টপটপ করতে লাগলো। বলল, এমন কথা কেন বলছো? কি হয়েছে তোমার? তুমি আমাদেরকে ছেড়ে কোথায় যাবে? কেন খুঁজে না পাওয়ার কথা বলছো তুমি?
আমি বললাম, আরে তুমি মন খারাপ করছো কেন? আমিতো এমনি বললাম। আমি আবার কোথায় যাবো। দেখলেতো কথাগুলোর সার্থকতা কত? বললাম আর অমনি তুমি এসে গলায় ঝুললে। তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্যই বলেছি।
না, তুমি মনে হচ্ছে কিছু লুকাচ্ছো। ইদানিং তোমার কিছু কথা কিছু ব্যবহার আমার কাছে অন্যরকম মনে হচ্ছে। যদিও সেসব কথা শুনে আমার ভালো লাগেছে। কিন্তু তোমাকে এতকাল যেভাবে দেখে এসেছি তার সাথে মিলাতে পারছিলাম না বলে ভালোলাগার মাঝেও কিছু উদ্বিগ্নতা জড়িয়ে থাকে । কেননা আমিতো তোমাকে চিনি। তোমাকে যেভাবে দেখে দেখে অভ্যস্ত তার ব্যতিক্রম দেখলে সেটা ভালো হলেও কেমন ভয় হয় মনে।
রূপা আমাকে নিয়ে এত ভাবে, আমার প্রতিটি আচার আচরণ তার নখদর্পনে। এই মেয়েকে ফাঁকি দেয়া আমার মত মানুষের পক্ষে কেমন করে সম্ভব হবে? অপরদিকে সোহেলীকেও আমি ভূলতে পারবো না কোনদিন। এখন তার সাথে সম্পর্কটা এমন একটা স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে যে তার উপরও কিছু দায়দায়িত্ব এবং অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে আমার। আমার উপরও সোহেলীর কিছু কিছু অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে আপনা আপনি।
“ ভালোবাসার ফলে এক ধরনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় অনায়াসেই। চাইলেও আমরা সেগুলো থেকে রেহাই পেতে পারি না”।
জীবন সংসার এসবের চালিকাশক্তি রূপা। রূপাকে ছাড়া আমার জগৎ অন্ধকার। আমার জীবনটাই থেমে যাবে যদি রূপা না থাকে জীবনে। অন্যদিকে সোহেলী আমার আত্মার খোরাক। আমার হ্্রদয়ের স্পন্দন। আমার প্রতিটি কাজের মাঝে জীবনের প্রতিটি পরতে সোহেলী আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে এক নিঁখুত ভালোবাসার শক্তি দিয়ে।
*
পরের দিনটা আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন একটা দিন ছিল। সকাল থেকেই নানান কাজে ব্যস্ত থেকেছি। সারাদিনে একবারও সোহেলীকে ফোন বা এসএমএস করতে পারিনি। আমার কিছু অপারগতা আছে। যেমন একসাথে অনেক কাজ করতে পারি না। যখন যেটা করি সেটাতেই মন প্রাণ সব বিনিয়োগ করে সেই কাজটিই সম্পাদন করি। তাই মাথায় হাজারো কাজের ঝামেলা নিয়ে সোহেলীর সাথে কখনোই কথা বলতে পারি না আমি। আর এজন্যই ওর সাথে যোগাযোগটা মাঝে মাঝে কমে যায়। সোহেলীকে যেমনটা কথা দিয়েছিলাম তেমনটা আমি রাখতে পারিনি। রাজশাহী গিয়েও কয়েকটা দিন পরিবারকে সময় দিতে হবে। এর মাঝে সোহেলীকে কেমন করে সময় দিব ভেবে পাই না। এমনিতেই রূপাদের রাজশাহী যাওয়া নিয়ে সোহেলীর মনটা খারাপ হয়ে আছে। তার উপর ঠিকমত কথাই বলতে পারছি না ওর সাথে। ভীষণ অভিমানী মেয়ে। না জানি সে নিজেই ফোন করে বসে।
প্রতিটি কাজ করার সময়েই ভাবি এটা শেষ করে সোহেলীকে ফোন করবো। কিন্তু কাজ আর শেষ হয় না। প্রচন্ড গরমে শরীর থেকে দরদর ঘাম ঝরছিল। দুপুরের পর অনেক ক্লান্ত হয়ে যখন একটু বিছানায় গেলাম দু’চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম। মুহূর্তেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। রূপা তখন কোনকিছু বাদ পড়ল কিনা সেসব খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিল।
কপাল মন্দ হলে এমনি হয়। অন্যকে দোষ দিয়েই বা লাভ কি। আমিই তো আমার কথামত কাজ করতে পারিনি।
আমি যখন ঘুমাচ্ছিলাম সোহেলী তখন একটি এসএমএস পাঠায়। মোবাইলটি তখন টেবিলের উপর চার্জ দেয়া ছিল। আর সেই ঘরে রূপা কাজ করতেছিল। সোহেলীর নম্বরটি ‘স্টুডেন্ট’ নামে সেভ করেছিলাম আমি। ঘুমের মধ্যেই এসএমএস আসার রিংটোন শুনতে পেয়ে কেন জানি মনটা বলে উঠল সোহেলীর কোন এসএমএস হতে পারে। তখনি বিছানা থেকে উঠে পাশের ঘরে যেয়ে দেখি রূপার হাতে ফোন। আমাকে দেখেই হাত বাড়িয়ে ফোনটি দিয়ে বলল তোমার কোন স্টুডেন্ট মেসেজ দিয়েছে দেখো। আমার কলিজা তখন দুরুদুরু কাঁপছিল। কী সর্বনাশ! যা ভেবেছিলাম তাই । সোহেলীর এসএমএস কি তাহলে রূপা পড়ে ফেলেছে? আল্লাহ্ রক্ষা করেছেন। রূপা মেসেজটি তখনো ওপেন করেনি। মাত্র হাতে নিয়েছিল এরই মধ্যে আমি এসে দাঁড়াই। ম্যাসেজটি ওপেন করে দেখি ইয়া বড় এক অভিযোগ পত্র। হায় আল্লাহ!্ রূপা দি এটা পড়তো তো আজই সংসারে একটা কেয়ামত হয়ে যেত!
এসএমএস টি যখন পড়ছিলাম রূপা তখন তার কাজ করতেছিল। কিন্তু আমার কেবলি মনে হচ্ছিল সে আমাকে সন্দেহ করছে। আমি দ্রুত পড়ে নিয়ে সাথে সাথে মুছে দিলাম। এসএমএস টি আমার মনের উপর বিষন্নতার এক বাতাস প্রবাহিত করে দিয়ে গেল।
রূপা আমার দিকে তাকিয়ে তখন জিজ্ঞাসা করে, কি ব্যাপার কোন খারাপ সংবাদ নাকি? কি লিখেছে?
আমি বললাম, তেমন কিছু না। আমার এক পুরনো স্টুডেন্ট এর এসএমএস।
রূপা তখন কয়েকটি প্রশ্ন করলো। পুরনো স্টুডেণ্ট কোথায় থাকে? এখনো তোমার সাথে যোগাযোগ আছে? নাম কি তার? সে কি লিখেছে? ছেলে নাকি মেয়ে?
আমি সংক্ষেপে বললাম, বরিশালের স্টুডেন্ট। এখন সে রাজশাহী থাকে। আমার সাথে হঠাৎ একদিন রাস্তায় দেখা । আমিতো তাকে চিনতেই পারিনি। সে ই আমাকে চিনেছিল। এখন মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়।
রূপা হয়তো আরো কিছু জানতে চাইতো তার আগেই আলাপের যবনিকা টেনে আমি বাসা থেকে একটু বের হওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল সোহেলীর সাথে কথা বলবো। সে ভীষণ ফুলে আছে। ঢাকা আসার পর থেকে আমি তাকে একেবারেই ভুলে গেছি। আরো কত কত অভিযোগ। ওর সাথে এখন কথা না বললে দেখা যাবে আরো এসএমএস এবং কলও করে বসবে। এবারতো ধরা পড়তে পড়তে কোনরকম বেঁচে গেছি। এভাবে যেন আর এসএমএস না দেয় সেজন্যই ফোন করবো বলে বের হচ্ছিলাম। রূপা তখন বাঁধা দিয়ে বলল, একটু পরই তো আমরা বের হবো। সময় বেশি নাই। তুমি আবার এসময় কোথায় যাচ্ছ?
বললাম দূরে কোথাও যাচ্ছি না। এখনি চলে আসবো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবছি রূপা কি আমাকে সন্দেহ করছে? এসএমএস আসার পরেই আমি বাইরে যাচ্ছি, সে আবার ভাবছে না তো আমি কারো সাথে কথা বলার জন্য বের হচ্ছি!
আসলে আমি এখন চোর। তাই আমার মনে সারাক্ষণই পুলিশ পুলিশ ভাবনা। হয়তো রূপা আমাকে নিয়ে কিছুই ভাবছে না। তারপরেও আমার কেবলি মনে হয় সোহেলীর ব্যাপারটা টের পেয়ে সে এখন আমাকে সন্দেহ করছে। রূপার চোখে আমি আসামী হয়ে গেলাম।
ঘর থেকে বেরিয়ে সোহেলীকে ফোন করতেই ফের অভিযোগ। কেন আমি তাকে একটিবারও ফোন করছি না, কেন কোন টেক্সট দিচ্ছি না । তারপর কখন রওয়ানা দিব, রাজশাহী কখন পৌঁছবো এসব। রাজশাহী পৌঁছেই যেন তার সাথে দেখা করি এমন প্রতিজ্ঞা করার পরেই সে ফোন রাখলো। আরো কথা দিতে হলো ট্রেনে প্রতি ঘণ্টায় যেন আমি তাকে আমার অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করি। আমি বললাম, সাথে রূপা এবং মৌটুসী থাকবে তো সেই সুযোগটা নাও পেতে পারি। কিন্তু সে সেকথা কিছুতেই মানতে নারাজ। বলে দুনিয়াতে বুঝি আর কারো বউ নেই। আপনার বউ কি আপনার দুটি হাত ধরে বসে থাকবে সারাক্ষণ? এ কথার কোন জবাব আমি দিতে পারলাম না।
যে তিনটি দিন আমি ঢাকা ছিলাম আর সোহেলীর সাথে ঠিকমত কথা বলতে পারিনি সেই তিনটি দিন সে ভীষণ অস্থিরতায় দিনতিক্রম করছিল। মিনিটে মিনিটে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দেখেছে আমার কোন এসএমএস আসছে কিনা। বারবারই আমাকে কল করতে যেয়ে আমার নিষেধাজ্ঞার কাছে হেরে গিয়ে সে বিরত থেকেছে। আমাকে নিয়ে সোহেলী এতটা অস্থির হয়ে উঠবে এ আমি ভাবিনি। শুরুর দিকে প্রশ্রয়টা হয়তো আমারি ছিল। ওর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমিই বেশি যোগাযোগ রাখতাম। অনেক সময় সোহেলী তার সংসারের দোহাই দিলে আমিই বলেছি জগতে সংসার কি তুমি একা করো? দেখা করার জন্য আমিই অস্থির হয়ে উঠতাম। সোহেলীকে নিরস হতে দেখে আমিই বলতাম আবেগটাকে একটু বাড়াও। আসলে এখন বুঝতে পারছি, যা কিছু করেছি সবই করেছি আমার প্রয়োজনে। আমার একাকী নিরানন্দে ভরা দিনগুলোতে আনন্দের ফল্গুধারা বইয়ে দিতে সোহেলীর উপর আশ্রয় করেছিলাম। এখন আবার আমার প্রয়োজনেই সোহেলীকে বলছি একটু ধৈর্যশীল হও, আবেগটাকে একটু সংযত করো। আমার কাছ থেকে এমন দ’ুমুখী ব্যবহার সোহেলী কখনো আশা করেনি। সে এখন বলে, স্যার এত তাড়াতাড়ি আপনি বদলে যাবেন এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
আমার যে এত সীমাবদ্ধতা এ যদি আমি বুঝতাম তাহলে কোনদিনই ওর সাথে এমন করে জড়াতাম না। আমার জন্য সোহেলী এমন কষ্ট পাবে জানলে কখনোই তাকে এমন স্বপ্ন দেখাতাম না। রাজশাহীতে যখন আমার একাকী নিরানন্দে ভরা দিনগুলো পার হচ্ছিল, সেই সময়গুলোতে উচ্ছাস আর ভালোলাগার কিছু মুহূর্ত নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল সোহেলী।
রূপাদের রাজশাহী আসার পর থেকে আমার সময়গুলো যেন রূপার কাছে বাঁধা পড়ে যায়। অফিসের হাজার রকম ঝামেলার মধ্যে যেটুকু সময় পেতাম রূপাকে না দিয়ে পারতাম না। তার উপর ওখানে আমি একা থাকতাম বলে পরিবার নিয়ে বসবাসের তেমন কোন সুব্যবস্থাও ছিল না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সেসব ব্যবস্থাও করতে হয়েছে। যদিও সেসব কাজের জন্য আমার লোকের অভাব ছিল না । তারপরেও মনে করেছি রূপা এখানে মাত্র পনের দিন থাকবে তো ওদের যেন কোন অসুবিধা না হয়। তাই কাজগুলো নিজেই তদারকি করেছি।
রূপাদের নিয়ে যেদিন রাজশাহী পৌঁছি সেই পুরো দিনটা অঝোরে বৃষ্টি ছিল। বাসায় সবকিছু ঠিকঠাক করতে এবং বৃষ্টির কারনেও পুরোটা দিন আমি ঘরেই ছিলাম। সোহেলীর সাথে কথা বলা দরকার এমনটা অনেকবার ভাবলেও সঠিক সময়টা ঠিক পচ্ছিলাম না। অত:পর অনেক পরে দুপুরের দিকে যখন একবার অফিসে বসি তখন তাকে ফোন করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমার সময়ের সাথে সোহেলীর সময় ঠিক মিলছিল না। ওই সময় সাদি বাসায় থাকাতে সৌজন্যমূলক সামান্য কথাতেই ফোন রাখতে হলো। সৌজন্যতা রক্ষার্তে সাদির সাথেও কথা বলতে হলো। কিন্তু মনের মাঝে আকুপাকু রয়েই গেল।
বাসায় কাজ করার অনেক মানুষ থাকলেও রূপাকে কিছূতেই কাজ থেকে বিরত রাখা যায়নি। আমি যতই বুঝাচ্ছিলাম এখানে তোমার কিছু করার দরকার নাই। তারপরেও সে নিজের হাতে সবকিছু দেখাশুনা না করে শান্তি পাচ্ছিল না।
*
রূপার আসার খবর পেয়ে অন্যসব অফিসারদের স্ত্রীরা এবং নারী অফিসাররা দেখা করতে আসলো। এতদিন সবাই হয়তো মনে করেছিল আমার বউ না জানি কেমন হবে। এখানের অন্যসব অফিসারদের বউদের মত খুব আধুনিক, অনেক সুন্দরী হবে এটাও আশা করেছিল হয়তো। কিন্তু রূপা একেবারেই সেরকম না। নিতান্তই সাধারণ একজন গৃহিনী বলতে যা বুঝায় রূপা তাই। চেহারার মধ্যে কোন জৌলুস নাই, চলনে বলনেও নেই আভিজাত্যের ছাপ। রং ঢং একেবারেই সে বুঝে না। যেটুকু তার মনের ভেতরে থাকে সেটুুকুই সে বাইরেও প্রকাশ করে। কারো কারো মতে রূপা খুবই ভালো এবং সরলমনা একজন নারী। কেউ বা আবার আড়ালে বলে যায় একজন জেলা প্রশাসকের বউ হিসেবে রূপা একদম বেমানান। একেবারেই ক্ষ্যাত। কেউ আবার আমাকে তোষামোদ করতে রূপার নানারকম গুন কীর্তন করে।
এখানে একটি রেওয়াজ প্রচলিত আছে, যখন কোন অফিসার এখানে বদলী হয়ে আসে বা কারো পরিবার প্রথম আসে তখন সেই অফিসারের পক্ষ থেকে সবার উদ্দেশ্যে একটি পার্টির আয়োজন করা হয়। আবার একই ভাবে অন্য অফিসার হাউজেও ওই পরিবারকে নিমন্ত্রন করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই রেওয়াজের কথা রূপাকে বলা হলো পর সে নিজের বাড়িতে অন্যকে নিমন্ত্রনের ব্যাপারে রাজি হলেও অন্যের বাড়িতে যাবে না বলে জেদ ধরলো। আমি তাকে বুঝালাম এটা এখানকার একটি সংস্কৃতি। সমাজে চলতে গেলে আমাদের এসব সংস্কৃতি মানতে হবে। রূপা বলল, আমি এখানকার কারো সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবো না। তারপর দেখা যাবে আমার জন্য তোমারি সম্মান ক্ষুন্ন হবে। আর অন্যকে খুশি করতে কোনকিছু করতে আমার ইচ্ছা নেই।
আমি বললাম এসব তোমার ভ্রান্ত ধারনা। তুমি আসলে নিজেকে ভালোভাবে জানোই না। তুমি যেমন আছো তেমনই থাকো। এভাবেই মানুষের সাথে মেশো, নিজের উপর আত্মবিশ্বাস রাখো। দেখবে সব জায়গাতেই তুমি খাপ খাওয়াতে পারবে। তোমার নিজস্ব একটা স্বকীয়তা আছে যা অন্যদের মাঝে নেই।
“সবাইতো অপরকে অনুকরন করে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে নিজেদেরই তাল হারিয়ে ফেলে। আপন আপন সংস্কৃতি ভুলে পরের সংস্কৃতি চর্চা করে”। তুমিতো তোমার ধাচে নিজেকে বহাল রেখেছো। তোমার স্বকীয়তা থেকে তুমি কখনো বিচ্যূত হওনি। এটাই তোমার অসাধারনত্ব। এটাই তোমার আভিজাত্য।
আমার কথাগুলো মুগ্ধ হয়ে শুনলো রূপা। তারপর বলল, তুমি এমন করে তো কখনো আমাকে বলোনি! যা বলছো ঠিক বলছো তো? তুমি নিজেই কি আমাকে কখনো চিনেছো? তোমারও কি কখনো আমাকে নিয়ে মন খারাপ হয়নি? কোন আক্ষেপ কোন অপূর্ণতা অনুভব করোনি? কখনোকি ভাবোনি আমার বউটা ঠিক আমার সাথে যায় না?
আমি বললাম, দেখো রূপা কখনো যে এমন কিছু ভাবিনি তা নয়। আমারো মাঝে মাঝে মন খারাপ হতো যখন দেখতাম আমার সহকর্মীদের স্ত্রীরা কত আধুনিক, সুন্দরী আর যুগপোযোগী। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আধুনিকতার মানে কি। তারাতো আসলে তাদের স্বামীদের পরিচয়ে নিজেরা পরিচিত, স্বামীর আভিজাত্যে নিজেরা অভিজাত। কিন্তু তুমি সর্বদা তোমার অবস্থান অনুযায়ী নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রেখেছ। তুমি একজন স্কুল শিক্ষক আর সেভাবেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলেছো। কখনো দেশের একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার স্ত্রী রূপে নিজেকে মেলে ধরোনি। এদিক থেকে চিন্তা করলে তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ অনেক বেড়ে যায় রূপা। আবার অনুতাপও হয় কেন তুমি আমার আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠোনা ।
রূপার ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক কিছু সামাজিকতা আমাকে মেনে চলতেই হয়েছে। রূপাও পরে আর এই বিষয়ে কোন কথা বলেনি। হয়তো আমার সম্মান রক্ষার্তে এসব অনুষ্ঠান আনুষ্ঠানিকতা সে পালন করে গেছে নিরবে।
*
বাসায় সবকিছূই ঠিকঠাক চলছিল। বাঁধ সাজলো শুধু সোহেলীর বেলায়। সোহেলীর সাথে দেখা হওয়াতো দূর; মনের মতো করে দিনে একটিবার কথা বলবো তাও হয়ে ওঠতো না। আর যেহেতু রূপা ছুটি কাটাতে আমার কাছে আসছিল তো তাকে একটু সময় না দিলে সেটাই বা কিরকম হয়! যদিও এসব নিয়ে রূপার কখনো কোন অভিযোগ ছিল না। অভিযোগ করবেই বা কখন? বিয়ের পর থেকে রূপার সকল ছুটিগলো সে তার পরিবার পরিজনের সাথেই কাটাতে পছন্দ করতো। আর সেই সুবাদে আমার মেয়েটা বাপের বংশের আত্মীয়দের তুলনায় মায়ের বংশের আত্মীয়দেরই বেশি চিনেছে এবং তাদেরকেই সে আপনজন বলে মনে বেশি।
রূপার উপস্থিতিতে সোহেলীর সাথে দিনকে দিন দূরত্ব সৃষ্টি হওয়াতে তার হতাশা এবং বিষন্নতা বেড়েই চলছিল। “ভালোবাসা পরস্পরের প্রতি এক ধরনের নির্ভরতার সৃষ্টি করে”। সোহেলীর ভালো থাকা মন্দ থাকাও আমার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল। আমারো যে সেরকম কিছু হয়নি তাতো নয়। তবে নিজেকে ব্যস্ত রাখার এবং বিষন্নতা কাটিয়ে ওঠার অনেকগুলো উপাদান এবং সুযোগ আমার থাকলেও সেহেলীর সেরকম কিছুই ছিল না। এর আগে আমিই তো সোহেলীকে অস্থির করে রাখতাম। এখন সে যখন অস্থিরাপন্ন আমি তখন নিরব দর্শক। আমি আমার সংসারে গোলযোগ চাইছিনা বলে সোহেলীর সাথে কত কত শর্ত দিয়ে যোগাযোগ রাখছি। আমার সুযোগমতো তার সাথে কথা বলছি দেখা করছি। যা করছি সবই আমার মতে আমার সিদ্ধান্তে। সোহেলীর মতামতের তেমন কোন গুরুত্ব কি আমি দিচ্ছি? এক্ষেত্রে আমিতো একজন স্বার্থপর পুরুষে পরিণত হয়েছি।
“ভালোবাসার সম্পর্কের ক্ষেত্রে মনে হয় সকল পুরুষই স্বার্থপর। মেয়েরা সবকিছু পেছনে ফেলে আগে ভালোবাসার মানুষটির কথা ভাবে, আর পুরুষ আগে সবকিছু ঠিক রাখে তারপর ভালোবাসা”।
যে নম্বরটিতে শুধু সোহেলীর সাথে কথা হয় যতক্ষণ বাসায় থাকি সেই নম্বরটি বন্ধ রাখি। যখন বাইরে যাই চালু করতেই সোহেলীর অনেকগুলি এসএমএস এসে জড়ো হয়। ওর এসএমএস পড়া শেষে মুছে ফেলি। যখন সুযোগ পাই জবাব দেই বা কল করি। কখনো কখনো রূপার আতংকে বা কাজের চাপে এসএমএসগুলো না পড়েই মুছে ফেলি। ইদানিং সোহেলী আমার উপর কোন রাগ অভিমান কিছুই দেখায় না। কোন অভিযোগও করে না। একেবারে বাধ্য মেয়ের মত কথা শুনে এবং বলে। সোহেলীর এই রূপ আমার কাছে অচেনা মনে হয়। বুকের ভেতর একধরনের কষ্ট অনুভব করি আমি। ওর ওই রাগ অভিমানে ভরা ঝাঁঝালো মৃদু শাসনেরই যেন আমি অভাব বোধ করি। তাকে জিজ্ঞাসা করি, তুমিকি আমার উপর রাগ করেছো সোহেলী? তখন বলে, নাতো। কেন রাগ করবো? রাগ করার কি কোন কারন আছে?
আমি তখন বলি, এই যে তুমি কেমন চুপচাপ হয়ে গেছো। আগের মত কথা বলো না, হাসো না, আমাকে হাসাও না, শাসন করো না এসবই রাগ কিংবা অভিমানের লক্ষন।
সোহেলী তখন বলে, স্যার আমার কি ওসবের অধিকার আছে? আমি আসলে নিজের অবস্থান থেকে ছিটকে পড়িছিলাম। হয়তো কিছু প্রশ্রয় আপনার ছিল আর কিছু ছিল আমার দু:সাহস। আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল আমি কে আমার কতটুকু প্রত্যাশা করা উচিৎ। আপনাকে ঠিক চোদ্দ বছর আগে যেভাবে ভেবেছিলাম এত বছর পরে দেখা হওয়ার পর সেখান থেকেই আমি শুরু করেছিলাম। মাঝখানে যে কেটে গেছে অনেকটা বছর, ঘটে গেছে অনেক ঘটনা, জীবনে যে অনেকে এসেছে এটা আমার মনে তেমন পাত্তাই পায়নি। আপনাকে কোন দোষ দিচ্ছি না স্যার। বরং আমার ভেতরের সুপ্তবোধ জাগ্রত হয়েছে। আর এটা আপনার জন্যই হয়েছে। গত ক’দিনের ব্যবহারে আমি বুঝতে পেরেছি আপনার কাছে আপনার পরিবার কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। এটা অবশ্যই ভালো দিক আপনার। আমারো নিজের পরিবার আছে। যদিও সেটা আপনার মত স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তবুও পরিবার তো।
কথাগুলো বলতে বলতে সোহেলীর কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে। তখন একটু চুপ করে থেকে আবার বলে, স্যার আমার আচরনে যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন বা আমার জন্য আপনার পারিবারিক জীবনে যদি কোন সমস্যা হয়ে থাকে আমাকে মাফ করবেন।
ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। আমি কেমন করে বোঝাবো সে আমার কতখানি। আমিকি তাকে ভালোবাসিনি? অনেক ভালোবাসি। আজ থেকে নয়। সেই চোদ্দ বছর আগে থেকে। জীবনের প্রথম ভালোবাসার বোধ আমি সোহেলীর কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। তারপর থেকে যত দূরেই গিয়েছি যত কিছুই হয়েছি, কখনোই সোহেলীকে হ্্রদয় থেকে একবিন্দু নড়াতে পারিনি। হয়তো অপ্রকাশিতই ছিল; কিন্তু ভালোবাসা বলতে যদি কিছু থাকে সে সোহেলীই ছিল এখনো আছে। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতে হয়তো আমরা দুজন এক হতে পারিনি। কিন্তু আমাদের আত্মা ঠিকই এক হয়েছিল। তাইতো এতটা বছর পর আবার আমাদের দেখা হলো। বড় অসময়ে হলেও আমরা দুজনেই দুজনের হ্্রদয়ের আকুতি শুনতে পেয়েছিলাম। মুখ ফুটে কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করেনি আসলে আমার কি চাই।
“যাকে ভালোবাসা যায় তাকে সারাটি জীবনই বাসা যায়। কেউ দেখে কেউ দেখে না”। আমাদের মধ্যকার সম্পর্কটা হয়তো দুনিয়ার কাছে অ-দেখাই রইলো তবুও আমার এটা ভাবতে ভালো লাগে যে সোহেলীর প্রতি আমার মনের গভীরে যে আবেগ ছিল তা এখনো আছে।
ওর কথার মাঝখানে থামিয়ে দিতে চেয়ে আমি বারবারই ব্যর্থ হচ্ছিলাম। সোহেলী এতটা গাম্ভীর্যের সাথে কথাগুলো বলছিল, আমি শুনে শুনে কেবল অবাক হচ্ছিলাম আর এক ধরনের সুক্ষè কষ্ট অনুভব করছিলাম। ওর কথা শেষ হলে তখন বললাম, সোহেলী আসলে আমি খুবই দু:খিত। আমি কিছু বলার আগে তুমি শুধু বলো এতক্ষণ যা বলেছো এসব তোমার মনের কথা নয়; অভিমানের কথা।
সে বলে, না স্যার এ সবই আমার মনের কথা।
আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম সে তখন কাঁদতেছিল। আমি বললাম, আমি বিশ্বাস করি না সোহেলী। আমি জানি তুমি আমাকে কিভাবে দেখো। তোমার জীবনে আমার স্থান কোথায় সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে বলতে পারে। আর তোমারো জানা উচিৎ তোমাকে আমি কোথায় রেখেছি। ‘হয়তো সমাজের কাছে আমাদের এই আবেগ এই ভালোবাসার কোন মূল্য নেই। হয়তো মানুষকে আমরা দেখাতে পারছি না আমরা কে কার কতখানি। হয়তো অন্য কাউকে নিয়ে জীবন যাপন করছি, সংসারের কাসুন্দি ঘেটে চলছি, তেল লবণে হিসেব করছি। কিন্তু এ সবকিছুর আড়ালে যদি কেউ একজন থাকে যে আমার হ্্রদয়টাকে বাঁচিয়ে রেখেছে সে হচ্ছো তুমি’। শোন “বেঁচে তো সবাই থাকে কিন্তু জীবনটাকে যাপন করে ক’ জনা”? আমি এতদিন শুধু বেঁচে ছিলাম। আর আমার ভেতরে তুমিও বেঁচে ছিলে সব সময়। তোমার ফিরে আসাতে আমি আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছি। এখন আমি জীবনটাকে যাপন করছি। সংসারের প্রয়োজনে আমার রূপাকে প্রয়োজন, যেমনটা তোমার প্রয়োজন সাদিকে। কিন্তু আত্মার প্রয়োজনে তোমাকে প্রয়োজন। আর তোমার প্রয়োজন আমাকে। আমার এ জীবনের প্রাণ হচ্ছো তুমি। আর আমি জানি তুমিও আমাকে সেভাবেই দ্যাখো।
*
প্রথম যেদিন সোহেলীকে নিয়ে হাওড়ের পাড়ে বসে গল্প করেছিলাম সেদিন কথায় কথায় আবিস্কার করেছিলাম সোহেলীর উচ্ছল অবয়বের পেছনে আর একটি গল্প আছে, একটি দু:খ আছে। তার গভীরতা এতখানি যে সেখানে পৌঁছানো কারো পক্ষে সম্ভব হয় না। সেদিন তাকে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম, কিন্তু তখন সে বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়েছিল। অনেক পরে অন্য আর একটি দিন সেই গল্পের কিছুটা অংশ প্রকাশ করেছিল আমাকে। আর ওই কিছুর সঙ্গে বাকিটা আমিই পড়ে নিয়ে ছিলাম। এখন আমি তার দু:খের ক্ষেত্রটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছি। আর সেও জানে আমি তার সুখের দিকটা যেমন খবর রাখি তেমনি দু:খটাকেও। আবেগের বশে সে তাই বলেছিল “আমারো নিজের পরিবার আছে। যদিও সেটা আপনার মত স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়”। তার এই কথাটি তাকে যতখানি কষ্ট দেয় ঠিক ততখানিই আমি অনুভব করতে পারি। কেননা সোহেলীর হ্্রদয়ের সাথে আমার হ্্রদয়ের গভীর যোগসূত্র আছে।
আমি বললাম “কোন মানুষই শতভাগ সুখি হয় না সোহেলী। আল্লাহ কারো প্রত্যাশাই কানায় কানায় পূরণ করেন না। এতসব না পাওয়ার মাঝেই আমাদের পাওয়াটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে”। তোমার হয়তো একটা দিক নেই। কিন্তু এমন অনেকেই আছে যাদের আরো কত দিক ই নেই। তাদের জীবনে কত কত অভাব-অপ্রাপ্তি। সেই দিক চিন্তা করলে তুমি আমি সকলেই সুখি। কোনকিছু নিয়ে আফসোস করো না। জীবনে যা কিছু পেয়েছো তাই নিয়ে সুখি থাকার চেষ্টা করো। নিজের জন্য নিজে ভালো থাকো।
সোহেলী তখন কিছুটা শান্ত। আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল। বলল, এজন্যইতো আপনাকে এত ভালোলাগে। আপনার মত করে কেউ কোনদিন আমাকে এমন করে কিছু বলে নি, কিছু বুঝায়নি। আপনার কথাগুলো শুনলে মনে হয় বেদবাক্য শুনছি।
আমি বললাম, মন খারাপ করো না সোহেলী। তোমার এ ভালোলাগার মানুষটিকে এতকাল যেভাবে মনের মাঝে সকলের অজ্ঞাতে পুষে রেখেছিলে এখনো সেভাবেই রেখো। সে তোমার মনের ওই ছোট্ট কুঠুরি রেখে কোথাও যাবে না। যত দূরেই যাই যত মানুষের মাঝেই থাকি না কেন, তুমি একটি মানুষ আমার হ্্রদয়ের একই স্থানে বিরাজ করবে সারাক্ষণ। হাজারো লোকের ভীরেও আমি আমার নিজস্ব অনুভূতি দিয়ে তোমাকে অনুভব করবো চিরকাল। হয়তো কিছু সীমাবদ্ধতার কারনে কখনো কখনো কথা হবে না, দেখা হবে না, তাই বলে ভেবোনা আমি হারিয়ে গিয়েছি। আমার উপর বিশ্বাস রোখো।
“যে হারিয়ে যাওয়ার সে অনায়াসেই হারিয়ে যায়; এভাবে কখনো ফিরে আসে না জীবনে।”
সোহেলী বলল, আমি জানি। কিন্তু আপনার সাথে কথা না হলে আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না। মেজাজ খারাপ হয়ে থাকে। আমি কোনকিছুতে মন বসাতে পারি না। সবকিছু ফেলে শুধু আপনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। আমি জানি এসব একদমই ঠিক না। কিন্তু মনটা আমার কিছুতই কথা শোনে না । আমি কেমন এলোমেলো হয়ে যাই।
বললাম, শোন মেয়ে এরকম এলোমেলো হলে চলবে কি করে। আমি চাই তোমার সবকিছু ঠিক রেখে তারপর আমাকে ভাবো। আর আমিও তাই। যাতে আমরা দুজন দুজনের জন্য ভালো থাকতে পারি। যাতে কেউ আমাদেরকে নিয়ে সন্দেহ না করে। আমি তোমাকে বুঝতে চেষ্টা করবো আর তুমি আমাকে। আমরা উভয়ে উভয়ের উপর বিশ্বাস রাখবো। এভাবেই পরস্পরের প্রতি সম্মান আর শ্রদ্ধাবোধের সহিৎ আমাদের ভালোবাসা বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। আমাদের সম্পর্কটা এমন এক ধরনের সম্পর্ক যেখানে কোন বৈষয়িক চাহিদা নেই, নেই কোন দেনা পাওনার হিসেব নিকেশ । শুধু আছে পরস্পরের প্রতি হ্্রদয়ের অগাধ প্রেম। এই প্রেমটাকেই আমরা হ্্রদয়ে লালন করে যাবো সোহেলী। আমরা বিরোধ চাই না, শুধু প্রেম চাই।
সোহেলী বলল, আপনার কথাগুলো আমারো মনের কথা। তবে জানি না আমি আমাকে কতটা স্থির রাখতে পারবো। বরাবরই আমার ধৈর্যশক্তি এতটা কম যে কোনকিছু বুঝতে পারলেও মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। আর যখন বুঝতে পারি আমার এসব করা ঠিক হয়নি তখন সেই ভুলের জন্য আরো বেশি করে অনুশোচনায় ভূগতে থাকে। ইচ্ছা করে খুব দ্রুত সবকিছু আবার ঠিক করে ফেলি। কিন্তু সবকিছুর জন্য যে একটা সুন্দর সময় আছে সেই সময়টা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারি না।
আমি বললাম, এতটা অস্থির হইওনা সোহেলী। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে, আমি আশা করি এখন থেকে যাই করবে হাজার বার বিবেচনা করে তারপর করবে।
তারপর বললাম, কদিন ঠিকমত যোগাযোগ করতে পারিনি বলে এতক্ষণ যা যা বলেছো সব তোমার অভিমানের কথা। মনটাকে নাড়া দেও সোহেলী। অনেকদিন তোমার মনের কথা শোনা হয় না আমার। এখন মনের কথা শুনতে চাই। আর কখনো বলবে না আমার প্রতি তোমার কোন অধিকার নাই।
‘‘অধিকার এমন একটা সম্পদ যা কেউ কারো হাতে তুলে দেয়ার দরকার হয় না। বরং আপনা আপনি কেউ কেউ অর্জন করে নেয়। সম্পর্কের মাঝে ভালোবাসা থাকলে সেখানে উভয়ের মাঝে এক ধরনের অধিকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এর জন্য কেউ দায়ী থাকে না।”
আমার এতগুলো কথায় সোহেলীর মনটা ভালো হয়ে উঠলো। ওর নি:শ্বাসে আমি ওর ভালোলাগা মনের অস্তিত্ব অনুভব করছিলাম । বললাম, আর মাত্র এক সপ্তাহ, রূপা ঢাকায় ফিরে যাবে, তখন আবার সবকিছু আগের মত হয়ে যাবে। আর একটু ধৈর্য ধরো । সে বলল, আমি বুঝতে পারছি স্যার। আর কখনো এমন উতলা হবো না। আপনি ওনাদেরকে সময় দিন। আমার কথা একদম ভাববেন না। আমি ভালো থাকবো। আর হ্যা, একদিন সবাইকে নিয়ে বেড়াতে আসবেন আমার বাসায়? আপনি যদি কথা দেন তাহলে আমি সাদিকে বলবো।
আমি বললাম, ভেবে দেখি। এখনো তো তোমার কথা রূপাকে কিছু বলিনি। আগে বলি তারপর তোমাকে জানাবো। আর বলার পরে তুমিও একদিন সাদিকে নিয়ে এসো। রূপা বলল, ঠিক আছে আপনার কাছে যেটা ঠিক মনে হয় স্যার। একটু নরম সুরে বলল, স্যার আমি কি কাল একটু আপনার সাথে দেখা করতে পারি? একটু সময়ের জন্য?
সোহেলীর মনের ইচ্ছা আমি বুঝতে পারছিলাম । দেখতে তো আমারো ইচ্ছা করছিল। কিন্তু সময় করে উঠতে পারছিলাম না। তার উপর রূপা এখানে আছে, দেখা করতে যেয়ে কোথাও কোন সমস্যা হয়ে যায় কিনা এসব ভেবে নিরব থেকেছি। এর আগে সোহেলীর সাথে এতদিন দেখা না করে থাকিনি । আমি বললাম, ঠিক আছে তাহলে কাল একবার অফিসে চলে এসো। তবে আসার আগে অবশ্যই ফোন করে এসো।
সে বলল, অফিসে গেলে সবাই কেমন করে যেন তাকায়। আমার কেমন অস্বস্তি লাগে। মনে হয় সবার চোখে আমাদেরকে নিয়ে সন্দেহ।
ওটা তোমার মনের ভ্রম। এমনটা আমারো মনে হতো যখন তোমার সাথে থাকতাম ভাবতাম আশে পাশের সবাই বুঝি আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে, আমাদের সম্পর্কটাকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করছে। আসলে নিজেদের মনের মধ্যে লুকোচুরি ভাব থাকে বলেই আমাদের কাছে এমনটা মনে হয়। বললাম, এই মুহুর্তে তোমাকে নিয়ে দূরে কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না। রূপার মনে কোন সন্দেহ আসতে পারে। এমনিতেই সে ইদানিং আমার আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করেছে। আমি নাকি অন্যরকম হয়ে গেছি। আবার ওদের প্রতি বেশি যতœশীল হচ্ছি দেখেও বলে আমি কোনকিছু লুকাতে একটু বেশিই ভালোবাসা দেখাচ্ছি কিনা। এখন কোনটা করতে যেয়ে কি করে ফেলি সেটাই বুঝে উঠতে পারি না। তাছাড়া কেউ আমাদেরকে দেখে ফেললে রূপাকে খবরটা দিতে একটুও দেরি করবে না।
*
অনেকগুলো ফাইল জমা হয়েছিল টেবিলে। লাঞ্চের পর অফিসে একটা মিটিং আছে। তাই রূপার সাথে কথা শেষ করেই ফাইলে ডুব দিলাম। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। ইদানিং প্রায়ই এই ঝিমঝিম ভাবটা অনুভব করি। হঠাৎ শরীরটা এমন করে যেন কোনকিছুতে শক্তি পাই না। বসে আছি না দাঁড়িয়ে আছি তাও বুঝতে কষ্ট হয়। কেমন একটা অবশ অবশ ভাব। মনে হচ্ছে একবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে । ভাবছি এককাপ আদা চা খাবো। তাতে ভালো লাগতে পারে। চায়ের কথা বলতেই রূপার ফোন। বলল, খেতে এসো আমরা অপেক্ষা করছি। আমি বললাম, হাতের কাজটা শেষ করে আসতেছি, তোমরা খেয়ে নাও। রূপা বলল, তুমি আসলে তারপর খাবো। আমি বললাম, ঠিকআছে তাহলে আর একটু অপেক্ষা করো। রূপাকে অপেক্ষা করতে বললাম ঠিকই কিন্তু ওর ফোন পেয়ে মনে হলো আর দেরি করা ঠিক হবে না। কাজগুলো পরে এসে করবো এই সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে পড়লাম। ধোঁয়া ওঠা আদা চা নিয়ে রবিউল এসে বলল, স্যার কোথায় যাচ্ছেন চা খাবেন না? আমি বললাম এখন আর চা খাবো না, বাসায় যাচ্ছি লাঞ্চ করে এসে মিটিং এ যাবো। তুমি ফাইলগুলো সব গুছিয়ে রেখো।
ঘরের বেল বাজাতেই রূপা দরজা খুলে দিল। আমার হাতে একটি গন্ধরাজ ফুল দেখে বলল, ফুল কোথায় পেলে? কে দিল তোমাকে? আমি বললাম আমাকে কেউ দেয়নি। আমি কাউকে দিব বলে নিয়ে এসেছি। রূপা তখন চোখ কপালে তুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হেসে দিয়ে বললাম আরে এত ভাবছো কি, অফিস থেকে বের হয়ে মাঠে নামতেই দেখলাম গাছে অজস্র ফুল ফুটে আছে। হাতের কাছে পেলাম তাই তোমার জন্য একটা ছিড়ে নিয়ে আসলাম।
আমার হাত থেকে ফুলটা নিয়ে নাকের কাছে ধরে বলল, বাহ্ চমৎকার গন্ধ। তোমাকে দেখে খুব অবাক হচ্ছি আজকাল। আমি বললাম, এতে আবার অবাক হওয়ার কি দেখলে?
বলল তোমার হাতে কখনোতো এমন ফুল দেখিনি তাই। তাও বলছো আমার জন্য নিয়ে এসেছো। ব্যাপারটা কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। কোনদিনতো আমার জন্য এমন উপহার আনতে দেখিনি তোমাকে।
আমি বললাম, ইদানিং আমি যাই করি তাই তোমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়। আসলে তোমার মনটাই অস্বাভাবিক হয়ে গেছে রূপা। কোনকিছুই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারো না।
আমার কেমন জানি রাগ হলো। ঢাকা যাওয়ার পর থেকে এই একটা কথা রূপা প্রতিদিনই কোন না কোন কারনে বলছে আমাকে। আচ্ছা মানুষের মন কি পরিবর্তন হতে পারে না? আগে আমি এটা করতাম না ওটা করতাম না, তাই বলে কি জীবনে আর কখনোই সেসব করা যাবে না? কোথায় সে খুশি হবে তা নয়, শুধু সন্দেহ আর মানে খুঁজে বেড়ায়। যে স্বাভাবিক ভালোলাগা নিয়ে ফুলটি গাছ থেকে ছিড়ে নিয়ে এসেছিলাম রূপার কথায় সেই অনুভূতিটা উবে গেল। কোন কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খাবার টেবিলে বসে পড়লাম। মনে মনে ভাবলাম এর চেয়ে অফিসে বসে ফাইলে সই করলেই সময়টা ভালো যেতো।
শোবার ঘরে বিছানার উপরে মোবাইল ফোনটি রেখে খেতে বসেছিলাম। ফোন বেজে উঠতেই আমার বুকের ভেতর কম্পন শুরু হয়ে গেল। সোহেলীর ফোন। ঘরে ঢোকার সময়ে ওই নম্বরটা ব›ধ করতে ভুলে গেছি। আমার আগেই রূপা গিয়ে ফোনটা হাতে নিল। ‘স্টুডেণ্ট’ লেখা দেখে বলল, তোমার সেই স্টুডেণ্ট ফোন করেছে।
আমি দ্রুত ওর কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে লাইনটা কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ করে দিলাম। সোহেলী একবার যখন কল করেছে আবারো করবে সেই আশংকায়। ফোনটা যে বন্ধ করেছি সেটা রূপা দাঁড়িয়ে দেখছিল । বলল, ফোনটা না ধরে কেটে দিলে কেন? আমি বললাম, এখন কথা বলার মুড নেই তাই। বুঝতে পারলাম এবার তার সন্দেহ’র মাত্রা কয়েক গুন বেড়ে গেছে । ওর দিকে না তাকিয়েই আমি বুঝতে পারছিলাম রূপার পঞ্চ ইন্দ্রিয় এখন আমার উপর স্থির নিবন্ধ। আমার ভেতরের অস্থিরতা বাইরে প্রকাশ না হয়ে যায় সেজন্য তাড়াহুড়ো করে খাবারটা শেষ করে বললাম অফিসে মিটিং আছে আমাকে এখনি বের হতে হবে। রূপা দেখলো আমি তেমন কিছুই খেলাম না। বলল, খেয়ে সাথে সাথেই বের হবে? একটু বিশ্রাম নিয়ে যাও।
আমি বললাম, না সময় নেই। আর বিশ্রাম নিতে গিয়ে আবার কি থেকে কি করে বসি তখন আবার বলবে আমার কাজগুলো কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। তারচেয়ে অফিসে গিয়ে কাজ করি সেটাই ভালো। রূপা বলল, তুমি কিন্তু খুব রেগে যাচ্ছ। আমি এমন কিছুই বলিনি যার জন্য তুমি এমন ব্যবহার করছো আমার সাথে।
আমি বললাম, দেখো রূপা ঘরটা হলো মানুষের শান্তির নীড়। যে যেথায়ই থাকুক কাজ শেষে একটুখানি প্রশান্তির জন্য সবাই ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু আমার ঘরে কেন শান্তি নেই?
রূপা বলল, আমিকি তোমার ঘরের শান্তি নষ্ট করেছি?
বললাম, প্লিজ রূপা একটু পর অফিসে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। মেজাজটা খারাপ করে দিওনা। আমি তোমাকে বলিনি যে শান্তি নষ্ট করেছো। আমি বলেছি কেন আমার ঘরে শান্তি নেই? সেখানে কিছু দায় আমারো থাকতে পারে। আর ঘরটা শুধু আমার একার নয়; তোমারো।
আমি আর কোন কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

*
আজ অফিস থেকে যখন বের হলাম আর রূপার জন্য অফিসের সামনের গাছ থেকে গন্ধরাজ ফুলটি ছিড়ে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বাসায় যাচ্ছিলাম মনে মনে ভাবছিলাম আজ রূপাকে সোহেলীর কথা বলবো। বলবো যে এই আমার সেই স্টুডেণ্ট যার সাথে এতটা বছর পর এই শহরে দেখা হয়েছিল। তারপর সোহেলীকে একদিন বাসায় আসতে বলবো। এর আগে সোহেলী অনেকদিন বলেছিল আমি কোথায় থাকি কেমন অবস্থায় থাকি সেটা তার অনেক দেখার ইচ্ছা। আমি একা থাকি বলে কখনো তাকে বাসায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। এখন রূপা থাকতে থাকতে একদিন সোহেলী আসতে পারবে।
কিন্তু বাসায় যাওয়ার পরে ফুল নিয়ে রূপার মন্তব্য আমার মনটাই বিষিয়ে দেয়। তার উপর সোহেলীর ফোন। তাই বিষয়টা মনের মাঝে চেপে রেখেই বেরিয়ে আসতে হলো। পরিস্থিতি কখনো সহায় হলে বলার চেষ্টা করবো এই ভেবে বিষয়টাকে এড়িয়ে গেলাম।
কিন্তু আমি এড়িয়ে গেলে কি হবে, “জগতে এমন এমন কিছু মানুষ আছে যাদের কাছে অন্যের বিষয়ে নাক গলানোটাই যেন প্রধান কাজ। সবকিছুতেই তারা কুটকচালী করে। আর এতেই তাদের পেটের ভাত হজম হয়”।
অফিসে এসে মিটিং এবং মিটিং শেষে বাইরে যেতে হলো। বিকেলে রূপা একবার ফোন করেছিল ধরতে পারিনি। আবার এটাও হতে পারে আমি ইচ্ছা করেই ধরিনি। মিটিং শেষে সোহেলীকে একবার ফোন করে কথা বলেছিলাম। আর একটু পরপর তার এসএমএস পড়ছিলাম।
ওর সাথে কথা বললে আমার খারাপ মন ভালো হয়ে যায়। যেন সোহেলীই আমার হ্্রদয়ের নি:সঙ্গতার রং বুঝতে পারে । বুঝতে পারে হ্্রদয়ের অভিব্যক্তি। অন্যদিকে রূপা শুধু বুঝে তার কখন কি প্রয়োজন আমাকে মেটাতে হবে। সবসময়ই ঘর সংসার বর্তমান ভবিষ্যৎ চাকরী অবসর এসব নিয়েই রূপার ভাবনা। জীবনটাকে একটা উদ্দেশ্যবহ করে তুলছে রূপা। “কিন্তু জীবনটা একটা উপভোগেরও বিষয়”। জীবনটাকে এরকম যান্ত্রিক আর উদ্দেশ্য প্রনোদিত করে তুলতে আমার একেবারেই ভালো লাগেনা। ওর চাকরীর কথা ভেবে সারাটি জীবন আমি নি:সঙ্গই থেকে গেলাম। এখানে ওখানে পোষ্টিং নিয়ে আমি একাই যাযাবরের মত ঘুরে বেরিয়েছি। রূপা সারাজীবনই তার ক্যারিয়ার নিয়ে ভেবেছে। কখনো আমার একাকিত্ব নিয়ে ভাবেনি। আমাকে সঙ্গ দেয়ার কথা ভাবেনি। এতটা বছরে কখনো আমার সাথে কোথাও বেড়াতে যায়নি। কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে তাকে স্বেচ্ছায় নিতে পারিনি। আমার মনের মত করে কখনো তাকে সাজাতে পারিনি। কোনদিন শপিংমলে গিয়ে একসাথে কেনাকাটা করতে পারিনি। নিজের পছন্দে একটা শাড়ি নিয়ে গেলে কখনো তাকে উচ্ছাসিত হতে দেখিনি। সে শুধু চেয়েছে একলা ঘরে নির্জন কামরায় শুধু তার সাথে আমি প্রেমালাপ করি, আর কানে কানে বলি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। এমন বউ নিয়ে আমি সুখে আছি কিনা এমনটা যে সে কখনো ভেবেছে তাও আমার মনে হয়নি। শুধু পেরেছে রোজগার করতে আর সঞ্চয় করতে। জীবনে যে আরো কিছু করার আছে তা তার মনে হয়নি কখনো। আর সুযোগ পেলেই তার মা ভাইদের কথা ভেবেছে। সেদিকে সে ঠিকই সবরকম দায়িত্ব পালন করতে জানে।
“মানুষের একটাই জীবন, এ স্বল্প জীবনে মানুষকে উপভোগ করে যেতে হবে যত কিছু ভালো আর সুখের দিকগুলো। ব্যবহার আর কর্মের দ্বারাই মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে হবে।”
*
সেদিন বিকেলে অফিস সহকারী রোকসানা আমার বাসায় যায়। আমি যখন অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম রূপা তখন একথা বলার জন্যই আমাকে ফোন করেছিল, কিন্তু আমিতো ফোনটা রিসিভ করিনি। রোকসানা আমার বাসায় গিয়েছিল রূপার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে । কিন্তু সাক্ষাতের পেছনে তার আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল সেটা পরের দিন আমি জানতে পারি।
রোকসানা গিয়ে নিজের পরিচয় দিলে রূপা তাকে যথা সম্ভব আপ্যায়ণ করে। রূপা বাইরের মানুষের সাথে তেমন একটা গল্প করতে পারে না। তাই রোকসানাও খুব একটা জমাতে পারেনি। অত:পর রোকসানা বিদায় নেয়ার সময় রূপাকে বলে, ভাবী আমার বাসায় কবে আসবেন? রূপা বলে, আমি আসলে তেমন কোথাও যাই না। এখানে এসে কারো বাসাতেই যাওয়া হয়নি। তখন রোকসানা বলে, স্যারের স্টুডেন্টের বাসায় গিয়েছেন? রূপা বলে, না। মনে মনে ভাবে ওই স্টুডেন্টের কথা রোকসানাও জানে! রোকসানা তখন বলে, স্যার আপনাদেরকে সেই বাড়িতে নিয়ে যাননি? স্যার তো প্রায়ই ওই বাড়িতে যান। প্রতি শুক্রবার সেই বাসায় স্যারের দাওয়াত থাকে। সেই মেয়েটাও অফিসে আসে মাঝে মাঝে। তারপর স্যার তাকে নিয়ে বেড়াতে যায়।
রোকসানার কথার মাঝে একটা অন্যরকম আভাস পেয়ে রূপার সন্দেহর বীজ দানা বেঁধে ওঠে। সে চুপচাপ রোকসানার কথাগুলো শোনে কিন্তু কিছু বলে না। রোকসানা ভাবে এমন একটা খবর বলার পরেও দেখি স্যারের বউয়ের কোন মাথাব্যাথা নেই। ব্যাপারটা কি? তখন রোকসানা আবার বলে, ভাবী আপনাকে মনে হয় স্যার এখনো তার স্টুডেন্টের কথা কিছু বলেননি। হয়তো ব্যস্ততার কারনে বলেন নি। আমার কাছ থেকে শুনেছেন এটা প্লিজ স্যারকে বলবেন না।
রূপা তখন বলে, আরে আপনি এত ভাবছেন কেন? আর এখানে তার একজন পুরোনো স্টুডেন্ট আছে সেটা সে আমাকে বলেছে। সেই স্টুডেণ্ট মাঝে মাঝে ফোন করে তাও আমি জানি। এতে তো দোষের কিছু নাই।
রূপা প্রসঙ্গটা পাল্টে রোকসানাকে বিদায় দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেননা রোকসানাকে তখন তার বিরক্ত লাগে। যেতে যেতে রোকসানা আরো একটু বলে যায়। বলে, ভাবী অনেকদিন আগে অফিসের ফোনে একটি মেয়ে কল করলে আমি ফোনটা রিসিভ করি। তারপর সেই মেয়েটি স্যারের নাম ধরে তার নম্বরটি চাইলে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি স্যার আপনার কি হয়। সে তখন আমাকে বলে, আমি তার স্টুডেন্ট। এরপর তাকে আমি স্যারের নম্বরটি দেই। তার কিছুদিন পরেই একটি সুন্দরী মেয়ের সাথে স্যারকে অফিসে এবং অফিসের বাইরে অনেক জায়গায় দেখা যায়। ভাবী আপনি আবার এটা ভাববেন না আমি স্যার কে নিয়ে উল্টা পাল্টা কথা বলছি। আসলে অফিসের সবাই এই ব্যাপারটা নিয়ে কানাঘুষা করে। আমি শুনলে তখন বলি মেয়েটাতো স্যারের স্টুডেণ্ট ছিল। তো তার সাথে কথা বলতেই পারে বা দেখা করতেই পারে। এটা নিয়ে গল্প বানানোর কি আছে। কিন্তু বুঝেনই তো ভাবী। আমাদের সমাজে কিছু না হলেও এমন অনেক ছোট ঘটনাকে মানুষ অনেক কিছু বানিয়ে ফেলে। যদিও আমি জানি স্যার কত ভালো মানুষ।
এভাবে আমাকে ভালো মানুষ বানাতে বানাতে শেষ অবধি কোনকিছুই বলতে আর বাকি রাখেনি রোকসানা। যা ঘটেছে তাও বলেছে, যা ঘটেনি তাও। সবকিছু রূপা হজম করে রেখে দিয়েছিল পরের দিন পর্যন্ত। সে হয়তো অপেক্ষা করেছিল সোহেলী প্রসঙ্গে আমি কিছু বলি কিনা। ততক্ষণ পর্যন্ত রূপা আমাকে বিশ্বাস করবে যতক্ষনে আমি সোহেলীর কথাটা তাকে বলবো। আর যদি না বলি তখন সে বুঝে নিবে পাছে লোকে যা কিছু বলে তার কিছু না কিছু তো অবশ্যই ঘটে।
আগের দিন রোকসানা যে এতকিছু বলে গেল তার কিছুই আমার জানা ছিল না। পরের দিন আমার সাথে দেখা করতে সোহেলীর অফিসে আসার কথা। আমিতো সেটা মনে রেখেছি। এবং যত কাজই থাকুক ওর জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় বের করে নিয়ে ওই সময়টাতে হাতে কোন কাজ রাখিনি। সোহেলীকে বলেছি দুপুরের দিকে আসতে। ওই সময় অফিসে একটু লোকজন কম থাকে। অনেকে লাঞ্চ করতে বাইরে যায়। আর আমারো মনে মনে আশা ছিল সোহেলীর সাথেই লাঞ্চ করবো। তাই হাতের কাজ শেষ করে সোহেলীকে ফোন দিয়ে বলে দিলাম এখন রওয়ানা দিতে পারো।
কিন্তু কেউ যে আমার পিছনে লেগে আছে এটা আমি বুঝবো কি করে। সোহেলীকে অফিসে ঢুকতে দেখেই রোকসানা আমার বাসার টিএন্ডটি নম্বরে ফোন করে। বলে, ভাবী স্যারের সেই ছাত্রী এসেছে অফিসে। এখন স্যারের রুমে আছে। শুনে রূপা বলে, দেখেন আপনি এসব বলার জন্য আমাকে আর ফোন করবেন না। আর আপনার সাহস দেখে তো আমি অবাক হচ্ছি। কার সম্পর্কে কি বলছেন একবার মনে রাখলে আপনার জন্যই উত্তম। মনে রাখবেন উনি আপনার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। রোকসানা তখন অনুতপ্তের সুরে বলে, ভাবী আমি দুখি:ত। আসলে আমি আপনার কথা ভেবেই বলছিলাম। তখন রূপা বলে, আমার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না। নিজের চাকরীটা ধরে রাখতে কি করতে হবে সেটা নিয়ে ভাবলে আপনারই উপকার।
রোকাসানার সাথে কথা শেষ হলে রূপা আমাকে ফোন দেয়। আসলে নারীর মন তো। তার উপর সে আমার স্ত্রী। কারো কাছ থেকে এমন কথা শুনলে সেই স্ত্রীর মনে তো নানান প্রশ্ন আসবেই। সেদিক থেকে চিন্তা করলে রূপা বেশ ধৈর্য্য এবং সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে। আর রোকসানাকেও তেমন পাত্তা দেয়নি। সেটা হয়তো আমাদের দুজনেরই আত্মমর্যাদা বজায় রাখতে যেয়ে এবং আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারটা রোকসানার কাছে বিন্দুমাত্রও প্রকাশিত হোক এটাও সে চায়নি। কিন্তু রোকসানার কথাগুলো ঠিকই তার মনে গেঁথে ছিল শক্ত হয়ে। যা হয়তো ভবিষ্যৎ কয়েক প্রজন্ম পর্যন্তই মনে গেঁথে থাকবে।
রূপা ফোন দিয়ে প্রতিদিনের মত বলে, খেতে আসো আমরা অপেক্ষা করছি।
বেলী ফুলের সুগন্ধী ছড়িয়ে দিয়ে শাদা শুভ্র শাড়িতে শান্ত স্নিগ্ধ সোহেলী তখন আমার সামনে বসা। আমি যখন রূপার কলটি রিসিভ করি সোহেলী তখন টেবিলের উপর রাখা একটি পেপার ওয়েট নিয়ে আনমনে ঘুরাচ্ছিল । ওর দিকে দৃষ্টি রেখেই রূপাকে বললাম, তোমরা খেয়ে নাও, আজ আমি অফিসেই লাঞ্চ করবো। রূপা বলে, এখান থেকে এখানে তোমার আসতে সমস্যা কিসের? মৌটুসী বসে আছে তোমার জন্য।(রূপা এই কাজটা প্রায়ই করে, আমাকে মানসিকভাবে আয়ত্ব করতে মেয়েকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে।) আমি বললাম সমস্যা কিছু না। আমার একজন গেষ্ট আসছে। রূপা তখন জানতে চায়, কে এই গেষ্ট। আমি বললাম, নাম বললেই কি তুমি চিনতে পারবে? সন্ধ্যায় বাসায় এসে বলবো। এখন এত জেরা করছো কেন? এই বলে আমি কথা শেষ করি। রূপা তখন যা বোঝার বুঝে নেয়।
পেপার ওয়েটে সোহেলীর দৃষ্টিটা তখনো নিবন্ধ রেখেই আমাকে বলল, বাসায় যেহেতু সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে তো যাওয়া উচিৎ ছিল না? কোন জবাব না দিয়ে আমি সোহলীর দিকে তাকিয়ে থাকি। ওর হ্্রদয়ের একখন্ড শূণ্য জমিনের উপর দৃষ্টি পড়তেই আমার অন্তরেও শূণ্যতা অনুভূত হয়। অকস্মাৎ আমার মনের আঙিনায় জেগে ওঠা প্রশ্নটা ওর দিকে চালান করে দিয়ে বলি, তুমি কি দেশের বাইরে একবার চেষ্টা করে দেখবে? এখনতো চিকিৎসা বিজ্ঞান কত এগিয়ে গিয়েছে। অসম্ভব বলে তেমন কিছুই নাই।
মাথাটা আরো একটু নিচু করে খাবারে মনোযোগ দেয়ার ভান করে সোহেলী বলে, আপনার অফিসের ক্যান্টিনের রান্নাতো ভালোই।
বুঝতে পারছি প্রসঙ্গটা এড়াতে চাইছে সে । কেউ যখন আমার কথার জবাব না দিয়ে প্রসঙ্গ এড়াতে চায় তখন আমার ভীষণ রাগ হয়। মনে হয় সে আমার কথার কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না। কিন্তু এক্ষেত্রে সোহেলীর উপর আমার কোন রাগ হলো না। বরং এক ধরনের মায়া অনুভব করলাম। আগেও দেখেছি ওই প্রসঙ্গে যখনি কিছু বলেছি তখনি সে বিষয়টা এড়িয়ে চলেছে। এই একটি বিষয়ই সোহেলীর হ্্রদয়ে কঠিন শূণ্যতা সৃষ্টি করে আছে। এই একটি বিষয় বাদ দিলে ওর মতো সুখি হয়তো আর কেউ ছিল না।
*
সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় যেয়ে রূপার অগ্নিমূর্তি দেখতে পাই। ওর চেহারার এমন কালিমাখা গাম্ভীর্য এর আগে কখনো আমার চোখে পড়েনি। সারাদিনে আমার অপরাধ কোথায় কোথায় হয়েছে সেটা মনে মনে খুঁজতে থাকি। পাওয়ার মধ্যে পেয়েছি দুপুরে বাসায় না আসা। এমনটা যে আজই হয়েছে তা তো নয়। কতদিনই তো দুপুরে কাজের চাপে আমি আসতে পারি না। তার জন্যতো রূপা কখনো এমন রুদ্র রুপ ধারণ করেনি!
মনটা বিগড়ে গেল বলে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে আমি মৌটুসীকে নিয়ে ছাদে যেয়ে কবুতর নিয়ে খেলা করি। মৌটুসী তখন বলে, জানো বাবা আজ মা খুব কেঁদেছে। বিষ্মিত হলাম, রূপা কেঁদেছে! কিন্তু কেন? আমিতো তেমন কিছু করিনি। তাহলে ওর কি কোন সমস্যা?
ছাদে আর মন টিকলো না। নিচে নেমে এলাম। বারান্দায় একা একা বসেছিল রূপা। ওর ওই বসে থাকার মধ্যেই স্পষ্টকরে জানান দিচ্ছিল ওর মনের অবস্থাটা। জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কি স্বাস্থ্য খারাপ? দেখতে এমন দেখাচ্ছে যে?
রূপা বলল, না আমার কিছু হয়নি।
আমার ভেতরের কৌতুহল আমি কখনো চেপে রাখতে পারি না। এবারো পারিনি। বললাম মৌটুসী বলল তুমি নাকি কান্নাকাটি করেছো। কি হয়েছে আমাকে বলবে? রূপা তখন এমনভাবে আমার দিকে তাকায় যেন ওর চোখের মনিকোঠায় জ্বলন্ত অগ্নিকান্ড দাউদাউ করে জ্বলতেছিল।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি আমাকে, রূপার অগ্নিমূর্তির রহস্য উদ্ঘাটিত হলো আর আমিও বিষ্ময়ে হতচকিত হয়ে গেলাম যখন শুনলাম এ সবই রোকসানার কৃতিত্ব। এমনকি সে আজকের দিনের বিশেষ প্রতিবেদন দিতেও ভুল করেনি। ইচ্ছা করছিল তখনি রোকসানাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করি তার এত সাহস কি করে হলো। কিন্তু সেসব না করে আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসলাম কিকরে রূপাকে এই ঘটনার একটা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। বললাম, ওহ এই কথা? এজন্য তোমার এত মেজাজ খারাপ হওয়ার কি আছে তাতো বুঝলাম না।
এরপর আমি ধীরস্থিরতার সাথে বলতে শুরু করলাম- আমার এক পুরোনো স্টুডেন্টের কথা তোমাকে বলেছিলাম, যার সাথে রাজশাহীতে এসে হঠাৎ অনেক বছর পরে আমার দেখা হয়ে যায়।
এটুকু বলার পরেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে রূপা বলল, আর সেই ষ্টুডেণ্ট যে একটি সুন্দরী নারী, যে যখন তখন অফিসে চলে আসে, তাকে নিয়ে ভ্রমনে বের হও, ছুটির দিনগুলোতে তার বাড়ি যেয়ে সময় কাটিয়ে আসো, আরো কত কি তাতো বলছো না।
আমি বললাম, দ্যাখো তোমার উচিৎ হবে বিষয়টা আমার কাছ থেকে জেনে নেয়া। আর তা না করে যদি রোকসানা কি বলল সেটা নিয়েই এমন কিছু একটা নিশ্চিৎ সিদ্ধান্তে পৌঁছো তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা ভুলও হতে পারে। নারী জাতিই হিংসাপরায়ণ। এখন বুঝতে পারছি এই রোকসানা কেন আমার সম্পর্কে এত কুটকচালি করেছে। এখন বুঝতে পারছি সোহেলী যেদিন প্রথম ফোন করেছিল রোকসানা কেন তাকে নানান প্রশ্ন করেছিল। সে নিশ্চয়ই তোমাকেও সেসব বলেছে। শোন আমি এখানে আসার পর রোকসানা যখন দেখেছে আমি একা, তখন থেকে সে আমার সাথে একটু বেশিই ভাব জমাতে চেয়েছিল। সবসময় আমার খোঁজখবর নিতে চেয়েছে। সে এখানে অনেকদিন চাকরী করছে সেই হিসেবে একধরনের আধিপত্য নিয়ে টিকে আছে এই অফিসে। অফিসের কারো কারো প্রতি রোকসানার এমন ব্যবহারের কথা ইতোমধ্যে আমিও শুনেছিলাম। আমি তাকে বেশি প্রশয় দেইনি বলেই সে আমার সম্পর্কে তোমার কাছে উদ্ভট সব গল্প করে গেছে।
রূপা তখন আমাকে আবার থামিয়ে দিয়ে বলল, নিজের দোষ ঢাকতে এখন রোকসানাকে নিয়ে পড়েছো কেন? সে খারাপ হোক না ভালো হোক তাতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না। আমি শুধু জানতে চাই সে যা যা বলে গেল সেসব কথা কতখানি সত্য, কতখানি মিথ্যা, কতখানি অতিরঞ্জিত?
আমি বললাম সোহেলী আমার কলেজ জীবনের ষ্টুডেণ্ট ছিল। ওকে আমি তিনবছর পড়িয়েছি। আমি যখন ইন্টার পাশ করে ঢাকা চলে আমি সোহেলী তখন এসএসসি পাশ করে । ওই সময় ওর বিয়ে হয়ে যায় আর আমিও ঢাকা চলে আসি। পরবর্তীতে আমাদের সাথে আর কখনোই কোন যোগাযোগ হয়নি। কিছুদিন আগে একদিন রাস্তায় তার সাথে আমার দেখা হয়। দেখা বলতে সোহেলীই আমাকে চিনতে পেরে এগিয়ে আসে। তারপর পরিচয় দিলে আমি তাকে চিনতে পারি। সেদিন অনেক ব্যস্ত থাকার কারনে আমরা একে অপরের ফোন নম্বরটাও নিতে পারিনি বা সেটা নেয়ার কথা আমার মনেও হয়নি। সে কোথায় থাকে, এখানে কি করে এলো এসবও জানতাম না। তারপর একদিন অফিসের নম্বর যোগাড় করে সে আমার সাথে যোগাযোগ করে।
রূপা বলল, ওহ এতকিছু? তরপর?
আমি বললাম, দ্যাখো এরমধ্যে তুমি যদি এতকিছু পেয়ে যাও তাহলে আমি আর বাকি ঘটনা সামনের দিকে এগিয়ে না নিয়ে যাওয়াই উত্তম মনে করি। বাকিটা বরং রোকসানার কাছ থেকে শুনে নিও।
রূপা বুঝতে পেরেছে আমার মনটা উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে যেকোন সময়। তাই সে কিছুটা নিরব থেকে খোঁচা মারার ভঙ্গিতে বলল, ওর বাসায় যে মাঝে মাঝেই যাওয়া হয় তাতো বললে না। আর আজ সে অফিসে আসলো বলে আমাদের সাথে খেতেও আসতে পারোনি তাও বলোনি। সে নিশ্চয়ই তোমার বিশেষ কেউ । নইলে তাকে আর তোমাকে নিয়ে অফিসে এত কানাঘুষা কেন?
আমি বললাম, এখানে রূপা না হয়ে আমার পূর্ব পরিচিত অন্য কোন একটি মানুষ হলে সেও আমার সাথে যোগাযোগ করতো। আর একই বরিশালের মানুষ হয়ে আমিও পারতাম না সেই মানুষটিকে এড়িয়ে চলতে। যেহেতু সোহেলী আমার ছাত্রী ছিল। সে আমার সাথে দেখা করতে আমার অফিসে আসতেই পারে । তার স্বামী সহ এসে আমাকে তাদের বাসায় দাওয়াত করে গেছে। আমি গিয়েছি। এতে দোষের কি আছে?
দোষের কিছু না থাকলে তুমি কখনো আমার কাছে তার কথা লুকাতে না। তার ফোন আসলে আমার সামনে সেটা রিসিভ না করে কেটে দিতে না। এসএমএস লুকিয়ে পড়া শেষে মুছে ফেলতে না। তার আসল নামের বদলে ষ্টুডেণ্ট নাম দিয়ে নম্বরটি সেভ করতে না। আমি আসছি এটা শুনে তারতো বাসায় আসা উচিৎ ছিল। সে তোমাকে একা তার বাসায় দাওয়াত করে নিয়ে যেতে পারে, আর আমি আসছি তো একবার দেখা করার কথাও তার মনে আসেনি! তোমার সাথে ওই মেয়ের স্বাভাবিক কোন সম্পর্ক হলে নিশ্চয়ই আমার সাথে দেখা করতো, চুপি চুপি অফিসে এসে তোমান সাথে লাঞ্চ করতো না। আর একেবারেই কিছু না হলে অফিস জুড়ে তোমাকে নিয়ে আলোচনা হতো না। যা কিছু রটে তার কিছু না কিছু ঘটে।
রূপা বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠতেছিল। ওর একের পর এক কথার বর্ষণে আমি থ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। প্রতিটি কথার সাথেই মনে হচ্ছিল আমি ধরা পড়ে গেছি রূপার কাছে। আমি হেরে গিয়েছি রুপার কাছে। আমি রুপার কাছে ছোটও হয়ে গিয়েছি। কিন্ত ওর কাছে আমার ধরা পড়ে যাওয়া, ছোট হওয়া, হেরে যাওয়াটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না । আমার ভেতরের জেদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই আমিও উচ্চস্বরে চেচাতে লাগলাম। আমার সমস্ত স্বত্ত্বা দিয়ে ওর যুক্তিগুলোকে ভিত্তিহীন ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করলাম ।
মাঝখান থেকে মৌটুসী আমদের চেচামেচি শুনে ভয়ে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সে কান্নাকাটি করে একবার এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে, একবার রুপাকে। রূপাকে বললাম, না চেচিয়ে মেয়েটাকে সামলাও।
সে বলল, তোমার মেয়ে তুমিই সামলাও।
আমি বললাম, আমার মেয়ে মানে? মেয়ে কি আমার একার? কথায় কথায় তুমি বলতে থাকো আমার মেয়ে আমার ঘর আমার সংসার। এসব কি ধরনের ল্যাংগুয়েজ রূপা? কই, আমিতো কখনো তোমাকে এসব বলিনি!
রূপা আরো গরম হয়ে বলল, অনেক করেছি আমি, অনেক সহ্য করেছি, আর না। তোমার সংসারকে কখনোই আমার নিজের সংসার মনে হয়নি, তাই এমন বলি।
আমার রাগ তার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। ওর এমন ব্যবহার আমি ভাবতেও পারছিলাম না। আমি বললাম, তা মনে হবে কেন? তুমিতো বিয়ের পরেও তোমার বাপের বাড়িকেই নিজের সংসার ভেবে আসছো । তাদেরকে নিয়েই তোমার সব চিন্তা ভাবনা। আমাকে তো রেখেছো সাইনবোর্ড হিসেবে। এমনই যদি করবে তো তখন আমাকে বিয়ে করছিলে কেন? আর তুমি কি সহ্য করেছো? সহ্য করেছিতো আমি। দিনের পর দিন তুমি আমাকে অবহেলা করেছো। স্বামী হিসেবে কোন মুল্যায়ণ কি করেছো আমাকে? নিজের ওই সামান্য মাস্টারনীর চাকরীটাকেই মনে করেছো জগতের সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদ। আমার কোন প্রয়োজনে আমি কোনদিন তোমাকে পাইনি। তোমার জন্যই মেয়েটা অবহেলা অযতেœ বড় হচ্ছে। একজন মায়ের কাছ থেকে যা যা পাওয়ার দরকার তোমার কাছে তার কিছুই পাচ্ছে না সে। তুমি ওকে সময় দেওনা বলেই সে সুস্থ্য থাকে না। তুমি যদি ঢাকা না থেকে আমার সাথে থাকতে তাহলে আমিও আমার সন্তানকে দেখাশুনা করতে পারতাম।
*
আমি কোনদিন রূপার চাকরী বা ওর শিক্ষকতা পেশাকে ছোট করে দেখিনি। এই নিয়ে কখনো কিছু বলিনিও। বিয়ের পর থেকেই দেখেছি রূপা ওর কাজটাকে কতটা শ্রদ্ধার চোখে দেখছে। সবকিছু থেকে চাকরীটাকে সে বেশি প্রাধান্য দেয়। তাই আমিও ওর কাজটাকে সেভাবেই দেখতাম। আমার নিজস্ব শ্রদ্ধাবোধ থেকে নয়, ওর বোধের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে যেয়ে। নিজের একাকী কষ্টের জীবন যাপন করলেও রূপাকে নিয়ে কখনো টানাহেচড়া করিনি। কতজনে কত বলেছে আমার স্ত্রীর ওরকম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা মানায় না। কেন তাকে দিয়ে আমি ওই চাকরী করাচ্ছি। কেন সে চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে আমার সাথে থাকে না। কিন্তু আমি কখনোই সেসব লোকের কথায় কান দেইনি। কেননা আমার কাছে মনে হয়েছে রূপার যোগ্যতানুযায়ী এর চেয়ে অনেক ভাল কিছু হয়তো সে করতে পারতো। কিন্তু তার সাথে রূপার ভালোবাসাটা হয়তো জড়িত থাকতো না।
কিন্তু আজ যখন সে আমার সাথে উত্তেজিত হয়ে সোহেলী প্রসঙ্গে একের পর এক কথা বলে যাচিছল, তখন এই প্রথমবারের মত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হই আমি। তার চাকরী নিয়ে কথা বলেছি। এমনকি সংসারের দুরবস্থার জন্য তাকে সরাসরি দায়ী করেছি। এসব আমার দীর্ঘদিনের জমানো ক্ষোভ ছিল। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত কষ্ট ভেতরে পুষে রেখে ফ্রিজ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। আজ সকলি বিষ্ফোরিত হলো। না জানি সামনে আরো কত কি বাকী আছে!
রূপার ভালো গুণ যেমন আছে তেমনি খারাপও রয়েছে। “কোন মানুষই দোষত্রƒটির উর্ধ্বে নয়”। রূপাকে আমি বিয়ে করেছিলাম ওর কিছু ভালো দিক বিবেচনা করে। যেগুলিকে আমি সত্যিই অনেক শ্রদ্ধার চোখে দেখেছিলাম। যদিও আমার শুভাকাঙ্খী এবং আত্মীয়দের চোখে রূপা কোনদিনই পছন্দের পাত্রী ছিল না।
রূপাকে খুশি রাখতে যেয়ে আমি আমার সেসব বন্ধু এবং আত্মীয়দেরকেও বিতাড়িত করেছি। রূপা বেশ বুদ্ধিমতী, হিসেবী আর ধার্মিক মেয়ে ছিল। মানুষের প্রতি ওর দারুণ মমত্ববোধ আমাকে আকর্ষণ করতো। সেই ষ্টুডেন্ট লাইফ থেকে রূপা ছিন্নমূল গরীব মানুষের কথা ভাবতো। গরীব অনাথ বাচ্চাদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতো, ওর সামর্থ অনুযায়ী যখন যেটুকু পারতো সাহায্য করতো।
ওর বাহ্যিক দিকটা নিয়ে আমি কখনো ভাবিনি। ভেতরটাকেই দেখতে চেষ্টা করেছিলাম। ওকে বিয়ে করবো বলে যখন সিদ্ধান্ত নিলাম এবং আমার পরিবারকে জানালাম কেউই তেমন আগ্রহ দেখায়নি। বিশেষ করে আমার মা চাইতেন আমি যেন বরিশালের মেয়েই বিয়ে করি। যে আমার সংস্কৃতিটা বুঝবে। যে আমার পরিবারকে ভালোবাসবে। যেহেতু রূপা অন্য অঞ্চলের মেয়ে ছিল তাই সবাই একটু অনাগ্রহ দেখিয়েছিল। তার উপর মানুষের চোখে পড়ার মত রূপা তেমন সুন্দরীদের মধ্যেও পড়েনি। যদিও আমার চোখে বরাবরই মানুষের বাইরের চেয়ে ভেতরের সৌন্দর্যটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হতো।
তারপর সবচেয়ে কষ্টের জায়গাটি যা আজও আমার মনে দগদঘে ঘা হয়ে আছে, আমাকে প্রতি মুহূর্তে বেদনা দিচ্ছে, আজ হঠাৎ করে আমার সেই কষ্টটা মুখ ফসকে বলেই ফেললাম। যে কষ্ট পাঁচ বছর আগে রূপা আমাকে দিয়েছিল ।
আমার ধৈর্য্যরে সমস্ত বাঁধ ভেঙে আমি চিৎকার করে বলতে থাকলাম আমার সমস্ত রাগ সমস্ত ক্ষোভের কথা। রূপা তখন আমার সাথে টক্কর দেয়ার বদলে কাঁদতে লাগলো। আমি বললাম তুমি আমার জন্য কি সহ্য করেছো, কতটা করেছো তার চেয়ে হাজার গুণ কষ্ট আমি পেয়েও চুপ করে ছিলাম তোমার কারনে। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি বলে সেসব কথা কখনো তোমাকে বলিনি। তুমি আমাকে আমার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছো। তোমার জন্য আমি আমার মাকে শেষবারের মতো দেখতে যেতেও পারিনি।
কথাটি বলার সাথে সাথে রূপা আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায়। আমার কষ্টের সাথে রাগ একীভূত হয়ে কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে আরো উচ্চস্বরে বলতে থাকলাম-আমার মা যেদিন মুমূর্ষু হয়ে আমাকে একটিবার দেখার জন্য ছটফট করছিলেন, তুমি সেদিন আমাকে আটকে রেখেছিলে। আমাকে মায়ের কাছে যেতে দেওনি। সেই কষ্টে মা আমার দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। এই কষ্ট আমি কেমন করে সহ্য করেছি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ জানবে না। আর তুমিতো কোনদিনই নও। কেননা তুমি সেই মেয়েই নও। তোমাকে মহানুভতী দয়ালু ভেবে আমি ভুল করেছিলাম রূপা। তুমি আসলে একটা পাষাণী। আমার মায়ের সাথে তুমি যা করোছো তা কোনদিন কোন নারীর রূপ হতে পারে না। আমার অসুস্থ্য মাকে চিকিৎসা করাতে ঢাকাতে আনতে চেয়েছিলাম তাও তুমি রাজী হওনি। বলেছিলে ছোট্ট বাসা মা এসে কোথায় থাকবে, মাকে কে দেখাশোনা করবে। বলেছিলে মৌটুসী ছোট্ট, তাই ওই মুহুর্তে মাকে এনে আর ঝামেলা বাড়াতে চাওনা তুমি। আর আমাকেও মায়ের কাছে যেতে দাওনি।
তুমি বলেছিলে “বয়স হলে এমন একটু আধটু সবারই শরীর খারাপ হয়, কিছু টাকা পাঠিয়ে দেও মা ঠিক হয়ে যাবে”। কত ছোট মন ছিল তোমার! “সন্তানের টাকার জন্য কোন মায়ের প্রাণ কাঁদে না; কাঁদে সন্তানের জন্য”। তুমিও একজন মা, জানি না তোমার প্রাণ কিসের জন্য কাঁদে।
আর আমি কি অযোগ্য পুত্র ছিলাম! তোমাকে বিয়ে করে আমি কুলাঙ্গার হয়ে গিয়েছিলাম রূপা। মায়ের জন্য প্রাণটা কাঁদলেও তোমার জন্য আমি যেতে পারিনি।
*
মৌটুসীর জন্মের কয়েক দিন পরের ঘটনা। মা বারবার অনুরোধ করেছিলেন রূপা এবং মেয়েকে সাথে নিয়ে আমি যেন বাড়ি যাই। মরার আগে আমার সন্তানকে একটু চোখের দেখা দেখতে চেয়েছিলেন আমার মা। রূপা তখন বলেছিল তার পক্ষে কিছুতেই গ্রামে যাওয়া সম্ভব না। আর আমাকেও সে যেতে দেয়নি। আমি গেলে একলা ঘরে তাকে আর বাচ্চাকে দেখাশুনার কেউ থাকবে না বলে আমাকে আটকে রেখেছিলো।
আমি বললাম, বিয়ের আগে তোমার দয়ালূ মমতাপূর্ণ একটি মন দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম এই মেয়েটি আমার মাকে আপন করে নিতে পারবে। আমি ছাড়া দুনিয়াতে মায়ের আর কে ছিল! সেই তুমি বিয়ের পরে ধীরে ধীরে তোমার রূপ পাল্টে ফেললে। আমি একটু একটু করে তোমার পরিবর্তনগুলো দেখতে পেয়েছিলাম, কিন্তু আমি আমার অঙ্গিকারের কাছে জিম্মি হয়ে গিয়েছিলাম। সংসারের খাতিরে আমি একের পর এক তোমার কীর্তিগুলো হজম করে গিয়েছি নির্বোধের মত। অনেক বলেছিলাম কিন্তু তুমি তোমার যুক্তি দিয়ে আমার অধিকারগুলো খন্ডন করে দিয়েছিলে।
বললাম, “তুমিও মা হয়েছো রূপা। বয়স তোমারো হবে একদিন। ওরকম একটু আধটু শরীর তোমারো খারাপ হবে। তোমার সন্তান যেন সেদিন তোমার কাছ থেকে দূরে না থাকে এই দোয়া করি।”
আমার কথাগুলো রুপাকে মারাত্মকভাবে আহত করছিল । কিন্তু আমারো কষ্ট ছাপিয়ে উঠেছিল। যাকে কেন্দ্র করে এই রণক্ষেত্র সেই সোহেলীকে ক্ষণকালের জন্য ভুলেই গেলাম। রূপার প্রতি সারা জীবনের যত অভিযোগ ছিল সব পেশ করতে থাকলাম। রূপা কাঁদছিল আর কাঁদছিলাম আমিও। ওইদিনের মতো আমি জীবনে আর কখনো কেঁদেছিলাম কিনা জানি না।
অনেক রাতে দেখি মৌটুসী পাশের ঘরে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।
তার পরের তিনটি দিন অনেক কষ্টে কেটেছে আমার। রূপা ঘরে ছিল ঠিকই, কিন্তু কোথাও যেন সে ছিল না। একই ছাদের নিচে থাকলেও আমাদের মাঝখানে যেন বিশাল এক সমুদ্রের দূরত্ব বিরাজ করছিল। আমার সাথে একটি কথাও বলতো না সে। আমিও বলতাম না। আবার অমন নিরবতাও সহ্য হচ্ছিল না আমার।
দরকারী কথাগুলো বাচ্চার মাধ্যমেই বলতো রূপা। ওই রাতের পরদিন সকালে রূপা তার সমস্ত কৃতকলাপের জন্য আমার কাছে ক্ষমা চায়। বলে, মায়ের প্রতি তার ওইরকম আচরণ করা আসলেই বড় অন্যায় হয়েছিল, আর সেই অপরাধেই আজ তার সংসারে অশান্তি। বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে আমিও অনুতপ্ত হই। আসলে এখন আমাদের নিজেদের কথা না ভেবে সন্তানের কথা ভাবতে হবে, ওর স্বার্থের দিকটাই আগে দেখতে হবে। তাই আমরা কী পেলাম, কী না পেলাম এসব না ভেবে ওর জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী কিভাবে গড়তে পারি সেটাই চিন্তা করা উচিৎ মনে করে আমিও পেছনের কথা ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক হতে চাইলাম ।
তিনদিন পর মৌটুসী আর রূপাকে ঢাকার গাড়ীতে তুলে দিলাম।
সবকিছুই শূণ্য শূণ্য মনে হচ্ছিল। ঘর অফিস কোনখানেই মনের একটুখানি প্রশান্তি ছিল না আমার। শুরুটা হয়েছিল ওই তিনদিন আগে থেকেই। ভেবেছিলাম সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। রূপাকে অতগুলো কথা শোনানোর জন্য আমারো কেমন অনুশোচনা হচ্ছিল। দোষতো আমারো ছিল। মা যখন অসুস্থ্য ছিলেন ছেলে হিসেবে আমার যা কর্তব্য ছিল আমি যদি তা পালন করতাম কোন্ জোরে রূপা আমাকে আটকে রাখতো? আমি কেন তখন ওর কথা শুনেই আমার কর্তব্য ভুলে থাকলাম? তখন কথাগুলো না বলে আজ এতটা বছর পরে কেন বলতে গেলাম?
এই নিয়ে আমার যখন অনুশোচনা হচ্ছিল রূপা তখন তার কৃতকর্মের হিসাব মিলাচ্ছিল। নিজের ভুল বুঝতে পারলেও আমার ভেতর থেকে কেন জানি খুব সহজেই ক্ষমা চাওয়ার প্রবনতা দেখা যায় না। মনে মনে দগ্ধ হলেও রূপার কাছে আমি ক্ষমা চাইনি। প্রথম দিকে মনে হচ্ছিল আমি যা বলেছি, যা করেছি সবই ঠিক ছিল। সব দোষইতো রূপার। কিন্তু যখন অনুভব করলাম সব দোষ রূপার কেন হবে, আমার নিজেরইতো দায়িত্ব ছিল রূপাকে বোঝানো। আমি কি সেটা করেছি? আর রূপা যদিও বিয়ের পরে পাল্টে যায়, সে দ্বায়তো আমারও থাকতে পারে। হতে পারে আমার অবহেলা বা অনাদরে তার হ্্রদয়টা বদলে গেছে।
এসব বুঝেও আমি ক্ষমা চেয়ে ওর কাছে ছোট হতে চাইনি। ‘এটা আমার এক ধরনের অহংকার, যে অহংকারের কারনে আমি ক্ষমা চেয়ে কারো কাছে ছোট না হয়ে অন্যকে ক্রমশই আমার থেকে বড় হতে সুযোগ করে দেই।’
কোনকিছু না বলেই রূপা চলে গেলো ঢাকা। আর আমার মনের উপর এক প্রকান্ড পাহাড় ভর করে রইলো দীর্ঘদিন পর্যন্ত।
কাজ না থাকলেও অফিসে বসে থাকি। ঘরে গেলে শূণ্যতার হাহাকার আমাকে স্বস্তি দেয় না কিছুতেই। যেন আসবাবপত্রগুলোও আমাকে দেখে বিদ্রƒপের হাসি হাসে। মাত্র পনেরো দিনেই আমার ছাদের নিচটা একখানি ঘর হয়ে উঠেছিল। তাতে ভালোবাসা কতখানি ছিল জানি না, তবে প্রাণের অস্তিত্ব অবশ্যই ছিল। মৌটুসীকে বড্ড বেশি মনে পড়ে। কষ্ট হয়। অনুতাপ হয় ওদেরকে ঠিকমত সময় দিতে পারিনি বলে। বিছানার দিকে তাকালেই চৈত্রের খরতাপের মতো খা খা করতে থাকে হ্্রদয়টা। শেষের তিনটি দিন কী ভয়ানক খারাপই না কেটেছিল। এতটা না করলেও পারতাম।
“একটা মানুষ যেরকম তাকে ঠিক সেরকম করে গ্রহণ করতে যেয়েই বিপত্তিটা ঘটে”। কিছু দায়তো আমারো ছিল। রূপার দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার দায়। ওর ভুলগুলি শুধরানোর দায়।
“মানুষ ততক্ষণ পর্যন্তই ভুল করতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ তাকে থামিয়ে না দেয়।” আমার উচিৎ ছিল রূপাকে থামিয়ে দেয়া। আমি সেটা না করে ওর প্রতি অভিমান করে নিজের কপালের লেখন মনে করে ভুলগুলোকে পরিপক্ক হতে সুযোগ করে দিয়েছিলাম । তবে আজ কেন এতদিন পরে সেসব কথা বলতে গেলাম! আমার বাচ্চাটা বড় হয়ে জানবে আমি কিরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন নির্বোধ পিতা ছিলাম। সেদিন মৌটুসীর সামনে অমন করে ঝগড়া করার জন্য বারবারই নিজের ভেতরে অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছিলাম । ওর কান্নাজড়িত ভয়ার্ত আঁখিদুটির কথা মনে পড়তেই ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল আমার। বাবা-মায়ের সংঘাত দেখে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ:
গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহ চূণর্-বিচূর্ন করে আকাশ ভাঙা গর্জনে ফেটে যাচ্ছিল ধরনী। সেই সাথে তুমুল বৃষ্টি। অফিসে আমার মন টিকছিল না। বাসার ছাদে অনেকটা সময় ধরে বৃষ্টিতে ভিজলাম। কোন পায়চারি করে নয়, আকাশের দিকেও তাকিয়ে নয়, আমার দৃষ্টি ছিল নত। একটি পাথরের উপর বসে অনবরত ভিজতে থাকি আমি। আর ভেজাতে থাকি আমার মনটাকে। বৃষ্টির দিকেই তাকিয়ে ছিলাম, কিন্তু বৃষ্টি আমি দেখছিলাম না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল রূপার জন্য। তার এত এত দোষের পরেও কেন জানি তারপ্রতি কোনপ্রকার বিরূপ আমি দেখাতে পারি না।
“বিয়ে নামক সম্পর্কটি পরস্পরের প্রতি এক ধরনের নির্ভরতা সৃষ্টি করে দেয়। সেখান থেকে বেরিয়ে আসা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্যই কঠিন।”
ওই মুহূর্তে আমি শুধু রূপার কথাই ভাবছিলাম। এতটা বছরে এই প্রথমবারের মত রূপা আমার কাছে বেড়াতে এসেছিল। অথচ আমি তাকে অপমান করেছি। কার জন্য করেছি!
না আমি কাউকে দোষারোপ করতে চাই না। সে আমার ভালোবাসা। আমি সোহেলীর কথাই বলছি। হয়তো সোহেলীর প্রসঙ্গ আসছিল বলেই নিজের যুক্তিটাকে দাঁড় করাতে যেয়ে আট বছর আগের কষ্টটা আমার হ্্রদয় ছেপে উঠেছিল, আর খোলস থেকে অকপটে বেরিয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমার জীবনে সোহেলীর আবির্ভাব সেতো আজকের নয়। বেঁচে থাকাকে যখন থেকে ‘জীবন’ বলে প্রতীয়মান করতে শিখেছি সোহেলী তখন আমার মনের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে বসেছিল। ছাত্র জীবনের দু:সহ কষ্টকর দিনগুলিতে সোহেলীই ছিল আমার ভালোলাগার একমাত্র উপাদান। তাকে আমি অবজ্ঞা করি কী করে! রূপাকে আমার জীবনের জন্য প্রয়োজন আর সোহেলীকে প্রাণের জন্য। কিন্তু ওই মুহুর্তে আমার সোহেলীর কথা একটুও মনে পড়েনি। মনে হচ্ছিল সেতো আমার রইলোই। কিন্তু আমিকি আমার রূপাকে হারালাম!
বারান্দায় পায়চারী করতে করতে শ্রীকান্ত’র গান শুনছিলাম-বধুয়া আমার চোখে জল এনেছো হায় বিনা কারনে..। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে কিছুক্ষণ হলো। গাছের পাতা থেকে টাপুসটুপুস পড়ছিল বৃষ্টির জমে থাকা পনি। প্রতিটি বাসার ছাদ থেকেই পানি পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। একটা নির্মল সতেজ ঠান্ডা আবহ সমস্ত প্রকৃতিকে ঘষেমেজে সিগ্ধ করে দিয়ে গেছে যেন। আমার মনে তখনও অনুশোচনার বর্ষণ।
অন্যদিনের চেয়ে সেদিন রূপাকে একটু বেশিই ফোন দেই। মনের মাঝে কিছু একটা বলার আকুলতা নিয়ে বারবার ফোন করি, কিন্তু সেই কথাটি আর সাজিয়ে গুছিয়ে বের করে নিয়ে আসতে পারি না। সেদিনের সেই বিমূঢ়তা থেকে রূপা তখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার কথার তোড়ে রূপা সেদিন কিরকম বিপর্যস্ত হয়ে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে পড়ছিল। হ্্রদয়ের মেরুদ্বন্ড সোজা করে আমার সামনে দাঁড়াতে তার যে আরো বহুদিন সময় লেগে যাবে সেটা আমি জানতাম। আমি নিজেই যদি এগিয়ে না যাই রূপা হয়তো এমনটাই থেকে যাবে।
আট বছর আগের সেই দিনের ভুলগুলো তাকে অল্পতে বললেই নিজেকে শুধরে নিতে পারতো, আর আমার মনেও খেদ রইতো না, সেকথা তখন না বলে এখন বলে তাকে নতুন একটা মোড়কে রূপ তো দিলাম, কিন্তু আমার মনে রয়ে গেল একপ্রস্থ খেদ। কিছুতেই স্বস্তি পাচিছলাম না আমি। আর শান্তি তো নয়ই। চিরকালের শান্তিপ্রিয় মানুষ আমি। সংসারে শান্তি বজায় রাখতে যেয়ে নিজের মনের বিরুদ্ধ হলেও অনেক কিছুই নিরবে সহ্য করে গিয়েছি । আমার জন্য কারো কোন সামান্যতম অসুবিধা হোক সেটা আমি কখনোই চাইনি। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে নিজেকে সহনশীল করে রেখেছি। মাঝে মাঝে নিজের জীবনকে মনে হয়েছে একটা তেলাপোকার জীবন।
যতক্ষণ কথা হলো, কথা আর হলো কোথায়! ছিল তো দুজনের দীর্ঘশ্বাস। না পারছিলাম নিজে স্বাভাবিক হতে, না রূপাকে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছিল রূপা আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার জীবনে আর যেই আসুক না আসুক তোমাকে আমি কোনদিন ঠকাইনি। তোমার স্থানে তুমি অধিষ্টিত। তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন।
*
প্রথম জীবনের ভালোবাসা অনুভব করলেও সোহেলীকে আমি গ্রহণ করতে পারিনি, সেটা ছিল আমার দৈন্যতা । নিজের ’পরে বিশ্বাসের দৈন্যতা। কিন্তু স্বার্থপরের মত তার ভালোবাসাটা ঠিকই গ্রহণ করেছিলাম । আর রূপা আমাকে গ্রহণ করেছিলো সেটা ছিল তার মহানুভবতা । আমি সোহেলীকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু বারবারই আমার মন সেদিকে ফিরে ফিরে দেখছিল। আজ এতকাল পরে সে আমার দিকে আবার ফিরে তাকালে আমি সেই দৃষ্টিতে বাঁধা পড়ে যাই। কিন্তু কালে কালে সময়টা যে গড়িয়েছে অনেকখানি সেটা বুঝতে আমার বাকি ছিল। আজ জীবনের অপরাহ্নে এসে ভালোবাসার দৈরথে আমি দোদ্যুল্যমান যাত্রী। আমার ভালোবাসা ফিরে এসেছে একথা কখনো বলবো না। কেননা ভালোবাসা তো কখনো আমার পথান্তরই হয়নি। সেতো নিরবধি বয়ে চলছিল সেদিকে, যেদিকে ছিল আমার সোহেলী। আর সেদিকেও বয়েছিল একটি ধারা, যেদিকে ছিল আমার ঘর; যার আধার ছিল রূপা। আমার একটি অন্তর আমি দুদিকে ভাগ করে দেইনি যে, কারো ভাগে অর্ধাংশের ছায়া পড়বে; বরং স্বত›ত্র দুটি অন্তর দুজনে নিয়েছিল ছিনিয়ে। আমি ভালোবাসতে কার্পণ্য করিনি; বরং প্রকাশিতে দ্বিধা করেছি।
রূপার সাথে কথা বলার পরেও যখন মনের অব্যক্ত বেদনা প্রকাশ করতে না পেরে মনকে হালকা করতে পারিনি, সেই মুহুর্তে সোহেলীর ফোন আসে। আমি একটু অবাক হই। ওই সময় সাধারণত সে ফোন করে না। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মাঝে মাঝে কখনো বা টেক্সট পাঠায়।
কারনটা সোহেলীই বলে, সাদির এক আত্মীয় হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে পড়লে তাকে নিয়ে সাদি হাসপাতালে ছোটে। আর সেই সুযোগে সোহেলী আমাকে ফোন করে। আমারো মন কেমন করছিল। তার ফোন তখন আমার উপর আশির্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
সোহেলীর সাথে কথা বলতে বলতে মনের আকাশ থেকে পুঞ্জীভূত মেঘমালা কেটে পড়ছিল ক্রমশ। মনে হচ্ছিল এই একটি আশ্রয়ের জায়গা আমার। সেই আশ্রয় আমার মনের আশ্রয়। জগতে যখন কোনকিছুই ভালোলাগে না, উপভোগ করার কিছুই থাকে না, তখন এক সোহেলীর মাঝেই আমি আশ্রয় খুঁজে পাই। আমার বিষন্ন মনটাকে একটু একটু করে স্বাভাবিক করে ভালোলাগার একটি অবস্থানে নিয়ে যেয়ে আমাকে আবারো স্বপ্নের মুখোমুখি পৌঁছে দেয় সোহেলী।
বাইরে তখনো টাপুরটুপুর শব্দ, বৃষ্টি আবারো শুরু হয়েছে। বৃষ্টির সাথে ছন্দ মিলিয়ে আমাদেরও কথা চলে অবিরাম গতিতে। কথায় কথায় কেটে যায় অনেকটা রাত। হাই তুলি বারবার। সোহেলী বলে, আপনার কি ঘুম আসছে? তাহলে ঘুমিয়ে পড়েন। আমি বললাম, ঘুম একটু একটু আসছে; কিন্তু তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না আজ। এমন রাত খুব কম আসে জীবনে। দ্যাখো আজই আমার মনের ভার লাঘব করার জন্য তোমাকে প্রয়োজন ছিল, আর উপরওয়ালা ঠিক তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সৃষ্টিকর্তার এ দান আমি কেমন করে ফিরিয়ে দেই বলো? অমন স্পর্ধা দেখানো কী এই অধমের পক্ষে সম্ভব? আজ আকাশের এত সাজ সেও তোমারি জন্য। মেঘে মেঘে পুঞ্জীভূত জলরাশি সেও তোমারি জন্য নিষিক্ত পৃথিবীকে সিক্ত করেছে।
সেই রাতে আমার মনটা আবেগে ভরে উঠছিল। নিজের কথাগুলো নিজের কাছেই বড় বেশি অচেনা লাগছিল। তবুও মন থেকে অনুভূত সকল শব্দ সকল বাক্যই সেদিন আমি প্রকাশ করেছিলাম নির্দ্বিধায়। বললাম, সোহেলী আজ আমাকে ঘুমাতে বলোনা প্লিজ। আমাকে আজ তোমার মনে ঠাঁই দাও। সেই নিভৃত অঙ্গনে একটুখানি সুখের নিবাস আমাকে দাও, একটু সুখের ঘ্রাণ পেতে চাই আমি। আজ আমার দৈন্যতা বড় বেশি নির্বোধ আর নির্লজ্জ। তাই মুখ ফুটে চাইতেও কোন সংকোচ নেই আমার। সোহেলী তোমার মন থেকে লক্ষকোটিবার শুনতে পেলেও মুখ থেকে কখনোই একটি কথা শোনা হয়নি আমার । যেকথা শোনার জন্য আজ আমি মরিয়া।
আমার কথাগুলো সোহেলীকে পুলকিত করে তুলছিল সেটা আমি ষ্পষ্টই অনুভব করছিলাম। সেদিন তাকে অমন করে বলতে পেরে আমারো ভাল লাগছিল। যেন হ্্রদয়ের সমস্ত জানালাগুলো খুলে দিয়ে গেছে অবারিত ঝড়ো বাতাস। তাই যা কিছু বলার আজই যেন বলে নিতে হবে, যা কিছু চাওয়ার আজই সব চেয়ে নিতে হবে-এমনটাই ছিল আমার অভিব্যক্তি।
আমি কোন্ কথাটা শুনতে চাইছিলাম সেটা সে বুঝতে পারলেও না বোঝার ভান করে বলল, আমিতো আপনাকে আমার সব কথাই বলি। কোনটা আবার বিশেষ করে শুনতে চাচ্ছেন তাতো আমার বোধের বাইরে।
আমি বললাম, শোন মেয়ে তোমাকে চিনেছি সেই ভোর বেলায়, যখন আমার পৃথিবীতে সূর্যের চিকন রশ্মি সবেমাত্র তীর্যকভাবে পতিত হচ্ছিল। আমি সেই রশ্মিতে মেলে ধরেছিলাম আমার পাপড়িগুলো। আকাশের সূর্যের দিকে দিকে মুখ করে থাকলেও আমার মনটি ছিল তোমারি মুখোমুখি। তাকে তুমি যেমন পড়ে নিয়েছিলে চুপিচুপি, আমিও বাদ রাখিনি তোমার কোন একটি অধ্যায়। শুধু প্রকাশিতে ছিল আমার যত বাঁধা যত সংকোচ দ্বিধা লজ্জা ভয়। এখন মনের কাছে প্রশ্ন করে দেখো আমি কি শুনতে এত উম্মুখ হয়ে আছি তোমার মুখের দিকে চেয়ে।
একটু লজ্জিত কণ্ঠে সোহেলী বলল, সবকথা মুখে বলার নয়, কিছু কথা বুঝে নিতে হয়। আপনি তো সেই প্রথম ভোরবেলার সুর্যের আলোতেই আমাকে পড়ে নিয়েছিলেন প্রথম থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। আজ আর আমি নতুন করে কী বলবো? আমার যা কিছু ছিল সবইতো সেই কবেই সঁপে দিয়ে শূণ্য কুঠিরে আজও আমি বড় দৈন্যতার সাথে টিকে আছি।
সময় বয়ে চলে নিরবধি, কথার খেই হারিয়ে আবার দুজনে আঁকড়ে ধরি। আবারো শুনতে চাই, বলি- প্লিজ লক্ষ্মী মেয়ে বলোনা আমাকে ভালোবাসো।
সোহেলীর হ্্রদয়ের স্পন্দন শুনতে পাই। কোন কথা বের হয় না তার। লজ্জা আর শিহরণে রক্তিম মুখটি কল্পনার চোখে এঁকে নেই আমার মনের আয়নায়। বলি, ওভাবে মাথা নিচু করে নয়, আমার চোখের দিকে তাকাও সোহেলী। আমি যা বলি শোনো। কান পেতে নয়, হ্্রদয় দিয়ে ।
সোহেলী আস্তেকরে অস্ফুটস্বরে বলে, হুম শুনতেছি আমি, কান দিয়ে নয়; হ্্রদয় দিয়ে; আমার সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে।
আমি বললাম, ওই যে দূরে দিগন্তজোড়া ঘন জলের ঢেউ। দ্যাখো চেয়ে, যতদুর চোখ যায় শুধুই নীলচে জলরাশি। আকাশ আর সমুদ্র যেখানে এক হয়ে মিলেমিশে একাকার তারই অপর প্রান্তে মাঝারি একটি শৈবাল পাথরে পা ছড়িয়ে বসে আছি তুমি আর আমি । খানিক পরপর ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমাদের চারখানি পা। আমার বা কাঁধে তোমার হেলানো মাথা, ডান হাতের মধ্যে তোমার ডানহাতের অঙ্গুিল। বা হাতে তোমাকে একটুখানি টেনে ধরেছি নিজের দিকে। সামনে অপার সমুদ্র, আর তোমার চোখের গভীরে ডুব দিয়ে আমি তুলে আনি ভালোবাসার নীলাপাথর। তোমার হ্্রদয় কাঁপছে, হাত কাঁপছে আর কেঁপে কেঁপে উঠছে ঠোঁট। আমি বলছি, হ্যাঁ বলো সোহেলী, আজ আর কোন সংকোচ করো না। বলে দাও তোমার মনের কথা। এই সমুদ্র এই আকাশ শুনে যাক আমাদের পোড়া মনের আকুল আবেগের কথা। হ্্রদয়ের উম্মত প্রেমের অকিঞ্চিৎ ভাবনাগুলো আজ মেলে ধরো সোহেলী। আর দেরি করোনা প্লিজ। এখনি ভরে দাও, সিক্ত করে দাও এই হ্্রদয়অঙ্গন। আমার প্রাণে এসো, আমার বুকে এসো, একবার বলো আমাকে তুমি ভালোবাসো।
এবার দুহাতে তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো আর বলো...
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কাঁপা কাঁপা স্বরে মৃদু ঝংকারে, শান্ত অথচ বিনত নয়নে ভেসে আসলো সেই সুমধুর চিরন্তন কথা। এক হ্্রদয় থেকে অন্য হ্্রদয়ে প্রবাহিত হলো সেই সুরের ঝংকার। সোহেলী বলে উঠল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। ”
*
পরের দিনটি ছুটির দিন হওয়াতে দুজনেরই ঘুম ভাঙলো অনেক বেলা করে। ঘুম জড়ানো চোখেই বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে সোহেলীকে ফোন করি। ফোন রিসিভ করেই সোহেলী বলল, গতরাতে আমিকি স্বপ্ন দেখেছিলাম নাকি বাস্তবিকই কিছু একটা হয়েছিল? সারারাত তুমি কেমন করে ছিলে আমার সাথে?
আমি বললাম ‘কখনো কখনো বাস্তব সত্যকে স্বপ্নের মত মনে হয় , আবার স্বপ্নকে মনে হয় সত্য।”
সেদিন ভোরে নতুন দিনের সূচনালগ্নে চোখের পাতার সাথে আমার মনের জানালাগুলো অবারিত ধারায় খুলে গেলো। মনে হচ্ছিল আমি নব জীবন লাভ করেছি। এ যেন পুরোপুরি সিদ্ধিলাভ।
সোহেলী বলল, আমারতো মনে হচ্ছে আমি এখনো স্বপ্ন দেখছি। কেননা তোমাকে আমি আগের ‘তুমি’র সাথে মেলাতে পারছি না। অথচ এই তোমাকে আমি কত্ত চেয়েছিলাম। সেই কৈশোরের শেষ বেলাটাতে যখন আমার মনের পাপড়িগুলো ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত আর রঙিন হয়ে উঠতেছিল, তখন থেকেই আমার সমস্ত সত্ত্বা তোমার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আমার পাগলামির জন্য কত বকা খেয়েছি, তবুও মন আমার তোমাকে ভালো না বেসে পারেনি।
কথার ট্রেন চলতে শুরু করলে সহজে আর থামে না। সোহেলী যে কথাটি বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আমি বললাম, চলো আজকের দিনটি আমরা অন্যরকম ভাবে উদযাপন করি । আজ সারাদিন আমরা এতসাথে কাটাবো।
সোহেলী বলল, সারাদিন হয়তো পারবো না, তবে অপরাহ্নের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পারবো। আমি বললাম, তাহলে তাই ঠিক রইলো।
বাইরে তখনো ঝুমঝুম বৃষ্টি। মনে মনে বৃষ্টিকে ধনব্যাদ দিচ্ছিলাম। বৃষ্টি না হলে হয়তো গতরাতে অমন করে মনের কথাগুলো বলতে পারতাম না। কথা বলতে বলতে বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসি। সোহেলী বলল, সব কথা ফোনেই বলে ফেললে আজ সারাদিন বলবে কি? আমি বললাম, তোমাকে বলার জন্য আমার কথার ঝুড়ি কোনদিন শূণ্য হবে না। কত কথা এ যাবৎ শুধু মনে মনেই বলে গিয়েছি। এখন থেকে সব সরাসরি বলবো। আমার ভেতরের সংকোচকে আমি চিরতরে দিলাম জাদুঘরে পাঠিয়ে। আজ থেকে সোহেলী নামের মেয়েটি আমাকে পুরোপুরি অর্জন করলো।
তারপর বললাম, একটা কথা বলি?
সোহেলী বলল, এত কথা বলার পরে আবার কোন্ কথাটি বলার জন্য অনুমতি নিতে হচ্ছে?
বললাম, তোমার মুখে ‘তুমি’ শব্দটি শোনার জন্যই বুঝি পৃথিবীতে এই শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল । এর আগে এই শব্দের এত মাধুর্য কখনো অনুভব করিনি আমি।
আমার কথায় সোহেলী তখন অস্তমিত সূর্যের মতো লাল হয়ে উঠেছিল।
*
নদীর ধারে অবাধেই বেড়ে উঠেছিল একটি জারুল গাছ। বেড়ে ওঠার স্বাধীনতা পেয়েই তাতে ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটেছিল বেগুনী রঙের অজস্র ফুল। তারই তলায় ঠাঁই নিয়েছে সোহেলী। যেন তাকে আশ্রয় দেয়ার জন্যই কোন একদিন এখানে গজিয়েছিল একটি জারুল চারা। ধীরে ধীরে সেটি বড় হয়ে আজকের দিনের জন্য অপেক্ষা করছিল। বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশ আর প্রকৃতিকে সুন্দরভাবে ঘষেমেজে ঝকঝকে করে দিয়েছে। মাঠের ঘাসগুলো গাঢ় সবুজ আর চকচকে দেখাচ্ছিল। তখনো তাতে শোভা পাচ্ছিল থেমে যাওয়া বৃষ্টির শীতল পরশ।
সোহেলী বলল, যে সমুদ্রকে মধ্যরাতে জন্ম দিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছিলে এই কি তোমার সেই সমুদ্র? রাতের সমুদ্র পরের দিন বিকেলে হয়ে গেল যমুনার ঢেউ!
আমি বললাম, সেই সমুদ্রতো আমার বুকের ভেতর, যেখানে তুমি রাতের বেলা গর্জন শুনেছিলে। সেখানে কান পাতলে এখনো তুমি গর্জন শুনতে পাবে। এই বলে হাতে এক থোকা জারুল ফুল নিয়ে সোহেলীর পাশ ঘেষে বসে পড়লাম। ফুলটি ওর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম ‘বধু আজ এই সমুদ্রের ধারে এভাবেই তোমাকে বরণ করলাম’। আমার আছে সমুদ্রের মত মন, আছে ভালোবাসার গর্জন। আর এখানে অবাধে বেড়ে ওটা এই জারুলের দু:স্বাহস আমাকে দিয়েছে অনুপ্রেরণা। যদি তুমি চাও আজই সমস্ত দেনমোহর আদায় করে নিতে পারো।
সোহেলী বলল, কোন দেনমোহর নয়, আমার চাই শুধুই মোহর। সে তোমার প্রেম। তোমার ভালোবাসা।
একথোকা ফুল নিয়ে ওর কানের কাছে গুজে দিলাম। ফুলের জন্ম যেন স্বার্থক হয়ে উঠলো অনায়াসেই। ওর চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো বেগুনি রঙের আভা। আমি বললাম, আচ্ছা আমরা কি সত্যিকার সমুদ্রের কাছে বেড়াতে যেতে পারি না সোহেলী?
চমকে উঠেনি সে। শান্তসুরে বলল, পারি অবশ্যই। সেতো আমি কতবারই গিয়েছি তোমার সাথে। তুমি অন্ধ ছিলে বলে ষ্পস্ট করে দেখতে পাওনি।
জানি, সে তোমার কল্পনার গমন। কিন্তু আমি যাব সত্যিকারের যাওয়া। বলো তুমি রাজি?
রাজি।
সোহেলী লক্ষ্য করলো সেদিন তার সাথে যতক্ষণ ছিলাম আমার ফোনটি একবারও বেজে ওঠেনি। এর আগে যতদিন সে আমার সাথে থাকতো আমার অফিসিয়াল ফোন এবং ব্যক্তিগত ফোন দুটোই খানিক পরপর বেজে উঠতো। সোহেলী এই নিয়ে বিরক্তও হতো । আশ্চর্য হয়েছিল যখন খেয়াল করলো সেদিন একবারও রূপা ফোন করেনি। জানতে চাইলে আমি বললাম, অফিসের ফোনটা বন্ধ রেখেছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে ছুটির দিনে অফিসের ফোন বন্ধ রাখবো এবং তোমার সাথে যখন থাকবো তখন অফিস বা অন্যকিছু আমাদের মাঝখানে প্রবেশ করতে দিব না।
সোহেলী বলল, অফিসেরটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তোমার বউ? সেতো ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেজে ওঠে। আর আমাকে তোমার সাথে দেখলে সে আরো দ্বিগুণ প্রবাহে এগিয়ে চলে। মানে তার ফোন।
আমার মনটা হঠাৎ উদাস হয়ে গেল। বললাম, সেই দিন আর নেই। রূপা আর আগের মত ফোন করে না আমকে। আমিই ফোন করে তাদের খবর নেই। যেটুকু কথা না বললেই নয় সেটুকু কথাই সে বলে।
সোহেলী বলল, কেন তোমাদের কি ঝগড়া হয়েছে? বউয়ের কথা বলতেই তোমার মুখটা কেমন অন্ধকার হয়ে গেল!
আমি বললাম, “সংসারে না চাইতেও অনেক কিছুই ঘটে। আবার যা চাই তা দিনরাত তপস্যা করেও ঘটাতে পারি না।” না চাইতেও অনেক কিছু হয়ে গেছে সোহেলী। আজ সেসব কথা বলে আমাদের এই সুন্দর সময়টা বিগড়ে দিতে কোন ইচ্ছা নেই আমার। অন্য একদিন বলবো। তোমাকে কোনকিছুই লুকাবো না। আমার সম¯তকিছু উজাড় করে দেয়ার জন্যেই আমার জীবনে তোমার আগমন।
আমার কথার পরে সোহেলী আর কোন কথা বলল না । পশ্চিম আকাশে গোধুলীর রঙ ফুটে উঠতে দেখে বুঝতে পারলাম সন্ধ্যা নেমেছে। সোহেলী বলল, আজ তাহলে ফেরা যাক। আগামীর জন্য রইলো কিছুটা অবশিষ্ট। ওর ডানহাত আমার বা হাতের সাথে কথা বলছে। জনহীন নদীর তীর হতে এগিয়ে চললাম দুজনে জনবহুল শহরের দিকে।
সেদিনের পর থেকে আমাদের দুজনরেই মনের উপর আর কোন আবরণ রইলো না। ভালোবাসার কথা অকপটে স্বীকার এবং প্রকাশ করে দুজনেই জীবনের নতুন এক আস্বাদ অনুভব করছিলাম। আমার যেদিন খুব বেশি কাজ থাকে সোহেলী সেদিন অফিসে এসে অল্প সময়ের জন্য আমাকে দেখে যায়। আর সুযোগ পেলেই আমরা দুজন বেরিয়ে পড়ি শহরের গন্ডি ছেড়ে মেঠো পথে, নদীর ধারে, সবুজ বনানী আর ধানক্ষেত যেখানে এক হয়ে মিশে গেছে সেখানে। যতদিন দূরে কোথাও গিয়েছি সোহেলীর গাড়ি নিয়েই বের হয়েছি। চালকের আসনে কখনো আমি কখনো সোহেলী থাকে। আমার সরকারী গাড়ি, সকলেই চিনে, তাই ভালোবাসার এই অভিসারে সেটাকে একশ হাত দূরেই রাখি।
যে কাল্পনিক সমুদ্রের কাছে নিয়ে গিয়ে সেদিন সোহেলীর মনের কথাটি শুনে নিয়েছিলাম মধ্যরাতের আলাপনে, একদিন সেই সমুদ্রকে বাস্তবায়িত করার জন্য সোহেলী মরিয়া হয়ে উঠলো। ইচ্ছাটা যে আমারো ছিল সেটা কিছুতেই গোপন রাখতে না পারলেও বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সম্ভাবনাটাকে নস্যাৎ করে দিতে বাধ্য হলাম। বললাম ‘আমরা যতই সমাজের চোখে ফাঁকি দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তি দাঁড় করাই না কেন, সমাজ ঠিকই আমাদেরকে অবলোকন করছে।’ তোমাকে পাশে নিয়ে সমুদ্র দেখবো, আমাদের পায়ের উপর ঢেউ এসে আছড়ে পড়বে, মাথার উপর বিশাল আকাশ আমাদেরকে পাহাড়া দিবে, বালুময় সৈকতে দুজনের পাশাপাশি পদচিহ্ন এঁকে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবো, তোমার যে হাতখানি একদিন আমাকে দিয়েছিলে সেই হাতখানি আমার হাতের মধ্যে নিয়ে নিরবে দাঁড়িয়ে সুর্যাস্ত দেখবো, এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে আমারো কি কম ইচ্ছা? কিন্তু সমাজকে আমরা অবজ্ঞা করবো কোন দু:সাহসে? কি পরিচয়ে তোমাকে আমি বহন করবো বলো? আমাদের সমাজে শুধু ভালোবাসার সম্পর্কের কোন নির্দিষ্ট পরিচয় নেই। আর যেহেতু তুমি আমি রক্ত মাংসের মানুষ এবং হ্্রদয়ে কঠিন ভালোবাসার বসবাস, তো কিছু ভুল আমাদেরও হতে পারে। সেই ভুল আমরা করতে চাই না যার মাশুল সারা জীবন দিয়ে যেতে হবে।
সোহেলী কোন কথা বলল না। ওর মনটা খারাপ করে দিতে আমারো ইচ্ছা ছিল না। “কিন্ত কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবেগকে দমন করতে না পারলে পরিণতি খুব ভয়াবহ হতে পারে”। সারাজীবন হিসেবের খাতা কষে পা ফেলার অভ্যাস আমার। তাই আবেগটাকে সংযত করে জীবনের যা কিছু সুন্দর যা কিছু মোহনীয় তাই শুষে নিতে চাই ধীরে ধীরে।
*
রাজশাহী থেকে যাওয়ার পর রূপা অনেকখানি বদলে গিয়েছে। এ বদল হয়তো আমারি দান। যে কথা কোনদিনই তাকে বলতে পারিনি তারচেয়ে হাজারগুণ বেশিকিছু বলে ফেলেছিলাম এক রাতেই। কথার সেই ঝড়ে ওই রাতে রূপার মনটা বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল । যা আজও সেরকমই রয়ে গেছে। সেও হিসেবের খাতা বের করে অংক মেলাতে বসে পড়েছিল। যে অংক অতীতে কোনদিনই সে মেলানোর প্রয়োজন মনে করেনি। সমস্ত হিসেব-নিকেষের পরে রূপা তার কর্তব্যে যে খাদ দেখতে পেয়েছিল সেটা শুধরানোর সমস্ত উপায় বিশ্লেষনের পর এই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, চাকরীটা সে ছেড়ে দিবে।
কথাটি শুনে আমি কিছুক্ষণের জন্য বিষ্ময় প্রকাশের ভাষা খুঁজে পেলাম না। রাত আটটার দিকে রূপার ফোন থেকে মৌটুসী বলে, বাবা আমাদের জন্য গাড়ির টিকিট করো। আমরা রাজশাহী যাবো। ওর কথার মর্মার্থ না বুঝতে পেরে আমি বললাম তোমার আম্মুকে ফোন দাও। সেরকমই গম্ভীর কণ্ঠে রূপা বলল, আগামী মাসের পহেলা সপ্তাহেই আমরা চলে আসতেছি। তুমি সব ব্যবস্থা করে রেখো। আমি বললাম, চলে আসতেছি মানে? সে খুবই অল্প কথায় বলল, “আমি চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছি। কারো উপর রাগ করে নয়। যে চাকরীর জন্য আমি ঠিকমত সন্তানের দেখাশোনা করতে পারছিলাম না, তোমার আদর স্নেহ ছাড়াই সে বড় হচ্ছে, যে চাকরীর জন্য তোমার সম্মান খুন্ন হচ্ছে; শুধুমাত্র আমার ইচ্চাকে প্রাধান্য দিতে যেয়ে সেই চাকরী আমি আর করবো না। ওটার উপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে”।
এই বলে রূপা ফোন রাখলে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমি ভাবতেও পারিনি রূপা আমাকে এভাবে জব্দ করতে পারবে। জানতাম এই সিদ্ধান্ত সে হুট করেই নেয়নি। রাজশাহী থেকে যাবার পর যে কদিন সে নির্বাক দিনতিক্রম করতেছিল, এই সিদ্ধান্ত তারই ফসল। আমি এটাও জানি সিদ্ধান্ত যখন সে নিয়েই ফেলেছে এবং আমাকেও জানিয়েছে তখন দুনিয়া এধার ওধার হয়ে গেলেও এই কথার কোন হেরফের হবে না।
আমি শুধু বললাম, এভাবে চাকরী ছেড়ে দিয়ে আমাকে অপরাধী না করলে কি হতো না? বরাবরই আমাকে অতিক্রম করার এক ভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা তোমার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। তুমি কখনো আমাকে সঙ্গী ভাবো না, একজন প্রতিযোগী ভাবো। “সঙ্গীবিহীন প্রতিযোগীর সাথে কখনো জীবনটাকে যাপন করা যায় না রূপা। হয়তো একসাথে থাকা হয়; কিন্তু তাতে প্রাণের স্পর্শ মিলে না।”
সে বলল,“চাকরীটা না ছাড়লে যে আমি কারো কারো কাছে চিরদিনের জন্য অপরাধী হয়ে থাকতাম। সেখানে প্রাণ থাকতো কিনা জানি না, তবে আমার স্বস্তিটা কিছুতেই থাকতো না।”
আমি বললাম, তুমি আর একটু ভাবো রূপা। একটা সময় যখন মেয়েটা বড় হয়ে যাবে তোমার করার মত কিছু থাকবে না। চাকরীটা তখন তোমার প্রয়োজন পড়বে। তোমাকে সঙ্গ দিবে। আর “প্রতিটি নারীরই একটা আর্থিক অবলম্বন থাকা দরকার। হোক না তার স্বামী যতই বিত্তশালী।” এই যে এতদিন তোমার কিছু একটা ছিল তারই বলে তোমার মধ্যে এক ধরনের শক্তি বিরজিত ছিল। ওইটুকুর আলোয় তুমি সর্বদা নিজেকে আলোকিত করে রেখেছিলে।
সে বলল, “আমার চাকরীর জন্য আমার সন্তানের অসুবিধা, সংসারের শ্রীহীনতা এসব নাহয় মেনে নিতাম, কিন্তু কেউ যখন বলতো আমার দূরে থাকার কারনে কারো জীবনে শূণ্যতা সৃষ্টি হয়েছে এবং সেই শূণ্যতা পূরণ করতে দ্বিতীয় কারো আবির্ভাব ঘটে গেছে অনায়াসে; সে দ্বায় আমি কিছুতেই মানতে পারতাম না। সংসারে বিশ্বাসের খুঁটি যে কখন নড়বড়ে হয়ে যায় স্বয়ং সংসারদাতাও তা জানেন না।”
রূপার এমন কথা যে কোন্ ইঙ্গিত বহন করছে সেটা আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম। তাই অযথা তর্ক না করে বললাম, ঠিক আছে কবে আসতে চাও বলো। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখবো।
নিজেকে নিয়ে বড় দোটনায় পড়ে গেলাম। রূপা চাকরী ছেড়ে দিয়ে একেবারে আমার কাছে থাকার জন্য চলে আসতেছে এই খবরে আমি খুশি হতে পারলাম না। আমার জন্য ওর কিছু ছাড়তে হবে এটা মেনে নিতে কষ্ট হলো আমার। যেন আমাকে হারানোর জন্যই রূপা জোর করে এভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে দেখালো ‘আমিও পারি’।
এদিকে আমার উপর সোহেলীর নির্ভরতা দিনে দিনে বেড়েই চলল। সবকিছু যেন রুটিনের বাইরে চলে যাচ্ছিল ক্রমশ। মন চাইলেই সে অফিসে চলে আসে। এখন আর কারো বাঁকা চোখের চাহনি তাকে পীড়া দেয় না। বরং অফিসের কেউ কেউ সোহেলীকে দেখলে কুশলাদি জানতে চায় । আমি যে সোহেলীর বিশেষ কেউ, আমার কাছে আসতে যে সে একটা আপন অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে সেটা সবাই বুঝে গেছে।
তার উপস্থিতি আমাকেও যে শান্তি দেয় সেটাই বা আমি অস্বীকার করি কোন দু:সাহসে! মনে মনে নিরব এক ধরনের অপেক্ষা সে তো আমিও করতে থাকি, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার পদচিহ্ন দেখতে পাই। আমিও যেন একটু প্রাণভরে নি:শ্বাস নিতে পারি। যখন চারিদিকের সবকিছু বিষময় হয়ে ওঠে, সবকিছুই মনের বিরুদ্ধে চলে, তখন এই এক সোহেলীর কাছেই আমার হ্্রদয়েটা আশ্রয় খুঁজে পায়।
*
যমুনার ধারে। সেই জারুল গাছটির নিচে তেমন করেই বসলো সোহেলী। গায়ে জড়িয়েছে হলুদ রঙ এর শাড়ি । মাথার উপরে ঝাঁকে ঝাঁকে বেগুনি ফুল। জমিনে সবুজ ঘাসের উপর বসে আছে এক হলুদ পাখি। হলুদে বেগুনীতে যেন মাখামাখি।
সোহেলী যখনি আমার কাছে আসে, বেছে বেছে সে শাড়িই পড়ে। এবং শাড়িটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে সে। ওর রূপের প্রশংসা আমি কখনো করিনি। কেন জানি মানুষের বাইরের রূপের প্রশংসা করতে আমার ভালো লাগে না। আমি খুব যতœ করে তার মনের ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করি। যদি সেটা খুব সুন্দর হয় তবে মন ভরে সেই মনের প্রশংসা করতে কার্পণ্য করি না।
সেদিন ওর দিকে যখন অপলক চোখে তাকিয়েছিলাম লজ্জায় মুখটি একটু ঘুরিয়ে নিয়ে বলেছিল, তুমি এমন করে তাকালে আমি নদী দেখবো কেমন করে? আমার দৃষ্টিতো তোমার চোখের তারায় বাঁধা পড়ে যায়। আমি বললাম “তুমি তোমার নদী দেখো, আর আমি তার গভীরতা অনুধাবনের চেষ্টা করি।” ভেবোনা, আমি তোমার সৌন্দর্য্য নিয়ে কিছু বলছি না। জানি মেয়েরা নিজেদের রূপের প্রশংসা শুনে রক্তিম হয়ে ওঠে, আবার মুখে বলে প্রশংসা শুনতে চাই না, কিন্তু মনে মনে ঠিকই প্রত্যাশা করে।
সোহেলী ঠাট্টা করে হেসে বলল, আমি জানি আমি সুন্দর। তোমার মুখে তাই আমার সৌন্দর্যের কথা শুনে কথাটির বিশেষত্বকে আর সস্তা করতে চাই না। তোমার মুখে সবসময় আমি মুল্যবান কথাটিই শুনতে চাই। আমিতো তোমার চিরদিনের বাধ্যগত ছাত্রী। বলে ছোট্ট একটি বাচ্চা মেয়ের মত করে হিহি করে হেসে উঠলো সে । ওর সাথে আমিও না হেসে পারলাম না। বললাম, আচ্ছা সোহেলী বলোতো আমার বিরুদ্ধে তোমার বিশেষ অভিযোগ কি?
সে বলল, কোন অভিযোগ তো নাই। কেন?
আমি বললাম, একসময় আমি তোমার শিক্ষক ছিলাম। শুনেছি শিক্ষক-ছাত্রীর মধ্যে বিয়ে হলেও সেই শিক্ষক নাকি আজীবন তার বউকে ছাত্রীই মনে করে এবং জ্ঞান দান করেই যায়। এই নিয়েই একসময় দাম্পত্যে কলহ সৃষ্টি হয়। “কেননা কোন বউ ই তার স্বামীর ছাত্রী হয়ে থাকতে চায় না। সে চায় স্বামীর একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হতে, প্রেমিকা হতে। স্বামীরা স্ত্রীদের শাসন অবশ্যই করবে। তবে সেটা যেন বন্ধুর মতো হয়, বাবার মতো নয়।” অনেক স্বামীগণই এই প্রভেদটা গুলিয়ে ফেলেন। তাতে সংসার হয়ে ওঠে রণক্ষেত্র। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে সন্তানদের উপর। অথচ স্বামীদের একটুখানি যতœশীল মনোভাবেই এক একটি ঘর এক একটি স্বর্গ হয়ে উঠতে পারে।”
সোহেলী বলল, সেক্ষেত্রে ঝামেলা তো মিটেই গেল। আমি তোমার বউ ও নই, ছাত্রীও নই। আর আমার কোন সন্তানও নেই যে দু’পক্ষের রোষানলে পড়ে সে বেকায়দায় পড়বে। একসময় ছাত্রী ছিলাম, এখন প্রেমিকা হয়েছি। আমার সাথে তোমার কখনো দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি হবে না।
আমি বললাম, শুধু কি প্রেমিকা? আমি তো তোমাকে আরো অনেক কিছু মনে করি। তবে সেই অনেক কিছুর কোন ব্যাখ্যা আমি দিতে পারবো না। আবার ওই একটুখানি শব্দ ‘প্রেমিকা’র মধ্যেও আমি তোমাকে সীমাবদ্ধ রাখতে পারবো না। তোমার সাথে আমার সম্পর্কের নির্দিষ্ট কোন নাম নেই; তবে সীমাহীন বিশালতা আছে। আছে সমুদ্রের গভীরতা।
সে বলল, “যে তোমার মনে থাকে তাকে কোন কিছু ব্যাখ্যা দিয়ে পরিচয় করানোর তোমার প্রয়োজন নাই। কেননা সে নিজেই তো ভালো জানে সে তোমার কতখানি”।
এরপর আমার আর কোন কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি। আমার কাঁধের উপর মাথা রেখে সোহেলী একহাতের আঙ্গুলের ভেতর শাড়ির আঁচল প্যাঁচাতে থাকে, আর অন্য হাতখানি ছিল আমার হাতে বাঁধা। দুজনেরই দৃষ্টি ছিল নদীর ওপাড়ে, যেখানে দূরের বৃক্ষগুলিকে মনে হচ্ছিল ঘন ধুষর মেঘ। সূর্যটা হেলে পড়ছিল অনেকখানি, আর লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ছিল আকাশময়। তারই ঝিকিমিকি আলোকচ্ছটা নদীর জলের সাথে মিশে চিকচিক করছিল।
*
“বড় বেশি সুখের সময় বিধাতা মানুষের প্রয়োজনীয় এমন কিছু কথা বলার মুহুর্ত এনে দেয়, যে কথাটি বলার পরে সুখের সময়টা আর সুখের থাকে না, হয়ে যায় বড় বেশি অসুখের”। রূপার কথাটা সোহেলীকে বলবো বলে সেই দুপুর থেকে চেষ্টা করছি; কিন্তু কোথাও একটা বাঁধা ঠেকছে মনে। সোহেলীকে কথাটা কিভাবে বলবো, সে কিভাবে গ্রহন করবে এই নিয়ে ভাবনার সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে একসময় বলেই ফেললাম। সোহেলী তখন আমার কাঁধে ভর করে সুর্যাস্ত দেখছিল।
আমি সারসরি কথাটা বলতে পারলাম না। একটু ভূমিকা নিয়ে শুরু করলাম-
সোহেলী একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
সেভাবেই আমার কাঁধের উপর মাথাটি রেখে আস্তে করে বলল, বলো- তখনো তার হাতখানি আমার হাতের আঙ্গুলে কথা বলছিলো।
আমি বললাম, রূপাকে নিয়ে বলতে চাই। জানি না তুমি কিভাবে নেবে।
এবার সোহেলী মাথা তুলে আমার মুখের দিকে তাকায়, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলল, কি ব্যাপার বলোতো? আমাকে কোনকিছু বলতে তোমাকেতো এতটা ভূমিকা করতে দেখিনি কখনো। ব্যাপারটা যে সিরিয়াস সেটা বুঝতে পারছি। বলে ফেলো কি হয়েছে।
আমি বললাম, আগামী সপ্তাহে রূপা চলে আসছে রাজশাহী।
চলে আসছে মানে?
মানে সে এখন থেকে আমার সাথেই থাকবে। আমি যেখানে থাকবো সেখানে।
কথাটি শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য সোহেলী স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর বলল, সেটা কী করে সম্ভব? তার চাকরী?
তখন আমি সবকিছু বুঝিয়ে বললাম। সোহেলীকে নিয়ে সেদিনের সেই বাকযুদ্ধের কথাও বললাম। সব শুনে সোহেলী একেবারে চুপ হয়ে গেল। ওর অন্ধকার মুখটি দেখে আমার বুকের ভেতর কষ্টের একটা দীর্ঘশ্বাস ধ্বনিত হলো। দুহাতে ওর মুখটি নিজের হাতের তালুর উপর ধরে বললাম, তুমি কিচ্ছু ভেবোনা সোহেলী। বিধাতা আমার জীবনে তোমাকে যে রূপে উপহার দিয়েছেন আমি তার মর্যাদা কখনো এতটুকু ক্ষুন্ন হতে দেব না । তুমি যেমন আছো তেমনি থাকবে। রূপা আমার ঘরে থাক বা আমার থেকে দূরে থাক, সেটা আমার সংসারের প্রয়োজনে এবং তার জেদের কারনে। আর তুমি চিরকাল আমার অন্তরের ঠিক মাঝখানটাতে থাকবে, আমার আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে, সেটা আমার জীবনের প্রয়োজনে। রূপার সাথে তোমাকে নিয়ে তর্ক করে আমি তোমার অস্তিত্বকে ছোট করতে চাই না। তুমি হলে সমস্ত যুক্তিতর্কের উর্ধ্বে, হ্্রদয়ের একান্ত নিভৃতচারিণী আমার।
রূপা চাকরী ছেড়ে আমাকে পাহারা দিতে চলে আসাটাকেও আমি গুরুত্ব দিচ্ছি না। কেননা এতে সে শুধু নিজেকেই ছোট করেছে। আমাকে তোমাকে নয়। সারাজীবন সে আমার উপরে তার কিছু সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে আর আমি তা মেনে নিয়েছি। সবই করেছি সংসারের শান্তি বজায় রাখতে। আজও আমি তার ব্যতিক্রম করিনি। কিন্তু “প্রতিটি মানুষের নিজস্ব একটি ভূবন থাকা চাই।” আমারো আছে। যে ভূবনে তোমার সাথে আমার বসবাস। এ বসবাস বাস্তবিক নয়, আন্তরিক। পুরোটাই হ্্রদ্বিক। এই জগতে আমি কাউকে প্রবেশ করতে দিব না। রূপাকেও না। এ একান্তই আমার। আমার নিজস্ব দুনিয়া।
আমার কথাগুলো সোহেলীর ভালো লাগলেও আমাকে নিয়ে তার উদ্বিগ্নতা কমলো না কিছুতেই। রূপার রাজশাহী আগমন সোহেলীর মনের আকাশটাকে মেঘাচ্ছন্ন করে দিল। দু’দিন ধরে সে ঠিক আগের মত কথা বলে না আমার সাথে। এমন অবস্থায় রূপা আসার দু’দিন আগে আর এক গোধুলী লগ্নে সোহেলীকে নিয়ে বের হলাম । সোহেলীর সাথে আমার এই ঘোরাফেরা অনেকের চোখেই কটাক্ষকর মনে হলেও ইতোমধ্যে কাউকে কাউকে আমি এর জবাব দিয়েছি। সবার আগে রোকসানাকে। সে এখন আর আমার ব্যাপারে নাক গলানোর দু:সাহস করে না।
এখন থেকে আমি যেখানে থাকবো রূপাও সেখানে আমার সাথেই থাকবে, এটা সোহেলীর সহ্যশক্তির বাইরের একটা বিষয়। সে বলে, তাহলে এতদিন কেন সে তা করলো না। এখন সে যদি তোমার সাথে বসবাস করে তো আমার সাথে তোমার একটা দূরত্ব অবশ্যই সৃষ্টি হবে। আর আমাকে নিয়ে তোমাদের সংসারে নিত্য কলহ সৃষ্টি হবে। সে এখানে আসলে নানান লোক তার কানে নানা ধরনের কথা বলবে। সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাবে। তারচেয়ে তুমি কেন তাকে নিষেধ করছো না? তার চাকরী ছেড়ে চলে আসাটাকে কেন নিরুৎসাহিত করছো না তুমি? তুমি তাকে বলো যে তার এভাবে চলে আসার কোন দরকার নেই। আর তুমিতো সারাজীবন রাজশাহী থাকবে না। তোমার বদলীর চাকরী তো আজ এখানে কাল ওখানে। সে এতদিন যেমন ছিল তেমনটাই থাকুক না।
তার কথাগুলো তার দিকে থেকে যুক্তিসঙ্গত হলেও আমি তা সমর্থন করতে পারিনি। বললাম, এখন আমি রূপাকে এসব কথা বললে সে নিশ্চিৎ হবে যে তোমার সাথে আমার বিশেষ কোন সম্পর্ক আছে। আর তাই আমি তাকে দূরে রাখতে চাইছি। তাই রূপা যা করে করুক। আমিতো বারবার তোমাকে বলছি, ওর এখানে থাকা আর ঢাকাতে থাকা এই নিয়ে আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের কোন পরিবর্তন হবে না।
সেদিন সোহেলী অকস্মাৎ আমার চোখের দিকে দৃষ্টি রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, আমি জানি তুমি আমাকে যতোই বোঝাও না কেন তোমার বউ তোমার সাথে থাকলে তুমি আমার সাথে স্বাভাবিক কথাটিও বলতে পারবে না। আমি এর আগেও দেখেছি তুমি ঢাকা যাওয়ার পরে এবং সে এখানে যতদিন ছিল তুমি আমাকে একেবারেই ভুলে ছিলে। তখন আমি ভেবেছি তোমার সাথে আমার ভালোবাসার সম্পর্কটা বুঝি একতরফা। শুধু আমিই তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু এখন আমি জানি তুমিও আমাকে কতোটা ভালোবাসো। তো এখন যদি বউকে পেয়ে আমাকে ভুলে থাকো সেটা আমার কিছুতেই সহ্য হবে না। তোমার একটুখানি দূরত্ব আমার কষ্টের বিশাল কারন হয়ে দাঁড়ায়। একটা দিন তোমার কণ্ঠের আওয়াজ না শুনে আমি থাকতে পারবো না। তোমাকে না দেখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। আমি ভাল করেই জানি সে আসলে তোমার পায়ে শেকল বাঁধা থাকবে। “লোহার শেকল ভাঙ্গা যায়; কিন্তু যে শেকল দেখাই যায় না তাকে তুমি ভাঙবে কি করে?”
আমি বললাম, আরে পায়ে শেকল থাকবে তো কী হয়েছে? আমার মনেতো আর শেকল থাকবে না। আর এভাবে ভাবছো কেন? ইচ্ছা থাকলে জগতে কোনকিছুই অসম্ভব না। তোমার সাথে কথা বলা, দেখা করার সুযোগ আমি নিজেই খুঁজে নেব। আচ্ছা, তুমিকি ভাবতে পারো তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারবো কখনো? এটা কি সম্ভব বলো? এই বলে ওর মাথাটা টেনে নিয়ে আমার বুকে চেপে ধরলাম। বললাম, সোহেলী তুমি আমার হ্্রদয়ের স্পন্দন। আমার হ্্রদয়টা সচল রাখার জন্যই আমি তোমাকে আমার বুকে রাখতে চাই; সংসারে নয়।
চাপা ক্রন্দন নিয়ে সোহেলী বলল, ইচ্ছা থাকলে যখন কোনকিছুই জগতে অসম্ভব না তাহলে চলো একটা কাজ করি।
আমি বললাম, কি কাজ?
যে কাজ করলে আমাকে আর তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে না।
ওর কথাটি শুনেই আমার অন্তরটা কেঁপে উঠলো। যে কথা এখনো স্পষ্ট করে সোহেলী উচ্চারণ করেনি মনে মনে আশির্বাদ করতেছি সেই কথাটি যেন সে ইহ জনমে আর ব্যক্ত না করে। কেননা সেই কথা শোনার পরে আমার বলার মত আর কোন কথা থাকবে না। আবার কিছু না বললেও সে তুষ্ট হবে না।
আমার কোন উৎসাহ না দেখে সে এবার বলল, পৃথিবীতে মানুষ কত কিছুইতো করছে। কত অসাধ্য সাধন করছে। “যে সংসারে অশান্তির আগুন টিমটিম করে জ্বলছে তাকে আমরা জ্বলতে দেই কেন?” ইচ্ছা করলেই তো আমরা আমাদের জীবনটা বদলে ফেলতে পারি। যে জীবন তোমার আমার পাওনা ছিল আজ তা নিয়ে নিতে পারি ।
আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম সোহেলী কোন্ জীবনের কথা বলছে। এটাও বুঝতে পারছিলাম সে কোন্ অসাধ্য সাধনের কথা বলতে চাইছে। তবু প্রসঙ্গটাকে অগ্রাহ্য করতে পারলাম না ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি কথা বলেছিলেন, “মনুষ্য সমাজ একটি জটিল ভ্রমের জাল। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করিতে কাহারো মনে পড়ে না। তাহার পরে বেঠিক সময়ে বেঠিক বাসনা লইয়া অস্থির হইয়া মরে।”
আমার এখন মনে হচ্ছে বরিঠাকুর বুঝি আমাদেরকে ইঙ্গিত করেই তখন এ কথাটি লিখে গিয়েছিলেন। নইলে এই অসময়ে আমিই কেন আমার সংসারে অশান্তি দেখতে পাই, আর সোহেলীই বা এখন কেন জীবনটাকে বদলে দিতে চায়?
সোহেলী বলল, “জীবন আমাদের কাছে যখন বেঠিক বলে মনে হবে আমরা তখনি তাকে শুধরে নিতে পারবো, বদলে নিতে পারবো; যদি আমাদের সেই ইচ্ছা, শক্তি, সামর্থ আর বাসনা থাকে।”
আমি বললাম, “কখনো কখনো আমাদের ইচ্ছা, শক্তি, সামর্থ, বাসনা বড় নির্লজ্জের মত হার মানে সমাজ এবং বাস্তবতার কাছে।” জীবনের এই অপরাহ্ন বেলায় কি পাইনি সেটা নিয়ে আর হিসেবের খাতা ভারি করতে চাই না। বরং যা কিছু পেয়েছি যতটুকু পেয়েছি তার মাঝেই জীবনের স্বার্থকতা খুঁজে দেখবো। তুমি আমি যেখানেই থাকি যত দূরেই থাকি ভালোবাসার একটা অদৃশ্য সূতার একদিকে থাকবে তোমার মনটি গাঁথা, আর অন্যদিকে আমার। সংসারের দর কষাকষিতে কেন আমরা আমাদের সবুজ মনটাকে ফিকে হতে দেবো?
এসব তত্ত্বকথায় আমার মন ভরবে না, বলল সোহেলী। বলল, আমি তোমাকে হারাতে পারবো না কিছুতেই, আর তোমার দূরত্ব সেও আমার সইবে না। আমি যেন চিরকাল তোমার কাছে থাকতে পারি সেরকম একটা কিছু করার কথা বলছি আমি।
আমি বললাম, আমিতো হারিয়ে যাচ্ছি না কোথাও। আর তোমার থেকে দূরেও যাচ্ছি না। সেই চোদ্দ বছর আগে তুমি যে আমার মনের সবচেয়ে নিরাপদ স্থানটুকু পেতে বসেছিলে আজও সেখানেই আছো। বরং পূর্বের তুলনায় আরো শক্ত অবস্থান তোমার। বেশ ষ্পষ্ট আর আলোকিত করে তুমি তোমার জায়গাটি ধরে রেখেছো । তাহলে মিছে কেন ভয় পাচ্ছো সোহেলী? হ্র্দয়ে কেন সংকীর্ণতাকে ঠাঁই দিচ্ছ?
বলল, কেন সোজা কথাটা বুঝতে পারছো না তুমি? আমি তোমাকে নিয়ে আমার জীবনটা নতুন করে সাজাতে চাই। এভাবে চুপিসারে নয়; সমাজের চোখে আমরা যাতে অপরাধী না হই সেভাবে তোমার সাথে চলতে চাই।
এরপর আমার বুকের উপর থেকে নিজের মাথাটি তুলে নিয়ে আমার চোখের প’রে চোখ রেখে সোহেলী বলল, ‘আমি তোমার বুকে এবং সংসারে দু’ জায়গাতেই থাকতে চাই। চলো আমরা বিয়ে করি’।
ওর মুখে বিয়ের কথাটি এমন অকপটে ব্যক্ত হতে দেখে আমার বিষ্ময়ের সীমা রইলো না। এতক্ষণ ধরে যে কথাটি আমি থামিয়ে দিতে চেয়েছিলাম সেই কথাটিকে সে পৃথিবীর বুকে জন্ম দিল বড় অসময়ে। এমনভাবে প্রকাশ করলো যেন আমার অপ্রকাশিত আশংকার উপর রড় যত্মসহকারে চাপিয়ে দিল একটি ধারালো বুলডোজার।
আমি বললাম, এ তুমি কী বলছো সোহেলী? এখন কি আমাদের বিয়ে করা স¤ভব?
কেন নয়? তুমিইতো বললে ইচ্ছা থাকলে জগতে কোনকিছুই অসম্ভব নয়। তাহলে আমাদের বিয়ে করতে বাঁধা কোথায়?
আমি বললাম, ক্ষ্যাপার মত কথা বলো না সোহেলী। তুমি ভালো করেই জানো তুমি যা বলছো তা কখনোই সম্ভব নয়। শুধু শুধু এসব বলে আমাদের সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট করে দিওনা প্লিজ। “বিয়েটাই জীবনের সারকথা নয়”। দেখোনা রূপাকে আমি বিয়ে করেছিলাম সুখী হবো ভেবে। কিন্তু আমিকি তা হতে পেরেছি?
“ভালোবাসলেই যে বিয়ে করে তার উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তাকে দখল করে নিতে পারলেই সবকিছু পেয়ে গেলাম, এমনটা নাও হতে পারে।” আর সমাজকে আমরা কখনোই অবজ্ঞা করতে পারি না। শুধু নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে আমরা কেন এমন একটি কাজ করবো? নিজেদের কপালে কলঙ্ক লেপন করে বাকিটা জীবন আমরা কিভাবে পার করবো বলো? সমাজ আমাদেরকে কিছু না দিতে পারলেও সমাজে আমাদের যার যার একটি অবস্থান আছে। ‘প্রতিটি মানুষই সমাজের কাছে দ্বায়বদ্ধ’।
সোহেলী বলল, কেন আমরা তা পারি না? দ্যাখো, আমরা পরস্পরকে কত গভীরভাবেই না ভালোবাসি। অথচ সারাজীবন তার সাথেই সংসার করবো যার প্রতি কখনোই হ্্রদয়ের সেই আবেগ অনুভবই করিনি। শুধু কর্তব্যের খাতিরে বিয়েটাকে মেনে নিয়ে জীবনটা পার করা মরনের সমান। আমরা কি আসলে জীবনটাকে যাপন করছি? না আমি করছি, না তুমি। তুমিও রূপাকে নিয়ে সুখি নও। সে সারাজীবন তোমাকে ছেড়ে থাকতে চেয়েছে তার চাকরীটাকে প্রাধান্য দিয়ে। আজ তোমার জীবনে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তোমার সুখের অংশটাকে মিলিয়ে দিতেই সেই চাকরী ছেড়ে তোমার কাছে ছুটে আসছে। সে কী তার সংকীর্ণ মনের পরিচয় দেয়নি?
এক দন্ড থেমে সোহেলী আবার বলল, আমি দু:খিত তোমার স্ত্রী সম্পর্কে আমার কোন নালিশ নেই। আমি শুধু এটা বলতে চাই তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি। সেই চোদ্দ বছর আগেই তুমি আমার হয়েছিলে। অথচ তুমি নিজেই তা অবহেলা করেছিলে, কিন্তু অস্বীকার করতে কখনো পারোনি। আবার সবকিছু জেনেশুনে আমাকে গ্রহনও করোনি। আমিতো তোমারি ছিলাম। আজ আমি সম্পূর্ণভাবে তোমার হতে পারতাম। অথচ কোথা থেকে রূপা উঠে এসেছিল তোমার জীবনে। তোমাকে না পেলে রূপার কোন ক্ষতি ছিল না। কিন্তু আমি তোমাকে হারায়ে আমার অনেক মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছি। আজ আমি তা ফিরে পেতে চাই। আমি বলছি না রূপাকে ছেড়ে তুমি আমাকে গ্রহন করো। তার মতো সে থাকুক, আমি শুধু তোমার হতে চাই। তোমার পরিচয়ে আমি পরিচিত হতে চাই।
ওর এক একটি কথা আমাকে কি পরিমান অস্বস্তি আর অসহায় করে তুলতেছিল সেটা বলে বোঝানোর নয়। সোহেলীকে যে আমিও অনেক ভালোবাসি, তাকে নিয়ে সুখের ছোট্ট সংসারের কল্পনা আমিও যে দিবানিশি দেখতে থাকি, আমার দুনিয়ায় তাকে নিয়ে হাত ধরে চলার ¯বপ্ন আমিও যে দেখতে দেখতে বিভোর, সেকথা মনে থাকলেও বাস্তব বড় বেরসিক। “যাকে নিয়ে কল্পনায় ভেসে চলা সহজ, তাকে নিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করা ততই কঠিন”। এই নির্মম সত্যটা যত সহজে যে বুঝে নিতে পারবে তার জীবনটা ততই সহজ হবে।
সোহেলীকে বললাম, তুমি যা বলছো তোমার দিক থেকে হয়তো ঠিকই বলছো। কিন্তু ভেবে দেখো সোহেলী, আমাদের দুজনের দুটি আলাদা জগৎ সংসার আছে, দুটি পরিবারের সাথে আরো দুটি পরিবার জড়িত, আমি একজন সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে আজ আমি এই অবস্থানে এসে পৌঁচেছি। চাইলেও আমরা যা কিছু করতে পারি না। সঠিক কাজটি করার জন্য সঠিক সময়েরও প্রয়োজন আছে তাইনা? আর আমার দিক থেকে এটা কখনোই সম্ভব নয়, কেননা আমার চাওয়া পূরণ করতে যেয়ে আমার সন্তানকে কিছুতেই বঞ্চিত করতে পারি না। পৃথিবীতে সে নিজের ইচ্ছায় আসেনি। আমরা তাকে নিয়ে এসেছি। তো আমাদের কোন অধিকার নেই তার জীবনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার। তাকে সম্মানজনক একটা জীবন দান করা পিতা হিসেবে আমার কর্তব্য।
সোহেলী বলল, তোমার সন্তান আমার কাছেও ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ। আমি কখনোই চাইবো না আমার জন্য তার প্রতি কোন অবিচার হোক। আর আমার জীবনের অপূর্ণতা পূরণ হবে তোমার সন্তানকে আপন করে নেয়ার মধ্য দিয়েই। এই একটি শূণ্যতা বিধাতা আমাকে এজন্যই দিয়েছেন হয়তো তোমার মাধ্যমে তা পাবো বলেই। আমি তোমাকে কখনো অসুখি করবো না। প্লিজ তুমি আমাকে তোমার করে নাও।
আমার কষ্ট আমি কাকে বোঝাই। সোহেলীর এসব কথাবার্তা যতটা আবেগীয় ততটা আমাদের জন্য শোভনীয় নয়। আমি বললাম, তুমি সেই ছোট্ট সোহেলী নও যে এত করে তোমাকে বোঝাতে হবে। এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো আর স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করো। আমার দ্বারা তোমার যদি কোন ক্ষতি হয়ে থাকে তাহলে আমি ক্ষমা চাচ্ছি সোহেলী। কিন্তু আজ যে কথাটি তুমি বললে, অত্যন্ত দু:খের সাথে বলতে হচ্ছে এ আমি কিছুতেই পারবো না।
সোহেলী বলল,“জানি পুরুষ মানুষ এমনই বলে। গোপনে গোপনে তারা কোন নারীকে ভালোবাসার বাণী শুনাতে পারে, কিন্তু তাকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্ন তুললেই সমাজ এসে মাথা তুলে দাঁড়ায়। ওই বিয়ের কাজটাই তখন হয়ে যায় অসামাজিক, বাকী সবকিছুই সামাজিক”।
আমি যদি আমার সংসার ত্যাগ করে তোমার কাছে আসতে পারি তুমি কেন পারবে না?
ওর চোখের ভেতর আগুন আর মুখের ওমন কথা শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। বললাম, সোহেলী আমি ভাবতেও পারছি না তুমি জগতের আর সব পুরুষের সাথে আমাকে কেমন করে মেলালে! তুমিকি আমাকে আজ থেকে জানো? আমার প্রতি এ কেমন বিশ্বাস তোমার?
সে বলল, “প্রতিটি মানুষই নিজেকে অনন্য ভাবে। গর্ব করে বলে, আমার মত কেউ নেই। আমি অন্য কারো মত নই। কিন্তু ভেতরে সবাই এক। শুধু মোড়কটাই ভিন্ন।”
সোহলীর কথাগুলো শুনে নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো । মনে হলো এই তাহলে আমি! রূপার কাছে আর সোহেলীর কাছে আমার অবস্থানের কি বিশেষ কোন পার্থক্য আছে? তারা কেউ কি তাহলে আমাকে বুঝে না? নাকি আমিই পৃথিবীর সমস্ত মানুষের বোধের উর্ধ্বে?
আমার ভেতরে দু:খ এবং রাগ দুটোই ইসপিস করতেছিল। আর কিছুক্ষণ সোহেলীর এধরনের কথা শুনলে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি কিনা সেই আশংকায় তখনি সভার সমাপ্তি ঘোষনা করতে চাইলাম। বললাম, আমাকে মাফ করো সোহেলী, আজ আমাকে উঠতে হচ্ছে। তোমার মাথা যখন ঠান্ডা হবে তখন এই বিষয়ে কথা বলবো।
বারুদের মাথায় লেগে গেলো আগুন। উচ্চস্বরে বলল, ওহ্ বিয়ে করার কথা বললাম বলে আজ আমার মাথা গরম? তোমাকে আমার চেনা হয়ে গেছে। আমারি ভুল ছিল তোমার কাছে বেশি কিছু প্রত্যাশা করেছিলাম। আসলে তুমি যে বউয়ের আঁচল ধরা পুরুষ সেটা আমার মনেই ছিল না। তোমার একাকী দিনগুলোতে আমাকে একজন সঙ্গী বানিয়ে তুমি শুধু আমার সাথে সময় কাটাতে চেয়েছো। আর কিছু নয়। তোমার মনে ভালোবাসা টাসা কিছু নেই। আগেও কোনদিন ছিল না। এখন বউকে নিয়ে আসতেছো তাকে নিয়েই তোমার জগৎ সাজাও। আমাকে আর দরকার নেই।
হায় রে অবাক দুনিয়ার অবাক সব মানুষ! এমনও বুঝি হয়! এই কিছুক্ষণ আগে যে প্রেয়সী আমার উপর তার সমস্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসা সমর্পণ করে দিয়ে আমার কাঁধের উপর তার সমস্ত নির্ভরতা অর্পন করে নিশ্চিন্তে নি:শ্বাস নিচ্ছিল, সেই এখন আমাকে পৃথিবীর সমস্ত পুরষের কাতারে দাঁড় করিয়ে আমাকে গজফিতা দিয়ে মেপে গেল। আমার দু:খ আমারি থাক। জয় হোক আমার সোহেলীর, আর জয় হোক রূপার।
*
বর্ষা শেষে শরৎ এলো। আকাশ জুড়ে সাদা সাদা তুলো তুলো মেঘের অবিরাম ভেসে চলা। মেঘের ওপাড়ে উঁকি দিয়ে আছে মসৃণ সমুজ্জ্বল নীল আকাশ। মনটা ভালো নেই। কোনকিছুই মনের মতো হচ্ছে না। রূপা এসেছে দু’দিন হলো। সে স্বাভাবিকই আছে। আমাকে খুশি করতে কিংবা আমাকে পাহারা দিতে সে যে চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে তার মধ্যে সেই ভাবটা অনুজ্জ্বল। এসেই আমার ঘরটাকে মেজে ঘষে বসবাস উপযোগী করতে উদ্যত হলো। আমাকে দিয়ে নতুন কিছু আসবাব কেনালো।
সেদিন বিয়ে নিয়ে তর্ক হওয়ার পরে ওই রাত এবং তার পরের দিন পর্যন্ত সোহেলীর সাথে আমার কোন যোগাযোগ হয়নি। সন্ধ্যায় সে আমার কাছ থেকে রাগ করে চলে যাওয়ার পরে আমারো মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে থাকে। ওর কথাগুলো মনের দেয়ালে আঘাত করে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। সোহেলীর সাথে আমার যে ধরনের সম্পর্ক তাতে একটুখানি আঁচড় লাগলে আমার ভীষন কষ্ট হতো। এই সম্পর্কটাকে আমি জগতের সমস্ত অকল্যাণ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। সবার অলক্ষ্যে সবার অনÍরালে আমাদের এই মধুর সম্পর্কটাকে আমরা বাঁচিয়ে রাখবো অতি যতœ করে-এই ছিল আমার মনের বাসনা। অথচ সেই মেয়েটি কেমন করে আজ আমাকে ভুল বুঝে চলে গেল!
পরদিন সকাল থেকে বারবার ফোনটা হাতে নিয়ে কল করতে যেয়েও নিজেকে বিরত রেখেছি। ভেবেছি সময়টা আর একটু পেরিয়ে যাক। ততক্ষণে সোহেলীর মনটা স্বাভাবিক হবে। সে নিশ্চয়ই তার ভুল বুঝতে পারবে। এমনতো অবুঝ মেয়ে নয় যে জেদ ধরে বসে থাকবে। নিজে থেকে ফোন দেইনি ঠিক, কিন্তু আশা করতেছিলাম সোহেলী যেন একবার আমাকে কল করে। কিন্তু সময় গড়িয়ে যায়, সে ফোন আর করে না।
এমন করে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত একটা অস্থির মন নিয়ে আমি ছটফট করতে থাকি। অফিস থেকে বাসায় চলে যাই। মনে মনে এই আশা যে সোহেলী একবার ফোন করলেই বলবো আমি তোমাকে দেখতে চাই। তখন বাইরে গিয়ে ওর মনটাকে ভালো করে দিব। অফিসের ঝামেলা এড়াতে সরকারী ফেনটাকে বন্ধ রেখে সবাইকে বলি যে আমার শরীর ভালো নেই।
পরের দিন রূপা আসবে । বাসায়ও তার কিছু প্রস্তুতি করে রাখা দরকার। কিন্তু কোনকিছুতেই মন বসছিল না। সোহেলীকে সেদিন ওভাবে বলেছিলাম বলে মনটা খুব খারাপ হয়ে ওঠে এক সময়। অনেক চেষ্টার পরেও রাতে যখন ঘুম আসছিল না বারবার এপাশ ওপাশ করেছি আর সোহেলীর কান্নাজড়িত মুখটির কথাই ভেবেছি। তখন মনে হচ্ছিল আমাকে নিয়ে জীবন সাজাতে চেয়ে সেতো কোন দোষের কথা বলেনি। আমাকে সে ভালোবাসে, তো বিয়ে করার কথা বলতেই পারে। যা কিছু বলেছে সবতো আমাকে কাছে পাওয়ার জন্যই বলেছে। অথচ আমি কত রুঢ়ভাবে তাকে প্রত্যাখ্যান করলাম। আমিতো আরো সুন্দরভাবে বলতে পারতাম। আমার কোন কথাই সে কখনো অবমাননা করেনি। সেদিনও করতো না যদি আমি সঠিকভাবে বোঝাতে পারতাম। নিজের উপরই রাগ হচ্ছিল।
সেই নির্ঘুম রাতে আমার চোখে ভেসে উঠলো সোহেলীর ঘরের চোদ্দ বছর আগের সেই পড়ার টেবিলটি। যার একপাশে চেয়ার টেনে বসতাম আমি আর আমার বাম পাশটায় আর একটি চেয়ারে বসতো সোহেলী। দোতলা বাড়ির দক্ষিণ দিকের ঘরটাতে আমরা বসতাম। সামনে ছিল একটি ম¯তবড় জানালা। সোহেলীকে যখন পড়াতাম কখনো কখনো সেই জানালার পাশে উড়ে এসে বসতো একটি দুটি কবুতর। সোহেলীর ছোট ভাইয়ের কবুতর পোষার শখ ছিল। সেখান থেকেই আমিও কবুতর পোষার উৎসাহ পাই। যা আজও ধরে রেখেছি। সোহেলীর সাথে দেখা হবার পরে কখনো জিজ্ঞাসা করা হয়নি ওদের বাড়ির ছাদে এখনো কবুতরগুলো আছে কিনা।
সেই নির্ঘুম রাতে আমি দেখতে পাই টেবিলের নিচে একটি পা দিয়ে সোহেলী তার পায়ের স্যান্ডেল নিয়ে দুষ্টুমি করছে। আর ইচ্ছে করেই আমার পায়ের সাথে তার পায়ের সংঘর্ষ ঘটিয়ে বারবার আমার কাছে সরি বলে নিচ্ছে। মুখে লেগে আছে দুষ্টুমি ভরা চাপা মিষ্টি হাসি। আমার মনে পড়ে গেলো সেইসব দিনগুলো, যে দিনগুলোতে সে পড়ায় মন না দিয়ে আমার সাথে গল্প করে পার করতে চাইতো। খাতার ভেতরের সেই কালো চশমা আঁকা ছেলেটি, যার পাশে লিখে রাখতো,“আমার স্যার একটা অন্ধ”।
অতীতের এমন সুখকর স্মৃতি ভাবতে ভাবতে আমার বর্তমান কখন যে স্মৃতির তলায় হারিয়ে গেল সেই খবর নেই। সেই মুহুর্তে শুধু এটাই মনে পড়তেছিল, সোহেলীকেই তো আমি ভালোবাসতাম, তাকে নিয়ে কত স্বপ্ন বুনতাম। সেই সোহেলী আজ আমাকে নিয়ে জীবন সাজাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। আর আমি কিনা তাকে প্রত্যাখান করেছি। তখন হঠাৎকরে ওর প্রতি এত মমতা এত মায়া অনুভব করলাম যে মনে হচ্ছিল কেউ যদি তখন আমার সোহেলীকে আমার সামনে নিয়ে আসতো অথবা সে নিজেই ছুটে আসতো আমার কাছে, দু’হাতে তাকে বুকে জড়িয়ে নিতাম চিরদিনের মতো করে। কখনো আর দুরে যেতে দিতাম না। একবার কেন, হাজারবার আমি তাকে বিয়ে করতে রাজি। আমার জীবনে সোহেলীই ছিল একমাত্র আরাধ্য। সোহেলী ছিল, সোহেলীই আছে, আর সোহেলীই থাকবে। এর বাইরে আর কেউ নেই, কিছু নেই। পৃথিবীর সমস্ত যুক্তিতর্ক তখন বৃথা মনে হতে লাগলো। সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবার, চাকরী সবকিছু তখন সোহেলীর কাছে তুচ্ছ বলে গন্য হলো। মনে হলো, এ আমি কি করেছি! যাকে এতটাকাল এত যতœ করে হ্্রদয়ের গভীরে রেখেছি, আজ সে আমার মন্দিরে প্রবেশ করতে চাইলো, অথচ তাকে আমি ফিরিয়ে দিয়েছি! এতটা নির্দয় আমি কেমন করে হতে পারলাম!
সোহেলীকে নিয়ে আমার যখন এমনতর ভাবনা, রাত তখন তিনটে। ইচ্ছা করছিল তখনি ফোন করে ওর মনটা নিমিষেই ভালো করে দেই। বলে দেই যে, আমি এখুনি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। সোহেলী আমার পাশে থাকলে আমার জীবনটা কতটা রঙিন হয়ে উঠবে সেটা ভাবতে ভাবতে বাকি রাতটাও পার করি। ভাবনাতেই যেন বড় সুখ নিহিত। বাস্তবতায় না জানি আরো কত কি!
যখন ভোরের আলো ফুটে ওঠে আমি তখন কাচা ঘুম ভাঙা বিক্ষিপ্ত মন আর ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসি। রাতের ভাবনাগুলো দিনের আলো ফুটতেই বদলে ফেলে তার রঙ রূপ। রাতের অন্ধকারে আবেগী মন যা কিছু কল্পনা করে, দিনের আলোতে তার অনেক কিছুই অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। সত্য এবং বাস্তবতা তখন পূর্বের তুলনায় আরো বেশি কঠোর হয়ে আবির্ভূত হয়। আবেগটা দূরীভূত হলে আমি ফের কঠিন বাস্তববাদী হয়ে যাই।
দুপুর পর্যন্ত খুব অস্থিরতায় কাটে আমার এক একটি মুহুর্ত। এর আগে কখনোই সোহেলীর সাথে এতটা সময় কথা না বলে থাকিনি। কোন কারনে কখনো যদি বলা না হয়ে থাকে সেটা কোন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। সেরকম কিছু হলে আগে থেকেই বলে রাখতাম যে আমি ওই সময়টা ব্যস্ত থাকবো। কিন্তু সেদিনের সময়টা অন্য যেকোন দিনের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিল। কারন সোহেলীর সাথে এর আগে কখনোই কোন বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়নি আমার। ওইদিন সে বিয়ে প্রসঙ্গটাকে এমন করে আমার সামনে উপস্থাপন করবে সেটা আমার ভাবনার অতীত ছিল। খারাপ যেমন লাগছিল, তেমনি আমার কিছু করারও ছিল না।
সোহেলীর সাথে এই মৌনতার কারনে আমার স্বাভাবিক কর্মক্রিয়ায় মনোযোগের বিপত্তি দেখা দিল। বারবার ওর প্রস্নন মুখটি মনের পটে ভেসে উঠছিল। দুপুরের পরে প্রচন্ড রোদে যখন পুড়তেছিল ধরণী, তখন আমারো পোড়া মনটি একটুখানি প্রশান্তির আশায় সোহেলীকে খুঁজতেছিল।
ঠিক তখনি ফোনটা বেজে ওঠে।
সেই মুহুর্তে আমার হ্্রদয়ের আকুল আকাঙ্খা কতটা দুরন্তের সাথে পূরণ হয়েছিল তা শুধু আমিই জানি। ফোনে ওর কণ্ঠস্বরটি আমার একদিনের শুকিয়ে যাওয়া হ্্রদয় জমিনে যেন আষাঢ়ের বর্ষণ হয়ে পতিত হচ্ছিল। মনের গভীর থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে আসলো, সোহেলী তুমি কেমন আছো? ফোনের অপর প্রান্ত থেকে চেপে রাখা ক্রন্দন শুনতেছিলাম আমি। বলল, তোমাকে ছাড়া আমি কি ভালো থাকতে পারি? গত রাত থেকে এই সময় পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর মুহুর্ত ছিল।
কথাটি বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে সে। হয়তো কণ্ঠটি স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করছিল। আমারো হ্্রদয় কেঁপে তখন কান্নার ঢেউ উথলে উঠতে চাইলো। তাকে দু হাতে বুকে জড়িয়ে ধরার আকুলতা আমাকে বিদ্রোহী করে তুলছিল।
আমি বললাম, আমিও একটুও ভালো ছিলাম না সোহেলী। অনেকবার ফোন করতে চেয়েছি তোমাকে। গতকালের ব্যবহারের পর একটা অপরাধবোধ আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল তোমার সাথে কথা বলার অধিকারটাই বুঝি হারিয়ে ফেলেছি। সারাটি রাত এবং আজকের দিনটা তোমার একটি ফোনের অপেক্ষা করেছি আমি ।
সোহেলী বলল, আমাকে তুমি ক্ষমা করো প্লিজ। আমি নিজেই লজ্জায় তোমার সাথে কথা বলতে পারিনি। গতকাল আমার কি যে হয়েছিল। আসলে তুমিই ঠিক। সারারাত তোমার কথাগুলো আমার মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। সমাজ এবং বাস্তবতাকে তুমি যেভাবে জানো আমি সেভাবে একটুও জানতে চাইনি। এখন আমি উপলব্ধি করতে পারছি ‘ভালোবাসার জন্য বিয়েটাই মূখ্য নয়’। এইতো ভালো আছি। যত দূরেই থাকি যেভাবেই থাকি আমি শুধু তোমারি থাকবো। তুমি যখনই আমার কথা ভাববে তখনই অনুভব করবে, “এই পৃথিবীতে কোটি মানুষের ভীড়ে কোথাও না কোথাও একটি মানুষ, যে তোমাকে ভালোবাসে। এই একটি মানুষ যে কখনোই তোমার হ্্রদয় থেকে দূরে থাকেনি।’’
“যখন তোমার ভালোবাসার অবমাননা দেখে জীবনে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়বে, দেখবে তোমার বুকভরা অভিমান পদাহত হয়ে ধুলোয় পড়ে লুটাচ্ছে, যখন নিরাশায় বুক ভেঙে যেতে চাইবে, সেদিন এই ভেবে সন্ত্বনা পেয়ো প্রিয়, যে এই দু:খের সংসারেও অন্তত একজন ছিল, যে তোমায় বড্ড প্রাণভরে ভালোবেসেছিল।”
এ আমার নিজস্ব আকাশ, যেখানে আমি মনের সুখে উড়বো, ভাসবো । আমার নিজস্ব সমুদ্র, আমার ভূবন; যেখানে থাকবে শুধু আমারি বসবাস। তোমার ভেতর আমার বিচরণ থাকবে জনম জনম বহমান। বাহ্যিক কোন লালসার তরে নয়, হ্্রদয়ের তরে হ্্রদয়ের আদান প্রদান।
আমি আর কখনো তোমাকে বিয়ের কথা বলবো না। আমি চিরকাল এভাবেই তোমার অন্তরে থাকতে চাই; সংসারে নয়।
“যে জিনিস সকলের জ্ঞাতব্যের মধ্যে পাওয়া যায় সে জিনিস বড়ই সস্তা”। আমাদের সম্পর্কটাকে আমি কখনোই সস্তা হতে দিতে পারি না।
ওর কথাগুলো শুনে আমার হ্র্দয় উদ্বেলিত হয়ে কান্না আসছিল। বহুদিন এমন কান্না অনুভব করিনি আমি। ইচ্ছা করছিল আমার সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরি। বললাম, সোহেলী কাল ভোরে রূপা আসতেছে। আমি আমার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তোমাকে সময় দেয়ার জন্য। তবু আজকের সন্ধ্যাটা আমি তোমাকে দিতে চাই।
আমার কথা শুনে সোহেলী বলল, ইচ্ছেটা আমারো ছিল। আরো একটা বিশেষ প্রয়োজনে আমি তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম।
*
দুপুরের প্রচন্ড তাপদাহের পর অপরাহ্ন বেলায় আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেল। সন্ধ্যা নামার অনেক আগেই প্রকৃতিতে নেমে এলো সন্ধ্যারাণী। মনের ভেতর আশংকা, আজ শেষ বিকেলে সোহেলীর সাথে দেখা হবে তো? আকাশের যে অবস্থা, না জানি এই বর্ষণ কোনকালেই শেষ না হয়। অথচ যে করেই হোক যত কিছুই হোক আজকের সন্ধ্যাটা যেন সোহেলীকে ছাড়া পার হবার নয়। আর এমন একটি সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করছি, যে সন্ধ্যা মহাকালের ভেতর কখনোই যেন না ফুরায়।
আমার অপেক্ষমান সেই সন্ধ্যার পূর্ব মুহুর্তে বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিস্কার হয়ে উঠলো। মন থেকে আশংকা দুরীভূত হতেই সোহেলীকে ফোন দেই। সেও একইভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিল। প্রিয় মানুষটির জন্য অপেক্ষার চেয়ে মধুর আর কী হতে পারে! তাকে নির্দিষ্ট স্থানে আসতে বলে আমিও বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। মনে হচ্ছিল বহুদিন পর আজ আমি আমার প্রিয়জনের দেখা পাচ্ছি।
আর সেই মুহুর্তে রূপা আমার বাচ্চাকে নিয়ে আমার কাছে আসছে। সেও আমার প্রিয়জন।
আকাশে তখন গোধুলীর রং লেগেছে। প্রকৃতি সেজেছে মিষ্টি হলুদাভ বর্ণে। কনে দেখার ওই শুভ লগ্নে সামনে বিশাল জলরাশি নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি আমি আর সোহেলী। গোধুলীর আলোর প্রতিফলন নদীতে প্রতিফলিত, আর ধুয়ে ফেলা নীল আকাশের নিচে দুজন মানুষের একজন তার প্রিয়জনকে আজ কিছু বলতে চায়, সে তা শোনার জন্য অধীর অপেক্ষমান শ্রোতা।
এদিকে রূপা রাজশাহী এসে তার স্বপ্নের সংসার সাজাতে ব্যস্ত। এতদিন পরে এই প্রথম তাকে কাজেকর্মে এমন উৎসাহী দেখতে পাই। সংসার, সন্তান এবং আমার প্রতি তার বিশেষ খেয়াল, যা এর আগে কোনদিনই দেখিনি, আমার কাছে সবকিছু অস্বাভাবিক লাগছিলো। রূপার আর একটা ব্যাপার খুব চোখে পড়ার মতো। এমনিতেই সে কিছুটা গর্তজীবি মানুষ। তার উপর ইদানিং ধর্মকর্ম নিয়ে তার এমন আয়োজন, বিষয়টা আমার কাছে বাড়াবাড়িই মনে হচ্ছিল। শরীরের আপাদমস্তক মুড়ে নিজেকে এমন একটা রূপ দিয়েছে যেন বাজারে আমদানি কোন পন্যের নতুন মোড়ক। ওর সাথে যেন তাল মেলাতে আমার কষ্ট হচ্ছিল।
এমন অবস্থায় একরাতে একটি বিষ্ময়কর ঘটনা ঘটে, যা আমার কাছে রূপার অবস্থানকে কয়েক ধাপ নিচে নামিয়ে দেয় এক নিমিষেই। একদিন ঘুমের মধ্যে আমার কানের কাছে বাতাস অনুভব করি। চমকে উঠে দেখি রূপা বিরবির করে কি যেন পাঠ করছে আর আমার কানে ফু দিচ্ছে। একলাফে বিছানায় উঠে বসে আকষ্মিকতায় হাঁপাতে থাকি। জানতে চাইলাম বিষয়টা কি? সে বলল, কিছু না, তুমি ঘুমাও। চরম বিরক্ত মনে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু কথা বলার আর কোন আগ্রহই পাই না আমি। মুহূর্তেই বুঝে ফেলি আমাকে বশ করতে সে তান্ত্রিকতার আশ্রয় নিচ্ছে। আর তারজন্যই নিজের ওই নতুন রূপ। তবু বিষয়টা পরিস্কার করতে সে রাতেই কিছু পরিকল্পনা করে ফেলি মনে মনে।
চাকরী ছেড়ে আমার কাছে রূপার চলে আসাটাকে আমি কেন জানি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিনি। আমার মুখ ফুটে বলার আগে সে যদি আমার জন্য এমন কিছু করতো তাহলে আমার গর্বের সীমা থাকতো না। আমি রূপার সেই ত্যাগের মহিমা নিজের সবকিছু দিয়ে মূল্যায়ণ করতাম। কিন্তু তার এ আসা তো সেই আসা ছিল না। তাই রাজশাহী আসার পরেও ওর সাথে আমার সম্পর্কটা কেমন একটু কঠিনের মত ছিল। মনে হচ্ছিল হয় সে আমাকে করুণা করে নিজের চাকরী ছেড়ে দিয়েছে, নয়তো এই ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে আমাকে হারিয়ে দিয়ে নিজে বড় হতে চেয়েছে, নয়তো সোহেলীকে আমার কাছ থেকে দুর করার জন্য তার মনের এই অভিসন্ধি, নয়তো আমার উপর জেদ করে এটা করেছে।
বিছানা থেকে উঠে আমি বসার ঘরের সোফায় যেয়ে শুয়ে পড়ি। সারারাত আর ঘুম আসেনি। রূপার এই বিশেষ কায়দার ধর্মকর্ম এবং মধ্যরাতে ঘুমের মাঝে আমার কানে ফু দেয়ার রহস্য অনুসন্ধান করে রাত পার করেছি। পরের দিন সকালে আমাকে কি করতে হবে সেটা রাতেই ঠিক করে ফেলি।
ভোরের আলো ফুটতেই আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। অনেকদিন পর সকালের স্নিগ্ধ আলোয় একা একা পায়ে হেঁটে চলি অনেকটা পথ। ন’টার দিকে অফিসে যেয়ে আমার সহকারী বুলবুলকে কাজটি বুঝিয়ে বলি। প্রথমে আমার একটু সন্দেহ হয়েছিল। সেই সন্দেহ’র উপর ভর করে আমার কাজ এগোতে থাকলো এবং দুপুরের আগেই সমস্তকিছু আবিস্কার করে ফেলি।
ক’দিন থেকে লম্বা কোর্তা পরিহিত এক লোক আমার অনুপস্থিতিতে প্রতিদিনই আমার বাসায় আসতো। রুপা আমার মন থেকে সোহেলীর নাম ঠিকানা মুছে ফেলার জন্য তাকে কোথাও থেকে নিয়োগ করেছে। সে ঝাড়ফুক, তাবিজ-কবজ, চিনি পড়া, পানি পড়া এসব দিয়ে আমার অন্তর থেকে সোহেলী নামক শনিগ্রহ ধ্বংস করতে রূপার কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার। রূপার চিন্তাধারা এতটা শোচনীয় হলো কি করে! একটা শিক্ষিত মেয়ে এসবে তার বিশ্বাস! ভীষণ করুণা হচ্ছিল রূপার উপর। এত সংকীর্ণমনা একজন নারী কেমন করে আমার মনের নাগাল পায়!
ঘটনাটি জানার পর রূপার প্রতি আমার বিদ্বেষ আরো প্রকট হয়ে উঠলো। ওই লোকটাকে বুলবুল আচ্ছামত শিক্ষা দিয়ে দিয়ে এলাকা ছাড়া করলো। সে আর ভুলেও আমার বাড়ির পথ মাড়াবে না।
*
শেষ বিকেলের গোধুলির আলোয় সোহেলী আর আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে । আগের দিনের ব্যবহারের জন্য সোহেলী বেশ লজ্জিত এবং ক্ষমা চাইলো। আমিও সরি বললাম। আসলে আমরা দুজনই দুজনকে এত বেশি ভালোবাসি যে দূরত্বটা কেউই কামনা করি না। তবুও বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এতটুকু দূরত্ব আমাদের বজায় রাখতেই হচ্ছে। এখন পর্যন্ত রাগ করে বা ভুল বুঝে কেউ কারো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেইনি। এই প্রথমবার একটা পুরো রাত এবং পরের দিন বিকেল পর্যন্ত আমরা কথা বলিনি। বিষয়টা আমাকে যতটা কষ্ট দিয়েছে সোহেলীকেও ঠিক ততটাই কষ্ট অনুভব করতে হয়েছে। সে একদিনেই বুঝতে পেরেছে এ সমস্ত কথা বলে আমরা কেবল আমাদের মাঝের সুন্দর সম্পর্কটাকেই খারাপ করতে পারবো, কিন্তু কোন সমাধান দিতে পারবে না।
কিছু একটা বলার জন্য সোহেলী আকুঁপাকু করছিল। ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আমি বললাম, কোন সংকোচ না করে বলে ফেলো সোহেলী। আমার কাছে কিছু বলতে কখনো দ্বিধা করোনা তুমি।
সে তখন বলল, “তোমার কাছাকাছি থাকার জন্যই আমাকে তোমার থেকে দূরে থাকতে হবে।”
“পাপী যদি শাস্তি পায়, তাহলে সে এই বলে শান্তি পায় যে তার উপর অবিচার করা হচ্ছে না। এই শাস্তিই যে তার প্রাপ্য। কিন্তু না পেলে ভিতরের বিবেকের যে দংশন, তা নরক যন্ত্রনার চেয়েও অনেক বেশি ভয়ানক।” কথাটি আমার নয়, নজরুলের। অথচ আমার ক্ষেত্রেই তা সত্য বলে আজ প্রতীয়মান হচ্ছে।
সোহেলী বলল,“যাকে ভিতরে, অন্তরের অন্তরে পেয়েছি তাকে খামোকা বাইরের পাওয়া পেতে এত বাড়াবাড়ি আমি কেন করলাম!”
ওর কথাটার অর্থ না বুঝতে পেরে আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে তখন বলল, আমি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি।
মানে? একী বলছো তুমি? কোথায় যাচ্ছো? কেন?
ওর কথাটি শুনে আমার বিষ্ময়ের সীমা রইলো না। শুধু ভাবলাম সোহেলী দূরে চলে গেলে আমার কী হবে!
বলল, গতরাত থেকে শুধু এটাই ভাবছিলাম কেমন করে তোমার কাছ থেকে দূরে থাকা আমার সম্ভব হবে! বিয়ের এত বছর পরে তোমার বউ চাকরী ছেড়ে আসছে শুধু আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে রাখার জন্যই। আমি চাই না আমাকে নিয়ে তোমাদের দাম্পত্য জীবনে সামান্যতম অশান্তির সৃষ্টি হোক। কেননা আমি তোমার সুখের কারন হতে চাই; দু:খের নয়। আমাকে তোমার সামনে রেখে কেউ তোমাকে অসম্মান করবে এটা আমার সহ্য হবে না। আর সে এখানে থাকলে আমাদের সম্পর্কে আজেবাজে কথা তার কানে পৌঁছে যাবে। এমনকি আমার ফোন কিংবা দেখা করতে আসলেও তার কাছে তোমাকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। একজন নারী হয়ে আর একজন নারীর কষ্টের কারন হতে চাই না আমি। এখন থেকে সে কখনোই তোমাকে চোখের আড়াল হতে দিবে না। আর আমি যে চিরকাল তোমার সাথে কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম সেটাও কোনদিনও পূরণ হবার নয়। তোমার দূরত্বও আমার সইবে না। তার চেয়ে পথের দূরত্ব সৃষ্টি হোক তাই ভালো। মনে মনে এই সান্ত্বনা থাকবে যে ইচ্ছা করলেই তোমার কাছে আমি ছুটে যেতে পারি না। আমাদের মধ্যকার ভালোবাসা বেঁচে থাকুক অনন্তকাল। তাকে বাঁচিয়ে রাখতেই আমার এই দূরে চলে যাওয়া। যখন আমি দেশে আসবো তোমার সাথে দেখা করবো। আর ইন্টারনেটের এই যুগে বিশ্বের যেখানেই থাকি না কেন তোমার সাথে সবসময় যোগাযোগ থাকবেই। তুমি বেঁচে থাকবে আমার হ্্রদয়ে। আমাদের প্রেম আকাশের ঐ সূর্যের মতো উজ্জ্বল অমলিন হয়ে আলো দিতে থাকবে অনন্তকাল। যেমনটি ছিলে চোদ্দ বছর আগে। ঠিক সেই স্থানে অবিকল তোমার উপস্থিতি আমি অনুভব করবো। গতকালের মত কথা কাটাকাটি করে আর কোন মধুর সময়কে আমি কলুষিত করতে চাই না; যে সময়ের স্মৃতি আমাদেরকে তাড়া করে যাবে প্রতিটি মুহূর্ত।
কখনো যদি আমাকে ভুলে যাও তো আমার হ্্রদয় টের পাবে, আমার প্রিয়জনকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। তবে জানি আমি কখনো তোমাকে হারাবো না। যদি হারানোর মতো হতে তাহলে এভাবে তোমাকে ফিরে পেতাম না।
সেদিন যা কিছু বলার সোহেলীই বলল। আমি শুধু বললাম, সোহেলী তুমি আমাকে এতবড় শাস্তি দিতে পারবে?
সে বলল, যে শাস্তি তোমার জীবনে মঙ্গল বয়ে আনবে সেই শাস্তিকে ‘শান্তি’ রূপে গণ্য করো। আর ভেবে দেখো শাস্তিটা যতখানি তোমার, তারচেয়ে অনেক বেশি অংশে আমার।
আমি বললাম, তোমাকে দিনের পর দিন না দেখে আমিকি থাকতে পারবো সোহেলী? এরচেয়ে বরং সেই ভালো তুমি আমার চোখের সামনে থাকো। আমি রূপাকেও ঠকাবো না আর তোমাকেও হারাতে পারবো না। তুমি আমার জীবনে চলে এসো সোহেলী।
সে বলল, আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন কথা আর বলো না। এতে আমাদের কষ্টটাই বাড়বে শুধু । গতরাতেই আমি সাদিকে বলেছি । সেতো কত আগে থেকেই আমাকে নিয়ে বাইরে চলে যাওয়ার কথা বলতো। আমিই কোনদিন রাজি হইনি। এখন রাজি হয়েছি। শুনেতো সে মহা খুশি। সে আজ থেকেই সমস্ত ব্যবস্থা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তুমি শুধু দোয়া করো, “যে পথে আমি যথার্ত সুখি হবো সেই পথে তোমার আশির্বাদ চিরকাল রেখো” (রবীন্দ্রনাথের কথা)। আজকের পর তোমার সাথে আর দেখা হবে না আমার। কাল তোমার বউ আসবে। তুমি তাকে সময় দিও। তোমার ভালোবাসা থেকে তাকে বিন্দুমাত্র বঞ্চিত করো না। আর নিজে ভালো থেকো। মনে রেখো-
“কোনদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে
বসন্ত বাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেই ক্ষণে খুঁজে দেখো-কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রান্তে; বিস্মৃতি প্রদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নাম হারা স্বপ্নের মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সবচেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়,
সে আমার প্রেম।”
(শেষের কবিতার উর্ধ্বৃতাংশ)
আমার কান্না কিছুতেই ধরে রাখতে পারছিলাম না। নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে কাঁদতেছিলাম। ভেতরটা ভেঙে আসতেছিল। সোহেলী আমার আরো কাছে এসে দাঁড়িয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলল, তোমার কাছ থেকে আমার যা পাওনা ছিল তা আমি পেয়েছি। বিনিময়ে আমি যদি কিছু দিয়ে থাকি সেটাও ছিল তোমারি দান।
ওর হাতদুটি ধরে কাছে টেনে নিলাম। চোখের পানি মুছে দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। পৃথিবীর আকাশের সমস্ত গোধুলীর রং মুছে গিয়ে তখন সন্ধ্যা পরবর্তী রাতের নিস্তব্দতা । জনমানবহীন নদীর পাড়ে দুটি হ্্রদয় বলে গেল কত কত কথা। অনেকটা সময় নিয়ে সোহেলী আমার বুকে এঁকে দিয়ে গেল তার শেষ কান্নার জলটুকু। আমিও আর বাঁধা দিলাম না। যে মমতায় ওকে সেদিন জড়িয়ে ধরেছিলাম সেরকম অনুভূতি জীবনে ওই একটিবারই অনুভব করেছিলাম আমি। আমার অন্তরের সমস্ত ভালোবাসা কেমন চুম্বকের মতো শুষে নিচ্ছিল সে। যখন সোহেলীকে ছেড়ে দাঁড়ালাম নিজেকে কেমন ভারমুক্ত মনে হলো। একটা তৃপ্তি অনুভব করলাম। বললাম, “যা কিছু আমার ছিল আজ সবটাই উজাড় করে তোমাকে দিয়ে দিলাম। তোমার হ্্রদয়টা যেন সমৃদ্ধ করতে পারো সেই আশির্বাদ রইলো আমার।”
ফেরার পথে কারো মুখ থেকেই তেমন কোন কথা বেরোলো না। সোহেলীকে তার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে বিষন্ন মনে শূণ্য হাতে বাসায় ফিরে আসলাম। হাতটা শূণ্য থাকলেও আমার হ্্রদয়ভূমি সোহেলীর ভালোবাসায় কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। দেয়ালে একজোড়া টিকটিকির ছুটোছুটি দেখতে দেখতে একটি থমথমে রাত পার করলাম। দূরে কোথাও থেকে একটি নি:সঙ্গ ডাহুকের আর্তনাদ ভেসে আসছিল থেকে থেকে। সকাল হওয়ার অনেক আগেই বিছানাকে ছুটি দিলাম। তারপর ড্রাইভারকে ডেকে গাড়ি নিয়ে রূপাকে আনতে ষ্টেশনে গেলাম।
আমার পুরনো দাম্পত্য নতুন করে সংসার সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। “কারো জন্য জীবন থেমে থাকে না; কিন্তু জীবনে কারো কারো প্রভাব এমন করে মনের উপর অংকিত করে রেখে যায় যে, শত চেষ্টায়ও তাকে মলিন করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। জীবন থেমে না থাকলেও হ্্রদয়ে সুখময় স্মৃতির দেয়াল জুড়ে তাকে বয়ে নিয়ে যেতে হয় অনাদিকাল।”

 

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ