|
ঈদ এলো ঈদ গেলো, এবার ডেটলাইন জানুয়ারি
মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরোধীদলের এতোটা দৈন-দশা কখনো পরিলক্ষিত হয়নি
। সব সময় বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে সরকারীদলই কম বেশি চাপে থেকেছে । এমন
কি সামরিক শাসনামলেও বিরোধীদল সমূহ রাজপথের রাজনীতিতে এখনকার চাইতে অনেক
বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল । রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি
না পারছে রাজপথে কার্যকর আন্দোলন গড়তে, না পারছে সরকারকে মেনে নিতে ।
সরকারের নানামুখী কৌশলগত চাপে বিএনপি তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন
সময় অতিক্রম করছে । বিএনপি নেত্রী বাড়ী থেকে বিতাড়িত হয়ে অঝোরে কেঁদেছেন,
যা মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচারও হয়েছিল । নেত্রীর এই কান্না নেতা-কর্মীদের মধ্যে
সঞ্চারিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়নি, নয়তো চোখের জলে সারাদেশে আগুন জ্বলবার
কথা । তাছাড়াও খালেদা জিয়ার দুই সন্তান ফেরারী আসামী হয়ে বিদেশে পড়ে আছেন ।
নেত্রী মার্চ ফর ডেমোক্রেসির আন্দোলনের ডাক দিয়ে বাসার সামনে বালির ট্রাকের
ব্যারিকেটে আটকা পড়লেও ঢাকার বাঘা-বাঘা নেতাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি,
এমনকি সেদিন ঢাকার রাজপথতো নয়ই, অলিগলিতেও বিএনপির ন্যূনতম প্রতিবাদী
অবস্থান সাংবাদিকদের দৃষ্টিগোচর হয়নি । অসহায় খালেদা জিয়া সেদিন বাসার
কাজের মেয়ে এবং দু/চারজন ব্যক্তিগত স্টাফের উপস্থিতিতে বাসার আঙ্গিনায়
দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের সামনে বক্তব্য দিয়ে ঘরে ঢুকতে বাধ্য হন । বিএনপির এহেন
মহাপরাক্রমশালী নেতারা নিজেদের সাংগঠনিক দূর্বলতাকে আড়াল করতে সরকারের
আগ্রাসী ভূমিকাকে প্রধান করে তুলে ধরার চেষ্টা করেন । অথচ এর চাইতে অনেক
বেশি চাপে থাকা সত্ত্বেও জামাত-শিবির যতটুকু প্রতিরোধী ভূমিকা রাখতে সক্ষম
হয়েছিল বিএনপির নেতাকর্মীরা তার কিয়দংশও রাখতে সক্ষম হননি ।
খালেদা জিয়া নেতাদের এহেন ঝাড়িঝুড়ি সম্ভবতঃ বুঝতে পেরেছেন, তাই দলীয় বৈঠকে
নেতাদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার জন্য বকাঝকাও করেছেন । মোটকথা খালেদা জিয়া
অতীতের সব বাস্তবতাকে উপলব্ধিতে এনে সংগঠনকে আন্দোলনমুখী করতে ইতিমধ্যে বেশ
কয়েকটি জেলা শহরে জনসভা করেছেন, তৃণমূলে আশাব্যঞ্জক সাড়াও পেয়েছেন । তাছাড়া
নিজ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা এবং ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সাথে
সিরিজ বৈঠক করেছেন । এতে নিকট অতীতের ব্যর্থতার মূল্যায়ন সহ আগামীদিনের
কার্যকর আন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহন করেছেন, সরকারকে আন্দোলন দমনে সুযোগ না
দেয়ার স্বার্থে মিডিয়াতে সেই পরিকল্পনা বিস্তারিত তুলে ধরেননি । তবে
মোটাদাগে বলার চেষ্টা করেছেন, এইবার জানুয়ারীতে ঢাকা কেন্দ্রিক স্বল্প
সময়ের জোরদার আন্দোলনে সরকারকে নতি স্বীকারে বাধ্য করাবেন ।
অতীত ব্যর্থতার কারন বিএনপি নেতারা কীভাবে চিহ্নিত করেছেন, তা স্পষ্ট নয় ।
তবে সাধারন দৃষ্টিতে বর্তমান সময়কাল ব্যতিত নব্বইয়ের এরশাদ বিরোধী
আন্দোলনের পর বিএনপিকে রাজপথে তেমন ভাবে আন্দোলনের মুখাপেক্ষী হতে হয়নি,
এরশাদের পতনের পর ৯১তে বিএনপি ক্ষমতাশীন হয়, আবার ৯৬ থেকে ২০০১ বিরোধীদলে
থাকলেও আওয়ামীলীগ বিনা যঞ্চাটে ২০০১ এ তত্ত্বাবধায়কের হাতে ক্ষমতা দিয়ে
নির্বাচনে গেলে বিএনপি আবারো জনগনের ভোটে ক্ষমতাশীন হন । মোটকথা দীর্ঘ
২২/২৩ বৎসর আন্দোলন থেকে দূরে থাকা এবং সাংগঠনিক তৎপরতার অভাবে দলের মধ্যে
কোন সমন্বয় নেই । তাছাড়া দীর্ঘ দিন যাবত বিএনপির মূল শক্তি ছাত্রদল ৪০/৪৫
বছরের আদু ভাই মার্কা অছাত্র নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে এবং কয়েক যুগ
ধরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ থাকাতে ছাত্রদলে জং
ধরেছে । আর যুবদল এবং মূলদলের নেতারা চুলে কলপ দিয়ে ইয়াং সেজে পদপদবী ধরে
রাখলেও দেহমন রাজপথে বেমানান এবং বৃদ্ধ বয়সে জেলখানায়ও যেতে চান না । তাছাড়া
ক্ষমতাশীন অবস্থায় যা কামিয়েছেন, তা রক্ষনাবেক্ষনে সরকারের সাথে গোপন
সম্পর্ক রাখাকে শ্রেয় মনে করেন । তাই দিনের বেলায় খালেদা জিয়ার দৃষ্টি
সীমানায় থাকলেও রাতের অন্ধকারে সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের সাথে যোগাযোগে
ব্যস্ত থাকেন । তাই খালেদা জিয়া কর্মসূচীতে নেতাদের খুঁজে পান না । মোটকথা
দলটি বরাবরই ভোটের জন্য ফিট হলেও আন্দোলনের জন্য আনফিট ।
অন্যদিকে, যারা (আওয়ামীলীগ) এবার বিএনপিকে আন্দোলনের পরীক্ষায় ফেলেছে, তারা
ইতিপূর্বে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কাছে আন্দোলনের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল ।
আওয়ামীলীগ প্রথম ধাপে ৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত রাজপথে ছিল, দ্বিতীয় ধাপে ৯১ থেকে
৯৬ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়কের দাবীর আন্দোলন । ঐ সময় বিএনপি তত্ত্বাবধায়কের
আন্দোলনকে উপেক্ষা করে ১৫ ফেব্রয়ারী-৯৬তে একটি প্রহসনের নির্বাচনও সম্পন্ন
করেন, কিন্তু শেষাবধি তৎকালিন ঢাকার মেয়র মরহুম হানিফের নেতৃত্বে পরিচালিত
জনতার মঞ্চে সাবেক সচিব মহিউদ্দিন খান আলমগীরের নেতৃত্বে সচিবালয়ের
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নেমে আসলে আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতা আসে । তৃতীয় ধাপে
২০০১ থেকে ২০০৫ আজিজ-ইয়াজউদ্দীনদের ঠেকাতে রাজপথে লগি-বৈঠার আন্দোলন ।
বর্তমানে বিএনপির সমর্থক শুভাকাংখীদের মধ্য চরম হতাশা ও অসন্তুষ্টি বিরাজ
করছে, এর কারন আওয়ামীলীগের আন্দোলনের কারনে বিএনপি ১৫ই ফেব্রয়ারীর নির্বাচনে
গঠিত সংসদটি ১২ দিনের মধ্যেই ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হয়েছিল, অথচ আওয়ামীলীগ
অনুরুপ ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন করেও দিব্যি সরকার পরিচালনা করে যাচ্ছে, তদুপরি
এই সরকারটি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার দম্ভোক্তি করেই যাচ্ছে । অথচ বিএনপির
নেতৃত্ব কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছেন না । তাই সম্ভবতঃ খালেদা জিয়া
আওয়ামীলীগের অনুকরনে জনতার মঞ্চ গঠনের লক্ষ্যে সচিবালয়ের সচিব
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে সম্প্রতি গুলশানস্থ কার্যালয়ে গোপন বৈঠকে
বসেছিলেন । কিন্তু সচিব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নেতৃত্বদান নিয়ে
উদ্ভূত কোন্দলের কারনে বিষয়টি একটি গ্রুপ সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন । এতে
সরকারের হাতে ঐসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রুখে দেয়ার মোক্ষম অস্রটি চলে আসে
। এখন সরকার সরকারী চাকুরী বিধি লঙ্ঘনের দায়ে মিটিংয়ে যাওয়া সরকারী
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লিষ্ট তৈরী করছেন । আন্দোলন ও সরকারের পতনতো দূরের
কথা, চাকুরী রক্ষাই দায় । সরকার ইতিমধ্যে একজন যুগ্মসচিবকে উক্ত অপরাধে
বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছেন । দুর্ভাগ্য বিএনপির, আন্দোলন নামক গাছের যেই
ঢালটিই ধরছেন, সেই ঢালটি ভেঙ্গে পড়ছে । উপরন্ত খালেদা জিয়া জানুয়ারীতে
আন্দোলনের ঘোষনা দেয়াতে শেখ হাসিনা ডিসিসি নির্বাচনের কৌশলিক মূলা
ঝুলিয়েছেন । এতে সরকারের লাভ দু-দিকেই বিএনপি নির্বাচনে আসলে আরেকটি
আন্দোলনের অপমৃত্যু হবে, আর না আসলে সরকার অনায়েসে ডিসিসির ফলাফল নিজেদের
অনুকূলে নিয়ে আসবে । আর বিএনপি নির্বাচন ও আন্দোলন এই দুইটিকে সমান্তরালে
হাতে নিলে সরকার কিঞ্চিত বেকায়দায় পড়বে । তবে সরকারীদলের প্রার্থীর বিজয়ের
সম্ভাবনা দেখলে নির্বাচনটি করাবে অন্যথায় বিরোধীদলের আন্দোলনের গতিকে শ্লথ
করিয়ে একটা সময় যে কোন অজুহাতে নির্বাচনটি স্থগিত করাবে । তাছাড়া বিরোধীদল
তথা জোটে অশান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে বিরোধীদলের মধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থী
সৃষ্টি এবং এদের সুযোগ সুবিধা দানের কৌশল গ্রহন করবে । তবে আমার দৃষ্টিতে
শেষাবধি নির্বাচনটি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ ।
মোটকথা বিভিন্ন ভাবে বিএনপি-জামাত জোটের আন্দোলনকে দমিয়ে সরকার তাদের এক
বৎসর পূর্তির সন্নিকটে । ইতিপূর্বে বিএনপি দুই ঈদকে সামনে রেখেই ঈদের পর
সরকার পতনের আন্দোলনের ঘোষনা দিয়েছিলেন, কিন্তু এই ঘোষনা-ঘোষনাতেই সীমাবদ্ধ
ছিল । নেত্রী সংগঠনকে মাঠে নামাতে পারেননি । আর বিএনপির এই অবস্থা আঁচ করতে
পেরে বর্তমানে জামাত-শিবিরও আন্দোলনের নামে বিএনপির সাথে লুকোচুরি খেলছে ।
তারা তাদের দলের শীর্ষ নেতাদের জীবন রক্ষা ও সংগঠনকে নিষিদ্ধের কবল থেকে
রক্ষা করতে ব্যস্ত, এই মুহূর্তে দূর্বল বিএনপির সাথে সরকার পতনের আন্দোলনে
গিয়ে সরকারের বাড়তি রোষানলে পড়তে চায় না । তাই জোটের রাজপথের কর্মসূচীতে
যুদ্ধাংদেহী মনোবৃত্তি পরিহার করে দায়সাড়া গোচের উপস্থিতি প্রকাশ করছে । এই
নিয়ে বিএনপির মধ্যে অস্বস্থি বিরাজ করলেও নিজ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের উপর
কনফিডেন্স লেবেল তলানিতে ঠেকায় জামাতকে পরিহারও করতে পারছে না । তাই বলা
যায় বিএনপির ডেটলাইন জানুয়ারীর ভবিষ্যত অনিশ্চিয়তার ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন । শত
দূর্বলতার মধ্যেও বিএনপির এই হাঁক-ডাক দেখে বাঘ নিয়ে রাখাল বালকের গল্পটি
মনে পড়ে গেল । এই গল্পের পরিণতিই বিএনপির জন্য অপেক্ষা করছে কিনা তা
অল্পদিনের মধ্যেই জানতে পারব । গল্পটি দিয়েই লিখাটির ইতি টানছি ।
বাঘ নিয়ে রাখাল বালকের এই গল্পটি সবারই জানা । রাখাল বালকের বাঘ বাঘ চিৎকারে
গ্রামবাসী দু/তিনবার এগিয়ে এসে বাঘ না দেখলেও আড়ালে লুকিয়ে থাকা রাখাল
বালকের দুষ্টুমী দেখেছে, সত্যিকার অর্থে বাঘ আসার পর রাখাল বালকের চিৎকারে
কেউ এগিয়ে আসেনি, অতঃপর রাখাল বালক মারা পড়ল । ২০ দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা
জিয়া দুই ঈদের আগেই বলেছিল ঈদের পর সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন, কিন্তু ঈদ
এলো ঈদ গেলো জনগন আন্দোলন দেখলো না, আন্দোলন হুমকি-ধামকিতেই সীমাবদ্ধ রইলো
। বিএনপির আন্দোলন নিয়ে এহেন খামখেয়ালীপনায় সরকারীদলের নেতারা এখন খালেদা
জিয়া তথা বিএনপিকে নিয়ে রীতিমত হাসি-ঠাট্টাই করেন । খালেদা জিয়া এবার আবারো
বলছেন -জানুয়ারীতে সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন, নেতারা না নামলে উনি একাই
নামবেন । এবারো যদি ঘোষনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, নেতা-কর্মীরা মাঠে না নামেন,
আন্দোলন গড়তে না পারেন, আর সরকার ব্যাঘ্র-মূর্তিতে খালেদা জিয়াকে জেলে
ঢুকালে রাখাল বালকের পরিণতিই বরণ করতে হবে বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের
বর্তমান পর্বের রাজনীতি ।
লেখকঃ জাপান প্রবাসী।
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|