[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তস্নাত পবিত্র মাটি গ্রহন করবে কি রাজাকার কাদের মোল্লাকে!

  

 

মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম


ইতিহাসের অর্জন ও দায় সাময়িক সময়ের জন্য খন্ডিতকরন বা চাপিয়ে রাখা সম্ভব, তবে তা স্থায়ীভাবে সম্ভব নয় । সময়ের পরিক্রমায় একদিন না একদিন ইতিহাসের সত্যতা প্রকাশ পাবেই । ইতিহাস বড়ই নির্দয় নির্মম, কাউকে বেশী-কম মূল্যায়ন করে না, ইতিহাস সবার হিসেব সবাইকে বুঝিয়ে দেয় । ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না ।
আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে হাজারো বিতর্ক, মতান্তর, মূল্যায়ন ও অতিমূল্যায়ন হচ্ছে এবং হবেও বটে । কিন্তু তা অবশ্য-অবশ্যই সাময়িক সময়ের জন্য, যতই দিন যাবে ততোই ইতিহাস বিশুদ্ধতা অর্জন করবে । এজন্যই ইতিহাসবিদরা বলেন-ইতিহাস তৈরীর কুশীলবরা জীবিত অবস্থায় ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক হলেও ঐ কুশীলবদের মৃত্যুর পঞ্চাশ-একশ বছর পর গবেষকরা যে ইতিহাস তুলে আনবেন, তা হবে অনেকাংশে শুদ্ধ ও বিতর্কমূক্ত । ধরুন, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের কোন তরুন সাগ্রহে মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা বা মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা মহসিন মন্টু বা মুক্তিযোদ্ধা মায়ার কন্ঠে মুক্তিযুদ্ধ শুনতে চাইলেন, ওনারা যা বলবেন তাতে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ থাকবে, তবে তা প্রভাবিত হবে ওনাদের বর্তমান দলীয় অবস্থানের প্রেক্ষিতে । এতে তরুন দ্বন্দ্বে পড়বে, অবিশ্বাস করাও কষ্টকর কেননা ওনারা মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত কিংবদন্তী কুশীলব কিন্তু ইতিহাসবিদ যখন ইতিহাসের প্রকৃত সত্য অনুসন্ধানে গবেষনায় বসবেন তখন প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে । এতে করে পরবর্তী প্রজন্ম প্রকৃত সত্য ইতিহাস জানতে পারবে এবং সবার যথোপযুক্ত সন্মান দিতে পারবে । প্রকৃত সত্য নির্ভেজাল শুদ্ধ ইতিহাসের জন্য সময়ক্ষেপন কার্যকরী পন্থা হলেও জীবিত মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের কৃতকর্মের পুরস্কার এবং শাস্তি নিয়ে সময়ক্ষেপণ করা ঠিক না, জীবিত অবস্থায় যথাযথ মূল্যায়ন অধিকতর বাঞ্চনীয় ।
স্বাধীনতা পরবর্তী সুদীর্ঘ বিয়াল্লিশটি বছর রাজাকার গোষ্ঠি বহাল তবিয়তে ছিল, দম্ভ ও হুংকার দিয়েও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল । আমরা কজনইবা মনে করতাম এদের বিচার হবে, শাস্তি ভোগ করবে, ওদের জীবদ্দশায়- এই বাংলায় । ওদের পক্ষে দেশে-বিদেশে কত চেষ্টা তদবির হাক-ডাক ছিল, দম্ভ করেই বলতো, ওদের টিকিটিও কেউ স্পর্শ করতে পারবে না, বাংলাদেশ নাকী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাঁই করে দিবে, আরো কত কী ! তবে সব কিছুকে মিথ্যা প্রমান করে, ওঁড়িয়ে দিয়ে বীর বাঙ্গালী এগিয়ে যাচ্ছে রায় কার্যকরের দিকে । বাস্তবিক অর্থে এটাই ইতিহাসের বাস্তবতা, আমরা মানি আর না মানি । এই ঘৃণিতদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না । এবাবে ক্রমান্বয়ে বাঙ্গালী জাতির দায়-মুক্তি আসবে ।
মুক্তিযুদ্ধের খলনায়কদের শাস্তিদান প্রক্রীয়া নিয়েও পক্ষ বিপক্ষ অবস্থান, কারো দৃষ্টিতে বাড়াবাড়ি, কারো দৃষ্টিতে শিথিলতা দেখাচ্ছে রাষ্ট্র । ভাবছেন, জীবদ্দশায় রাজাকারদের ফাঁসীর রায় কার্যকর হচ্ছে, শিথিলতা কোথায় ! অপরাধের শাস্তি বিবেচনায় সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা । তারপরও শিথিল বলছি, কারন কুখ্যাত রাজাকার কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসীর রায় কার্যকরের ঘোষনা পরবর্তীতে কাদের মোল্লার সাথে তার স্ত্রী ছেলে মেয়ে ও আত্মীয়-পরিজনদের জীবিত অবস্থায় শেষ সাক্ষাতের প্রতিবেদন এবং কাদের মোল্লার ফাঁসী কার্যকরের পর মরদেহ বহনকারী এ্যাম্বুলেন্স ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা ও কবরস্থ করার দৃশ্য দেখে কারো মনে যদি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি বা দয়া ভাব জাগে এটাকে কীভাবে দেখবেন, এটা কী দয়া বা সহানুভূতি নয় ! আমার বিবেচনায় জীবিত রাজাকারদের শাস্তি ফাঁসী হলেও তাতে ঘৃণার তীব্রতা কম । কারন আমরা দেখছি জীবিত রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসী ও তার পরিবারের আকুতি, কিন্তু ৭১ এ কাদের মোল্লার হিংস্রতায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন ও তাদের পরিবারের হাহাকার আহাজারী পত্রিকা ও টিভি মিডিয়ায় অনেকাংশে অনুপস্থিত । যা কোন না কোন ভাবে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার পক্ষেই যাচ্ছে । তবে এ ক্ষেত্রে পত্রিকা ও টিভি মিডিয়ায় আরো যত্নশীল রিপোর্টিং প্রয়োজন ।
অন্য বিবেচনায়, এই ঘৃণিত রাজাকারদের স্বাভাবিক মৃত্যু পরবর্তীতে ৫০/১০০ বৎসর পরও যদি ঠিক এই প্রতিকী বিচার ও প্রতিকী রায় হতো, সেক্ষেত্রে ঘৃণা-শ্লেষ ও ধীক্কারের তীব্রতা অনেক বেশী প্রখর হতো, দয়া-মায়া সহানুভূতির প্রশ্নই ওঠে না । তাই বলে আমি জীবিত অবস্থায় শাস্তির বিপক্ষে তা নয়, শুধুমাত্র রাজাকার সমর্থকগোষ্টীকে স্মরন করিয়ে দিচ্ছি আপাতঃ কম ঘৃণা বা শাস্তিটুকু মেনে নাও, যদি এমনটাও হয় এই ঘৃনিত অভিশপ্ত কূলাঙ্গার রাজাকার কসাই কাদের মোল্লাকে স্বাধীন বাংলার মাটি গ্রহনে দ্বিধা করছে এবং ফরিদপুর তথা সমগ্র দেশের জনগন বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে, তাও মেনে নিতে হবে কেননা এই বাংলার মাটিকে ওরা পাকিস্থানীদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল, শুধু তা করেই ক্ষান্ত হয়নি এই রাজাকারগোষ্টী, ওরা পাকিস্থানীদের পক্ষ নিয়ে এই মাটিকে রক্তে ভাসিয়েছে, মা-বোনের সম্ভ্রম লুটেছে । আজ কেন মুক্তিযোদ্ধার রক্তস্নাত মাটিতে এই অভিশপ্তের চিরনিদ্রার স্থান হবে ? এইতো সেইদিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতালীর যুদ্ধাপরাধী এরিখ প্রিব রোমের সামরিক আদালত কতৃক যাজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে শাস্তি ভোগ অবস্থায় ১০০ বছর বয়সে ১১ অক্টোবর ২০১৩ ইং ইতালীর কারাগারে মৃত্যু বরন করেন । দন্ডাবস্থায় স্বাভাবিক মৃত্যুবরণের মধ্য দিয়ে এরিখ প্রিবের শাস্তি শেষ হয়নি, চরম শাস্তি ও ঘৃণা জানিয়েছিল ইতালীর লাজিলা শহরের বিক্ষুব্ধ জনতা, বিক্ষুব্ধ জনতা লাশবাহী গাড়ীর ওপর হামলে পড়ে গাড়ীতে লাথি মারে এবং লাজিলা শহরের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীকে সমাধিস্থ করতে বাঁধা দেয় এবং শেষোবদি বিক্ষুব্ধ জনতার ঘৃণা ও ক্ষোভই জয়ী হয় এবং লাশবাহী গাড়ী হিমাগারে ফেরত নিতে সরকার বাধ্য হন ।
যাহোক, মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাপরাধীদের সন্মান ও ঘৃণাকে সময়ের ফ্রেমে নির্ধারন করা যায় না । আজকের বাংলাদেশ রাজাকারদের শাস্তি স্বরূপ ফাঁসী দিয়ে হয়তঃ এখনকার দায়িত্ব পালন করবে, আবার ভবিষ্যত প্রজন্ম ভবিষ্যতের দায়িত্ব পালন করবে । ভবিষ্যত প্রজন্ম যদি বৎসরের বিশেষ কোন নির্ধারিত দিনে দেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজাকারদের ঘৃণা প্রকাশের প্রতিকী কর্মসূচী হিসেবে থুথু নিক্ষেপের কর্মসূচী গ্রহন করে, তা হবে ঘৃণা প্রকাশের অধিকতর কার্যকরী পন্থা । ভাববেন না, এই রাজাকারগোষ্ঠীকে এতোটা ঘৃণার দরকার কী ! অবশ্যই দরকার আছে, মুসলমানের কবরে থুথু দিয়ে ঘৃণা প্রকাশের রীতি কল্পনা করতে পারেন ! নিশ্চয়, তা চিন্তাতীত বিষয় । কিন্তু রাজাকারদের পেয়ারে দোস্ত পাকিস্থানীরা আমাদের স্বাধীনতার সর্বোচ্চ খেতাবধারী বীরশ্রেষ্ট মতিউরের কবরের সাইন বোর্ডে লিখে দিয়েছিল-এ জাতীয় গাদ্দার, একে থুথু দিন । তাহলে আমরা কেন পারব না ! আমরা ঘৃণা প্রকাশের থুথু রীতি রাজাকারদের কবরে নয়, বিশেষ দিনে সম্মিলিতভাবে সব রাজাকারের ছবিতে করতে পারি ।
স্বাধীনতার সর্বোচ্চ খেতাবধারী বীরশ্রেষ্ট মতিউরের কবর পাকিস্থানীদের ঘৃণার হাত থেকে রক্ষা করে যথোপযুক্ত সন্মান দিয়ে স্বাধীন দেশের পবিত্র মাটিতে শায়িত করতে ৩০ বছর লেগেছিল । এভাবেই সময়ের পরিক্রমায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্রে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন হবেন । অন্যদিকে রাজাকারগোষ্টী ঘৃণাভরে প্রত্যাখাত হবে । ভবিষ্যত প্রজন্ম ওদের ঘৃণা জানাতে থুথু কর্মসূচীসহ অপরাপর কর্মসূচী গ্রহন করবে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তস্নাত পবিত্র মাটি থেকে রাজাকারদের লাশ অপসারনের আওয়াজ তুলবে।


লেখকঃ জাপান প্রবাসী

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ