[প্রথমপাতা]
|
এই খেলায় হারবে কে? বিএনপি নাকি জামাত!
মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম
শিরোনাম দেখে প্রশ্ন জাগতে পারে, বিএনপি-জামাতের মধ্যে কোন প্রীতি ফুটবল বা
ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন করা হয়েছে ! নাকি সামনে কোন নির্বাচনী লড়াই আছে ! না,
খেলা-ধূলা নয়; আর অদূর ভবিষ্যতে কোন নির্বাচনও নেই । তাহলে হারজিতের প্রশ্ন
আসবে কেন ? ঠিক হারজিৎ নয়, তা হচ্ছে এই দুই দলের সাথে ক্ষমতাশীন আওয়ামীলীগ
যে কৌশলের খেলা খেলছে এতে দিন-দিন রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টে নতুন দিগন্তের
উন্মেষ ঘটতে যাচ্ছে । আর তারই আদ্যোপান্ত বিশ্লেষনের চেষ্টা করব এ-পর্যায়ে
।
রাজনৈতিক দলের উত্থান-পতনের ইতিহাস কমবেশী সবারই জানা । ৬৪/৬৫ সালে কেউ
ভাবেনি আওয়ামীলীগ ৭১ এ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বে দিবে এবং ৭৬/৭৭
এ বিএনপিকে কেউ ভাবেনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দলের মর্যাদা লাভ করবে
আবার ৮২ তে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ নয় বছর টিকতে পারবে,
এমনটা ছিল কল্পনাতীত বিষয় । অন্যদিকে মুসলিমলীগ ও ভাসানীর ন্যাপের মত দল
হারিয়ে যাবে আবার স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারনকারী দল হিসেবে জামাত বহাল তবিয়তে
উত্থানের ধারায় থাকবে । এই সবই রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্থান-পতনের নির্মম
বাস্তবতা ।
কোন রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে আদর্শিক লড়াইয়ের ঘাটতি থাকলে বা একাধিক দলের
মধ্যে জনগনের আস্থা অর্জনের প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পড়লে ধীরে-ধীরে ঐ দলটি তার
হারিয়ে যাওয়াকে নিশ্চিত করে । দমন-পীড়ন ও সুবিধা দিয়ে রাজনৈতিক দলের ধ্বংস
ও বিকাশ সম্ভব নয়, বর্তমান সময়ে জামাত ও জাতীয় পার্টি তারই অন্যতম নিদর্শন
।
যাহোক, বর্তমান জাতীয় রাজনীতির নিরুত্তাপ পরিবেশ সত্যিই কি অলস ভাবে কাটছে,
নাকী ধীরে-ধীরে নতুন কোন রাজনৈতিক সমীকরনের দিকে মোড় নিচ্ছে । বর্তমান
রাজনীতির চালচিত্র বিবেচনায় রেখে একটি কাল্পনিক দৃশ্যপট তুলে ধরব ।
এখন পর্যন্ত দেশের অন্যতম প্রধান দুটি দল হচ্ছে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি আর
উপজেলা নির্বাচনের পূর্বে তৃতীয় প্রধান দলের স্বীকৃতি ছিল জাতীয় পার্টির,
যা এখন জামাতে ইসলামের দখলে এবং বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে একমাত্র
বাসদ(খালেকুজ্জামান) ছাড়া অন্যরা ক্ষয়িঞ্চু পর্যায়ে অথবা কোনভাবে টিকে আছে,
তাছাড়া ড.কামাল হোসেন,ডাঃ বদরুদ্দৌজা চৌধুরী, কর্ণেল অলি আহমদ ও বঙ্গবীর
কাদের সিদ্দিকীদের মত নেতা কেন্দ্রীক দলগুলি বড় জোড় ওনাদের জীবদ্দশা
পর্যন্ত টিকে থাকবে, এমনটা জ্যোতিষী না হলেও বলা সম্ভব । এর বাহিরে পীর
মাশায়েক বা মাদ্রাসা কেন্দ্রীক দলগুলি হয়তঃ টিকে থাকবে কিন্তু মূলধারায়
প্রভাব রাখার মত দলে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা নাই বললে অত্যুক্তি হবে না ।
যাহোক, দৃশ্যপটটি আঁকবো আওয়ামীলীগ বিএনপি ও জামাতকে ঘিরে । দেশের প্রাচীনতম
দল হিসেবে আওয়ামীলীগ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক অর্জনে নেতৃত্ব দানের
অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ দল যার তৃণমূল পর্যায়েও সংগঠন বিস্তৃত আর ঐ বিবেচনায়
স্বাধীনাত্তোর দল হিসেবে বিএনপির সংগঠন তৃণমূলে বিস্তৃত থাকলেও সফল
আন্দোলনের অভিজ্ঞতা একমাত্র স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, তাও আবার একক
আন্দোলন নয়, জোটগত আন্দোলনেই স্বৈরাচারের পতন হয় । আর জামাতে ইসলামী
স্বাধীনতা যুদ্ধে কলংকজনক ভূমিকার কারনে স্বাধীন দেশে নিষিদ্ধ ছিল, যা ৭৫
পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হাত ধরে রাজনীতিতে পূনর্জন্ম লাভ
করে, ইতিমধ্যে সংগঠনটি ত্যাগী কর্মী বাহিনীর উপর ভর করে সারাদেশে কমবেশী
প্রসার লাভ করেছে এবং সংগঠন সম্পৃক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শক্তিশালী ভীত
গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, যা অন্যান্য সংগঠনের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত ।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধে বিচারে গঠিত
ট্রাইব্যুনালের কারনে জামাত ব্যাপক চাপে পড়ে, জামাতের প্রথম শ্রেনীর প্রায়
সব নেতৃত্বই ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন হয়ে জেলে আছেন এবং এরই মাঝে আবদুল
কাদের মোল্লার ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে । এছাড়া অন্য একটি আইনী মামলায়
সংগঠনটির নিবন্ধনও বাতিল হয়েছে এবং ৭১ এ সংগঠনগত অপরাধের দায়ে সংগঠনটি
নিষিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনাও আছে । ইতিমধ্যে জামাত পরিস্থিতি মোকাবেলায় তার
সর্বশক্তি নিয়োগ করে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে । অথচ ২০০৯/১০
সালে জামাতের ধারনা ছিল বিএনপির সহযোগীতা ব্যতিত সরকারীদল আওয়ামীলীগকে
রাজপথে মোকাবেলা সম্ভব নয়, যা গোলাম আযমের এ্যারেষ্ট পূর্ববর্তী সময়ে উনার
বিভিন্ন টিভি সাক্ষাৎকারে প্রকাশ পেয়েছে । জামাতের থিংক ট্যান্ক অধ্যাপক
গোলাম আযম বিভিন্ন সমীকরন দেখিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন বিএনপি ও জামাতের
জোটগত অবস্থান আওয়ামীলীগের জন্য হুমকী, তাই আওয়ামীলীগ জামাতকে বিএনপি থেকে
বিচ্ছিন্নকরন এবং জামাতকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হিসেবে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে
সামনে এনেছে ।
এটাও সত্য আওয়ামীলীগ ক্ষমতাশীন হয়ে প্রথমে জামাতকে চতুর্মুখী চাপে ফেলে আর
এই চাপ মোকাবেলায় জামাত প্রত্যাশানুযায়ী বিএনপিকে পাশে পায়নি, এমনকি সরকার
বিরোধী আন্দোলনেও বিএনপি তাদের সংগঠনকে মাঠে নামাতে পারেনি । মূলতঃ জামাত
নিজ দলের কর্মসূচী ও জোটের কর্মসূচীতে রাজপথে প্রধান শক্তি হয়ে লড়েছে । ফলে
জামাত যে একক ভাবে যে কোন সরকারীদলকে মোকাবেলায় সক্ষম, তা এখন জামাত-শিবির
কর্মীরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে ।
অতীতে সরকারীদল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জামাতকে বিএনপি জোট থেকে
বের করার চেষ্টা করেও সফল হয়নি । তার কারন জামাত তার একক শক্তি সম্পর্কে
তখনও সন্দিহান ছিল, তাই বিএনপির সাথে থাকাটাকে স্বস্তিদায়ক মনে করতো ।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় জামাত যে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তাতে বিএনপি
ছাড়াও একক শক্তিতে জামাত যথেষ্ট কনফিডেন্ট ।
এইতো রাজপথে শক্তিমত্তার হিসেব, কিন্তু রাজপথের রাজনীতি যখন ভোটের
স্বীকৃতির দরকার পড়ে, তখন ভোটের মেরুকরনই নির্ধারন করে দেয় কোন দলটি
রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্জন করবে । ভোটের রাজনীতিতে সারাদেশে এখনও
আওয়ামী ও এ্যান্টি আওয়ামী ভোটের হিসাবটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় । এর বাহিরে
বামপন্থী ও ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির আদর্শগত কর্মী সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীর
ভোট আছে, যার পরিমান এখনও উল্লেখযোগ্য নয় । এখন পর্যন্ত এ্যান্টি আওয়ামী
ভোটের অন্যতম প্রধান দাবীদার বিএনপি এবং এ্যান্টি আওয়ামী রাজনীতির
অন্যদলগুলি বিএনপিকে ঘিরেই পরিচালিত হয়, তার মধ্যে জামাত দ্বিতীয় প্রধান
শক্তিতে পরিণত হয়েছে ।
সরকারীদলের প্রধান প্রতিদ্বন্ধী বিএনপির জোট থেকে জামাত এই পর্যায়ে সরে
দাঁড়ালে বা নিষ্কৃীয়ভাব দেখালে লাভ-ক্ষতির হিসেবটা কেমন হবে । এরই মাঝে
প্রমান হয়েছে রাজপথে জামাতই জোটের অন্যতম প্রধান শক্তি অথচ নির্বাচনী
রাজনীতির ফসল তুলে বিএনপি । স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসবে রাজপথের শক্তিহীন
বিএনপি এ্যান্টি আওয়ামী ভোটারদের আস্থা এভাবে কতদিন ধরে রাখতে পারবে ?
রাজপথের শক্তিহীন বিএনপি জনগনের আস্থা হারালে তা কোন দলের পক্ষে যাবে ?
স্বাভাবিকভাবে এখন পর্যন্ত এ্যান্টি আওয়ামী রাজনীতিতে জামাতই একমাত্র
পরীক্ষিত বিকল্প শক্তি । এভাবে বিএনপির অসাড়তায় এ্যান্টি আওয়ামী ভোটে
জামাতের উত্থান ঘটলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না ।
তাই এখন বিএনপির সামনে কঠিন প্রশ্ন জামাত বিহীন বিএনপি বা নিষ্কৃীয় জামাতকে
নিয়ে বিএনপি কী পারবে রাজপথ উত্তপ্ত রাখতে ? বিএনপি কী পারবে তার
নেতা-কর্মীদের রাজপথে নামাতে ? নাকী জামাত ধীরে-ধীরে দখল নিবে এ্যান্টি
আওয়ামী ভোট ব্যাংকের হিসেব-নিকেশে ।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের কিছু ঘটনা বিএনপিকে জামাত সম্পর্কে
ভাববার ক্ষেত্র তৈরী করে দিয়েছে । লক্ষ্যণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে- এক) সরকারীদল
গণজাগরনকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে । দুই) দীর্ঘদিন ধরে
ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম মন্থরগতিতে এগুচ্ছে । তিন) জামাত-শিবিরের উপর
পরিচালিত সরকারের স্টীম রোলার পরিবর্তীত হয়ে বিএনপির উপর ভর করেছে । চার)
সরকারীদল উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের জয় ছিনিয়ে নিলেও জামাত
প্রার্থীদের ছাড় দিয়েছে, তা না হলে মাঃ দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ছেলের জয়
সরকার অবশ্যই ছিনিয়ে নিত । তাছাড়া সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে- উল্লেখযোগ্য আসনে
সরকারীদল চেয়ারম্যান পদে পাস করলেও ভাইস চেয়ারম্যান পেয়েছে জামাত । পাঁচ)
এতবড় বিজয়ের পরও জামাত সরকার বিরোধী বক্তৃতা-বিবৃতিতে রহস্যজনক নীরবতা পালন
করছে । এমনকী বিএনপির তিস্তা অভিমুখের লংমার্চ ও গুম খুন নিয়ে গণঅনশনে
জোটভূক্ত অন্যদলের নেতারা উপস্থিত হলেও জামাতের উপস্থিতি ছিলনা ।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মধ্যে অনেকে মনে করেন জামাত ও সরকারের মধ্যে পর্দার
অন্তরালে কোন ধরনের সমঝোতায় হয়েছে । এক্ষেত্রে জামাত হয়তঃ বিগত সরকারের
আমলে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব গ্রহন না করে যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল তার
হিসাব-নিকাশকে বিবেচনায় রেখেছে । তাছাড়া বিএনপিসহ আন্দোলন করে সামনের
দিনগুলোতে এই সরকারের পতন ঘটাতে পারবে তারও সম্ভাবনা কম, সেহেতু সরকারের
সাথে পর্দার অন্তরালে সম্পর্ক রেখে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিতে চাইবে । এতে
জামাত নিষিদ্ধ হলেও সমঝোতার কারনে নতুন নামে লাইসেন্স প্রাপ্তী সহজ হবে এবং
নতুন জামাতের রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনে সরকার বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না এবং
সরকার যতোটা সম্ভব ট্রাইব্যুনালকে নমনীয় রাখবে এবং বিনিময়ে জামাত সরকার
বিরোধী আন্দোলনে নিষ্কৃীয় এবং নমনীয় ভাব দেখাবে, এতে সরকার নির্ধিদ্ধায়
পাঁচটি বছর কাটিয়ে দিতে পারবে । কিন্তু সার্বিক রাজনীতি এবং স্ব-স্ব দলের
কর্মী সমর্থকদের আস্থা-বিশ্বাস ধরে রাখার স্বার্থে উভয় দলই পর্দার
অন্তরালের সমঝোতাকে অস্বীকার করবে ।
রাজনীতির এইসব মারপ্যাচের কারনে ভবিষ্যত রাজনৈতিক মেরুকরনে পরিবর্তনের
ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে । রাজনীতি বিশ্লেষকদের কেউ-কেউ মনে করেন- বিএনপি যদি
বর্তমান মেয়াদেও তত্ত্বাবধায়কের দাবী আদায় করতে না পারে এবং আগামী
নির্বাচনে জামাতকে পাশে না পায় এবং সরকার যদিও ছয়-নয় করে তৃতীয়বার ক্ষমতা
ধরে রাখে, এই দীর্ঘ বিরতীর কারনে বিএনপির রাজনৈতিক অস্তিত্ব সংকটে পড়বে ।
আর বিএনপির এই অস্তিত্বের সংকটে এ্যান্টি আওয়ামী ভোটাররা কমবেশী জামাতের
দিকেই ঝুঁকবে এবং অদূর ভবিষ্যতে জামাতই এ্যান্টি আওয়ামী ভোটারদের মূল
আশ্রয়স্থলে পরিণত হবে । আর এই কর্মপরিকল্পনা মাথায় রেখে জামাত তার সাংগঠনিক
কর্মকৌশল নির্ধারন করলে বিএনপি যুগ বা অধ্যায়ের অবসান ঘটার যথেষ্ট সম্ভাবনা
আছে ।
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|