প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

 এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 


আমার ভাস্কর্য প্রীতি এবং হাচিকোর স্মৃতি

 

 

-লুৎফর রহমান রিটন- 

 

 

লিবার্টিকে আমেরিকা স্ট্যাচু বানিয়ে রেখেছে! নাম দিয়েছে ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’। নিউ ইয়র্কের ব্যাটারি পার্ক-এর ফেরি ঘাট থেকে ছোট ছোট জাহাজে করে পর্যটকরা ছোটেন দলে দলে, সেই স্ট্যাচু অথবা লিবার্টি সন্দর্শনে। জাহাজগুলো ঘন্টায় ঘন্টায় ব্যাটারিপার্ক ফেরি ঘাট থেকে হাডসন নদীর মুখে লিবার্টি আইল্যান্ডে পৌঁছে দেয় পর্যটকদের। ফিরতি জাহাজও ঘন্টায় ঘন্টায়। লিবার্টি অঞ্চলে যতোক্ষণ খুশি থাকতে পারে দর্শনার্থী। সকাল থেকে বিকেল অবধি। আমেরিকার অন্যতম সেরা এবং জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট এট্রাকসন এই স্ট্যাচু। আলোর মশাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা তামার তৈরি বিশাল এক নারীমূর্তি এই ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’। মজার ব্যাপার হচ্ছে— বেদিসহ প্রায় তিনশ ছয় ফুট উঁচু আমেরিকার বহুল পরিচিত প্রতীক বা সিম্বল এই ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ আমেরিকার নিজস্ব নির্মাণ নয়। আমেরিকার শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে ফ্রান্স এটা উপহার হিশেবে আমেরিকাকে দিয়েছিলো ১৮৮৬ সালে। ফ্রান্স-আমেরিকার বন্ধুত্বের নিদর্শন-স্মারকটি পরবর্তীতে সারা পৃথিবীর মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্র হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিউইয়র্ক ভ্রমণকালে পর্যটকরা অবশ্যদর্শনীয় স্থানতালিকার শীর্ষে রাখেন এই স্মারকটিকে।

১৯৯৯ সালে স্ত্রী-কন্যাসহ আমেরিকা ভ্রমণকালে আমিও রেখেছিলাম। বিখ্যাত মূর্তি বা স্ট্যাচুর সঙ্গে ছবি তোলা আমার প্রিয় একটা শখ। তো প্রচুর ছবি তুলেছিলাম চারলক্ষ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড ওজনবিশিষ্ট ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র সঙ্গেও। আমার ব্যক্তিগত য়্যালবামে ছবিগুলো অনেক যত্নে রাখা আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের সামনে ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের ‘অপরাজেয় বাংলা’র সঙ্গে প্রচুর ছবি তুলেছি একসময়, বাংলা বিভাগের ছাত্রথাকালীন। এখন সেই ছবি দেখি আর হাসি—এককালে আমিও কীনা রোগা-পটকা ছিলাম! পিলখানার বিডিআরের মূল ফটকের কাছে জিগাতলা মোড়ের ‘আজকের কাগজ’ কার্যালয়ে সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদ শিল্পী রাশাকে দিয়ে নির্মাণ করিয়েছিলেন জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি মুখমন্ডল ভাস্কর্য। বঙ্গবন্ধুর আদলটিকে ঠিকমতো ফুটিয়ে তুলতে না পারলেও নব্বুইয়ের দশকে মোটামুটি আলোচিত হয়েছিলো ঘটনাটা। ছবি একটা তুলেছিলাম বটে, সেই ভাস্কর্যটির সঙ্গেও। উদয়ন বিদ্যালয় পেরিয়ে তিন রাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের নামে ভয়াবহ একটা ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন ভাস্কর শামীম শিকদার। শরীরের সঙ্গে মাথার কিংবা মাথার সঙ্গে হাতের কিংবা কাঁধের প্রপোসনে বিশাল গ্যাঞ্জাম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্কর্যটি আমাকে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করেনি। বঙ্গবন্ধুর অবয়বের লেশমাত্র আসেনি সেই ভাস্কর্যে। বিকটদর্শন সেই ভাস্কর্যের সঙ্গে ছবি তোলারই সাহস হয়নি আমার!

শিশু একাডেমীর ভেতরে চমৎকার একটা ভাস্কর্য আছে। নাম ‘দুরন্ত’। বিষয়--একটি বালক ‘চাক্কি’ চালাচ্ছে। অসাধারণ সেই ভাস্কর্যের শিল্পী ছিলেন বয়েসে নবীন সুলতানুল ইসলাম। সুলতানের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমি বিটিভিতে। এই ভাস্কর কার্টুনও আঁকতেন। উন্মাদের প্রথম দিককার সংখ্যাগুলোতে প্রচুর কার্টুন আছে সুলতানের আঁকা। ‘দুরন্ত’র সঙ্গেও অনেক ছবি তুলেছি। ভাস্কর্যের সঙ্গে ছবি তুলতে আমার ভালো লাগে।

১৯৯৭ সালে স্ত্রী-কন্যাসহ ইংল্যান্ড বেড়াতে গেলে অনুজপ্রতীম সৈয়দ আবুল মনসুর লিলু একদিন লন্ডনের বিখ্যাত একটি পার্ক ও অন্যান্য দর্শনীয় জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলো। লন্ডনের বিখ্যাত বিগবেন-এর কাছাকাছি একটা জায়গায় চার্চিল-এর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে বিপুল আগ্রহে কয়েকটা ছবি তুলেছিলাম। বন্ধু সৈয়দ নাহাস পাশা নিয়ে গিয়েছিলো মাদাম ত্যুশো মিউজিয়মে। ওখানে পৃথিবীর তাবৎ বিখ্যাত মানুষদের মোমের মূর্তি আছে। আমার কন্যা নদীর আগ্রহ ছিলো ‘টার্মিনেটর টু’ খ্যাত সোয়েজনেগারের দিকে। আর স্ত্রী শার্লি গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো মেরিলিন মনরোর পাশে। সবাইকে বাদ দিয়ে আমি প্রচুর ছবি তুলেছিলাম আমার প্রিয় চার্লি চ্যাপলিন আর মাইকেল জ্যাকসনের সঙ্গে।

অটোয়ার পার্লামেন্ট হিল এলাকায় টেরি ফক্স-এর একটা ভাস্কর্য আছে। সারা দুনিয়ায় অনন্যসাধারণ চরিত্র টেরি ফক্সের নামে ম্যারথন রেস হয়। বাংলাদেশেও হয়। অটোয়ার এই টেরি ফক্সের সঙ্গে গত বছরও ছবি তুলেছি মুনতাসীর মামুন আর সৈয়দ ইকবালকে নিয়ে।

গেলো মাসে আর্কিটেক্ট শিখা আহমেদ ও কবি ইকবাল হাসানের আমন্ত্রণে থান্ডার বে নামের চমৎকার একটা শহরে গিয়েছিলাম বেড়াতে। পাহাড় ঘেরা ছোট্ট ছিমছাম একটা শহর। শিখা আর ইকবাল আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন উঁচু একটা টিলার ওপরে, যেখান থেকে বিশাল নদী ‘লেক সুপিরিয়র’-এর কোল ঘেঁষে শুয়ে থাকা স্লিপিং জায়ান্ট ‘নানাবিজো’কে দেখা যায়। মিথ অনুযায়ী নানাবিজো নামের এই দেবতা মানুষের কল্যাণ সাধন করতে এসেছিলেন। কিন্তু কাহিনির ঘনঘটায় পাথরে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। দূর থেকে পাথুরে নানাবিজোকে দেখে বুকে হাত রেখে অনন্তের দিকে তাকিয়ে থাকা একজন মানুষের ভাস্কর্য বলে ভ্রম হয়। সেই টিলার ওপরে টেরি ফক্সের একটা মূর্তি আছে। ওখান থেকেই তাঁর জগৎ বিখ্যাত ‘হাঁটা’ কর্মসূচিটির শুভযাত্রা সূচিত হয়েছিলো। থান্ডার বে-র টেরি ফক্স-এর ভাস্কর্যের সঙ্গেও ছবি তুলেছি কয়েকটা।

অটোয়া কার্লটন ইউনিভার্সিটিতে নদীকে আনা-নেয়া করার সময় একদিন দেখলাম ভার্সিটি ক্যাম্পাসে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লেংটিপরা মহাত্মা গান্ধির একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। ভারতীয় ছাত্রছাত্রী-সরকার এবং দূতাবাসের উদ্যোগ ও অর্থায়নেই এটা সম্ভব হয়েছে। এই বুড়োটার সঙ্গে এখনো ছবি তোলা হয়নি আমার। সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে হাতে সময় থাকে না আবার হাতে সময় থাকে যেদিন সেদিন ক্যামেরা থাকে না। তবে হয়ে যাবে শিগগিরই।

১৯৯৬ সালে ইউনেস্কোর আমন্ত্রণে আমার প্রথম টোকিও সফরকালে এক বিকেলে স্থানীয় ক’জন বন্ধুর সঙ্গে শহরটা ঘুরতে বেরিয়েছি। ট্রেনে করে ওরা আমাকে নিয়ে গেলো শিবুইয়া নামের জমজমাট একটি জায়গায়। এখানকার রেল স্টেশনের নামটিও শিবুইয়া। স্টেশনে নেমেই দেখলাম আশপাশটায় ব্যাপক ভিড় তরুণ তরুণীদের। স্টেশন সংলগ্ন খোলামেলা চত্বরটিতে ছোটখাট একটা পার্ক স্থাপন করা হয়েছে। পার্কে বেঞ্চি পাতা আছে। ওখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঝকঝকে তরুণ-তরুণীরা মেতে আছে কলহাস্যে। কিছু বয়স্ক মানুষের আনাগোনাও চোখে পড়লো। কিন্তু সংখ্যায় ওরা অপ্রচুর। এই শিবুইয়া চত্বরটি হচ্ছে তরুণ-তরুণীদের মিটিংপ্লেস বা ডেটিংপ্লেস। অন্য যে কোনো স্টেশন থেকে শিবুইয়ার চরিত্র একেবারেই আলাদা। রেলস্টেশন বলে এখানে বিপুল সংখ্যক যাত্রীর ওঠা-নামার ছুটোছুটির বাইরেও ব্যস্ততার পাশাপাশি আলাদা একধরণের মৌনতা এবং স্নিগ্ধতা মাখানো সৌন্দর্য আছে। তাড়াহুড়োও আছে তবে সেটা ট্রেন মিস করার তাড়াহুড়ো নয়। এই তাড়া অপেক্ষার। এই হুড়োহুড়ি বন্ধুকে খুঁজে পাওয়ার। তারুণ্যচমকিত উচ্ছ্বল উজ্জ্বল বর্ণিল প্রাণবন্ত শিবুইয়া এলাকাটাকে আমার খুব ভালো লেগে গেলো। তরুণদের পাশাপাশি ট্যুরিস্টরাও এই এলাকাটিতে এসে ভিড় জমান। স্টেশন লাগোয়া তারুণ্যপ্লাবিত একটা জায়গায় জটলাটা খানিক বেশিই মনে হলো। এগিয়ে গেলাম। দেখলাম একটা স্ট্যাচুকে ঘিরেই জটলাটা থেমে থেমে জমাট বাঁধছে বারবার। অবাক কাণ্ড, স্ট্যাচুটা কোনো মানুষের নয়। একটা কুকুরের। প্রেমিক-প্রেমিকারা এবং পর্যটকরা বিপুল উদ্যমে ছবি তুলছে সেই কুকুরের ভাস্কর্যের সঙ্গে। একটা কুকুরের প্রতি জাপানিজদের অপরূপ ভালোবাসা আর আগ্রহের আতিশয্য দেখে আমিও আগ্রহী হয়ে উঠলাম—কে আপনি হে সদাশয় কুকুর মহাশয়?

খুব দ্রুতই জেনে গেলাম আমি কীর্তিমান সেই কুকুর মহাশয়ের নাম-পরিচয় এবং কীর্তিকাহিনি।
নাম তার হাচিকো।
হাচিকোর প্রভুর নাম উইনো। প্রোফেসর উইনো। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। উইনোর খুব প্রিয় কুকুর ছিলো হাচিকো। শিবুইয়া স্টেশনের কাছাকাছি একটা এলাকায় থাকতেন উইনো। সকালে হাচিকোকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে হেঁটে হেঁটে শিবুইয়া স্টেশনে আসতেন তিনি। তারপর ট্রেনে করে চলে যেতেন তাঁর কর্মস্থলে, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফিরতেন বিকেল তিনটার ট্রেনে। হাচিকো প্রতিদিন উইনিকে তার প্রভুকে বা বন্ধুকে এগিয়ে দিতো স্টেশন পর্যন্ত। উইনো চলে যাবার পর স্টেশনে এবং স্টেশনের আশপাশটায় উইনোর জন্যে অপেক্ষা করতে করতেই সময় পার করতো হাচিকো। বিকেল তিনটার ট্রেনে ফিরে আসতেন উইনো। স্টেশনে নেমেই উইনো দেখতেন হাচিকো দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাঁরই অপেক্ষায়। উইনোকে দেখতে পেয়ে খুব দ্রুততায় লেজ নাড়াতে নাড়াতে খুশিতে কুঁইকুঁই করে উঠতো হাচিকো। ছুটে গিয়ে উইনোর শরীরের শরীর ঘষে সে তার আনন্দ প্রকাশ করতো। হাচিকোর মাথায় ঘাড়ে কানে গলায় আদর করতে করতে কতো কথা যে বলতেন উইনো! হাচিকোও অবিরাম মাথা ঝাঁকিয়ে কুঁউ কুঁউ করে যেনো বা সারাদিনে সে কী কী করেছে তার ফিরিস্তি দিতে দিতে প্রভুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসতো বাড়ি।

১৯২৫ সালের ২১ মে। সেদিনও হাচিকো সকাল বেলায় যথারীতি স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিলো প্রোফেসর উইনোকে। হাচিকোর মাথায় গালে হাত বুলিয়ে উইনো বললেন—যাই রে। তোর সঙ্গে দেখা হবে বিকেলে। উইনো চলে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ নিতে।
তখন বয়েস কতো হাচিকোর? বড়জোর দু’বছর। শিবুইয়া স্টেশনে হাচিকো প্রতিদিনের মতোই অপেক্ষা করতে লাগলো। বিকেল তিনটার ফিরতি ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা। সেদিন, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে পড়াতে পড়াতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন প্রোফেসর উইনো। বিকেলে, শিবুইয়া স্টেশনে তিনটার ট্রেন এলো ঠিকই কিন্তু অবাক বিস্ময়ে হাচিকো দেখলো—উইনো ফেরেননি! শুরু হলো হাচিকোর অপেক্ষা। উইনোর জন্যে অপেক্ষা। উইনো আসবেন নিশ্চয়ই। আজকের ট্রেন মিস হলেও কালকের ট্রেনে অবশ্যই আসবেন উইনো। কিন্তু না। পরের দিনের বিকেল তিনটার ট্রেনেও ফেরেন না উইনো। প্রতিদিন উইনোর জন্যে শিবুইয়া স্টেশনের ঠিক যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে থাকতো বা বসে থাকতো হাচিকো, ঠিক সেই জায়গাতেই অপেক্ষা করতে থাকলো সে। উইনোর ফিরে না আসা পর্যন্ত হাচিকো এখান থেকে যাবে না।

লোকজন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো—কারো অপেক্ষায় একটা কুকুর দিনমান বসে থাকে স্টেশনে। কোত্থাও যায় না। স্টেশনমাস্টার প্রোফেসর উইনোকে চিনতেন। তিনি প্রোফেসরের মৃত্যুর কথাও জানতেন। হাচিকোকেও চিনতেন তিনি। হাচিকো যে রোজ রোজ উইনোর প্রতীক্ষায় স্টেশনে এসে বসে থাকে সে ব্যাপারটা খেয়াল করলেন তিনি। খুব মায়া হলো তাঁর। তিনি চাইলেন হাচিকোকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু হাচিকো যাবে না। প্রভুকে ছাড়া সে যাবে না কারো সঙ্গেই।
স্টেশনে অপেক্ষারত কুকুরটিকে নিয়মিত খাবার দিলেন দয়ালু সেই স্টেশন মাস্টার। অনেক চেষ্টা করলেন তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু হাচিকো রাজি হয় না। হাচিকো কেবল কাঁদে আর উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকে স্টেশনের দিকে। দিবস-রজনী শিবুইয়া স্টেশনের পথের ধুলোয় হাচিকো বসেই থাকে বসেই থাকে।

এক সাংবাদিক প্রভুর প্রতি হাচিকো নামের কুকুরটির ভালোবাসার কথা জেনে খুব হৃদয়ছোঁয়া একটা রিপোর্ট লিখলেন। পাঠকনন্দিত একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় হাচিকোর ছবিসহ সেই সংবাদটি ছাপা হবার পর রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে উঠলো হাচিকো। দলে দলে মানুষ দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসতে শুরু করলো শিবুইয়া স্টেশনে। উইনো নামের একজন মানুষের প্রতি হাচিকো নামের একটি কুকুরের অপরূপ ভালোবাসার কাহিনি সবাইকে বিস্মিত এবং ব্যথিত করে তুললো। প্রভু বা বন্ধুর প্রতীক্ষায় থাকা কুকুরটির জন্যে মানুষের দরদ ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে গেলো। লোকজন প্রচুর টাকা দান করলো হাচিকোর জন্যে। হাচিকোকে স্টেশন মাস্টার একাই কেনো খাবার কিনে দেবেন নিজের খরচে?

সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত্রি দিবানিশি শিবুইয়া স্টেশনেই পড়ে থাকে বিষণ্ণ হাচিকো। দিন যায়। সপ্তাহ যায়। মাস যায়। বছর যায়। প্রতিদিন কতো মানুষ ফিরে আসে বিকেলের ট্রেনে, কিন্তু হাচিকোর প্রভু উইনো ফিরে আসেন না। এভাবে, প্রভুর প্রতীক্ষায় ঝাপসা চোখে স্টেশনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রায় দশটি বছর পার করে দিলো হাচিকো। অবশেষে একদিন ক্লান্ত শ্রান্ত বিপন্ন বিষণ্ণ বেদনার্ত হাচিকোকে মৃত্যু এসে আলিঙ্গন করলো। দিনটি ছিলো ০৭ মার্চ। সাল ১৯৩৪।

প্রভু বা বন্ধুর প্রতি হাচিকোর এই অবিস্মরণীয় ভালোবাসাকে স্মরণীয় করে রাখতে জাপানের বিখ্যাত একজন ভাস্কর এন্ডো নির্মাণ করলেন হাচিকোর একটি অপরূপ ভাস্কর্য। প্রতীক্ষারত হাচিকোর সেই ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হলো শিবুইয়া স্টেশনের সম্মুখবর্তী সেই জায়গাটিতেই, যেখানে হাচিকো দিবস-রজনী উইনোর আশায় পথ চেয়ে থাকতে থাকতে অবশেষ একদিন ঢলে পড়েছিলো মৃত্যুর কোলে।

বহু বিখ্যাত মানুষের ভাস্কর্যের সঙ্গে আমি ছবি তুলেছি, কিন্তু হাচিকো নামের কুকুরটির ভাস্কর্যের সঙ্গে ছবি তুলতে গিয়ে অদ্ভুৎ একটা শিহরণ আমাকে পলকের জন্যে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো। প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়মের জগত বিখ্যাত ভাস্কর্যগুলোর সঙ্গে ছবি তুলতে গিয়েও আমি এরকম শিহরণ অনুভব করিনি। হাচিকোর বেদিতে হেলান দিয়ে আমি ছবি তুলছিলাম। আমার বাঁ দিকে কাঁধ বরাবর উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছে হাচিকো। ভঙ্গিতে ওর বন্ধুর জন্যে দীর্ঘ প্রতীক্ষার হাহাকারময় অভিব্যক্তি। হঠাৎ আমার মনে হলো আমার বাঁ কাঁধের পাশ ঘেঁষে ভাস্কর্যের ভেতর থেকে হাচিকো আচমকা একটা লাফ দিয়ে সামনে চলে গেলো। আমি খুব ধুসর অস্পষ্ট ক্ষীণদেহী টাই পরা শার্ট ইন করা বেটেখাটো একজন মানুষকে যেনো বা দেখতে পেলাম। হাচিকো সেই ক্ষীণদেহী মানুষটার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশঃ মিলিয়ে যাচ্ছে আমার চোখের সামনে থেকে...

 
 

 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ