প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

 এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

পেছনে ফেলে আসি—০৪: নদীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা

 

-লুৎফর রহমান রিটন- 

 

 

নদীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা মগবাজারের গলিতে ডাক্তার লুৎফুন নাহারের ক্লিনিকে। ১৯৮৭ সালের অক্টোবরের ০৩ তারিখের প্রশান্ত এক ভোরে। আগেরদিন সন্ধ্যায় নদীর মা শার্লিকে ওই ক্লিনিকে নিয়ে আসা হয়েছে। নানান রকম পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর লুৎফুন নাহার জানালেন শার্লিকে আজ তাঁরা রেখে দেবেন। তিনি আশা করছেন আগামীকাল এই পৃথিবীতে আগমন ঘটবে আমাদের সন্তানের। সন্তানটি যে কন্যা সেটা আমরা আগেই জানতে পারিনি বা জানতে চাইনি। তবে শার্লি এবং আমার দুজনারই প্রত্যাশা ছিলো একটা কন্যা সন্তানের। আমরা ঠিক করে রেখেছিলাম--ছোট্ট বেনী দোলানো পুতুলের মতো একটি মেয়ে হলে ওর নাম রাখা হবে নদী। আর সন্তানটি ছেলে হয় যদি তবে ওর নাম হবে ‘পুত্র’। তখন ভোর। মাত্র উদিত হয়েছে সকালের সোনারঙ সূর্য। ক্লিনিক থেকে টেলিফোন এলো—কন্যা সন্তানের জনক হয়েছেন আপনি। চলে আসুন। কেবিন নাম্বার...।

সারা রাত ঘুম হয়নি। নদীর আগমন প্রতীক্ষায় আমি ছিলাম আধো-ঘুম আধো জাগরণে, সারাটা রাত্রিজুড়ে। শার্লিকে একা ক্লিনিকে রেখে না এসে উপায় ছিলো না। ওখানে স্বামীদের অবস্থান করার কোনো সুযোগ বা ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়েই রাত বারোটার পর চলে আসতে হয়েছিলো। চলে আসবার আগে ক্লিনিকের প্রশস্ত গাড়ি বারান্দা বা লবিতে আরো কয়েকজন ‘হবু পিতা’র সঙ্গে তুমুল আড্ডায় মেতেছিলাম। সেই আড্ডায় হবু পিতা তনুও ছিলেন। আনিসুর রহমান তনু। বিটিভির তরুণ মেধাবী সঙ্গীত পরিচালক। আমরা প্রায় সমবয়েসী হলেও বাবা হিশেবে তিনি আমার সিনিয়র। দুটি পুত্র সন্তানের জনক ইতোমধ্যে। দুটোই কি যথেষ্ঠ নয়? আবার আরেকটি কেনো? আমার কৌতুহলের জবাবে তনু বলেছিলেন—আর বইলেন না ভাই, আমার বাবা আর মায়ের নাকি একটা মাইয়া লাগবো। খালি নাতি দিয়া পোশাইতাছে না। একটা নাতনিও চাই। তো কী আর করা...। আগামীকাল ডেট রে ভাই। দোয়া কইরেন। তনু ভাইকে বেস্ট অব লাক বলে বিদায় নিয়েছিলাম।

ওয়ারির বাসায় ফিরে এসে আমার শুধু শার্লির কথা মনে হচ্ছিলো। আহারে বেচারি! কতো কষ্টই না সহ্য করছে গত দশটি মাস! মায়ের পেটের ভেতরে সন্তানের অবস্থানটা সঠিক জায়গায় আছে কী না সেটা নিশ্চিত হতে সন্ধ্যায় একটা এক্সরে করিয়েছেন লুৎফুন নাহার। এক্সরের রে তে পিচ্চিটার কোনো ক্ষতি হবে নাতো! আমার প্রশ্নের জবাবে লুৎফুন নাহার বলেছিলেন—তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। তাছাড়া সিজারিয়ান করতে চাইছেন না যেহেতু, আমি নিশ্চিত হতে চাইছি ওটা সম্ভব কী না। সিজারিয়ান মানে পেট কাটা। আমি চাইছিলাম না শার্লির বিধ্বস্ত শরীরটা কোনো কাটাকাটির মধ্যে পড়ুক। তাছাড়া সিজারিয়ানের খরচ অনেক। মিনিমাম দশ হাজার টাকা। গরিব লেখক আমি। একটানে দশ হাজার খরচ হয়ে গেলে বিপদেই পড়বো।

ভোরের আলো যে এতোটা স্নিগ্ধ হয় তা আমার জানা ছিলো না। কারণ আমি ঘুমাই গভীর রাতে আর আমার ঘুম ভাঙে অনেক দেরিতে। ন’টার আগে জাগার স্মৃতিই তো নেই আমার! ক্লিনিকের ফোনকলে জেগে উঠে দ্রুত ফ্রেস হয়ে ভোরের সোনালি রোদ্দুর গায়ে মেখে র্যাং কিন স্ট্রিট থেকে একটা স্কুটার নিলাম। স্কুটারটি আমাকে নিয়ে চললো মগবাজারের দিকে। গুলিস্তান পেরিয়ে ছুটে যাচ্ছে স্কুটার। বাঁয়ে খাবার দাবার রেস্তোরাঁটা তখন সবে শাটার তুলছে। প্রভাতের হিমশীতল বাতাসে আমার ঝাকড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মুখের ওপর। ক্লিনিকের পথ যেনো ফুরোতেই চাইছে না। আর এদিকে আমার তর সইছে না। কখন দেখবো পিচ্চিটাকে! ও কি এখন ঘুমিয়ে আছে? আমি ওখানে পৌঁছে যাবার পরেও ও কি ঘুমিয়েই থাকবে? ঘুমিয়ে থাকলে ওকে জাগানো কি ঠিক হবে আমার? আমি চাইছি আমার অপেক্ষায় জেগে থাকা একটা মেয়েকে দেখতে। ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটাকে শার্লি যদি জাগাতে না দেয়? আমি খুব গোপন একটা সিদ্ধান্ত পাকাপাকি করে রাখলাম। পিচ্চিটা ঘুমিয়ে থাকলে আমি ওকে আদর করার ছলে ওর ছোট্ট নরম গালে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে জাগিয়ে দেবো—এই দ্যাখ মামনি তোর গরিব বাবাটাকে দ্যাখ...

ক্লিনিকে পৌঁছে ক্ষীপ্র গতিতে পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট কেবিনে। শার্লি শুয়ে আছে একটা বেডে। যন্ত্রণাক্লিষ্ট শুকনো একটা মুখ। অনেক কষ্ট আর বেদনার ছাপ ওর চোখে, কিন্তু অপূর্ব একটা হাসি ওর মুখজুড়ে! শার্লি ইশারায় দেখালো ওর বিছানার মাথার দিকে চারিদিকে উঁচু রেলিং দেয়া খুদে আরেকটা বিছানায় শুয়ে আছে আমাদের কন্যা। শার্লির কাছে না গিয়ে ছুটে গেলাম আমি পিচ্চিটার দিকে। আরে! মেয়েটা জেগেই আছে! ছোট্ট এইটুকুন একটা মেয়ে! কী অসাধারণ মায়ামায় ওর চোখ দুটো! ডাগর ডাগর মায়াবী চোখে আমাকে দেখেই কী রকম হাত পা নাড়তে শুরু করলো! ওর ছোট্ট এইটুকুন পা দুটো অবিরাম নাচানাচি করছে—যেনো বা অদৃশ্য একটা সাইকেল চালাচ্ছে মেয়েটা! কী যে ছোট্ট ওর হাত আর হাতের আঙুলগুলো! আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা মেয়েটা অবিরাম সাইকেল চালাচ্ছে আর অদ্ভুত একটা শব্দ করছে! মুখ দিয়ে বাতাস টেনে নিয়ে গলা দিয়ে রিভার্স একটা শব্দ বের করছে সে। বাংলা ভাষার বর্ণ বা অক্ষরগুলো ওই শব্দকে প্রতিস্থাপিত করতে অক্ষম। আমি ঝুঁকে পড়ে ওকে দেখছি। আর মেয়েটা ওর খুদে খুদে হাত দিয়ে আমাকে যেনো বা ধরতে চাইছে। ওর ঠোঁট দুটো কেমন কালচেলাল! টুকটুকে লাল রঙকে অতিরিক্তি গাঢ় করতে গেলে যেমনটা হয়। আমি আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের পাশের আঙুলটা খুব নরমভাবে আলতো করে ওর ঠোঁটের ওপর রাখলাম। ঠান্ডানরম পবিত্র একটা ষ্পর্শে কী রকম অদ্ভুত একটা শিহরণ বয়ে গেলো আমার সমস্ত শরীরে! আমি ডাকলাম—মামনি! মেয়েটা আবারো সেই অদ্ভুত শব্দ করতে করতে সাইকেল চালানো আরম্ব করলো। ওর ঠোঁট থেকে আঙুলটা তুলে এনে ওর একটা হাতের কাছে নিতেই আমার আঙুলটাকে মুঠো করে ধরলো সে। ধরলো যে ধরলোই। আর ছাড়তেই চায় না! ফ্লোরে হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসে আমিও ধরে থাকলাম ওর হাতটা। চুকচুক করে কিছু একটা খাওয়ার শব্দ করছিলো সে। এই শব্দটা নতুন। নদী আমার হাত ছাড়ে না। আমিও ছাড়ি না নদীর হাত।
আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি ওর হাতটা ধরে থাকবো।

পুনশ্চ/ সেদিন বিকেলেও ক্লিনিকের গাড়ি বারান্দায় আমাদের নব্যপিতাদের আড্ডা জমে উঠলো। আনিসুর রহমান তনুও আছেন। জিজ্ঞেস করলাম—কী খবর ভাইজান? ঘটনা বলেন। তনু বললেন—ভাইরে এই ক্লিনিকে তো ভোর রাত থিকাই লম্বা সিরিয়ালে খালি মাইয়াই হইছে। এক দুই তিন চাইর কইরা আপ্নের মাইয়া পর্যন্ত মাইনি আট নাম্বার পর্যন্ত এক নাগাড়ে একের পর এক মাইয়াই জন্মাইলো। আমার বউয়ের সিরিয়াল আছিলো নাইন। আমাগো সিরিয়াল নয় নম্বরে আইসা একটা পোলা জন্মাইয়া আবার দশ নম্বরটা মাইয়া! কন, কুনো মানে হয়!! শালার সিরিয়ালের গুষ্ঠি কিলাই...!

 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ