প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

 এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

 পেছনে ফেলে আসি--১২
পত্রিকা হকার হতে চেয়েছিলাম

 

 

-লুৎফর রহমান রিটন- 

 

 

পত্রিকার বাণ্ডিলের ওপর ঘুমিয়ে থাকা ক্লান্ত কিশোরের এই ছবিটা দেখে বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। আহারে বেচারা! জীবন তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে! দুনিয়ার সমস্ত খবরের ওপর শুয়ে থাকা ছেলেটা জানেই না তার কী খবর!

পত্রিকা হকারদের সঙ্গে আমার দারূণ সখ্য সেই ছেলেবেলা থেকেই। আমাদের ওয়ারির বাড়িতে পত্রিকা দিয়ে যেতেন আলী হোসেন নামের টিঙটিঙে এক ভদ্রলোক। নোয়াখালী অঞ্চলের। ঢাকা হকার্স ইউনিয়নের ৯৯ ভাগ কর্মকর্তা কর্মচারীই ছিলেন নোয়াখাইল্লা! সেটা আমি জেনেছিলাম 'ছোটদের কাগজ' নামের মাসিক পত্রিকাটি প্রকাশ করতে গিয়ে। হকার্স ইউনিয়নের সঙ্গে দোস্তি ছাড়া বাংলাদেশে পত্রিকা বের করে কেউ সুবিধে করতে পারেনি। পত্রিকা মালিক যতো বড় শাহেনশাহই হোক--হকার্স ইউনিয়নের সঙ্গে টক্কর লাগিয়ে কেউ পার পায়নি। বলা চলে হকার্স ইউনিয়নের কাছে জিম্মি থাকেন পত্রিকা মালিকরা।উচ্চশিক্ষিত ধনাঢ্য ক্ষমতাবান 'মালিক-সম্পাদক'রা হকার্স ইউনিয়নের কম শিক্ষিত-অর্ধ-শিক্ষিত এমনকি অশিক্ষিত সদস্যদের কাছেও রীতিমতো এবং নিয়মিত নাকাল হন।হকার্স ইউনিয়ন এমন একটা সাম্রাজ্য তৈরি করে রেখেছে যে সাম্রাজ্যে প্রবেশ বা অনুপ্রবেশ করা রীতিমতো দুঃসাধ্য। বিশাল বিশাল হাউজের বিশাল বিশাল 'মালিক-সম্পাদক'রা পত্রিকা বিক্রির কাজটা নির্বিগ্নে সারতে এবং হকার্স ইউনিয়নের নেতাদের হাতে রাখতে কতো রকমের কৌশলই না করেন! ফাইভস্টারে খানাখাদ্যির আয়োজন ছাড়াও প্রয়োজন অনুযায়ী 'বিশেষ খাম' তাদের কাছে পৌঁছে দেন। অনেকে সেটা পান মাসিক ভিত্তিতেও। হিডেন আরো নানারকম বাড়তি সুবিধে হকার্স ইউনিয়নের নেতারা পেয়ে থাকেন। অনেক নেতা ফিল্মে টাকাও লগ্নি করেন। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের একাধিক বহুতল বাড়িও আছে। ওদের নেটওয়ার্ক ভাঙার চেষ্টা একবারই করা হয়েছিলো। দৈনিক জনকণ্ঠ তার যাত্রার শুরুর দিকে হকার্স ইউনিয়নকে পাশ কাটিয়ে তাদের পত্রিকাটি বিলি-বন্টন করার উদ্যোগ নিয়েছিলো। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলো জনকণ্ঠ। সে অন্য প্রসঙ্গ। আমার হকার হবার স্বপ্ন-আকাঙ্খার গল্পটা বলি।

ভালোবাসার মেয়েটিকে বিয়ে করার অপরাধে পরিবার থেকে বিতাড়িত হবার কাহিনির সঙ্গে এটা রিলেটেড। যাত্রাবাড়িতে একটি পরিবারের সঙ্গে সাবলেট ভিত্তিতে থাকি তখন। একটা কোনো চাকরির খুব দরকার।১৯৮১/৮২ সালের ঘটনা। ছোটদের জনপ্রিয় পত্রিকা 'কিশোর বাংলা' তখন বেরোয় অবজারভার হাউস থেকে। রফিকুল দাদুভাই কিশোর বাংলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। আমি তখন দাদুভাইয়ের ছায়াসঙ্গী। প্রতিদিন যাই কিশোর বাংলায়। দাদুভাইয়ের অলিখিত এসিস্ট্যান্ট আমি। তার অনেক কাজ করে দিই হাসিমুখে। সম্পাদকীয় লেখা, ডিকটেশন নেয়া, বিশেষ কোনো দোকান থেকে বিশেষ কিছু কিনে আনা, এমন কি তাঁর বাড়িতে বাচ্চাদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের বেলুন ফোলানো, রঙিন কাগজ কেটে ডিজাইন তৈরি--হেনো কাজ নেই যেটায় আমি হাত লাগাই না। কারণ দাদুভাই আমাকে কথা দিয়েছেন--একটা কাজ তিনি আমাকে দেবেন এবং সেটা কিশোর বাংলায়। সেই আশায় আমি তাঁর সঙ্গে লেপ্টে থাকি। আমার সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত্রির বড় একটা সময় ব্যয় হয় দাদুভাইয়ের পেছনে।কিশোর বাংলায় আমার অবস্থান এতোটাই প্রবল যে প্রেসের কর্মচারি এবং পেস্টিং সেকশনের লোকজন আমাকে কিশোর বাংলার স্টাফ হিশেবেই বিবেচনা করতো। আমি আমার অর্থ সংকটের কথা দাদুভাইকে জানিয়েছি। দাদুভাই আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন--একটা কিছু হবেই এবং সেটা খুব শিগগিরই। দিন-সপ্তাহ-মাস পেরোয়। চাকরি আমি পাই না।পাওয়ার মধ্যে যেটা পাই সেটা হলো দুপুরে বাদশা হোটেলে কাবাব-রুটির একটা লাঞ্চ। দাদুভাই অলস প্রকৃতির মানুষ। দুপুরের লাঞ্চ তিনি বিকেলে সারেন। আমার বেশি খিদে পেলে আমি নিজের উদ্যোগে খেয়ে আসি। খিদে কম থাকলে অপেক্ষা করি। তারপর দাদুভাইয়ের সঙ্গে ফ্রি একটা লাঞ্চ সেরে নিই। অফিস ছুটির পর সন্ধ্যায় ঢাকার রাস্তায় এলোমেলো হেঁটে বেড়াই আমি আর দাদুভাই। কতো কথাই না আমরা বলতাম সেই সময়টায়!আমার প্রতি তাঁর মমতাটা ছিলো অসীম। আমার হাতটা মুঠোয় পুড়ে তিনি হাঁটছেন আর আমাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন--আমরা একসঙ্গে অনেক কাজ করবো। মাস গেলে মোটামুটি সম্মানজনক একটা মাইনে পাবো।নতুন বিয়ে করে এবং বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে যে অকুল সমুদ্রে আমি পড়েছি সেটা থেকে শিগগিরই তিনি আমাকে উদ্ধার করে দেবেন।কিন্তু দাদুভাই দেন না উদ্ধার করে। আমি ভাসতে থাকি অভাবের সাগরে। ঠিক সেই দুঃসময়ে এক বিকেলে আমার প্রথম ছড়ার বই 'ধুত্তুরি'র জন্যে অগ্রণীব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কারের পাঁচ হাজার টাকার চেকটা হাতে আসে। শিশুএকাডেমি মিলনায়তনে রিয়ার এডমিরাল এম এ খানের হাত থেকে পাঁচ হাজার টাকা মূল্যের চেকটা গ্রহণ করি।অন্ধকারে আলোর দিশা হয়ে টাকাটা হাতে এলো। মনে আছে চেকটা পকেটে নিয়ে আমি আর শার্লি শিশু একডেমি থেকে হাঁটতে হাঁটতে অনেক গল্প করতে করতে চলে এসেছিলাম যাত্রাবাড়িতে। এতোটা পথ হেঁটে আসতে আমাদের একটুও কষ্ট হয়নি।

কিশোর বাংলার পিওন ছিলো ওয়াজিউল্লাহ নামের কৈশোরোত্তীর্ণ একটা ছেলে। খুব হাসিখুশি আর কর্মচঞ্চল। ওর সঙ্গে আমার খুব খাতির ছিলো। আমি জানতাম অফিসে আসার আগে দুতিন ঘন্টার আরেকটা কাজ সে করে বাড়তি টাকা রোজগারের জন্যে।আর সেটা পত্রিকা হকারী। খুব ভোরে উঠে মতিঝিল হকার্স ইউনিয়ন থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করে বিভিন্ন বাড়িতে সেগুলো বিলি-বন্টন করে একটা গোসল সেরে সকালের নাস্তা সমাপনান্তে সে চলে আসে অফিসে। এর পেছনে ওর ইনভেস্টমেন্ট তিন হাজার টাকা।এবং মাস শেষে ওর হাতে চলে আসে লাভ হিশেবে হাজার তিনেক টাকা। এটা ওর বাড়তি রোজগার। ওর কাছে হাজার তিনেক টাকা রোজগারের কাহিনি শুনে আমিও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি--হকারই হবো আমি। চাকরি যেহেতু দিচ্ছেন না দাদুভাই, পত্রিকা হকারি করেই আমি টিকে থাকবো। আমার এলাকা ওয়ারিতে কী পরিমাণ পত্রিকা আমি বিক্রি করতে পারবো--তার একটা রাফ হিশেবও করে ফেললাম। ওয়াজিউল্লাহর কাছ থেকে জেনেছি--দৈনিক পত্রিকার চাইতে বেশি লাভ সাপাহিক পত্রিকা বিক্রি করতে পারলে। দৈনিক পত্রিকার দাম দুই বা তিন টাকা। কিন্তু সাপ্তাহিক পত্রিকার দাম দশ টাকা। প্রতিটি পত্রিকার গায়ের দাম থেকে চল্লিশ পারসেন্ট কেটে রাখে হকার্স ইউনিয়ন।এই চল্লিশ পারসেন্ট থেকে বড় একটা অংশ বিক্রেতারা পায়। আমি চিন্তা করে দেখলাম--ওয়ারির বিভিন্ন বাড়িতে কম করে হলেও পঞ্চাশটা শুধুমাত্র 'বিচিত্রা'ই আমি বিক্রি করতে পারবো প্রতি সপ্তাহে।অন্যান্য দৈনিক এবং সাপ্তাহিক মিলিয়ে মাসে হাজার তিনেক টাকা আমার রোজগার করা কোনো ব্যাপারই না। আমি পত্রিকা হকার হলে আমার এলাকার লোকজন আনন্দের সঙ্গেই আমার কাছ থেকে পত্রিকা কিনবে। শার্লিকে জানালাম পরিকল্পনাটা। খুব মন খারাপ করে মেয়েটা সম্মতি জানালো। বললো—খুব ভোরে উঠে তোকে আমি তৈরি করে দেবো। না খেয়ে যাবি না। ফিরে এসে ঘুমাবি রোজ।

পরদিন কিশোর বাংলায় গিয়ে ওয়াজিউল্লাহকে বললাম—পরিকল্পনা ফাইনাল। এখন তুই বল আর কী কী করতে হবে আমাকে। ওয়াজিউল্লাহ বললো—আম্নেরে একটা সাইকেল কিনতে হবে। সাইকেল ছাড়া তো ফাইত্তেন ন।

--আরে ব্যাটা এইটা তো আগে কস নাই!

--আম্নে যে চিরিয়াস সেইটা আঁই বুইজ্জিনি!

আমার আর ওয়াজিউল্লাহর কথপোকথন শুনে আমার পত্রিকা হকার হবার পরিকল্পনার কথাটি জেনে দাদুভাই মহা উৎসাহে বললেন—তুমি শুরু করো। আমি তোমাকে নিয়ে একটা ফিচার লিখবো—শিরোনাম দেবো--‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পত্রিকা হকার’। হাহ্ হাহ্ হাহ্ দারূণ ব্যাপার হবে!

দাদুভাইয়ের হাহাহায় কান না দিয়ে আমি ব্যস্থ হয়ে পড়ি ওয়াজিউল্লাহকে নিয়ে—তুই ঠিকই বলেছিস—সাইকেল একটা লাগবেই। ঠিক আছে সাইকেল একটা কিনবো না হয় সেকেন্ড হ্যান্ড। আমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা আছে। হবে না?

--আম্নের ফুঁজি নগদ তিন হাজার টিঁয়ার লগে সাইকেল খরিদ বাবদ ফাঁচ হাজার তো ঠিকই আছে কিন্তু আম্নের আরো টিঁয়া লাইগবো।

--ক্যানো? আরো টাকা লাগবে কেনো?

--রিটন চার আম্নে যে এলাকায় ফত্রিকা বেঁইচবেন হেই এলাকায় আগেত্তোন একজন দুইজন হকার ফত্রিকা বিলি কইত্তেছে। হেঁতারা তো আম্নেরে হেঁতাগো কাস্টোমার মাগনায় মাগনায় দিই দিতো ন। হেঁতারা কাস্টোমার বেঁইচবো আম্নের কাছে।

--আরে ব্যাটা বলিস কী! আমার এলাকার কাস্টমারকে ওরা আমার কাছে বিক্রি করবে? তোর কি মাথা খারাপ? আমি গিয়ে দাঁড়ালে এলাকার সবাই ওদেরকে বাদ দিয়ে আমার কাছ থেকেই নেবে পত্রিকা। আমার তো কোনো কাস্টমারকে কেনার দরকার নেই!

--আছে।

--কী ভাবে?

--ধইল্লাম আম্নে কইলে এলাকার মাইনসে আম্নেরে ভালাবাসি আম্নেত্তোন ফঁত্রিকা লইবো। কিন্তু আম্নেরে তো হকার্স ইউনিয়ন ফঁত্রিকা দিত ন! হেঁতিরা আসি নালিস কইরবো আম্নের নামে। কইবো আম্নে হেঁতিগো কাস্টোমার মারি দিছেন। তহন আম্নে নগদ টিঁয়া দি ফঁত্রিকা কিনতে চাইলেও হকার্স ইউনিয়ন বেঁইচত ন। কইবো—আগে ফুরানা হকারের লগে মিমাংসা করি লন।

--তা মিমাংসাটা কীভাবে করতে হবে?

--অইযে কাস্টোমার কিনন লাইগব। একেকজন কাস্টোমার হাঁইশসো টিঁয়া রেট।

--কস কী ব্যাটা! একেকজন কাস্টমারের জন্যে পাঁচশ টাকা করে দিতে হবে আমাকে!

--জ্বে। হাঁইশস টিঁয়া পার ফিছ!

পত্রিকা হকার হবার স্বপ্নটা আমার ওই মুহূর্তেই ইন্তেকাল ফরমাইলো!
 
 

 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ