[প্রথমপাতা]
|
এপার ওপার, সোহেল রানা, আজাদ রহমান এবং আমার
ভালোবাসার মূল্য--৩ পর্ব একসঙ্গে
-লুৎফর রহমান রিটন-
আমি তখন সিনেমার পোকা। সত্তরের দশক। গুলিস্তান বিল্ডিং-এর ছোট্ট মুভি
থিয়েটার ‘নাজ’এ মুক্তি পেলো শাদাকালো সিনেমা ‘এপার ওপার’।
পত্রিকা মারফৎ আগেই জেনেছিলাম নতুন একজন নায়িকার আগমন ঘটতে যাচ্ছে এপার
ওপারের মাধ্যমে। ছবির নায়ক নায়িকা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ছবির নামটি
ছিলো যথার্থ। নায়ক সোহেল রানা ঢাকা অর্থাৎ এপারের আর নায়িকা সোমা
মুখার্জি ওপারের, অর্থাৎ কলকাতার। ছবির পরিচালক মাসুদ পারভেজ আর সোহেল
রানা যে একই ব্যক্তি সেটাও আমার জানাই ছিলো। সোহেল রানা থাকেন ঠাটারি
বাজার লাগোয়া বিসিসি রোডে। আর আমি ওয়ারি হেয়ার স্ট্রিটে। হাঁটাপথের
দূরত্ব। নিজের মহল্লার নায়ক বলে ছবিটার ব্যাপারে আলাদা একটা আকর্ষণও
কাজ করছিলো আমার ভেতরে। কাজী আনোয়ার হোসেনের বিখ্যাত চরিত্র ‘মাসুদ
রানা’র মাধ্যমে নায়ক সোহেল রানার অভিষেক ঘটলেও আমার মুগ্ধতা কেড়ে নেন
তিনি এপার ওপারের মাধ্যমে।
নাজ ছিলো ঢাকার সবচে খুদে সিনেমা হল। সিট সংখ্যা বড়জোর শ খানেক।
নবাবপুর স্কুলের ছাত্র ছিলাম বলে গুলিস্তান আর নাজের টিকিট সংগ্রহ করা
আমার জন্যে সহজ ছিলো। অধিকাংশ টিকিট ব্ল্যাকার তখন আমার চেনাজানা,
চেহারার সুবাদে। নিয়মিত দর্শক পরিচয়ের বাইরে নবাবপুর স্কুলের ছাত্র বলে
ওরা আমাকে খানিকটা খাতিরও করতো। সুতরাং সিনেমা সুপারডুপার হিট হলেও
সামান্য কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে টিকিট জোগাড় করে ফেলতাম যে কোনো শো-এর।
প্রথম ছবি ‘মাসুদ রানা’য় ড্যাসিং ইমেজের নায়ক সোহেল রানা দর্শকের
সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেও দ্বিতীয় ছবি এপার ওপারে খুব
মামুলি ডিজাইনের পাজামা আর একটা ফতুয়া টাইপ জামা পরা সোহেল রানা
বাজিমাৎ করে ফেললেন। ঢাকার ছবির দর্শকরা সাদরে তাঁকে গ্রহণ করলেন। আমি
মুগ্ধ হলাম তাঁর হাসিতে। এইরকম মিষ্টি হাসির অধিকারী নায়ক আমাদের কি
দ্বিতীয়টি আছে? নেই। এপার ওপারে নায়ক হিশেবে সোহেল রানার খুব স্বাভাবিক
অভিনয় দেখে আমি রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ঢাকার অন্য নায়করা তখন
উচ্চমাত্রার উচ্চকণ্ঠ ঢিঁশ্যুম ঢুঁশ্যুম অভিনেতা। যাত্রার ঢঙে সংলাপ
প্রক্ষেপনে অভ্যস্ত। এই ছবিতে সোহেল রানা আবির্ভূত হলেন নতুন
ম্যানারিজমে, একটি সফট ইমেজ নিয়ে। এরকম ইমেজ ১৯৭৫ সালের ছবিতে তখন
অকল্পনীয় ছিলো। বলা চলে এপার ওপার-এর মাধ্যমে রোমান্টিক সোহেল রানা জয়
করে নিলেন সিনেমাপ্রিয় মধ্যবিত্ত বাঙালির হৃদয়।
এপার ওপারের গল্পটি এমন কোনো আহামরি ধরণের ছিলো না। আজারবাইজানের উপকথা
‘আলী ও আসমা’ থেকে আখ্যানটি ধার করা। শেষ দৃশ্যে নায়ক নায়িকা দুজনেই
মারা গেলে ছবির দর্শকরা সেটা ভালোভাবে নেয় না এমনটাই দস্তুর ছিলো।
কিন্তু এই ছবির বিয়োগান্তক শেষ দৃশ্যটা দর্শক লুফে নিলো। শেষ দৃশ্যে
নায়ক নায়িকা দুজনেই ডেড। ছবি হিট। ছবির চাইতে হিট ছবির গান।
নাজ সিনেমা হলে বসে ছবিটা দেখার সময় দুটো গান আমাকে দারুণ রকম চমকে
দিয়েছিলো। গানের কথা সুর আর মিউজিক কম্পোজিশন এক কথায় দুর্ধর্ষ! এর
একটি ‘ভালোবাসার মূল্য কতো’ আর দ্বিতীয়টি ‘মন সঁপেছি আমি কারো মনের
আঙিনায়’।
প্রথমটির গায়ক আজাদ রহমান আর দ্বিতীয়টির আবদুল জব্বার। আজাদ রহমান এপার
ওপারের সঙ্গীত পরিচালক।
ভালোবাসার মূল্য কতো গানটির কথা ফজল-এ-খোদার। মন সঁপেছিরও। আমাকে তখন
পেয়ে বসেছিলো ‘ভালোবাসার মূল্য কতো’।
দিনরাত করোটির ভেতরে বারবার বহুবার ‘গুঞ্জরিয়া ওঠে’ গানটি। ১৯৭৫ সালে
বাংলা ছবির ভিএইচএস কিংবা ডিভিডি পাওয়া যেতো না। তখন কোনো ছবির কোনো
গান আমাকে একবার পেয়ে বসলে সেই ছবিটি আমি বারবার দেখতাম। এপার ওপারও
দেখতে হলো কয়েকবার। কতোবার? কম করে হলেও পাঁচবার তো হবেই। স্কুলের
টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে সেই টাকায় সিনেমা দেখতাম। আর সিনেমা দেখতাম
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। প্রতিটা ক্রেডিট লাইন (টেলিভিশনে যাকে আমরা টেলপ
বলতাম) মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করতাম। এমন কি অপটিক্স হাসান মুদ্রণ পরিস্ফুটন
ইউসুফ আলী খান খোকা পর্যন্ত। তো এপার ওপার ছবিতে কণ্ঠশিল্পী হিশেবে
বিখ্যাত আবদুল জব্বারের পাশাপাশি আজাদ রহমান নামের একজন নতুন শিল্পীর
নামও ঝলমল করে উঠলো পর্দাজুড়ে। ‘ভালোবাসার মূল্য কতো’ শোনার সময়ই বুঝতে
পারছিলাম—এটা কোনো চেনাজানা পরিচিত কণ্ঠ নয়। সিনেমায় আগে কখনোই শুনিনি
তাঁর গান। আহারে কী অপূর্ব ব্যাতিক্রমী কণ্ঠ এই শিল্পীর! বারবার বহুবার
দেখলাম এপার ওপার ছবিটা শুধু দুটো গানের জন্যে, বিশেষ করে ভালোবাসার
মূল্য কতো।
আমার জীবন যাপনের অংশ হয়ে উঠলো ভালোবাসার মূল্য কতো গানটি। গুনগুন করে
গাই। মুড ভালো থাকলে এবং আশেপাশে কেউ না থাকলে গলা ছেড়ে গাই। এই ঘটনার
প্রায় তিন দশক পর যখন আমি অনিশ্চিত জীবনে প্রবেশ করে এইদেশ সেইদেশ
ঘুরেটুরে কানাডায় এসে থিতু হলাম তখনো এই গানটা আমাকে ছেড়ে যায়নি।
ইউটিউবে আমার একাউন্টে গানটা জমা রেখেছি। প্রায়ই নাগারে চলতে থাকে
প্রিয় কণ্ঠশিল্পী আজাদ রহমানের ভালোবাসার মূল্য কতো।
এপার ওপারের এই গানটি গায়ক আজাদ রহমানকে জনপ্রিয়তা এনে দিলে তিনি একের
পর এক চলচ্চিত্রে গাইতে থাকেন নানান রঙের নানান ঢঙের গান। দস্যু বনহুর
ছবিতে আজাদ রহমানের গাওয়া ‘ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়/বাতাসের
বেগ দেখে মেঘ চেনা যায়/মুখ ঢাকা মুখোশের এই দুনিয়ায় মানুষকে কি দেখে
চিনবে বলো’ লোকের মুখে মুখে ফিরতে শুরু করলো। গুনাহগার ছবিতে গাইলেন
‘লোকে আমায় কয় গুনাগার’।
এটাও হিট। ডুমুরের ফুল ছবিতে গাইলেন অসাধারণ একটা গান, মাকে নিয়ে—‘করো
মনে ভক্তি মায়ের থাকতে হাতে দিন/হয় না মুক্তি না শুধিলে মায়ের দুধের
ঋণ/চিড়া বলো পিঠা বলো ভাতের সমান নয়/খালা বলো চাচি বলো মায়ের সমান
নয়/মা হলো গর্ভধারিণী/সব দুঃখ হরণকারিনী/সেই মায়েরে না চেনে যে সে তো
অর্বাচীন’।
আজাদ রহমান নিজে গাননি কিন্তু সুর করেছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গানের। স্মৃতি
থেকে কয়েকটা চলচ্চিত্রের নাম এখানে উল্লেখ করি যেগুলোর সঙ্গীত পরিচালক
ছিলেন আজাদ রহমান। তালিকাটা দীর্ঘ। আমি কয়েকটা বলি—পাগলা রাজা, অনন্ত
প্রেম, মাসুদ রানা, মায়ার বাঁধন, যাদুর বাঁশী ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
পাগলা রাজায় রুনা লায়লার গাওয়া ‘বনে বনে যতো ফুল আছে/মাথায় মাথায় যতো
চুল আছে/ততোদিন, ততোদিন বেঁচে থাকো রাজার কুমার’, মাসুদ রানায় রুনার
গাওয়া ‘ও রানা ও সোনা, এই শোনো না/ মধুর এই রাতে আমি যে তোমারই হয়েছি
দেখো না/কিছু আজ বুঝিনা হয়েছি দিওয়ানা’, মাসুদ রানায় সেলিনা আজাদের
গাওয়া ‘মনের রঙে রাঙাবো/বনের ঘুম ভাঙাবো/সাগর পাহাড় সবাই যে কইবে কথা’,
মায়ার বাঁধনে সেলিনা আজাদ এবং এম, এ হামিদের ডুয়েটে ‘প্রেম যদি লুকিয়ে
রাখো তবে কেমন প্রেমিক তুমি বলো/সুর যদি ছড়িয়ে না দাও তবে কেমন সাধক
তুমি বলো’, যাদুর বাঁশীতে রুনার গাওয়া ‘আকাশ বিনা চাঁদ হাসিতে
পারেনা/যাদু বিনা পাখি বাঁচিতে পারেনা/যাদু পাখি এক দুজনা/ওরে যাদু
তোরে ছাড়া জীবনে কিছুই চাহিনা’, অনন্ত প্রেমে সাবিনা ইয়াসমিন এবং
খুরশিদ আলমের ডুয়েটে ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি/তুমি হলে মনের রানী/তোমার
দৃষ্টি যেনো ছোবল হানে/ যখন তখন শুধু আমার প্রাণেতে হয়ে কালনাগিনী’
গানগুলো আমাকে কী বিপুল আনন্দই না দিয়েছিলো! অনন্ত প্রেমে তিনি অসাধারণ
একটি ধ্রুপদী গান নির্মাণ করেছিলেন ‘যুগে যুগে প্রেম আসে জীবনে’।
গহীন বনের ভেতরে রাজ্জাক-ববিতার গোপন বসবাসের দিনলিপি হিশেবে চমৎকার
চিত্রায়ণের সঙ্গে ব্যাকগ্রাউণ্ডে বাজছিলো গানটি। অসাধারণ এই গানটিতে
কণ্ঠ দিয়েছিলেন সম্ভবত ওস্তাদ আখতার সাদমানী এবং সঙ্গে আরেকটি
নারীকণ্ঠ। নাম ভুলে গেছি, স্মৃতি ঠিকমতো কাজ করছে না।
আমাদের চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিশেবে আজাদ রহমানকে আমরা প্রথম
পেয়েছিলাম ষাটের দশকের মাঝামাঝি কিংবা শেষান্তে ‘আগন্তুক’ নামের একটি
চলচ্চিত্রে। অনেকগুলো শ্রুতিনন্দন গান উপহার দিয়েছিলেন তিনি এই
চলচ্চিত্রে। আগন্তুক ছবিতে খুরশিদ আলম নামের একজন নতুন কণ্ঠশিল্পীকে
ব্রেক দিয়েছিলেন তিনি। এবং প্রথম গানেই শ্রোতাদের সমস্ত মনোযোগ কেড়ে
নিয়েছিলেন খুরশিদ আলম। খুরশিদের কণ্ঠে ‘বন্দী পাখির মতো মনটা কেঁদে
মরে/মুক্ত আকাশখানি কে আমার নিলো কেড়ে/ ও পাহাড় ও নদী বলে দাও কি নিয়ে
থাকি/ এ ব্যথা কি দিয়ে ঢেকে রাখি/স্বর্ণ ঈগল মন আমার অসীম আকাশে ওড়ে না
আর/ডানা তার ভেঙে গেছে ঝড়ে আঘাতে জানোনা কি?’ বিপুল জনপ্রিয়তা
পেয়েছিলো। তখন ছিলো রেডিওর যুগ। রেডিওতে নিয়মিত বাজতো এই গানটা। এই
গানের মাধ্যমেই খুরশিদ আলম বিশেষ করে নায়ক রাজ্জাকের লিপের অপরিহার্য
কণ্ঠ হিশেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্রে। এবং দাপটের সঙ্গে
তুঙ্গে অবস্থান করেছেন দশকের পর দশক। ফিল্মী গানের ময়দানে এন্ড্রু
কিশোরের আগমনের পর খুব দ্রুতই অস্ত গিয়েছিলো খুরশিদ আলমের একক আধিপত্য
ও জনপ্রিয়তার সূর্যটা।
এপার ওপারের ভালোবাসার মূল্য কতো গানটিই আমাকে আজাদ রহমানের মূল্য
বুঝতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলো। এই গানটিই আজাদ রহমানের ব্যাপারে
আমাকে আগ্রহী করে তুলেছিলো। আমাদের চলচ্চিত্রের গান এবং আবহসঙ্গীত
আধুনিক হয়ে উঠেছে একজন আজাদ রহমানের মেধা আর মননের সমন্বয়ে। সময়ের
সঙ্গে ঐতিহ্যের নবায়নই আধুনিকতা। আজাদ রহমান সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় ধারাকে
বর্তমান সময়ের সঙ্গে যুক্ত করেছেন নিপূণ দক্ষতায়। আর তাই আমরা দেখেছি
সুরস্রষ্টা আজাদ রহমানের গানে পুরনো ও নতুন যন্ত্রানুষঙ্গের অপরূপ
মিথস্ক্রিয়া। হারমোনিয়ম তবলা বাঁশী ও সেতারের সঙ্গে গীটার কীবোর্ড
পারকেশন পিয়ানোর অপূর্ব মেলবন্ধনে আজাদ রহমান নির্মাণ করেছেন সুর ও
ছন্দের মোহনীয় অর্কেস্ট্রার অভূতপূর্ব সিম্ফনি। ইলেকট্রনিক এবং
একুইস্টিকের যৌথ মূর্ছনায় আজাদ রহমান আমাদের নিয়ে গেছেন অনির্বচনীয় এক
আনন্দ-বেদনার ভুবনে।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লাসিক্যাল মিউজিকে উচ্চতর ডিগ্রি
অর্জন করেছেন (প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন) অত্যন্ত মেধাবী এই
সঙ্গীতসাধক। দীর্ঘকাল তিনি বাংলা খেয়াল নিয়ে গবেষণা করেছেন নিবিষ্ট
চিত্ত্বে। তাঁর লেখা ‘বাংলা খেয়াল’ নামের মূল্যবান একটি গ্রন্থ দুই
খণ্ডে প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমী। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর
মহাপরিচালক ছিলেন। এই কিছুদিন আগেও তাঁকে দেখা গেছে বাংলা খেয়াল নিয়ে
চ্যানেল আইতে ‘সুর মঞ্জুরি’ নামের একটি অনুষ্ঠান নিয়মিত উপস্থাপনা
করতে। একটি চল্লচ্চিত্রও নির্মাণ করেছিলেন তিনি। নাম ছিলো ‘গোপন কথা’।
প্রাপ্তবয়স্কদের ছবি ছিলো ওটা। য়্যাডাল্ট ট্যাগ লাগানো ছিলো বলে স্কুল
লাইফে অভিসার সিনেমা হলে বহু কাহিনি ঘটিয়ে হলের ভেতরে প্রবেশ করেছিলাম।
যদিও সিনেমাটা কোনো আহামরি কিছু ছিলো না।
আমার এই লেখার ফোকাস পয়েন্ট আমাদের চলচ্চিত্রের গানে আজাদ রহমান বলে
বিষয়ের বাইরে যেতে পারছি না হুট করে। নইলে আজাদ রহমানের সুর করা হৃদয়
আকুল করা দেশাত্ববোধক গানের কথাও বলা যেতো। আমি শুধু একটা গানের কথাই
উল্লেখ করি এখানে। সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘জন্ম আমার ধন্য হলো
মাগো/এমন করে আকুল হয়ে আমায় তুমি ডাকো/তোমার কথায় হাসতে পারি/ তোমার
কথায় কাঁদতে পারি/ মরতে পারি তোমার বুকে/বুকে যদি রাখো আমায় বুকে যদি
রাখো’।
আজাদ রহমানের তুলনা নেই। অদ্বিতীয় তিনি।
আজ আমার প্রিয় শিল্পী আজাদ রহমানকে খুব মনে পড়ছিলো। আবার নতুন করে
ভালোবাসার মূল্য কতো গানটা শুনলাম একাধিকবার। একসময় মনে হলো একটু কথা
বলি আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে। গীতিকার ফজল-এ-খোদার কাছ থেকে টেলিফোন নম্বর
সংগ্রহ করে কল দিলাম বাংলাদেশে। রাত তখন সাড়ে দশটা। কানাডা থেকে ফোন
করেছি বুঝতে পেরে খুবই খুশি হলেন তিনি। ভালোবাসার মূল্য বিষয়ে নতুন করে
দ্বিতীয়বার আমার মুগ্ধতার কথা শুনে প্রথমবারের মতোই অবাক ও খুশি হলেন
আজাদ ভাই।
এক বছর আগে কানাডা থেকেই ফোন করে তাঁকে আমি আমার কৈশোর থেকে লালিত
মুগ্ধতার ব্যাপারটা জানিয়েছিলাম। বয়েস তাঁর প্রায় সত্তর। কিন্তু স্মৃতি
তাঁর সতেজ এবং সজীব। তাঁর সুরারোপিত যাদুর বাঁশীর গান এবং মিউজিক নিয়ে
অনেক কথা বললাম। আমি এতোদিন জানতাম ওই ছবিতে যাদুর বাজানো বাঁশীর মূল
পিসটা বাজিয়েছেন প্রখ্যাত বংশীবাদক আবদুর রহমান। আজ আজাদ ভাই
বললেন—আবদুর রহমান কিছু কিছু অংশ বাজিয়েছিলেন বটে কিন্তু মূল অংশটা
বাজিয়েছিলেন খবির নামের একজন বাজিয়ে। এমনিতে খবির অন্য কি একটা
ইন্সট্রুমেন্ট বাজিয়ে থাকেন। অবশ্য যাদুর বাঁশী চলচ্চিত্রটি দেখার সময়
ক্রেডিট লাইনে ‘যাদুর বাঁশীর বাদক’ হিশেবে আবদুর রহমানের নামটাই
দেখেছিলাম। এবং সেটাই আমার স্মৃতিতে গেঁথেছিলো এতোকাল। আজ একটা নতুন
তথ্য জানা হলো।
আমার পাঠকদের আজকে একটা নতুন তথ্য দিই ভালোবাসার মূল্য কতো গান বিষয়ে।
এই গানটি গাইবার জন্যে আবদুল জব্বারকেই নির্বাচন করেছিলেন আজাদ রহমান।
গানটির দুটি ভার্সন আছে ছবিতে। ছবির শুরুর দিকে একবার নায়ক সোহেল রানা
গানটি গেয়েছেন অতি আনন্দিত চিত্ত্বে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে। ছবির শেষদিকে
আরেকবার গেয়েছেন বিষাদমাখা চিত্ত্বে বেদনার্ত কণ্ঠে। একবার হ্যাপি মুডে
আরেকবার প্যাথজ মুডে। শিল্পী আবদুল জব্বার এই গানটির জন্যে দুবার
পারিশ্রমিক দাবি করেছিলেন। দুবার পেমেন্ট না করলে জব্বার গানটি গাইবেন
না বলে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজাদ রহমান জব্বারকে দুবার
পেমেন্ট করতে রাজি ছিলেন না। অতঃপর ‘মন রেখেছি আমি কারো মনের
আঙিনায়/কেউ ডেকো না আমায় কেউ খুঁজো না আমায়’ গেয়েই চলে গিয়েছিলেন আবদুল
জব্বার। ‘ভালোবাসার মূল্য কতো’ গানটি তৈরি করে প্রযোজক পরিচালক সোহেল
রানাকে শুনিয়েছিলেন আজাদ রহমান। আজাদ রহমানের কণ্ঠে গানটি শুনে সোহেল
রানাই প্রস্তাব করেছিলেন—আবদুল জব্বার না গাইলে আপনিই গেয়ে ফেলুন
গানটা। আপনার কণ্ঠেও খুব ভালো লাগছে। এরপর আজাদ রহমান নিজের
সঙ্গীতায়োজনে নিজেই কণ্ঠ দিলেন। আমাদের চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক সিঙ্গার
হিশেবে দুর্দান্ত এক নতুন শিল্পীর আগমন ঘটলো।
এই কাহিনির দ্বিতীয় অংশটি অর্থাৎ সোহেল রানার প্রস্তাবে গানটা আজাদ
রহমান গাইলেন--এটুকু আজাদ রহমান নিজেই বলেছেন আমাকে। কিন্তু কাহিনির
প্রথম অংশ অর্থাৎ ‘আবদুল জব্বারের ডাবল পেমেন্টের দাবি নচেৎ
প্রত্যাখ্যান’ ব্যাপারটি আমি জেনেছি খুবই বিশ্বস্ত একটি সূত্রে। আজাদ
রহমান ভদ্রতা বশত হয়তো আবদুল জব্বারের অপ্রত্যাশিত আচরণের ঘটনাটা বলতে
চাইছেন না। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস—আমার বিশ্বস্ত সূত্রটি আমাকে সঠিক
তথ্যই দিয়েছে। ধন্যবাদ প্রিয় শিল্পী আবদুল জব্বার, আপনি সেদিন বেঁকে না
বসলে আজাদ রহমানের মতো অসাধারণ ব্যাতিক্রমী একজন সিঙ্গারকে আমরা পেতাম
না। আর ‘ভালোবাসার মূল্য কতো’ গানটি আজাদ রহমান ছাড়া আর কোনো কণ্ঠে
এরকম ধ্রুপদী ব্যাঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হতো কিনা সন্দেহ আছে।
প্রিয় আজাদ রহমান, আমার প্রিয় আজাদ ভাই, আপনার কাছে অনেক ঋণ আমার। আপনি
আমার আনন্দ-বেদনার দীর্ঘ দিবস আর দীর্ঘ রজনীগুলোকে সোনার আলোয় ভরিয়ে
রেখেছেন। আজ, আমি আমার ভালোবাসার সবটুকু মূল্য দিয়েই আপনাকে প্রণতি
জানাই। বারো হাজার তিনশ কিলোমিটার দূরের দেশ কানাডার রাজধানী অটোয়া
থেকে এই শীতের রাত্রিতে আপনাকে পাঠানো আমার উষ্ণপ্রণতিটুকু গ্রহণ করে
আমাকে আরেকটু ঋণী করুন। আমাদের বাংলা গান আপনার হাত ধরে অফুরান সৌরভ
ছড়াক। সেই সৌরভের গৌরবে সিক্ত থাকুক আমাদের গানের ভুবন।
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|