|
পেছনে ফেলে আসি-০৯: রাইড বিষয়ক প্যাঁচাল ।। ওহ্ কি
গাড়িয়াল ভাই...
-লুৎফর রহমান রিটন-
২০০২। সদ্য এসেছি কানাডায়। ড্রাইভিং লাইসেন্স
নেই, নেই ড্রাইভ করার মতো গাড়িও। খুব বিপদে পড়লে এর-ওর কাছ থেকে রাইড
নিতে হয়। কারো কাছ থেকে রাইড নিতে না চাইলেও প্রবাসী বাঙালিদের ‘দাওয়াত
কালচার’ রক্ষা করতে গিয়ে আমাকে অহেতুক নিতেই হয়েছে কিছু কিছু রাইড।
রাইড নিতে বা দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই কিন্তু ব্যাপারটা হতে হয়
আন্তরিক। হতে হয় শিষ্টাচার ও সৌজন্যের মিশ্রনে। কানাডার প্রথম জীবনে,
বন্ধুস্থানীয় এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এক বিকেলে আমাদের তিনজনকে (স্ত্রী
শার্লি, কন্যা নদী এবং আমাকে) ডাউন টাউনের একটি বাসস্টপে নামিয়ে
দিয়েছিলেন। প্রচণ্ড শীতের সেই বিকেলটা ছিলো মারত্মক উইন্ডি। উইণ্ডচিল
মাইনাস টুয়েন্টিফাইভ-থার্টির মতো। বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আমরা কাঁপছিলাম
রীতিমতো। অথচ বন্ধুস্থানীয়টি হাইওয়েতে মাত্র পাঁচ মিনিটের বাড়তি ড্রাইভ
করলেই আমরা বেঁচে যেতাম ভয়ংকর নিগ্রহ থেকে। দুটো বাস বদল করে আমাদের
বাসায় ফিরতে লেগেছিলো প্রায় এক ঘন্টা। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম—দ্রুত
ড্রাইভিং লাইসেন্সটা পেতে হবে। থাকতে হবে নিজের বাহন। কিনতে হবে গাড়ি।
শুধু কানাডায় নয়, বাংলাদেশেও আমি লক্ষ্য করেছি যাঁদের গাড়ি আছে তাঁদের
অনেকেই রাইড দেয়ার ব্যাপারে সাধারণ সৌজন্য বা ভদ্রতার ধার ধারেন না।
তাঁরা সবাই—‘নামিয়ে দিতে’ চান। ‘পৌঁছে দিতে’ চান না কেউই। (কানাডায় এখন
আমাকে কেউ নামিয়ে দিতে চাইলে আমি ঠাট্টা করে বলি—এতো কষ্ট করে এই
পর্যন্ত উঠে এসেছি আর আপনি কীনা আমাকে নামিয়ে দিতে চাইছেন!)
নব্বুই দশকের মাঝামাঝি সময়ে, সার্কিট হাউজ রোডের ‘চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা
অধিদপ্তর’--ডিএফপিতে সেট ফেলে হুমায়ুন আহমেদের ‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকটির
শুটিং হতো। নদী ওই নাটকের একজন শিশুশিল্পী বিধায় সন্ধ্যায় ওকে নিয়ে শুটিং
স্পটে যেতো শার্লি। যেদিন শুটিং থাকতো সেদিন ফিরতে ওদের রাত হয়ে যেতো।
এক রাতে আমি বাড়ি ফেরার আগে ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ‘সেট-এ একটা উঁকি
দিয়ে যাই’ ভেবে উঁকিটা দিতে গিয়ে গেলাম ফেঁসে। হুমায়ুন ভাই আমাকে চলে
আসতে দেন না। আমাকে থাকতে হলো শুটিং-এর শেষ পর্যন্ত। আমার কোনো গাড়ি
ছিলো না তখন। শুটিং শেষ হলো রাত প্রায় দেড়টায়। শুটিং শেষে প্রত্যেকেই
তৎপর হলো যে যার মতো। এতো রাতে রিকশা বা স্কুটার পাওয়াটাও একটা ঝক্কির
ব্যাপার। আমার গাড়ি না থাকার বিষয়টা সবারই জানা। ডিএফপির অন্ধকার ভুতুড়ে
গলিটা পার হওয়াটাও বিপজ্জনক। ঠিক হলো শমী কায়সার আমাদের রাইড দেবে।
নিশ্চিন্ত মনে ওর সঙ্গে গাড়িতে উঠে বসলাম। শমী ওর মায়ের সঙ্গে নিউ
ইস্কাটন রোডের বাড়িতে থাকে। ওর বাসা থেকে আজিমপুর শেখ সাহেব বাজার
রোডের আমাদের বাসার দূরত্ব গাড়িতে বড় জোর পনেরো মিনিটের। গভীর রাত বলে
কোনো ট্রাফিকজ্যাম নেই। সুতরাং ওই পথটুকু তখন মিনিট দশেকের। শমীকে মনে
মনে থ্যাংক্স দিচ্ছি—এর মধ্যে মগবাজার মোড়ে এসে ওর গাড়ির ড্রাইভার
ব্রেক কষলো। শমী বললো—‘রিটন ভাই তোমরা এখান থেকে একটা স্কুটার নিয়ে নাও।’
ডিএফপির গলি থেকে বেরিয়ে সামান্য ডানে এগোলেই মগবাজার মোড়। রাত-বিরেতে
আমাদের তিনজনকে মগবাজার মোড়ে নামিয়ে রেখে চলে গেলো শমী বাংলা মোটরের
দিকে। আমি বিস্মিত এবং হতভম্ব। ওর মা পান্না কায়সার এবং ওর সঙ্গে আমার
খুব চমৎকার সম্পর্ক। তাছাড়া সঙ্গে আমার স্ত্রী এবং কন্যা। এবং সময়টা
মধ্য রাত। আশপাশে কোনো স্কুটার বা রিকশা নেই। এরকম পরিস্থিতে আমাকে
উদ্দেশ্য করে আমার স্ত্রী শুধু একটা লম্বা ডায়ালগ দিলো—‘এই অভদ্র মেয়েটা
আর ওর মায়ের জন্যে তোর না এত্তো দরদ! এই ছোটলোকটার সঙ্গে আসতে রাজি হলি
কেনো? প্রতিদিন আমাদের পৌঁছে দিতে প্রোডাকশনের গাড়ির একটা ব্যবস্থা তো
রেখেছেনই হুমায়ুন ভাই! ওর গাড়িতে তুই লাফিয়ে উঠতে গেলি কেনো?’
লজ্জায় একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেলাম আমি। এতো রাতে আমাদের বাড়ি
পর্যন্ত যেতে কতো টাকার তেল পুড়তো শমীর? কতো মিনিট বাড়তি সময় লাগতো?
সেই রাতের ঘটনার পর থেকে শমীর ব্যাপারে আমি মোটামুটি নিস্পৃহ। (২০১২
সালে আগারগাঁও-এ ওর নিজের কোনো এনজিও বা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে আয়োজিত
শিশুকিশোরদের কী একটা সমাবেশে আমাকে খুব করে ধরেছিলো অতিথি হিশেবে
যেতে। রাজি হয়েও শেষ মুহূর্তে আমি ফোন করে অন্য একটা কাজের ছুতোয় যাবো
না বলে দিয়েছি। আগেই বলে দিতে পারতাম যে যাবো না। কিন্তু কেনো যেনো
একটু প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করলো। এমন একটা প্রতিশোধ যাতে ওর খুব বেশি
ক্ষতি হবে না। কিন্তু সে বুঝবে যে আমি ওকে ইগনোর করলাম।)
১৯৯৮/৯৯ সালের বইমেলার সময় প্রীতিভাজন তুহিন এসে খুব করে ধরলো—সিলেট
যেতে হবে একদিনের জন্যে। জগন্নাথপুরের বইমেলা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অতিথি
হয়ে। হুমায়ুন আহমেদের নাটকে হিমুর চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি পাওয়া
তুহিন। আগুনের পরশমনি ছবিতে পাকি মেজর যার আঙুল কেটে দিয়েছিলো। তুহিন
ছেলেটা আমার বিশেষ প্রীতিভাজন। কিন্তু আমি রাজি হই না। বলি
—বইমেলার সময় আমি কোত্থাও যাই না। সরি।
কিন্তু তুহিন নাছোড়—শুধু একটা দিন রিটন ভাই। সকালের ফ্লাইটে যাবেন।
সন্ধ্যার ফ্লাইটে ফিরে আসবেন। প্লিজ রিটন ভাই, না করবেন না। আপনি আর
তৌকির যাবেন।
আমি বললাম—শুধু তৌকিরকে পাঠালেই তো হয়।
তুহিন বললো—বিখ্যাত টিভি স্টার হিশেবে তৌকির ঠিক আছে কিন্তু বইমেলায়
একজন বিখ্যাত লেখকও তো লাগবে রিটন ভাই! আমার দিকে তাকিয়ে বইমেলার একটা
বিকেল না হয় আপনি উৎসর্গই করলেন! প্লিজ!
তুহিনের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলাম না। শেষ পর্যন্ত রাজি আমাকে হতেই হলো।
ঢাকা সিলেট বিমান যাত্রা খুব স্বল্প সময়ের। কিন্তু সেই স্বল্প সময়টা
কতো দ্রুত যে কেটে গেলো! তৌকির আমাকে ওর জীবনের খুব একান্ত কয়েকটি
বিষয়েও আমার সঙ্গে খুব খোলামেলা কথা বললো। কিছুদিন পরেই বিপাশাকে বিয়ে
করতে যাচ্ছে সে। আমাকে আগাম আমন্ত্রণও জানিয়ে রাখলো তৌকির। নানান বিষয়ে
স্মৃতিচারণ করতে করতে তৌকির জানালো—একবার সিলেট থেকে ঢাকায় ফেরার কথা
তৌকির আর আসাদুজ্জামান নূরের। রাতের ফ্লাইটে একটা মাত্র টিকিট যোগাড়
করা গেলো। পরদিন সকালে তৌকিরের ঢাকায় থাকাটা খুব জরুরি ছিলো। ওর
ফার্মের একটা কন্সট্রাকশন ওয়ার্ক চলছিলো। সকাল বেলায় স্পটে ওকে থাকতেই
হবে। কথাটা নূর ভাইকে বলেও লাভ হয়নি। তৌকিরকে সিলেটে রেখেই চলে
গিয়েছিলেন নূর ভাই। তৌকির আশা করেছিলো ওর জরুরি কাজটাকে বিবেচনা করবেন
নূর ভাই। কিন্তু বাস্তবে সেটা হলো না।
--তুমি তাহলে কীভাবে ঢাকা পৌঁছুলে?
--সিলেট থেকে বিমানের ফিরতি ফ্লাইট পরদিন সন্ধ্যায়। সুতরাং সারা রাত
ট্রেন জার্নি করা ছাড়া উপায় ছিলো না রিটন ভাই। সিনিয়রদের কাছ থেকে আমরা
তো একটু সুবিবেচনা আশা করতেই পারি তাই না?
আমি বললাম—তাতো বটেই।
সিলেটের লন্ডনী উচ্চবিত্তদের আবাসিক এলাকায় পাহাড় ঘেঁষা একটা চমৎকার
নির্জন বাড়িতে দুপুরে খাবার খেয়ে খানিকক্ষণ রেস্ট নিয়ে আমরা রওনা হলাম।
এই বাড়িটায় কেউ থাকেন না। বাড়ির মালিক থাকেন লন্ডনে। একজন কেয়ারটেকার
কাম বাবুর্চি বাড়িটার দেখাশুনা করেন। লোকটার রান্নার হাত চমৎকার।
জগন্নাথপুর যাবার পথে আমরা অধ্যাপক সফিউদ্দিন আহমেদ এর বাড়িতে চা বিরতি
নিলাম। তিনিও যাবেন আমাদের সঙ্গে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের তিনি সভাপতি।
সফিউদ্দিন স্যারের সঙ্গে আমার এর আগেও দেখা হয়েছে, ময়মনসিংহে। তখন তিনি
ময়মনসিংহ থাকতেন।
স্যারের বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেলো তৌকিরকে নিয়ে। বাড়ির সদস্যরা এমনকি
পাড়া প্রতিবেশিরাও এসে জড়ো হয়েছেন—তৌকিরের সঙ্গে একটা ছবি তুলতে।
হাসিমুখে জনপ্রিয়তার বিড়ম্বনা সইতে হচ্ছিলো তৌকিরকে।
বইমেলার উদ্বোধন পর্ব বক্তৃতা ইত্যাদি শেষ করে স্যারকে মঞ্চে রেখেই আমি
আর তৌকির রওনা হলাম বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে। বইমেলার দর্শকেরা তৌকিরকে
কী আসতে দেয়! তৌকিরকে নিয়ে পাবলিকের আগ্রহের আতিশয্যে আমাদের বহনকারী
মাইক্রোটার প্রায় চ্যাপ্টা হবার যোগাড়!
এয়ারপোর্ট পৌঁছুতে আমাদের বেশ দেরিই হয়েগিয়েছিলো। পথে তৌকিরের টেনশন
ছিলো চোখে পড়ার মতো। আগামীকাল সকালে খুব জরুরি ভিত্তিতে ওকে ঢাকায়
থাকতেই হবে। স্পটে(সাইটে) কন্সট্রাকশন তদারকি বিষয়ক কাজ। শখানেক লোকের
ইনভল্বমেন্ট। ফ্লাইট মিস করলে কেলেংকারী কাণ্ড হয়ে যাবে। ওকে
বললাম—টেনশন করো না। বেসরকারী এয়ারলাইন্স কাউন্টারের তরুণ কর্মকর্তার
সঙ্গে আমাদের ফিরতি যাত্রার বিষয়টা কনফার্ম করে এসেছি আমি।
এয়ারপোর্টে ঢুকেই দৌঁড়ে গেলাম জিএমজি(?) ফ্লাইটের কাউন্টারে। সকালের
দেখা টাই পরা স্মার্ট তরুণ কর্মকর্তাটি আমাকে দেখেই হইহই করে উঠলেন
—আরে ভাই এতো দেরি করলেন? কোথায় ছিলেন আপনারা? আজকে তো টাইট অবস্থা!
সিট তো রাখাই যাচ্ছিলো না। অনেক কষ্টে শুধু আপনারটা আটকে রেখেছি। তৌকির
সাহেবেরটা আরেকজনকে দিয়ে দিতেই হলো। আমার হাতে এখন একটা মাত্র সিট।
(কাউন্টার থেকে সামান্য দূরে আমাদের বিদায় জানাতে আসা লোকদের সঙ্গে কথা
বলছিলো তৌকির। আমাদের কথাবার্তা স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছিলো সে। তরুণ
কর্মকর্তার কথা শুনে প্রচণ্ডভাবে হতাশ হলো তৌকির। ঘাড় ঘুরিয়ে ওর বিমর্ষ
অভিব্যক্তিটা নজরে পড়লো।)
তরুণ সেই কর্মকর্তাকে আমি বললাম--বলেন কী! আমি তো কনফার্ম করে
গিয়েছিলাম আমাদের ফিরতি যাত্রা!
--তা তো আপনি করেইছিলেন। কিন্তু এখন কয়টা বাজে দেখেন! আর দশ মিনিট পরে
তো ফ্লাইট টেক অফ করছে! টিকিটটা অটোম্যাটিকেলি ক্যান্সেল্ড হয়ে গেছে।
আপনি যান যান জলদি যান! প্লেনের দরোজা তো বন্ধ হয়ে গেছে অলরেডি!
আমি কাউন্টারের সেই তরুণ কর্মকর্তাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করছি। খুব
নিচু কণ্ঠে সেই তরুণ আমাকে জানালো, ইউনিভার্সিটি জীবনে আমার বেশ কিছু
ছড়া খুবই পছন্দের ছিলো ওঁর। সেই কারণেই আমার টিকিটটা তিনি হাতছাড়া
করেননি। বহু কায়দা করে আটকে রেখেছিলেন। কিন্তু ওর পক্ষে কিছুতেই দুটো
সিট আটকে রাখা সম্ভব ছিলো না। তাই তৌকিরের টিকিটটা ইস্যু করা সম্ভব না।
আমি আরো নিচু কণ্ঠে, আশপাশের কেউ শুনতে না পায় এমন ফিঁসফিসিয়ে তাঁকে
বললাম—আপনি তাহলে আমার টিকিটটা তৌকিরের নামে ইস্যু করে দিন।
--তাহলে আপনি যাবেন কী ভাবে?
--রাতের ট্রেনেই যেতে হবে আর কি। বইমেলা চলছে। তাছাড়া তৌকির আমার
প্রীতিভাজন। ছোটভাইয়ের মতো। ওকে ফেলে আমি তো চলে যেতে পারি না।
তিনি আমার টিকিটটা তৌকিরের নামে ইস্যু করে আমার হাতে দিয়েই দ্রুত ভেতরে
চলে গেলেন।
টিকিটটা হাতে নিয়ে আমি এলাম তৌকিরের কাছে। তৌকির বললো—‘তাহলে যান আপনি
রিটন ভাই। আমি রাতের ট্রেনে আসছি।’
আমি টিকিটটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললাম—আমি যাচ্ছি না, তুমি
যাচ্ছো এই ফ্লাইটে। আমি টিকিটটা তোমার নামে ইস্যু করিয়েছি। বলেছিলে খুব
জরুরি কাজ তোমার। এই নাও। জলদি যাও।
চটজলদি আমাকে একটা হাগ দিয়ে ‘আমি ভাবতেই পারিনি রিটন ভাই আপনি এমন
কাণ্ড করবেন’ বলতে বলতে প্লেন ধরতে দৌড় লাগালো তৌকির।
অনুজপ্রতীম একজন জনপ্রিয় অভিনেতার বিস্মিত হবার অভিব্যক্তিটি দেখে মনে
বড় আনন্দ হলো। সিনিয়ররা অনুজদের জরুরি কাজকে বিবেচনায় আনেন না, তৌকিরের
এমত বিশ্বাস বা অভিযোগটি সব সময় সঠিক নয় সেটাও প্রমাণিত হলো।
একটু পরেই কাউন্টারের সেই তরুণ কর্মকর্তা ত্রস্ত ভঙ্গিতে আমাকে ডাকলেন।
কাছে যেতেই ফিঁসফিসিয়ে বললেন—পাইলটকে অনেক বলে কয়ে রাজি করিয়েছি রিটন
ভাই। আপনি কি ককপিটে বসে যেতে পারবেন?
--কেনো পারবো না! অবশ্যই পারবো। মেনি মেনি থ্যাংক্স!
কম্পিউটার থেকে একটা প্রিন্ট বের করে আমার হাতে দিয়ে ‘তাহলে আসেন’ বলতে
বলতে আমাকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে গেলেন তিনি জিএমজি বিমানের ভেতরে।
শেষ মুহূর্তে আমাকে বিমানে ঢুকতে দেখে এবং সেই কর্মকর্তার সঙ্গে ককপিটে
চলে যেতে দেখে আরেক দফা বিস্মিত হলো তৌকির।
আমাকে পাইলটের কাছে অর্পণ করে কর্মকর্তাটি নিষ্ক্রান্ত হলেন অতিদ্রুত।
ছোট্ট সরু একটা আসনে আমাকে বসতে দিয়ে পাইলট ভদ্রলোক বললেন—কোনো কিছুতে
হাত দেবেন না!
আমি খুবই লজ্জা পেলাম। ছোটদের জন্যে লিখি বলে আমার চেহারাতেও শিশুশিশু
ভাব আছে নাকি! একজন কো পাইলটসহ ককপিটে আমরা মোটে তিনজন। ওরা দুজন আমার
সঙ্গে একটি কথাও বললেন না। আমিও ‘সুবোধ বালক’ হয়ে বসে থাকলাম কোনো
কিছুতেই হাত না দিয়ে!
ঢাকা এয়ারপোর্টে তৌকিরকে নিতে এসেছে ওর বন্ধু এবং ব্যবসার পার্টনার
শাকুর মজিদ। তৌকির আর শাকুর দুজনেই বুয়েটিয়ান। স্থপতি। দুই বন্ধু মিলেই
গড়ে তুলেছে ফার্ম। এই শাকুরও আমার প্রীতিভাজন। স্থপতি পরিচয়ের বাইরে ওর
লেখক এবং সাংবাদিক পরিচয়টিও আমার জানা। দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায়
ছাত্রথাকা অবস্থাতেই আমার সহকর্মী ছিলো সে। আমি ছিলাম বাংলাবাজার
পত্রিকার ফিচার এডিটর। শাকুর ছিলো তরুণ রিপোর্টার/প্রতিবেদক। আমাকে কেউ
নিতে আসেনি জেনে শাকুর বললো—‘ রিটন ভাই আপনার বাসা কোথায়?’
বললাম—‘আজিমপুর শেখ সাহেব বাজার। ছাপড়া মসজিদের পাশে।’
'তাইলে রিটন ভাই আপনি আমাদের সঙ্গেই চলেন।’ শাকুর বললো।
‘ঠিক আছে’ বলে আমি ওদের সঙ্গী হলাম। সামনের সিটে তৌকির আর শাকুর। আমি
পেছনে। ড্রাইভ করছে শাকুর।
‘সিলেটে বইমেলা কেমন হলো, আমাদের জার্নি কেমন ছিলো ইত্যাদি আলাপের এক
পর্যায়ে শাকুরের গাড়িটি মহাখালি চৌরাস্তায় এসে পড়লো। রাস্তার একপাশে
গাড়িটি পার্ক করে শাকুর বললো—‘আপনি রিটন ভাই এইখান থেকে একটা
ট্রান্সপোর্ট নিয়ে ন্যান।’
‘শিওর’—বলতে বলতে আমি নেমে পড়লাম। আমাকে মহাখালি চৌরাস্তার মোড়ে
‘নামিয়ে দিয়ে’ চলে গেলো শাকুরের ছোট্ট সুন্দর গাড়িটা।
একটা স্কুটারে চেপে আজিমপুরের দিকে যেতে যেতে আমি ভাবছিলাম--শাকুর
ইচ্ছে করলে আমাকে আজিমপুর পর্যন্ত একটা রাইড দিতে পারতো। আবার
ভাবছিলাম--মে বি ওর হয়তো ব্যস্ততা ছিলো। আবার ভাবছিলাম—সিনিয়ররা অনেক
সময় জুনিয়রদের ব্যাপারে সুবিবেচনা করেন না এটা যেমন ঠিক তেমনি
জুনিয়রদের কাছ থেকেও তো খানিকটা সুবিবেচনা সিনিয়ররা আশা করতে পারেন।
কী, পারেন না? (আচ্ছা আমি কি তৌকিরের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান প্রত্যাশা
করেছিলাম অই মুহূর্তে? নইলে শাকুর আমাকে নামিয়ে দেয়ার সময় আমি কেনো মনে
মনে আশা করছিলাম যে তৌকির একবার অন্তত বলবে—‘শাকুর, রিটন ভাইকে চলো
আজিমপুর পৌঁছে দিয়ে আসি’......)
মানুষের মন বড়ই বিচিত্র! কখন সে কার কাছে কী প্রত্যাশা করবে তা সে
নিজেই জানে না।
১৯ মে ২০১৪
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|