প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

 এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

পেছনে ফেলে আসি—০৬: জাহানারা ইমাম স্মারকগ্রন্থঃ নেপথ্য কাহিনী

 

 

-লুৎফর রহমান রিটন- 

 

 

২৬ জুন, ১৯৯৪। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মিশিগানের ডেট্রয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালের বেডে ৬৫ বছর বয়েসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক শহিদ জননী জাহানারা ইমাম। আমি তখন কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহবানে ‘মৌলবাদী ফতোয়াবাজ রাজাকারদের প্রতিরোধের জন্যে আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে’ অংশ নিচ্ছি। সেই সমাবেশে, সন্ধ্যায়, জননেতা আফম মাহবুবুল হক তাঁর বক্তৃতায় বললেন—‘যে কোনো মুহূর্তে দুঃসংবাদ আসতে পারে। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন আমেরিকার একটি হাসপাতালে।’ শহিদ মিনারের পাদদেশে বসে থাকা আমি চমকে উঠেছিলাম। প্রার্থনা করেছিলাম—এমনটি যেনো না হয়। কোনো দুঃসংবাদ যেনো না আসে। কিন্তু আমার প্রার্থনা কাজে আসেনি। পরে সময় মিলিয়ে দেখেছি—সেদিনের সেই সন্ধ্যায় শহিদ মিনারে আফম মাহবুবুল হকের বক্তৃতার সময়টাতেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন জাহানারা ইমাম।

জুলাই ০৪, ১৯৯৪। আমেরিকা থেকে শহিদ জননী জাহানারা ইমামের মরদেহ বাংলাদেশে এলো। পরদিন ০৫ জুলাই শত-সহস্র শোকার্ত মানুষের ঢল নেমেছিলো কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। ওখানে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হয়েছিলো সব শ্রেণি সব পেশার সববয়েসী মানুষ। উপস্থিত ছিলাম আমিও। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। জাহানারা ইমামের কফিনে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। জাতীয় কবিতা পরিষদের পক্ষ থেকে ফুলের রিং নিয়ে এসেছেন মুহম্মদ সামাদ। তাঁর সঙ্গে আছেন কেবল একজন, সৈয়দ শামসুল হক। সামাদ ভাই আমাকেও অনুরোধ করলেন তাঁদের সঙ্গে থাকতে। আমিও শামিল হলাম। তখন কমিটিতে না থাকলেও শুরু থেকেই কবিতা পরিষদে সক্রিয় ছিলাম জোড়ালো ভাবেই। সুতরাং সাবেক সদস্য হিশেবে তাঁদের সঙ্গে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণে অংশ নেয়াই যায়। (দীর্ঘ লাইনে রিং নিয়ে এগোনো আমাদের ছবিটা পরবর্তীতে আমাকে দিয়েছিলেন আলোকচিত্রি পাভেল রহমান। স্মারকগ্রন্থে এই ছবিটাও আছে।) সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বিশাল জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। সহস্র মানুষের সঙ্গে জানাজায় শামিল হয়েছিলাম আমিও। জনসমূদ্রে রূপান্তরিত হয়েছিলো সেদিন, ঈদগাহ ময়দানটি।

তখন, পত্র-পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে অসংখ্য রচনা প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিন। জাহানারা ইমামকে নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থের পরিকল্পনা এঁটে পত্রিকা থেকে লেখাগুলো সংগ্রহ করে রাখছি। আমার অনেক বইয়ের প্রকাশক আলমগীর রহমান। তাঁর দুটি প্রকাশনা সংস্থা। প্রতীক এবং অবসর। জিজ্ঞেস করলাম পরিকল্পিত স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশ করতে তিনি আগ্রহী কি না। তিনি ভেবেচিন্তে কয়েকদিন পর জানাবেন বললেন। কিন্তু আমি তাঁকে ভাবার জন্যে কয়েকদিন দিতে রাজি হলাম না। বললাম—কালকের মধ্যেই জানাতে হবে। আগামীকাল আপনার ফোন না পেলে আমি অন্য কোনো প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলবো। স্মারকগ্রন্থটি আদৌ বিক্রি হবে কি হবে না এই নিয়ে খানিকটা দ্বিধায় ছিলেন তিনি। অবশ্য পরেরদিনই ফোন করে আমাকে জানিয়েছিলেন যে আমি যেনো এটা অন্য কাউকে না দিই। তিনিই হবেন প্রকাশক। তবে শর্ত থাকে যে—লেখকদের কাছ থেকে অনুমতি আমাকেই নিতে হবে এবং লেখকদের কোনো সম্মানী তিনি দিতে পারবেন না। আমি বললাম, তথাস্তু।(স্মারকগ্রন্থটি সম্পাদনা বাবদও আমি কোনো সম্মানী নিইনি।)
এরপর নেমে পড়লাম আমি—যাকে বলে কোমর বেঁধে নামা। ভোরের কাগজ, যায় যায় দিন, জনকণ্ঠ, আজকের কাগজ, চিন্তা, খবরের কাগজ, সময়, বাংলার বাণী, সংবাদ এবং প্রবাসী পত্রিকায় রচনাগুলো প্রকাশিত হয়েছিলো। লেখকদের কাছ থেকে অনুমতি চাইতে গিয়ে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলাম। মনে আছে, শওকত ওসমানের একটি কবিতা নিয়েছিলাম ভোরের কাগজ থেকে। স্মারকগ্রন্থে কবিতাটি ছাপার অনুমতি চেয়ে ফোন করেছিলাম তাঁকে। টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে তিনি আমাকে প্রিন্টিং মিসটেক এবং তাঁর কবিতাটির যতিচিহ্ন বিষয়ে বলেই যাচ্ছিলেন। অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা সেদিন দিতে হয়েছিলো আমাকে। অতঃপর ফাইনাল প্রুফটি তাঁকে দেখিয়ে নিতেও বলেছিলেন। কিন্তু আমি বিনয়ের সঙ্গে তাঁর দাবি পুরণে অসম্মতি জ্ঞাপন করে বলেছিলাম—সেরা একজন প্রফেশনাল প্রুফ রিডার এই সংকলনের প্রুফ রিডিং করছেন। আমার পক্ষে সম্ভব নয় লেখকদের কাছে গিয়ে গিয়ে তাঁদের দিয়ে প্রুফ রিডিং করানো। তাহলে এইরকম একটি সংকলন প্রকাশ করতে আমার সময় লাগবে অন্তত এক বছর। আমার ওপর আপনার আস্থা না থাকলে শওকত ভাই, আমি অপারগ। আপনি এখন বলুন কবিতাটা আমি ছাপবো কী না। কয়েক মুহূর্ত নিরবতার পর তিনি বলেছিলেন—ঠিক আছে ভ্রাত। তোমার ওপর আস্থা রাখা হলো।

শুধুমাত্র পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলোর একটা স্তুপ দাঁড় করালেই তো হবে না। নতুন কিছু লেখাও যোগাড় করতে হবে। আগামী প্রজন্মের জন্যে জাহানারা ইমাম নামের অবিনাশী একটি ইতিহাসকে দুই মলাটের মাঝে নিয়ে আসার চেষ্টা আমার। রাতদিনের পরিশ্রমকে সেচ্ছায় বরণ করে নিলাম। কোনো সহযোগী নেই। সমস্ত দৌড়-ঝাঁপ একলা একাই করতে হয়েছে। যাকে বলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ। আমি তখন আজিমপুর শেখ সাহেব বাজারের একটি গলিতে ভাড়া থাকি। সেখান থেকে বাংলাবাজারে আলমগীর রহমানের প্রেস টু পল্টনের গ্রাফিকস্ক্যান লিমিটেড। শাহবাগ চারুকলা ইন্সটিটিউট টু মতিঝিল বিচিত্রা অফিস। জাহানারা ইমামের বাসভবন এলিফ্যান্ট রোডের কণিকা টু বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। কিংবা প্রেসক্লাব টু মিন্টু রোড বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাসভবন করতে করতে আমার চব্বিশ ঘন্টার দিন-রাত্রির অধিকাংশ সময় ফুরিয়ে যায় দ্রুত। আমার সম্পাদনায় প্রকাশিতব্য স্মারকগ্রন্থের জন্যে বিশেষ কিছু রচনা লিখে দিয়েছেন কয়েকজন সংস্কৃতিযোদ্ধা, লেখক ও রাজনীতিবিদ আমার বিরামহীন তাগাদা এবং তাঁদের অন্তর্গত তাগিদে। এই তালিকায় আছেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, নাট্যকার অভিনেতা আবদুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ হাসান ইমাম, বেগম মুশতারী শফী, মফিদুল হক, আনু মুহাম্মদ, লায়লা হাসান, কামাল পাশা চৌধুরী,কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন এবং জননেত্রী শেখ হাসিনা। মিলন লেখাটা নিজেই নিয়ে এসেছিলেন আলমগীর রহমানের অফিসে। চট্টগ্রামের বেগম মুশতারী শফীর লেখাটা পেয়েছিলাম ডাকযোগে। জননেত্রী শেখ হাসিনার লেখাটার প্রসঙ্গে একটু বলি।

আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তখন সংসদে বিরোধীদলের নেত্রী। জুলাই(১৯৯৪)-এর প্রথম সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় মিন্টু রোডে তাঁর বাসভবনে গেলাম। আপার সঙ্গে কুশল বিনিময় ইত্যাদির পর নানা বিষয়ে কথা বলছি। আপা বাহাউদ্দিন নাসিমকে বললেন আমাদের চা দিতে। এক পর্যায়ে আমি তাঁর কাছে আসার কারণটা বললাম—একটা স্মারকগ্রন্থ করছি জাহানারা ইমামের ওপর। আপনার একটা লেখা চাই আপা। আপা বললেন—আমি লিখবো না।
--ক্যানো আপা? লিখবেন না ক্যানো?
--তোমার খালাম্মা(জাহানারা ইমামকে আমি খালাম্মা বলতাম)আমার সঙ্গে খুব অন্যায় আচরণ করেছেন।

নেত্রীর কাছ থেকে জানলাম গণ-আদালতে তাঁরও থাকবার কথা ছিলো। শেষ মুহূর্তে তিনি আপাকে একটা চিরকূট পাঠিয়ে ওখানে না যাবার জন্যে অনুরোধ করেছেন। আপা গেলে ওটা নাকি আওয়ামী লীগের সমাবেশ হয়ে যাবে। আপার কণ্ঠে ক্ষোভ আর অভিমান। বললেন—মঞ্চে তোমার খালাম্মার পাশে থেকে তাঁকে শক্তি যোগায় আমাদের রাজ্জাক(আবদুর রাজ্জাক)। রাজপথে তোমার খালাম্মাকে নিরাপত্তা আর পাহারা দেয় আমার মায়া(মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া)। তখন সেটা আওয়ামী লীগের হয় না? মঞ্চের খুঁটি পুতবে আমার ছেলেরা। বাঁশ জুড়বে আমার ছেলেরা। মাইক বাঁধবে আমার ছেলেরা। ব্যানার লিখবে আমার ছেলেরা। পুলিশের মার খেয়ে রক্ত ঝরবে আমার ছেলের। বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে মিছিল করে উপস্থিত হয়ে বিশাল সমাবেশ তৈরি করবে আমার লোকজন। মাইকের ভাড়া দিতে হবে আমাকে। স্টেজের খরচ যোগাতে হবে আমাকে।সব কিছু আমার কাছ থেকেই নেবে আর আমি উপস্থিত থাকলে তোমার খালাম্মার কাছে সেটা আওয়ামী লীগের সমাবেশ হয়ে যায়!!

আপার ক্ষোভের কথাগুলোয় যুক্তি আছে। আমি তাই বিদায় নিলাম। কক্ষ থেকে বেরুতে বেরুতে বললাম—আমি আবার আসবো আপা।
আপা বললেন—এসো। কিন্তু লেখা চাইতে এসো না।
হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলাম আমি। একদিন পরেই আবার গেলাম। বিকেলে। রিসেপশনে তখন বসতো শামীম। শামীম বললো—যান, আপার মুড এখন ভালো। আপার সঙ্গে এটা সেটা বলার পর ফের তুললাম লেখার প্রসঙ্গ। বললাম—আপা আপনি এতো সাহায্য সহযোগিতা করে এতো বড় একটা আন্দোলনকে সফল করে তুললেন। আপনি না লিখলে হবে? জাহানারা ইমাম তো আপনার কাজটাকেই এগিয়ে দিয়েছেন। আপনার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন আর সহযোগিতা ছাড়া নির্মূল কমিটি(সমন্বয় কমিটি)এতো বড় সাফল্য অর্জন করতে পারতো না সেটা সবাই জানে। আমার এই সংকলনটা তো আপা ব্যক্তি জাহানারা ইমামকে নিয়ে হলেও—বিশেষ একটা সময়কে ধারণ করে রাখবে। সেই সময়কে যে সময়ে আপনি ছিলেন প্রধান নেপথ্যকুশীলব। খালাম্মার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে অভিমান করে তাঁকে নিয়ে ছোট একটি লেখাও যদি না লেখেন আপনি তাহলে তো নেক্সট জেনারেশনের কাছে ভুল বার্তা যাবে। শত্রুরা খুশি হবে। নতুন প্রজন্মের তরুণদের কাছে শহিদ জননীর যে ইমেজ যে গ্রহণযোগ্যতা সেটার পুরোটাই তো আলটিমেটলি আপনারই পক্ষে যায় আপা। একাত্তরের ঘাতক দালাল রাজাকার আলবদরদের বিরুদ্ধে আপনার লড়াইটাই তো লড়ে গেছেন জাহানারা ইমাম। আমাদের কথার মাঝখানে বিখ্যাত এক সাংবাদিক এসেছেন বলে জানালেন বাহাউদ্দিন নাসিম। আপা বললেন জরুরী কথা বলছি। এখন না। আগামীকাল আসতে বলো।
এরপর আপা টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতির কথা বললেন খালাম্মাকে ঘিরে। আমি বললাম—আপনার লেখা ছাড়া আমি এটা বের করবো না আপা। আমার নাছোড়বান্দা টাইপের উক্তিতে হেসে ফেললেন আপা—ঠিক আছে যাও। লিখবো।

এক সপ্তাহের মাথায় লেখাটা পেলাম। ১১ জুলাই সন্ধ্যায় রিসেপশনে শামীমের সঙ্গে গল্প করছিলাম। আপা আজ ভীষণ ব্যস্ত। আমার সঙ্গে তাঁর আজ দেখা হবে না। আমাকে হতাশ হতে দেখে শামীম বললো—আপনার কাজ হয়ে গেছে রিটন ভাই। আপা লিখেছেন আপনার জন্যে লেখাটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাইবেন। একটু পরেই ঘরের ভেতর থেকে বেবী মওদুদ এসে আমার হাতে ব্রাউন রঙের একটা বড় খাম দিলেন। খুলে দেখি তার ভেতরে জাহানারা ইমামকে নিয়ে শেখ হাসিনার লেখাটার ফটোকপি। শিরোনাম—আমাদের চেতনার অগ্নিশিখা। এই লেখাটা আপা কয়েকটি পত্রিকাকেও দিয়েছিলেন। দুদিন পর কয়েকটি পত্রিকায় লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিলো। স্মারকগ্রন্থে লেখাটা আমি ছেপেছিলাম রচনাকাল ১১ জুলাই ১৯৯৪ উল্লেখ করে। সূত্র হিশেবে কোনো পত্রিকার নাম দিইনি। কারণ পত্রিকায় প্রকাশিত হবার আগেই লেখাটা আমাকে দিয়েছিলেন তিনি। আর এটা তিনি লিখেছিলেন আমার সম্পাদিত স্মারকগ্রন্থের জন্যেই।

‘লিখবো না’ বলেও লিখেছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। আরেকজন বিখ্যাত ব্যাক্তিও আমাকে ‘লিখবো না’ বলেছিলেন। তিনি গাজী শাহাবুদ্দিন। সন্ধানী প্রকাশনীর কর্ণধার। একাত্তরের দিনগুলির প্রকাশক। বেইলি রোডের সাগর পাবলিশার্সের সামনে তাঁর সঙ্গে এক সন্ধ্যায় দেখা হলে খুব আগ্রহ নিয়ে আমি তাঁর কাছে আমার স্মারকগ্রন্থের পরিকল্পনা এবং তাতে তাঁর একটি লেখা প্রত্যাশা করেছিলাম। আমার দিকে কপাল কুঁচকে বিস্ময়ভরা চোখে খানিক তাকিয়ে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন—আপনি করবেন স্মারকগ্রন্থ! তারপর বলেছিলেন—আমি তো তাতে লিখবো না। তাঁর চাহনি এবং কণ্ঠস্বরে বিরক্তি ঝরে পড়ছিলো। তাঁর বিস্মিত হবার ভঙ্গিটিকে অনুবাদ করলে যে অর্থ দাঁড়ায় তাতে আমার উদ্যোগটিকে একটি অপরাধ হিশেবেই গণ্য করতে হবে। জাহানারা ইমামের সবকিছু তাঁর লিজ নেয়া নয়—এমন ভঙ্গিতে আমিও বললাম—আপনি না লিখলেও ওটা বেরুবে। আমার সম্পাদনাতেই বেরুবে। আমার ভঙ্গিতে আরেকটি ব্যাপার ছিলো—পারলে ঠেকান!

স্মারকগ্রন্থের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত জাহানারা ইমামের হাস্যোজ্জ্বল চাররঙা আলোকচিত্রটি তুলেছিলেন বিখ্যাত আলোকচিত্রি শামসুল ইসলাম আলমাজী। আমি সেটি সংগ্রহ করেছিলাম চক্রেশ চক্রবর্তীর কাছ থেকে। চক্রেশ আবৃত্তিকার রূপা চক্রবর্তীর স্বামী। সদ্য তরুণ নবীন আলোকচিত্রি আবীর আবদুল্লাহর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম জাহানারা ইমামের আরেকটি অসাধারণ ছবি, যেটা আমি শেষ প্রচ্ছদে ব্যবহার করেছি। ছবির নিচে দুলাইনের ক্যাপশন লিখে দিয়েছিলাম—জাহানারা ইমামের মৃত্যুতে শোক/শোক আজ শক্তিতে পরিণত হোক। কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর অনুজ এই আবীর। আলমাজীর আলোকচিত্র অবলম্বনে স্মারকগ্রন্থের প্রচ্ছদটি করেছিলেন ধ্রুব এষ।

যৌবনে অসাধারণ রূপসী ছিলেন জাহানারা ইমাম। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ‘জাহানারা ইমাম’ শীর্ষক রচনায় লিখেছেন-- ‘পঞ্চাশের দশকে আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, জাহানারা ইমাম তখন ঢাকা শহরের সুচিত্রা সেন।...সৌন্দর্যে,ব্যক্তিত্বে,পরিশীলনে এবং মাধুর্যে তিনি ছিলেন তাঁর(সুচিত্রা সেনের) নিকটতম উপমা।’

পরবর্তীকালে মুখের ভেতরে ক্যান্সার থাবা বসালে তাঁর মুখ আর আগের মতো থাকে না। মুখটা কিঞ্চিৎ বেঁকে যায়, ঠোঁটটা সামান্য ঝুলে পড়ে। স্মারকগ্রন্থের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবিতে আমরা প্রত্যক্ষ করি থুতনিতে ডান হাতের তর্জনি আঙুলটি দিয়ে নিচের ঠোঁটটি ঢেকে রেখেছেন জাহানারা ইমাম। শামসুল ইসলাম আলমাজীর তোলা অসাধারণ এই ছবিটা জাহানারা ইমামের খুবই প্রিয় ছিলো। আমার সম্পাদিত স্মারকগ্রন্থ থেকে এই ছবিটা পৃথিবীর কতো জায়গায় যে ব্যবহৃত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

‘স্মৃতি এলবামঃ জাহানারা ইমাম’ শিরোনামে শহিদ জননীর একগুচ্ছ ছবিও ছাপা হয়েছিলো স্মারকগ্রন্থে। ছবি সংগ্রহের কাজটাতেও ছিলো হ্যাপা। আমি পরিচিত কয়েকজন ফটোসাংবাদিকের কাছে ছবি চেয়েছিলাম। প্রকাশক কোনো টাকা দিতে পারবেন না—এটাও জানিয়ে দিয়েছিলাম। চারুকলায় একটা অনুষ্ঠানে একটি দৈনিকের ফটোগ্রাফার আমার বন্ধু ইউসুফ সাদের সঙ্গে দেখা হলে সে বললো—তোকে আমরা ছবি দেবো না বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কে কে সিদ্ধান্তটা নিলি? ও টিংকুসহ দুতিনটে নাম বললো। আমি বললাম—আরে ব্যাটা ফুটবলার-ক্রিকেটারদের ছবি যারা তোলে আমি তো তাদের ছবি নেবোও না। তুই দেখিস তোদের সহযোগিতা ছাড়াই ওটা বেরুবে। সাদ জিজ্ঞেস করলো—তুই ছবি কই পাবি? আমি বললাম—প্রয়োজনে ছবি ছাড়াই বেরুবে। ছবির খ্যাতা পুড়ি।
আমাকে জাহানারা ইমামের চমৎকার কিছু ছবি দিয়েছিলেন পাভেল রহমান। এছাড়াও ইনামুল কবীর, সেলিম হাসান, আমিনুল ইসলাম শাহীন, এস এম গোর্কি, মোঃ রফিকউল্লাহ এবং সালাম আজাদ আমাকে তাঁদের তোলা ছবি দিয়েছিলেন সানন্দে। আর জাহানারা ইমামের পারিবারিক এলবাম থেকে একগুচ্ছ এক্সক্লুসিভ ছবি পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী।

জাহানারা ইমামের কনিষ্ঠপুত্র জামী তখন বাংলাদেশে। এক সন্ধ্যায় শাহাদত ভাই আমাকে কণিকায় নিয়ে গেলেন। জামীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার পরিকল্পনার কথা জামীকে বললাম বিস্তারিত। সব শুনে জামী কয়েকটা এলবাম এনে দিলেন। আমি ওখান থেকে বেশ কিছু ছবি বাছাই করলাম। শাহাদত ভাই দায়িত্ব নিলেন—তিনি ছবিগুলোর ফটোপ্রিন্ট করিয়ে সেগুলো দুদিনের মধ্যেই ফেরত দেবেন জামীকে। দুটো সেট করিয়েছিলেন শাহাদত ভাই। একটা সেট নিজের সংগ্রহে রেখে অন্যটা দিয়েছিলেন আমাকে। শাহাদত ভাই না থাকলে জামী আমাকে এলবাম থেকে ছবি দিতেন না আমি জানি। কারণ তাঁর সঙ্গে আমার তো কোনো পরিচয়ই ছিলো না।

আমার অনুরোধে জাহানারা ইমামের স্কেচ করে দিয়েছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, সৈয়দ এনায়েত হোসেন, মাশুক হেলাল ও ধ্রুব এষ। গৌতম চক্রবর্তীর একটা স্কেচ আমি কোনো একটি মুদ্রিত কার্ড থেকে নিয়েছিলাম। কাইয়ূম চৌধুরী অসাধারণ একটি স্কেচ ছাড়াও দ্বিতীয় আরেকটি দুর্দান্ত শাদাকালো ছবি এঁকে দিয়েছিলেন। প্রতিটি রচনার শুরুতে লোগো হিশেবে ব্যবহার করার জন্যে শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরীর কাছে আলাদা একটি মোটিফ দাবি করেছিলাম আমি। আমার দাবিটিকে অগ্রাহ্য করেননি তিনি। এঁকে দিয়েছিলেন অসাধারণ একটি ছবি। শামসুল ইসলাম আলমাজী আর আবীর আবদুল্লাহ-র তোলা ছবির আদলেই কাইয়ূম ভাই এঁকে দিয়েছিলেন স্কেচ আর মোটিফ দুটো।

স্মারকগ্রন্থের লেখক তালিকায় ছিলেন—শাহরিয়ার কবির,নীলিমা ইব্রাহিম,শামসুর রাহমান,আনিসুজ্জামান,হায়াৎ মামুদ,হায়দার আকবর খান রনো, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সরদার ফজলুল করিম, আশীষ-উর-রহমান শুভ, সৈয়দ শামসুল হক, কবীর চৌধুরী, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, কে এম সোবহান, রাবেয়া খাতুন, মাহফুজ সিদ্দিকী, আবদুল মান্নান, সিরাজুর রহমান, নুরুল ইসলাম নাহিদ, আসিফ নজরুল, সৈয়দ সিদ্দিক হোসেন,মুনতাসীর মামুন,ফয়েজ আহমদ,শাহ এ এম এস কিবরিয়া,ফকির ইলিয়াস,আবদুল্লাহ আল মামুন,আমান-উদ-দৌলা,রামেন্দু মজুমদার,শামসুজ্জামান খান,দিলীপ মালাকার, শেখ হাসিনা,পান্না কায়সার,মফিদুল হক,বেগম মুশতারী শফী,সৈয়দ হাসান ইমাম,লায়লা হাসান,আবেদ খান,ফরিদা আখতার,হাসান ফেরদৌস,আজফার হোসেন,কামাল পাশা চৌধুরী,মুহম্মদ জাফর ইকবাল,আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ,সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী,আনু মুহাম্মদ,ইমদাদুল হক মিলন,হারুণ হাবীব,সৈয়দ আবুল মকসুদ,রবিউল হুসাইন,হুমায়ূন আহমেদ,জেলেনা চৌধুরী,লুৎফর রহমান রিটন, ফরহাদ মজহার, শওকত ওসমান,সিকদার আমিনুল হক, রেজা ফারুক,ফারুক মাহমুদ,কামাল চৌধুরী, ইউসুফ পাশা এবং একজন সরকারি কর্মকর্তা। এই ‘একজন সরকারী কর্মকর্তা’র লেখাটি আমি সংগ্রহ করেছিলাম ভোরের কাগজ থেকে। লেখাটা আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। লেখার শেষে ছোট্ট হরফে মুদ্রিত ছিলো—‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা’। স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর তাঁর পরিচয়টি আমি জানতে পেরেছিলাম। তিনি আমার বন্ধু মোহাম্মদ হাননান। ‘বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস’ নামের বিখ্যাত গ্রন্থের লেখক। সরকারী চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন বলে নিজের নামটি প্রকাশ করতে সাহস পাননি। শহিদ জননীর মৃত্যু সংবাদটি বাংলাদেশে পৌঁছোয় যখন, তখন তিনি জাতীয় সংসদে কর্তব্যরত ছিলেন।

স্মারকগ্রন্থের প্রচ্ছদে এমনকি পুটেও আমি আমার নামটি ছাপিনি। ‘সম্পাদনা লুৎফর রহমান রিটন’ কথাটা ইনার পেজে ছোট্ট হরফে ১০ বোল্ড টাইপে ছাপা হয়েছিলো। অনেক খেঁটেখুটে জাহানারা ইমামের একটা জীবনীও লিখেছিলাম এবং সেটাও ‘জীবনপঞ্জি’ শিরোনামে ছাপা হয়েছে আমার নাম ছাড়াই। পরে, ২০০১ সালের বইমেলায় শিকড় প্রকাশনী থেকে ‘জাহানারা ইমাম’ নামে আমার একটা বই বেরিয়েছিলো প্রকাশকের অতি উৎসাহের কারণে। সেই জীবনীগ্রন্থে আমি শুধু বাড়তি একটি প্যারা যুক্ত করেছিলাম একেবারে শেষ অংশে—‘ব্যক্তি জাহানারা ইমামের মৃত্যু ঘটেছে কিন্তু প্রতীক জাহানারা ইমামের মৃত্যু ঘটেনি। জাহানারা ইমাম ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল আলবদর রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার সংগ্রামের প্রতীক। এই প্রতীকের মৃত্যু নেই। যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ রাজাকারমুক্ত না হবে ততদিন পর্যন্ত জাহানারা ইমাম শীর্ষক প্রতীকের মৃত্যু হবে না।’

হ্যাঁ, গতকাল জাহানারা ইমামের জন্মদিনেও আমার সেই কথাটাই মনে হয়েছে। শাহবাগের গণ-জাগরণ মঞ্চেও আমরা দেখেছি তারুণ্যপ্লাবিত বিশাল ক্যানভাসে ভেসে উঠেছেন তিনি শক্তি আর প্রেরণার প্রতীক হয়ে।
 

 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ